প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
|৩১|
বেক্ষাপ্পা ধরনের সাদা দু’তলা বাড়ি; রাস্তার ধারে স্কুল ঘরের মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। নিশিতাকে দেওয়া হয়েছে উপরের তলার কোণার এক ঘর। একটা বিভাগীয় শহরের ডাক বাংলোর এহেন অবস্থা দেখে মনে মনে বিরক্ত হলো নিশিতা। সারা শাড়িতে রক্ত মাখামাখি। ছিনতাইকারী ছেলেগুলো ইচ্ছেকৃতভাবে চাকুর পোঁচ মেরেছে নিশিতার পেটের কাছে। খুব একটা কাঁটেনি কিন্তু রক্তক্ষরণও কম হয়নি। থানায় এক মহিলা কনস্টেবল জায়গাটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডজ করে দিলেও এই শাড়ি পরে থাকার জো নেই। সারা শাড়িতে রক্ত আর কাদার ছোপ ছোপ দাগ। তারওপর ভিজে কেমন চটচটে হয়ে আছে। নিশিতার কাছে দ্বিতীয় কোনো শাড়ি নেই। কাল কাগজপত্রগুলো পাওয়া যাবে কী-না সেও তো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। যদিও ডিউটি অফিসার বাংলোতে নামিয়ে দেওয়ার আগে আশ্বস্ত করেছেন তবুও নিশিতা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। নিশিতার কাছে ঘড়ি, মুঠোফোন কিচ্ছু নেই। ঝড়-বৃষ্টির জন্য শহরব্যপী লোডশেডিং। থেকে থেকে আত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া বজ্রপাতের আলো ব্যতিত এই শহরে আপাতত আলোর কোনো উৎস নেই। নিশিতার ঘরে অবশ্য একটা মৃদু আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমন নিকষ অন্ধকারে এই আলোটুকুকে লাগছে ভূতূড়ে আঁধারের মতো। নিশিতার বুক কাঁপছে। ভূত বা ঝড়বৃষ্টির ভয় নয়। যুবতী থেকে পরিপূর্ণ রমণী হয়ে উঠতেই এসকল ছোটখাটো ভয় কাটিয়ে উঠেছে সে। তার ভয় লাগছে মানুষকে। এই পঁচিশ বছরের জীবন পেরিয়ে নিশিতা আজ বাস্তবিকভাবে উপলব্ধি করেছে, নারী জাতির জন্য পুরুষ মানুষের থেকে বড়ো ভয় আর কিছু হয় না। এতোক্ষণ কাগজ-পত্রের চিন্তায় অস্থির থাকলেও এখন স্থির হয়েছে নিশিতা। ধীরে ধীরে নিজের কথা ভাবছে। আজ রাতে কতবড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে। ভয় হচ্ছে এই অসুরক্ষিত বাংলোর সুরক্ষা নিয়ে। যদিও ঘরের বাইরে একজন কনস্টেবলকে পাহারায় রেখে গিয়েছে অফিসার। কনস্টেবলকে কাল দুপুর অব্ধি নিশিতার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে দুপুর দিকে নিশিতাকে থানায় যেতে বলা হয়েছে। নিশিতা দরজায় ছিটকিনি টেনে গায়ের শাড়িটা খুলে, ধুয়ে মেলে রাখলো জানালায়। গায়ের উপর কাঁথা টেনে বসে রইলো স্থবির হয়ে। আজ রাতে তার ঘুম নেই। ঘুম নেই অচেনা কিছু অনুভূতির যন্ত্রণায়।
সকাল হতেই ঝড়-বৃষ্টির আভাস কেটে গেল। ঠিক দুপুরে মাথার উপর রণচণ্ডীর মতো উত্তাপ ছড়াতে লাগলো সূর্য। নিশিতা যখন থানায় পৌঁছলো তখন বেলা বারোটা। রিকশা থেকে নেমে সবেমাত্র বারান্দায় পা রেখেছে। ঠিক তখনই ধ্রুবকে আসতে দেখা গেল। ভীষণ লম্বা দেখতে ধ্রুব পুলিশী পোশাক গায়ে মাথা নিচু করে হাঁটছে। আশপাশ থেকে সেলাম ঠুকতেই আনমনে মৃদু মৃদু মাথা ঝাঁকাচ্ছে। নীরব, চুপচাপ অথচ সূর্যের থেকেও প্রখর। পরিণত হওয়ার পর নিজেকে কখনো বিব্রত হওয়ার সুযোগ দেয়নি নিশিতা। অথচ আজ ভেতর ভেতর সে প্রচন্ড বিব্রতবোধ করছে। সব থেকে বিব্রতকর বিষয় হলো তার রিকশা ভাড়াটাও আজ ধ্রুবর কনস্টেবল থেকে নিতে হয়েছে। নিশিতা ইচ্ছে করেই চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। ধ্রুব এলো ধীর পায়ে। বারান্দা পেরিয়ে ভেতরের দিকে যেতে যেতে থামলো। নিশিতাকে অবাক করে দিয়ে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে শুধাল,
‘ আপনার কাজ হয়েছে?’
