#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১ঌ।
ঠাস করে উঠা একটা চড়ের শব্দে চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে ঢোক গিলল কেবল। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা চওড়া শরীরের ব্যক্তিটি কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘খালি একটা ছবি নিয়ে নাচতে নাচতে চলে এলি কেন? দেখতি পারলি না, ওরা কোথায় যায়? কী করে? ওদের ফলো করতে পারলি না, আহাম্মকের বাচ্চা?’
ছেলেটি মিইয়ে যাওয়া সুরে জবাব দেয়,
‘স্যার, ঐ লোকটা আমাকে ধরে ফেলতো, তাই আমি তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। আর নাহলে তো ধরা পরে যেতাম।’
ফরহাদ প্রচন্ড রেগে যায়। রাগে তার হাতের ছবিটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। প্রচন্ড রাগে হাত জোড়া কাঁপছে তার। কপালের রগ ফুলে আছে। চোখগুলো লাল। সে পৃথার বাবাকে কল দেয়। কল রিসিভ হতেই চেঁচিয়ে বলে,
‘আপনার মেয়ে এবারও ঐ অর্ণবের সাথে পালিয়েছে। আপনারা বাপ মেয়ে মিলে কি আমার সাথে মজা শুরু করেছেন? আগেও একবার এরকম হয়েছে, পরে আপনি অনুরোধ করেছেন, আমি যেন সব ভুলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করি। আমিও দয়া দেখিয়ে রাজি হই। কিন্তু, এখন আবারও আপনার মেয়ে একই কাজ করল। ও আবার অর্ণবের সাথেই পালাল। এবার আমি আপনার মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার পর ওকে আর ছাড়ব না। আমাকে এত ঘুরানোর শাস্তি ওকে পেতেই হবে।’
পৃথার বাবা ভয় পেলেন। যে ভয়টা পাচ্ছিলেন অবশেষে সেটাই হলো। ভেবেছিলেন, মেয়ের স্মৃতি নেই, এই সুযোগে বিয়েটা দিয়ে দিবেন। কিন্তু, মেয়ে তার আবার একই কাজ করল। তিক্ত সুরে তিনি বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করো, বাবা। ওকে খালি একবার খুঁজে বের করো তুমি,তারপর দেখো, আমি ওকে কীভাবে তোমার সাথে বিয়ে দেই।’
‘আপনার আর লাগবে না, এবার যা করার আমি একাই করব।’
ফরহাদ কল কেটে দিয়ে তার সহকারীকে বলল,
‘গাড়ি বের করো, আমি এক্ষুনি সেই জায়গাটাই যাব।’
,
সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগেই। চারদিকে এখনো আলোর ছটা রয়ে গেছে। পৃথা খোলা চুলে বারান্দায় দাঁড়ানো। অর্ণব পেছন থেকে এসে বলল,
‘রুমে এসো, পৃথা। তোমার চুলে তেল দিয়ে দেই।’
পৃথা পেছনে চেয়ে অবাক চোখে বলল,
‘আপনি চুলে তেলও দিয়ে দিতে পারেন?’
‘হু।’
‘বাহ, আপনি তো দেখছি বেশ কাজের মানুষ। আপনাকে বিয়ে করে আমার লাভই হয়েছে মনে হচ্ছে। আমার খুব একটা খাটতে হচ্ছে না, সব আপনিই করে ফেলছেন।’
‘জি ম্যাডাম, এত সুন্দরী বউয়ের খেয়াল না রাখলে হয়? আসুন, এখানে এসে বসুন।’
অর্ণব বিছানার উপরে বসল। আর পৃথা তার বরাবর নিচে মেঝেতে বসল। অর্ণব বিলি কেটে কেটে তার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। পৃথার বেশ আরাম বোধ হয়। সে চোখ বুঝে সেই আরামটা উপভোগ করে। সেই সময় হুট করেই কেন যেন তার মনে হয়, আগেও একবার কেউ তাকে ঠিক এভাবেই তেল দিয়ে দিয়েছিল, এত যত্ন নিয়ে, আরাম করে। কিন্তু সে কে, সেটা সে মনে করতে পারছে না। পৃথা মস্তিষ্কে খুব চাপ প্রয়োগ করে, ব্যক্তিটাকে মনে করার জন্য, কিন্তু সে পেরে উঠে না। বরাবরের মতো এবারও সে ব্যর্থ। সে বিষাদ মনে অর্ণবের পায়ের উপর মাথা রাখে। অর্ণব বলে,
‘মাথা সোজা করো। এভাবে রাখলে তেল দিতে পারব না তো।’
পৃথা ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘জানেন অর্ণব, আমার না মাঝে মাঝে কেমন যেন লাগে। মনে হয় একই ঘটনা আমার সাথে বারবার ঘটছে। আমি এই ব্যাপারটা কোনোভাবেই না মেলাতে পারি না। এই যে, আপনি এখন আমাকে তেল দিয়ে দিচ্ছেন, আমার এখন বারবার মনে হচ্ছে, এমন ভাবে আমাকে আগেও কেউ তেল দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, সেটা কে, সেটাই বুঝতে পারছি না। মা’কে খুব ছোট বেলায় হারিয়েছি। মায়ের সাথে খুব একটা স্মৃতি আমার নেই। খালাও কখনো ওভাবে আমাকে তেল দিয়ে দেননি। মাঝে মাঝে রুহা বাসায় এলে তেল দিয়ে দিত। কিন্তু, এভাবে না। এভাবে অন্য কেউ একজন আমাকে তেল দিয়ে দিত, কিন্তু আমার তার কথা কোনোভাবেই মনে পড়ছে না। মাথায় খুব চাপ পড়ছে। ইদানিং এমন খুব বেশি হচ্ছে। কী একটা যেন মনে হতে হতে নিয়েও হচ্ছে না। আমি আসলে আমার প্রবলেমটা কাউকে বোঝাতে পারছি না। নিশ্চয়ই আমার বড়ো কিছু একটা হয়েছে, আমি বুঝতি পারছি। কিন্তু, সেটা কী, ধরতে পারছি না।’
