#প্রেমময়_পিপাসা
#স্বপ্না_ফারিন
#পর্বঃ২
চিঠিতে লেখা ছিল,
–“কি দিয়ে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। কোথায় থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আজকে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মধ্যে সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে যাচ্ছি। কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা। ভুল সময়ে ভুল মানুষের প্রেমময় পিপাসা’তে আসক্ত হয়ে জীবনের সব থেকে বড় ভুল করেছি। যে ভুলের মাশুল আমাকে এভাবে দিতে হবে আমার কল্পনার বাহিরে ছিল। যে ভুলের জন্য জীবন কেমন বিষাক্তময় হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে
ইচ্ছে করতো নিজেকে শেষ করে দেয়। কিন্তু কাছের মানুষ গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত
করতে পারেনি। কারণ আমার ভুলের মাশুল তারা কেন দিবে। আমার জন্য তারা কেন কষ্ট পাবে। কি দোষ তাদের? আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করা, আমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসা তাদের দোষ! যে বিশ্বাস এবং ভালোবাসার মুল্য আমি রাখতে পারিনি। আমি আসলে তাদের বিশ্বাস এবং ভালোবাসার যোগ্য না। আমার কি সত্যি কোন ক্ষমা হয়?
তখন সবকিছু ভেবে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেলাম। নতুন করে জীবন কে সাজানোর চেষ্টা করলাম। তারপর সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। অতীতের কালো ছায়া ভুলে জীবন কে নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলাম। কারণ জীবনে চলার পথে মানুষ ভুল করে। কিন্তু সে ভুল কে স্মৃতি হিসেবে আঁকড়ে ধরে রাখেনা। জীবনে নতুন করে বাঁচতে শিখে।
কিন্তু আজকে বিয়ের কিছু মুহূর্ত আগে, নতুন জীবন শুরু করার আগে। জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবার আগে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল অজানা কোন ঝড়ে। আমার জীবনে নেমে এলো মূহুর্তের মাঝে অতীতের কালো ছায়া। যেখান থেকে ইচ্ছে করলে বেরিয়ে আসার সাধ্যে আমার হবেনা। কিন্তু আমার অতীতের কালো ছায়া যেন আমার কাছের মানুষের জীবনে না এসে পড়ে। তারজন্য চলে যাচ্ছি বহুদূরে। ভালো থেকো পারলে মন থেকে মুছে ফেলো আমাকে। আমার কখনো সাধ্যে হবেনা তোমাদের সামনে এসে দাঁড়ানোর। জানি যে ভুল করেছি তার কোন ক্ষমা হবেনা। কিন্তু এছাড়া এবং নিজেকে শেষ করে দেয়া ছাড়া আমার কাছে কোন পথ খোলা ছিল না। নিজেকে তো শেষ করতে পারলাম না। তারজন্য চলে যাচ্ছি অনেক দূরে। যখন চিঠিটা পাবে তখন শুভ্রতা বহুদূরে হারিয়ে যাবে। ভালো থেকো।
ইতি,
তোমাদের শুভ্রতা।
এসব শুনে,
শুভ্রতার মা আলেয়া বেগম ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। শুভ্রতার বাবা নাহিদ সাহেব নিজেকে বৃথা শক্ত করার চেষ্টা করে বললেন,
–“আলেয়া আমার ভুল ছিল আমি আমার মেয়েকে সঠিক ভাবে শিক্ষা দিতে পারেনি। নিজেকে আজকে বাবা হিসাবে খুব ব্যার্থ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার শিক্ষার কোন ভুল ছিল। যে ভুলের মাশুল আমাকে এখন এভাবে গুনতে হচ্ছে। কিন্তু জানো সবকিছু এখনো আমার কাছে কেমন বিশ্বাস হচ্ছেনা। সবকিছু কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছি। ঘুম ভেঙে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এটা যে বাস্তবতা সে কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কেন এতো কষ্ট হচ্ছে আমার বলতে পারো? কারণ যে মেয়ে আমার এতো কাছের ছিল, আমার এতো প্রিয় ছিল, যে আমার গর্ব ছিল, সে এমন একটা কাজ করবে কিভাবে বিশ্বাস করা যায় বলবে? তার যে কোন সিদ্ধান্ত আমাকে জানাতে পারতো। তার যে কোন সমস্যা আমাকে বলতে পারতো। তার বাবা সবকিছু সামলে নিতো। তার বাবার উপর কি তার সামান্য বিশ্বাস ছিল