নিশিতা চোখ ফেরাতে বাধ্য হলো। ধ্রুবর সেই সুখী সুখী চেহারা দেখেই মানসপটে ভেসে উঠলো কোনো এক সুখী নারীর ছবি। হয়তো সেই নারীকে খুব ভালোবাসে ধ্রুব। হয়তো জীবনের থেকেও সুন্দর ভোর আসে তাদের ঘরে। উপলব্ধি করলো, যে পুরুষের চোখে নারী একবার মুগ্ধতা দেখেছিলো; সে পুরুষ নিজের না হলে, নারী মন তাকে দেখতে চায় চির বিষণ্ণরূপে। চির দুঃখীরূপে। সেই দুঃখী চোখে সুখ বড়ো বেমানান, নিষ্ঠুর। নিশিতার হঠাৎ করেই খুব বিষণ্ণ লাগলো। মুখে সেই বিষণ্ণতার এক বিন্দু ছিঁটে না ফেলে বললো,
‘ অলমোস্ট। থেংকিউ!’
ধ্রুব একহাত পকেটে পুরে দাঁড়িয়ে ছিলো। মৃদু মাথা হেলিয়ে অভিবাদন জানালো। তারপর আগের মতোই ধীর পায়ে ঢুকে গেল ভেতরে। কেউ সাহায্য চাইলে ঠিক যতটা করতে হয়, মেপে মেপে ঠিক যেন ততটা সাহায্য করেই বাধিত করলো নিশিতাকে। তবে যতটুকু করলো, ততটুকুই করলো অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। নিশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকলো। খুবই সুখের ব্যাপার, টাকাগুলো ঠিকঠাক পাওয়া না গেলেও কাগজপত্রগুলো আর ফোনটা ঠিক ঠিক পাওয়া গেল। সকল কাজ শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। ক্লান্ত নিশিতা থানা থেকে বেরুতেই দেখা হয়ে গেল আরও এক ধ্রুবর সাথে। লম্বা-চওড়া, শ্যাম গায়ে সাদা শার্ট। পায়ের জুতো থেকে গলার টাই পর্যন্ত বড়োই ঝকঝকে। কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা হাতাটাও যেন গোটানো হয়েছে মেপে মেপে। টাইটা একটু ঢিলে হয়ে এসেছে। হাতে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ। পরিপাটি, গোছানো চুল। দেখতে ঠিক ধ্রুবর মতো হলেও চালচলনে বড়ো বেখেয়ালি, উচ্ছল ভাব। এতো এতো বছর পরও নিশিতা বুঝে ফেলল, ছেলেটি আবির। আবির! সেই মিষ্টি ছেলেটা! কেমন চিনচিনে ব্যথা করে উঠলো নিশিতার বুক। রেলগাড়ির বগির মতোই একের পর এক দেখা দিতে লাগল মিষ্টি মিষ্টি স্মৃতিরা। বৃষ্টির মতো কল্লোল তুললো নিশিতার প্রাণে। রৌদ্রস্নাত বিকেলে বড়ো আপন ঠেকলো অপরিণত নিশিতার অনুভূতি, বিশেষ একজনের দৃষ্টিতে শরীরময় থরথর কাঁপুনি, তার ছোঁয়া, বৃষ্টিভেজা রাতের নিগূঢ় কিছু অনুভূতি। একই দোলনায় বসে থাকা ঘনিষ্ঠ দুটো নর-নারী। ভাবতে ভাবতেই থমথমে হয়ে গেলো নিশিতার বুক। আহা! বুকটা যে পুড়ে যাচ্ছে তার। কেন পুড়ছে? কেন পুড়ছে? নিশ্চয় রোদের তাপে? মাথায় পুরাতন কথার