পৃথার খুব অসহায় লাগে। সবকিছু স্বাভাবিক থেকেও যেন কিছু স্বাভাবিক নেই। কেমন যেন করে, কী ভেবে যেন মাঝে মাঝে তার খুব যন্ত্রণা হয়। যদি কাউকে সে খুলে সবটা বোঝাতে পারতো, তাহলে হয়তো কিছুটা শান্তি পেত।
অর্ণব বুঝতে পারে। সে পৃথার সমস্যাটা বুঝতে পারছে, কিন্তু চেয়েও কোনো সমাধান বের করতে পারছে না। খুব ইচ্ছে করছে, পৃথাকে সব সত্যিটা বলে দিতে। কিন্তু, যদি তখন পৃথা আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে? ডাক্তার বলেছেন, ওর জন্য এখন উত্তেজনা একদমই ঠিক না। ওর মস্তিষ্কে বেশি চাপ পড়লে ও আরো বেশি স্মৃতি ভুলে যেতে পারে। এখন যেইটুকু স্মৃতি আছে, সেটাও যদি হারিয়ে যায়, তবে সে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তাই আপাতত সব মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
অর্ণব পৃথার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নরম সুরে বলে,
‘এত টেনশন করো না। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের সবার সাথেই মাঝে মাঝে এমন হয়। মনে হয় যেন, “আরে, এই ঘটনাটা তো বোধ হয় আগেও আমার সাথে ঘটেছে।” কিন্তু, আসলে তেমন কিছুই না। আমরা সারাক্ষণ যা নিয়ে ভাবি যদি আমাদের সাথে তেমন কিছুই হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্ক তার মতো আরো একটা ইমেজ তৈরি করে। আর তখন আমরা ভাবি, একই ঘটনা আমাদের সাথে আবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আসলে, তা হয় না। মূলত আমাদের মস্তিষ্কে যে ইমেজটা তৈরি হয়, সেটা আমাদের কল্পনা। আর আমরা আমাদের কল্পনাটাকেই বাস্তব বলে ভেবে নেই। ভেবে নেই, অতীতেও এমন কিছু হয়েছে।’
পৃথা অর্ণবের দিকে মুখ করে বসে। চিন্তিত স্বরে বলে,
‘আমার তো আপনাকেও খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয় যেন, আপনি আমার পূর্ব পরিচিত। অথচ আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়, সাজেকে। এটাও কি আমার কল্পনা? আপানাকে আগে না দেখে থাকলে আমার মস্তিষ্ক আপনার ইমেজ তৈরি করল কী করে?’
অর্ণব কী করে বোঝাবে, পৃথার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা আলাদা। তার তো মুছে যাওয়া স্মৃতিগুলোই আবছা ভাবে মনে পড়ছে। অর্ণব যে তার কল্পনা না, সে তো বাস্তব। তার মস্তিষ্ক অর্ণবের কোনো ইমেজ তৈরি করেনি, বরং চো তার বাস্তব স্মৃতিগুলোই আলতো ভাবে ভাসিয়ে রেখেছে।
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘হয়তো এমন কিছুই। হতে পারে আগে কোনো একদিন আমাদের দেখা হয়েছিল। সেই দেখা থেকেই আমার স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কে রয়ে গিয়েছে। তুমি হয়তো সেটা জানোও না। কিন্তু তোমার মেমোরিতে সেই দৃশ্য ঠিকই আটকে আছে।’
পৃথা আর কিছু বলে না। চুপচাপ ঘুরে বসে। অর্ণব আবারও তার চুলে তেল দিতে আরম্ভ করে। তেল দেওয়া শেষ করে, ম্যাসাজ করে দেয়। পৃথার ভীষণ আরাম লাগে। যেন আরামে চোখও লেগে যাচ্ছে তার। ঘুমে বসে বসে ঢুলছে সে।
কিন্তু তার সেই আরাম আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঠকঠক দরজার শব্দে পৃথার ঘুম জানলা দিয়ে পালায়। সে হকচকিয়ে উঠে, অর্ণবের দিকে চেয়ে বলে,
‘কেউ এলো বোধ হয়।’
অর্ণব বলল,
‘হ্যাঁ, চাচা হয়তো। তুমি বসো, আমি গিয়ে দেখছি।’
অর্ণব গিয়ে দরজা খুলে। খুলে দেখে, সত্যি সত্যিই চাচা এসেছেন। অর্ণবকে দেখে তিনি বললেন,
‘তোমাদের সাথে নিচে কিছু লোক দেখা করতে এসেছেন।’
অর্ণব ভ্রুক্ষেপ করে প্রশ্ন করতে যাবে, তার আগেই কয়েকজন লোক চাচাকে সরিয়ে হুরমুড়িয়ে তার বাসার ভেতর ঢুকে পড়ে। অর্ণব তখন সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে বলে,
‘এই কারা আপনারা? বাসার ভেতরে ঢুকছেন কেন?’
চলবে…