প্রেমাঙ্গনা পর্ব ১৮

0
403

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।

‘এত ঝাল কেন দিচ্ছ?’

‘কেন, আপনি ঝাল খেতে পারেন না।’

‘পারি, কিন্তু এতটাও না। তুমি তো একগাদা মরিচ দিয়ে দিয়েছ।’

‘মুরগী মাংস একটু ঝাল ঝাল না হলে হয়?’

‘আচ্ছা, হয়েছে। তুমি এবার সরে এসো। বাকি রান্নাটা আমি শেষ করছি।’

‘না, আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখুন। আমি রান্না করব।’

অর্ণব পৃথাকে জোর করেও রান্নাঘর থেকে বের করতে পারে না। পৃথাই সব রান্না করে। অর্ণব পাশে দাঁড়িয়ে তাকে টুকটাক সাহায্য করে। সেই পুরোনো মুহূর্তগুলো অর্ণবের খুব মনে পড়ে তখন। আগে কীভাবে রান্না করার সময় পৃথাকে জ্বালাত। মেয়েটা রেগে গিয়ে খুনতি হাতে অর্ণবের পিছে ছুটত। হয়তো, আবার পৃথা আগের মতো হবে। আগের স্মৃতি মনে না পড়লেও, নতুন করে হয়তো শুরু হবে সবকিছু। হোক, তাতেও খারাপ কী? পুরোনো ভালোবাসা নতুন করে, নতুন রূপে ফিরবে।

দু’দিন স্বাভাবিক ভাবেই কেটে যায়। এই দু’দিনে অর্ণবের সাথে পৃথার সম্পর্কটাও বেশ জমেছে। সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি যেন চলতেই থাকে। পৃথাও তার এই নতুন জীবনে খুব খুশী। অর্ণবের ব্যবহার তাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। ছেলেটাকে যত দেখে, অবাক হয়। এত কেন যত্ন নেয় সে? সারাক্ষণ পৃথাকে নিয়ে অস্থির থাকে। সেদিন পৃথা একবার বমি করাতেই কী পাগলামীটাই না শুরু করেছিল। এত ভয় কিসের? একবার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে বলে কি তার এত ভয়? হয়তো সে তার প্রথম স্ত্রীকেও এইভাবেই ভালোবাসত। সে তাকে ভুলে যাওয়ায় মনে হয়তো তার খুব কষ্ট জমে আছে। তাই এখন পৃথাকে ও হারাতে সে এত ভয় পায়।

,

আজ বিকেলে পৃথার শরীরটা একটু বেশিই খারাপ করে। অর্ণব সেই সময় বাইরে ছিল। পৃথা প্রথমে এটাতে এত গুরুত্ব না দিলেও পরে শরীর খারাপ আরো বাড়ে তার। কেমন একটা অশান্তি লাগে। সে অস্থির হয়ে এই রুম ঐ রুম পায়চারি করে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না যেন। বিরক্ত হয়ে অর্ণবকে কল দেয়। অর্ণব কল রিসিভ করলে সে বলে,

‘এক্ষুনি বাসায় আসুন, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে।’

কথার বলার পনেরো মিনিটের মধ্যে অর্ণব ছুটে বাসায় আসে। পৃথা দরজা খুলতেই সে বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,

‘কী হয়েছে? আবার বমি পাচ্ছে? পেটে ব্যথা করছে না তো? মাথা ব্যথা করছে নাকি?’

পৃথা মুখ কালো করে বলল,

‘জানি না। বুঝতে পারছি না কিছু। শরীর যেন কেমন করছে, অস্থির অস্থির লাগছে। কোনো ব্যথা নেই, তাও শরীরটা খারাপ লাগছে কেন বুঝতে পারছি না।’

অর্ণবের চোখে মুখের অস্থিরতা রেশ কাটে না। সে কী করে পৃথাকে বলবে, এই সময় এমন একটু আধটু হয়। কিন্তু, ব্যাপারটা তো আর লুকিয়েও রাখা যাচ্ছে না। অর্ণব পৃথার কাছে যায়। দু’হাত গালে স্পর্শ করে বলে,

‘খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করছো না বলে হয়তো শরীর দূর্বল লাগছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আরো খাব? দেখুন, এমনিতেই কত মোটা হয়ে যাচ্ছি। আমার পেটটাও ইদানিং খুব বড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাই ভাবছিলাম বেল্ট ইউজ করব। আমাকে একটা বেল্ট এনে দিবেন?’

‘না, একদম না। কোনোকিছু ইউজ করবে না তুমি। হোক পেট বড়ো। পেটে একদম হাত দিবে না।’

পৃথা ঠোঁট গুঁজ করে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলে,

‘পেট বড়ো হলে ভালো লাগবে না তো। আচ্ছা, শুধু কিছু ব্যায়াম করব।’

অর্ণব তাকে বুঝিয়ে উঠতে পারছে না। সে পৃথাকে নিয়ে রুমে যায়। পৃথাকে বিছানায় বসিয়ে সেও পাশে বসে। অসহায় সুরে বলে,

‘একটা কথা রাখবে, পৃথা?’

‘কী, বলুন।’

‘চলো আমরা একটা বাচ্চা নেই।’

পৃথা যেন আকাশ থেকে পড়ল। কোন কথা থেকে সে কোন কথাই চলে গিয়েছে। সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। খানিক বিরক্ত সুরে বলে,

‘এখানে বাচ্চা নেওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে?’