ঝাঁক মেলে আনমনেই বারান্দা থেকে নেমে গেল নিশিতা। আবিরও নিশিতাকে খুব একটা খেয়াল করলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলকে ভাইয়ের কথা শুধিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিয়েই এক নজর চাইলো নিশিতার দিকে। তারপর চেয়ে রইলো অনেকটাক্ষণ। এই মলিন শাড়ি গায়ে কেবল চাহনিতে তেজ ছড়ানো মেয়েটিকে সে চিনে। আবির ভেতরের দিকে চলে গিয়েও পেছনে ফিরে দেখলো। ততক্ষণে গেইটের কাছে পৌঁছে গিয়েছে নিশিতা। পেছন থেকেই কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ভদ্রমহিলাটা কে?’
‘ কাল রাতে জিডি করেছিল স্যার। ছিনতাই কেস।’
আবির ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলে আরও একবার পেছন ফিরে চাইলো। ধ্রুবর অফিস ঘরে ঢুকেই শুধাল,
‘ ভাইয়া উনি, উনি কী বিবাহিত?’
ধ্রুব কিছু নথিপত্র ঘাঁটছিলো। আবিরের হঠাৎ আগমনে যতটা না অবাক হলো তার থেকেও অবাক হলো তার প্রশ্নে। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ কে? কার কথা বলছিস?’
‘ভাবী’ শব্দটা আবিরের গলা অবধি এসেও আটকে গেল। যে আবিরকে নিশিতা অসংখ্যবার চোখ রাঙিয়ে পরাস্ত করতে পারেনি আজ সেই আবির নিজ থেকেই বুঝে গেল সেই সম্বোধনটা সেই নারীর জন্য নয়। বোধহয়, ছিলো না কখনও। কিন্তু কী বলে ডাকবে তাকে? যাকে একদিন আকাশ সমান শ্রদ্ধা করেছিলো তাকে কী নাম ধরে ডাকা যায়? যায় না। আবির আমতা আমতা করে বলল,
‘ ওইতো… বারান্দায় দেখলাম যে… একজন ভদ্রমহিলা, সাদা-গোলাপি শাড়ি পরনে?’
ধ্রুব প্রশ্নটা প্রথমেই বুঝেছিলো। আবিরের লম্বা বিশ্লেষণ শেষ হতেই সে নিজের কাজে মন দিলো। ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
‘ তা কি আমার জানার কথা?’
‘ তুমি চাইলে জানতে পারতে।’
‘ তাহলে হয়তো জানতে চাইনি।’
কথাটা বলে আবারও চোখ তুলে চাইলো ধ্রুব। আবির সে কথার জবাব দিলো না। ব্যাগটা চেয়ারের উপর রেখে নিজেও বসলো অন্য এক চেয়ারে। একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলল,
‘ চলো ভাইয়া আজ বাইরে খাবো। দাদার টাকা তো আছেই। এছাড়া, বাবার ইনকাম, মায়ের ইনকাম, তোমার-আমার ইনকামের এতো এতো টাকা খরচ করতে হবে না? আমাদের তো আর নেক্সট জেনারেশন আসবে না। তাহলে এতো কামিয়ে লাভ কী? সুতরাং, টাকা খরচে মনোযোগ দেওয়া উত্তম।’
ধ্রুব কলম রেখে অবাক হয়ে চাইল। বলল,
‘ নেক্সট জেনারেশন আসবে না কেন?’