না। কেন করলো শুভ্রতা এমন। কেন এভাবে আমাদের ভাসিয়ে চলে গেল। কি উত্তর দিব বর পক্ষকে এখন? যখন সবকিছু জানাজানি হবে, কারো কাছে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা থাকবে আমাদের। মানুষ আমাদের নিয়ে সমালোচনা করবে। নানা রকমের কথা বলবে কিভাবে মানুষের মুখ বন্ধ করবো বলতে পারো। বিভিন্ন মানুষ তিরস্কার দিয়ে কথা বলবে, কি নাহিদ সাহেব মেয়েদের নিয়ে এতো অহংকার করতেন সেখানে আজকে আপনার বড় মেয়ে শুভ্রতা কি করলো? কি উত্তর দিব তাদের। আমার কাছে কি কোন উত্তর আছে। তারা আমাদের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। নানাভাবে অপদস্ত করবে আমাদের। আমাদের বাড়ির মেয়েদের সম্মান দিবে না। এভাবে কি করে বাঁচতে পারবো বলো আলেয়া।
কথাগুলো বলতে চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু পড়ছে নাহিদ সাহেবের। নিজেকে অনেক চেষ্টা করেও শক্ত রাখতে পারলেন না তিনি। অবশেষে তার স্ত্রী আলেয়া বেগম এর মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। কোন পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে মুগ্ধতার অজানা ছিল। নিজের বাবাকে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতো না। পুরুষ মানুষ ও এভাবে কাঁদতে পারে।
মুগ্ধতা সামান্য কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অশ্রু ভেজা চোখে এসব দৃশ্য দেখছিল। এমন অসহায়ত্ব অবস্থায় সে কখনো তার পরিবার এবং বাবা-মা কে দেখিনি। কিভাবে দেখবে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি এর আগে কি কখনো হয়েছিল তাদের?
তখন মুগ্ধতা অশ্রু ভেজা চোখে বিড়বিড় করে বলে,
–“আপু কোথায় তুমি ? কেন করলে এমন। তোমার জন্যে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। কেন চলে গেলে তুমি। কেন?
_______________________
শুভ্রতা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। অশ্রু সিক্ত চোখে নিজেকে লুকানোর চেষ্টায় ব্যাক্ত সে। হাতে দুটি বাসের টিকিট। কাঁধে তার ঝুলানো ব্যাগ। দেখতে তাকে খুব সাধারণ মেয়ের মতো লাগছে। তাকে দেখে বোঝার কোন চিহ্ন ছিলনা, সে কোন বিয়ের কোনে এবং বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছে। সে নিত্যদিনের সাধারণ মানুষের মতো বাস স্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে অজানা কোন ঠিকানায় পৌঁছানোর। যে গন্তব্যের ঠিকানা তার নিজের অজানা।
নিস্তব্ধতা নীরবতা কাটিয়ে অপেক্ষার সীমা পেরিয়ে, অবশেষে সঠিক সময়ে বাসস্ট্যান্ডে বাস এসে পৌঁছায়। তখন শুভ্রতা বাসে উঠার আগে৷ শেষ বারের মতো পিছনে ফিরে আলতো করে তাকিয়ে দেখে তার প্রিয় শহর’টা কে। যে শহরের সাথে তার কতশতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে হাজারো মুহূর্ত। যেখানে তার ছোট থেকে বেড়ে উঠা, বড় হয়ে উঠা। সেই চিরচেনা শহর কে এভাবে বিদায় জানাতে হবে ভাবতে শুভ্রতার বুকের ভেতর’টা কেঁপে উঠলো। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, তখন অশ্রু জোড়া দু’হাতের তালুতে মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে। নিজেকে শক্ত করে দ্রুত বাসে উঠে পড়লো। পিছনে ফিরে তাকালো না।
বাস নিজের গতিতে চলছে। জানালার পাশের সিটে বসে গভীর ভাবনার মাঝখানে মগ্ন হয় শুভ্রতা। জীবন বড় অদ্ভুত! যে মেয়েটার আজকে নববধূ সাজে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। সে আজকে অজানা কোন ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে কে জানে।