অর্ণব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে। অতঃপর বলে,

‘আমার একটা বাচ্চার খুব শখ। আর তাই আমি লেইট ও করতে চাইছি না। তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, একটা বাচ্চা হলে আমাদেরই লাভ। তুমি তখন সেই বাচ্চার উসিলায় তোমার বাবাকেও বোঝাতে পারবে। তখন দেখবে তোমার বাবাও আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবেন। তাই প্লিজ পৃথা, না করো না।’

‘আশ্চর্য, আমাদের বিয়ের কেবল দুই কী তিন দিন হয়েছে; আর আপনি এখনই বাচ্চা নেওয়ার কথা বলছেন? হুট করে এই চিন্তা কীভাবে আপনার মাথায় এল?’

‘এখানে খারাপের কী আছে? বিয়ের পর তো মানুষ ফ্যামিলি প্ল্যানিং করেই থাকে, তাই না? আমাদেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন একটা বাচ্চা হলেই, আমাদের পরিবার সম্পন্ন হবে। এটা নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কী আছে?’

পৃথা থ মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। অর্ণব তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘আমি বুঝতে পারছি, তোমার কাছে এখন এই ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু, আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলে আমাদেরই লাভ। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে।’

পৃথা শক্ত গলায় বলল,

‘আমি তো এখন বাচ্চা নিব না। আমি ভেবেছিলাম, বিয়ের পর আপনার কাছে এসে আমার নিজের মতো একটা জীবন পাব, আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। ভেবেছিলাম, আপনিও আমার পাশে থাকবেন। তা না, বিয়ের দু’দিনের মাথায় আপনি আমাকে বাচ্চার কথা বলছেন? যেই পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়েটা হয়েছে, সেই পরিস্থিতির সাক্ষেপে আপনি কীভাবে হুট করে বাচ্চা নেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন? আপনার সাথে আমার ঐরকম ভাবে ঘনিষ্ঠ কোনো সম্পর্কই তৈরি হয়নি। কেবল বন্ধুত্ব হয়েছে, আস্তে ধীরে হয়তো সবকিছু নরমাল হবে। কিন্তু, আপনি এখনই এত তাড়া দিচ্ছেন কেন?’

অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। পৃথাকে বোঝানোর সাধ্য এখন তার নেই। এই মেয়ে যে তার এই সিদ্ধান্ত ভুলেও গ্রহণ সেটা সে আগেই জানতো। এখন কী করবে? কীভাবে প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা সে পৃথাকে বলবে? সে মাথায় হাত রেখে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ে। পৃথা তাকিয়ে থাকে তার দিকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

‘এখন এর জন্যও আপনি আমার সাথে রাগ করবেন?’

অর্ণব মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলল,

‘রাগ করলাম কোথায়?’

‘তাহলে এভাবে শুয়ে পড়লেন কেন?’

‘এমনি।’

‘শুতে হবে না, উঠুন। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যান। ঘুরতে গেলে মনটা একটু ভালো লাগবে।’

অর্ণব উঠে বসে। পৃথাকে বলে,

‘ঠিক আছে, যাও। তুমি গিয়ে রেডি হও।’

বাইরে গিয়েই পৃথা বায়না করল, সে নাকি ফুচকা খাবে। কিন্তু, এই সময় বাইরের এসব খাবার শরীরের জন্য ভালো হবে না বলে, অর্ণব তাকে বারণ করে। কিন্তু, এই মেয়ে কি আর সহজেই তার বারণ শোনার পাত্রী। সে জেদ ধরে বসে, আজকে ফুচকা না খেয়ে সে আর বাড়িই ফিরবে না। একপর্যায়ে বউয়ের কাছে পরাজিত হয়ে অর্ণব তাকে নিয়ে ফুচকা খেতে যায়। রিক্সা থেকে নেমেই পৃথা ছুটে যায় ফুচকাওয়ালার দোকানে। ঝাল দিয়ে এক প্লেট ফুচকা দিতে বলে। অর্ণব এসে বলে,

‘মামা, একদম কম ঝাল দিবেন না।’

পৃথা বাঁকা চোখে চেয়ে বলে,

‘আমি আমারটাতে বেশি ঝাল দিতে বলেছি, আপনারটা কম ঝাল দিয়েই বানাবে।’

‘না মামা, দুজনেরটাই কম ঝাল দিয়ে বানাবেন। বেশি ঝাল খেলে পেটে অসুখ হবে।’

পৃথা জেদ দেখাতে গিয়ে উল্টো অর্ণবের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যায়। পরে ঝাল ছাড়া ফুচকাটাই চুপচাপ খায় সে।

________________________

বিকেল পাঁচটা,

অর্ণব বাসায় ফেরার রিক্সা ঠিক করছিল। সেই সময় সে খেয়াল করে একটা লোক দূর থেকে তাদের ছবি তুলছে। ব্যাপারটাই অবাক হয় সে। পৃথাকে দাঁড় করিয়ে লোকটার কাছে যেতে নিলেই লোকটা দৌড়ে পালায়। অর্ণব আর তাকে ধরতে পারে না। সে পৃথার কাছে ফিরে এসে বলে,

‘ঐ লোকটা আমাদের ছবি তুলছিল।’

পৃথা কথাটা শুনে ঘাবড়ে যায়। ভীত সুরে বলে,

‘ঐ লোকটা আবার ফরহাদের লোক নয়তো? যদি এখন ফরহাদ আমাকে খুঁজে বের করে ফেলে?’

‘তাতে কী? কারোর বাপেরও সাহস নেই আমার বউয়ের গায়ে হাত দেওয়ার।’

অর্ণবের নিমিষেই রক্তাক্ত হয়ে উঠা চোখগুলো দেখে পৃথা ঢোক গিলে। মনে মনে ভাবে, এই ভেজা বিড়াল রাগলে নিশ্চয়ই সিংহের মতো হুঙ্কার ছাড়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here