‘ আসবে কীভাবে? তুমি তো বিয়েই করছো না। তুমি বিয়ে না করলে আমিও করবো না। আমি না করলে কল্পও করবে না। সুতরাং, আমাদের জেনারেশন এখানেই স্টপ।’
ধ্রুব হেসে ফেলে বলল,
‘ তোকে কে বলল, আমি বিয়ে করবো না?’
আবির টেবিলের উপর রাখা মায়ের একদম অন্যরকম ছবিটা দেখছিলো। ধ্রুবর কথায় বিভ্রান্ত চোখে চাইলো। যদিও বিষয়টা সত্য, ধ্রুব কখনোই বিয়ে না করা নিয়ে কোনো মতবাদ জারি করেনি। তবু আবির ভেবে নিয়েছিলো ধ্রুবর হয়তো হৃদয়ঘটিত কোনো ঝামেলা আছে। সুতরাং….! আবির ইতস্তত করে বলল,
‘ তুমি বিয়ে করবে? তারমানে আমাকেও বিয়ে করতে হবে? কী আশ্চর্য! তবে যে বছর কয়েক আগে বললে, এখন বিয়ে নয়!’
‘ তখন আমার প্রমোশন পিরিয়ড চলছিলো। মাত্র চাকরিতে ঢুকেছি। কনসেনট্রেশান ব্রেক করতে চাইনি, এজন্য মানা করেছিলাম। কখনোই বিয়ে করবো না এমন তো বলিনি!’
আবির কী মনে করে গভীর চোখে চাইলো। শুধালো,
‘ যাকে বিয়ে করবে তাকে ভালোবাসবে ভাইয়া?’
ধ্রুব চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। অবাক হয়ে বললো,
‘ কেন ভালোবাসবো না?’
আবির ঠিক উত্তর খুঁজে পেলো না। ঠিকই তো, নিজের বউকে কেন ভালোবাসবে না? আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ পাল্টালো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমি চা দিয়ে যেতে বলি। একদম কড়া লিকার।’
ধ্রুব জবাবে কিছু বললো না। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা সিগারেট ধরালো। ধোঁয়াগুলো কুন্ডলী পাকিয়ে উড়ে গেল দূর থেকে বহুদূরে। তারা বুঝি মিশে যাবে পেঁজা পেঁজা মেঘের সাথে? ধ্রুব সেই মেঘমালার দিকে চেয়ে রইলো অনেকটাক্ষণ। ঠিক সেই সময়টাতে, রিকশা করে একদম ভিন্ন পথে চলে গেল মলিন শাড়ি গায়ে ভীষণ অন্যরকম সেই নারীটা। সেই খুব অন্যরকম নারীটির সাথে ধ্রুবর সম্পর্কটাও তো বড়ো অন্যরকম। কিছু নেই, কিছু নেই বলেও অসীম শূন্যতায় গিয়ে কোথায় যেন অসীম অ-মিলনে বেঁধে গেছে দুটো মন। ধ্রুব জানে, সেই সুতোতে কেবল বিষাদ আঁকা। সেই সুতোর পথ সেই নারীর বেছে নেওয়া পথটির মতোই বড়ো আলাদা রঙের। সে রঙ দুটোর কোনো সন্ধি নেই। সেই পথের কোনো শেষ নেই। কেবল ক্লান্তিহীন হেঁটে যাওয়া। বহু বহু পথ পেরিয়ে যাওয়া, খুব গোপনে, কোটি কোটি দীর্ঘশ্বাস আপন করে।। ধ্রুবর দৃষ্টি নড়লো না। পলক পড়লো না। কাঁপলো না ঠোঁটের সূক্ষ্ম কোনো পেশী। সেদিকে চেয়ে, কেবল মনের গহীন থেকে মেঘের মতো বেরিয়ে এলো সহজ কিছু স্বীকারোক্তি,