বিয়ের কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তের ঘটনা, শুভ্রতা যখন নতুন জীবনের সূচনা করার জন্য ব্যাস্ত। তখন তার কাছে একটা পার্সেল আসে। পার্সেল টা কে দিয়েছে কে পাঠিয়েছে কোন কিছু লেখা ছিলনা সেখানে। ছোট একটা বাচ্চা এসে তাকে দিয়ে ছুটে চলে যায়। বিয়ে বাড়ি এতো মানুষ কে দিয়েছে এটা? এসব ভাবতে তখন শুভ্রতা কৌতুহল নিয়ে পার্সেলটা খুলে ফেলে। কারণ অজানা বিষয়ে মানুষের জানার খুব আগ্রহ থাকে। পার্সেল টা খোলার পরে দেখে একটা এন্ড্রয়েড ফোন। এমন সময় তাকে ফোন কে গিফট করবে। এসব ভেবে ফোন অন করতে ফোনে কল চলে আসে। যেখানে আগে থেকে ফোনের মধ্যে সিম ছিল। কৌতুহল নিয়ে ফোন রিসিভ করে শুভ্রতা বলে,
–“হ্যালো মি. ইজহান? কিছুক্ষণ পড়ে আমাদের বিয়ে, এখন এরকম করারা কোন মানে হয়। কি হলো নিশ্চুপ কেন এখন? কি ভেবেছিলেন শুভ্রতা আপনার সারপ্রাইজ বুঝতে পারবে না। কি বোকা মানুষ আপনি মি. ইজহান খান। নিজে সারপ্রাইজ এর কথা বলে নিজে কিভাবে ভুলে গেলেন। কি হলো কিছু বলেন না। কথা না বললে ফোন রেখে দিলাম কিন্তু। এখনো কথা বলবেন না? ঠিক আছে ফোন রেখে দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ নীরবতা তারপর ফোনের বিপরীত পাশে থেকে উত্তর আসে।
–“আজকে তাহলে আমার মিষ্টি পাখি’টার বিয়ে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা? এতো সারপ্রাইজ কিভাবে বিশ্বাস করি বলো। শুনলাম দেশের নামকরা বিজনেস ম্যান ইমতিয়াজ খানের ছেলে বর্তমান দেশের নামকরা বিজনেস মি. ইজহান খানের সাথে বিয়ে হচ্ছে আমার মিষ্টি পাখি’টার। কিন্তু দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছিল? শেষ পর্যন্ত তোমার মতো ইউজলেস মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।
কিন্তু আমাকে ছাড়া কিভাবে তোমার বিয়ে সম্পূর্ণ হবে বলো। আমাকে ছাড়া তোমার বিয়ে পূর্ণতা পাবেনা। তুমি কিভাবে পারলে আমাকে না জানিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসতে। তুমি কিন্তু এটা ঠিক করলে না শুভ্রতা। তোমার বিয়েতে আমার কতকিছু করার বাকী আছে। আমাদের কতশতো স্মৃতি সকল কে দেখানোর বাকী আছে। এসবের জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম এতো দিন। অবশেষে সে দিন এলো। কিন্তু মি. ইজহান মানে তোমার হবু বর কি জানে আমি তোমার কে? আমাদের মধ্যে কি রিলেশন ছিলো? না জানলে আমি জানিয়ে দিতে পারি তোমার কোন কষ্ট করতে হবেনা। আমার মিষ্টি পাখি’টা।
চিরচেনা কন্ঠের আওয়াজ শুনে কেঁপে উঠে শুভ্রতা। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। তাহলে কি অতীতের কালো ছায়া ফিরে এলো তার জীবনে? কি করবে এখন সে। মূহুর্তের মাঝে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
তখন শুভ্রতা নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো গলায় বলে,
–“তুমি?
ফোনের বিপরীত পাশে থাকা লোকটা অদ্ভুত ভাবে হেসে দিয়ে সে বলে,
–“হ্যাঁ আমি। অবশেষে তাহলে আমাকে চিনতে পারলে শুভ্রতা। চিনতে পারবে না কেন? কাছের মানুষ বলে কথা। কাছের মানুষ কে কি এতো সহজে ভুলে যাওয়া যায়।
শুভ্রতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
–“কাছের মানুষ কথাটা তোমার মুখে ঠিক মানাচ্ছে না। তুমি শুধু পারো মানুষকে ব্যবহার করতে। নিয়াজ?
শুভ্রতার কড়া জবাব শুনে, মুহূর্তের মধ্যে নিয়াজের চেহারা পাল্টে গেল। সে করা গলায় বললো,
–“আমাকে তো তুমি খুব ভালো করে চিনো শুভ্রতা। জানো তো নিয়াজ কি করতে পারে। তোমার সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত স্মৃতি হিসেবে আমার কাছে আছে। সময় হয়েছে সবকিছু এখন ফিরিয়ে দেওয়ার। তোমার কবুল বলার সাথে সাথে, আমার সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো নেট দুনিয়ায় মূহুর্তের মাঝে ভাইরাল হয়ে যাবে।
নিয়াজের বলা কথাগুলো শুনে, শুভ্রতা’র হাতে থেকে ফোনটা পড়ে গিয়ে কল কেটে যায়। তারপর আবার রিং হচ্ছে শুভ্রতা তখন কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে বলে,
–“তুমি কি চাচ্ছো আমার কাছে থেকে নিয়াজ? আমাকে কি বাঁচতে দিবেনা তুমি। পুনরায় ব্ল্যাক করছো আমাকে?
#চলবে…