‘ ভালোবাসা কাউকে কাউকে ঋণি করে ফেলে আবির। কেউ কেউ তা জীবন দিয়ে শোধ করে। কাউকে কাউকে করে ফেলে চিরপ্রেমিক। আমার খুব গোপন একটা বুক ব্যথা আছে। সেই বুক ব্যথা বইতে বইতে আমি তার চির প্রেমিক হয়েছি। আমি তাকে পাওয়ার আশা করি না। তাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে হয় না কখনো। কিন্তু তাকে ভাবলে আমার বুক কাঁপে। আমি তার প্রেমিক হওয়ার অভ্যাস ভুলে যেতে পারি না। আমি এখন চাইলেই কারো যোগ্য স্বামী হতে পারি, পিতা হতে পারি। কেবল কারো প্রেমিক হতে পারি না। আমার যে তার সাথে আমৃত্যু বুক ব্যথার দায়। আমৃত্যু তার প্রেমিক হওয়ার দায়। সকল চাওয়া, সকল ছোঁয়ার উর্ধে গিয়ে এই প্রেম। এই প্রেম মেঘের মতো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় কিন্তু বুকে ধরা যায় না। আমি যাকে বিয়ে করবো তাকে খুব মন দিয়ে ভালোবাসবো আবির। তার ভালোবাসার মানুষ হবো। কিন্তু তার প্রেমিক হতে পারবো না। চন্দ্রত্রপার প্রেমিক হওয়ার দায়িত্বটা খুব কঠিন। আমার বুক ভর্তি ব্যথা নিয়ে এই কঠিন দায়িত্বটা পালন করে যেতে হবে আজীবন। পুরুষ মানুষ নাকি দুঃখ না পেলে সার্থক প্রেমিক হয় না? অথচ আমি দুঃখ দিয়ে সার্থক প্রেমিক হয়েছি। এই প্রেমিক হওয়ার দায়িত্বটা কী ভুলে যাওয়া যায়?
প্রিয় চন্দ্রত্রপা? তুমি আমার প্রাক্তন নও, বর্তমান নও, ভবিষ্যৎ নও। অথচ তুমি ধ্রুব সত্য। অথচ আমি তোমার আজন্ম প্রেমিক পুরুষ। অবসর পেলে, আমায় একটু মুক্তি দিও। তোমার সব দুঃখ ঘুচিয়ে, প্রেমিকের খাতায় আমার নাম কেটো?
ইতি,
তোমার আজন্ম প্রেমিক ধ্রুব।’
__________________
নিশিতা যখন ঢাকায় পৌঁছালো তখন রাত নেমেছে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে বাসায় ঢুকতেই প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ ওমাইগড! ওমাইগড! তোকে তো একদম ভিখারিদের মতো লাগছে।’
নিশিতা প্রিয়তার কথায় কোনো রকম প্রতিক্রিয়া করলো না। সম্প্রতি প্রিয়তা প্রেম ঘটিত সেঞ্চুরি সমাধা করে খুশি খুশি মনে তার পুরোনো প্রেমিকের স্ত্রী হয়েছে। ক’দিন পর মা হবে। সে তার ভারিক্কি পেট নিয়ে সোফার উপর বসলো। নিশিতার থেকে কোনোরকম উত্তর না পেয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,
‘ তূর্য ভাইয়ার যন্ত্রণায় তো কাল রাতে আমাদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল বুঝলি? বড়ো ভাইয়ার থেকে তোর খবরটা শোনার পর থেকে সে পারে তো মিনিটে মিনিটে ফিট খায়। উফ! কী একটা অবস্থা!’
নিশিতা মলিন হাসলো। নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
‘ বাসায় এসেছিলো নাকি?’
‘ তা নয়তো কী?’
নিশিতা জবাবে কিছু বললো না। প্রিয়তা তার ফোনটা নিশিতার ঘরে টেবিলের উপর রেখে গিয়ে বলল,
‘ তূর্য ভাইয়া ফোন করবে।’
নিশিতা ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানায় বসলো। অন্যমনস্ক, বিষণ্ণ মনটা একের পর এক ভাবনার সুতো ধরলো। প্রত্যেক সুতোতেই তীব্র এক বেদনার ছায়া। নিশিতার ভাবনার মাঝেই ফোন বাজলো। অন্যমনস্কভাবে ফোন উঠাতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো অস্থির কন্ঠস্বর,
‘ নিশু বলছো? এই তুমি ঠিক আছো? তোমাকে কতবার করে বললাম, আমায় সাথে নাও। নয়তো ভাইয়াদের কেউ যাক সাথে। তুমি কখনো কোনো কথা শুনো না আমার। কাল কতবড়ো বিপদ হতে পারতো ভাবতে পারছো? আচ্ছা, তুমি সুস্থ আছো তো? আর ইউ অলরাইট?’
তূর্যের কন্ঠে নিখাঁদ ভালোবাসার স্পর্শ। কোথাও কোনো বণিতা নেই। এই তূর্যকে নিশিতা বাস্তবিকই ভালোবাসে। এমন একটি ছেলের সাথে নির্দ্বিধায় কাটিয়ে দেওয়া যায় গোটা একটি জীবন। তবুও কোথাও যেন কিছু নেই। বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে নিশিতার বুক। ভীষণ ভীষণ গভীর রাতে বিষণ্ণ হয়ে আসে ঘুম। বহু বহু বছর আগের সেই অ-প্রেমের মতো, তূর্যের আকুতিতে তার বুক কাঁপে না। তার মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিশিতার শরীর কাঁপে না। অবশ লাগে না জগৎ সংসার। কিন্তু কেন লাগে না? তাদের ভালোবাসা বড়ো পরিণত বলে? নাকি সে কখনো তূর্যর প্রেমে পড়তে পারেনি বলে? নিশিতার চোখদুটো টলমল করে উঠলো। তার যে খুব প্রেমজবার অভাব। কালরাত থেকে থম ধরে থাকা অজানা কান্নাগুলো এবার ফুলেফেঁপে উঠলো। নিষ্প্রভ কন্ঠে বলল,
‘ আই এ্যাম অলরাইট। একটু রেস্ট নিবো। ভীষণ ক্লান্ত।’
‘ ওহ, সরি! সরি! আই অ্যাম সো সরি নিশু। তুমি রেস্ট নাও। আর প্লিজ কিছু খেয়ে নিও৷ অফিসের পর দেখা হচ্ছে। লাভ ইউ।’
নিশিতা কোনোরকম প্রত্যুত্তর করলো না। বুকের ভেতর থেকে থেকে যে ব্যথা হচ্ছে সেই ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে সব সুখ। মিইয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার প্রাপ্তি। অজানা এক কান্নায় বুকের ভেতরটা উথাল-পাতাল ঢেউ তুলছে। মনে হচ্ছে, বড়ো ঠকানো হয়েছে তাকে। এই পৃথিবী বড়ো ঠকালো তাকে। এক জীবনে বড়ো ঠকা ঠকে গেল সে। তার খুব দুঃখ। খুউব। এতো এতো দুঃখ সে কোথায় রাখবে? নিশিতা ভীষণ বিষণ্ণ মন নিয়ে কাপড় ছাড়লো। হাতে-মুখে পানি ছিটিয়ে লিখতে বসলো তার প্রকাশিতব্য উপন্যাসের উপসংহার। কী এক মন ব্যথায় চোখের জলে ভেসে গেল পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। অথচ তার জীবনে কোনো ব্যথা নেই। তার জীবনে ব্যথা থাকতে নেই। কলমের ঢগা ছুটতে লাগল দ্রুত। উপন্যাসের শেষটা না লিখে লিখে ফেললো এক নামহীন চিঠি,
‘শুনছো পৃথিবী,
ধ্রুবকে আমি ভালোবাসি না। বাসিনি কখনো। কিন্তু প্রেমে পড়েছিলাম শত সহস্রবার। খুব ভুল করে দিয়ে ফেলেছিলাম আমার প্রেমজবার একমাত্র কুঁড়ি। আমাদের মাঝে প্রেম এসেছিলো কিন্তু প্রেমসন্ধি হয়নি কখনো। ধ্রুব আমার প্রেমিক হতে পারেনি। হতে পারেনি সার্থক আগুন্তক। আগুন্তকের হাতে প্রেমজবা থাকতে নেই। অথচ ধ্রুবর হাতে টকটকে দুটো প্রেমজবার কুঁড়ি। আমার একটি মাত্র প্রেম জবার দায়ে ধ্রুব সাধারণ হতে পারেনি, অসাধারণ হতে পারেনি, আগুন্তকঃ হতে পারেনি। হয়ে গিয়েছে আজন্ম অ-প্রেমিক। আমি তাকে ভুলে যাই বারবার। কেবল প্রেম জবার কথা ভুলে যেতে পারি না। প্রেম জবার প্রতি যে আমার বড়ো মায়া। এখন আমি অন্য পুরুষের চোখে চেয়ে নির্দ্বিধায় ভালোবাসি বলতে পারি। অথচ একটি প্রেম জবার অভাবে কোনো পুরুষের প্রেমে পড়তে পারি না। বুক চিনচিনে প্রেমসুখ পাই না। বড়ো তৃষ্ণার্ত আমার মন। বহু বহু বছর হলো আমি প্রেমসুধা পান করি না।
অ-প্রেমিক ধ্রুব? তোমার- আমার প্রেম জবার আঁড়ি। হাজার বছরের দায়। অবসর পেলে সেই দায়ে তোমার নাম কেটো। দোহায় লাগে, চন্দ্রতপার প্রেম জবা তাকেই আবার ফিরিয়ে দিও?
ইতি…
যে মেয়েটির আজন্ম প্রেমজবার দায়! ‘
চিঠিটা লেখার পর বেশ কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে চেয়ে রইলো নিশিতা। এই চিঠি তো কাগজে হওয়ার কথা নয়। এই চিঠি তার মনে মনে। শহরের আনাচে কানাচে নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেমন ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য অ-প্রেমিক, অ-প্রেমিকার মৌন চিঠি? ঠিক তেমনই ভেসে বেড়াতে হবে তাকেও। নিশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনেকটা সময় পর কাগজটাকে মুড়িয়ে আগুন দিলো তাতে। চোখের জল আর অনুভূতিতে ডোবা চিঠি ধোঁয়া হয়ে উড়ে গেল দূর থেকে বহুদূরে। মিশে গেল অন্ধকারে। ধোঁয়ার সাথে সাথে কী অনুভূতিরাও উড়ে গেল? নিশিতা চেয়ে রইলো অন্ধকার আকাশে। দেখতে লাগলো তার অ-প্রেমের গল্পটা ধোঁয়া হয়ে মিশে যাচ্ছে ভেজা ভেজা মেঘের দেশে। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলো নিশিতা, ‘ এ গল্পটা বড়ো গোপন গল্প। এ হলো দীর্ঘ এক মৌন যুদ্ধের গল্প। আমার প্রেম জবা হারিয়ে ফেলার গল্প। এই গল্পের মানুষ দুটি বাঁচে এখন আলাদা দুটো গ্রহে। এই গল্পটা আমি তোমায় দিলাম। প্রিয় মেঘ, গল্পটা তুমি গোপন রেখো। এ গল্পে ভীষণ পাপ। ভীষণ মন খারাপ। অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস। এই প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্পটাকে তুমি সাজিয়ে রেখো কোনো এক অ-প্রেমের শহরে। যেখানে মন ব্যথার গল্পগুলো আড়াল থাকে ভীষণ ভীষণ অন্ধকারে।’
#সমাপ্ত……
( প্রত্যেকবার শেষ পর্বে এমন হয়। কেন জানি, অনুভূতিগুলো গুছিয়ে লিখতেই পারলাম না। কোথায় জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে শূন্যতা আর বিচ্ছিন্নতার জন্য দুঃখিত।)