প্রেমময় পিপাসা পর্ব ১

0
1833

নববধূ সাজে নিজের বড় বোনের বাসরে বসে আছে মুগ্ধতা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। যেখানে আজকে তার বড় বোন শুভ্রতার থাকার কথা ছিলো। সেখানে মুগ্ধতা নিজেকে কিছুতে মেনে নিতে পারছেনা। কিভাবে পারবে মেনে নিতে। যেখানে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, যে সম্পর্কে বাধা পড়েছে। ইচ্ছে করলেই সে সম্পর্ক অস্বীকার করা যায়না। ইচ্ছে করলেই সে সম্পর্ক মুছে ফেলা যায়না। ইচ্ছে করলেই সে সম্পর্ক স্বীকার করা যায়না। এখন সে বুঝতে পারছে না কি করবে। কি করা উচিৎ তার। অদ্ভুত দোটানার মধ্যে পড়েছে মুগ্ধতা। তার উত্তর কি কখনো খুঁজে পাবে সে। এসব কিছু শুভ্রতার জন্য হয়েছে। কারণ আজকে শুভ্রতার বিয়ে ছিলো। দু’পরিবারের সম্মতি’তে বিয়ে ঠিক হয়েছিল শুভ্রতার। ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছিলো শুভ্রতার। বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। অনুষ্ঠান, আয়োজনের কোন কমতি ছিল না কোথাও। কিন্তু মুহূর্তের মাঝে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। কোন অজানা ঝড় সবকিছু কেমন উল্টো পাল্টা করে দিল। বিয়ে বাড়ি এতো আয়োজন, এতো আলোকিত সজ্জার মাঝখানে, মুহূর্তের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এলো। যখন শুভ্রতা বিয়ের পিড়ি ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। এমন একটা খবর পুরো পরিবারে মাঝখানে শোকের ছায়া নেমে আসে। শুভ্রতা এমন একটা কাজ করবে তার পরিবারের সদস্য’রা বিশ্বাস করতে পারছেনা। বিশ্বাস করবে কিভাবে? কারণ শুভ্রতা এমন মেয়ে না। সে কখনো কোন বিষয়ে তার পরিবারে কথার বিরুদ্ধে দ্বিমত করেনি। এজন্যই সকলের কাছে সে খুব প্রিয় ছিল। বিশেষ করে তার বাবার চোখের মণি ছিল শুভ্রতা। তাকে নিয়ে তার বাবা গর্ব করে বলতো,

–“মেয়ে হলে যেন আমার মেয়ের মতো হয়, আমার শুভ্রতার মতো।সে আমার ভরসা, আমার বিশ্বাস, আমার সবকিছু। তাকে উদ্দেশ্য করে মাঝেমধ্যে মুগ্ধতা কে বলতো, শুভ্রতার থেকে কিছু শেখো। কিছুদিন পরে যখন মেয়েটা অন্যের ঘরে চলে যাবে, তখন তোমার কি হবে। এতোদিনে তো তার কাছে থেকে কিছু শিখতে পারলে না। আদব-কায়দা, ভদ্রতা কিচ্ছু না। আমার মেয়ে দুটি হয়েছে, দু’জনেই দুটো বিপরীত মেরুর মতো। শুভ্রতা পশ্চিম হলে, মুগ্ধতা হবে পূর্ব। কিন্তু তাদের ছাড়া অপূর্ণ আমার আলোকিত ঘর।

কথাগুলো বলতে নাহিদ সাহেবের চোখদুটো টলমল করতো। তখন নিজেকে সামলে নিয়ে বলতো,

–“এখনো সময় আছে মুগ্ধতা। শুভ্রতার থেকে কিছু শেখো।

তখন মুগ্ধতা অভিমানী কন্ঠে বলতো,

–“হ্যাঁ সবকিছু তোমার বড় মেয়ের কাছে থেকে শিখতে হবে, সে সবকিছু পারে। এজন্যই সে সবার প্রিয় এবং বিশেষ করে তোমার আব্বু। আমি আমার মতো দিব্যি আছি। আমার দ্বারা কারো মতো হওয়া সম্ভব না। আমি কেন আপুর মতো হতে যাবো। আমি কারো মতো না এবং কারো মতো হতে পারবো না। আমি তোমার বড় মেয়ের মতো এতো ভালোনা। তোমার বড় মেয়ে কেমন একটা রোবটের মতো। নিজের কোন অনুভূতি আছে কি তার? সে তোমার বাধ্য মেয়ে, আমি তোমার অবাধ্য মেয়ে। তাছাড়া সে তোমার নিজের মেয়ে। আমাকে তুমি কুড়িয়ে নিয়ে এসেছ। তারজন্য সব সময় তুমি আমার সাথে এমন করো। ভালো লাগেনা আমার। এখন তুমি মুগ্ধতার মূল্য বুঝতে পারছো না। যখন বুঝতে পারবে তখন মুগ্ধতা কে হারিয়ে ফেলবে বলে দিচ্ছি মিলিয়ে নিও। তখন তুমি তোমার বড় মেয়ে শুভ্রতা কে নিয়ে ভালো থেকো এবং সব সময় তার প্রশংসা করো।

তখন পাশে থেকে শুভ্রতা এসে বলতো,

–“কি হয়েছে আব্বু? তুমি কি শুরু করলে মুগ্ধতার সাথে। আমার বোন ছোট, বড় হলে সময়ের সাথে সবকিছু শিখে যাবে। তুমি এতো চিন্তা করোনা।

তখন তাদের বাবা মুচকি হাসি দিয়ে বলতো,

–“দেখ মুগ্ধতা কিভাবে সবকিছু সামাল দিতে হয়। শুভ্রতা তোমার থেকে খুব বেশি বড় না, দুই বছর এর বড়। কিন্তু বুদ্ধিতে তোমার থেকে অনেক বড়। যার নামে এতকিছু বললে, সে তোমার পক্ষে কথা বলছে। বোন এমনই হয় বুঝতে পারছো। সব সময় পাশে থাকে সেটা তোমার খারাপ সময় কিংবা ভালো সময় হোকনা কেন। সত্যি কারের সম্পর্ক গুলো এমনই হয়।

তখন মুগ্ধতা বিড়বিড় করে বলে,

–“আব্বুর সামনে ভালো সাজতে আসছে। এজন্যই আমার ওকালতি করছে। এসব মনে হয় আমি বুঝতে পারিনা। মুগ্ধতা সব বুঝতে পারে, সে এতো বোকা না বুঝলে আব্বু। তোমার বড় মেয়ে কেমন খুব ভালো করে জানি। সময় হলে বুঝতে পারবে কে তোমার বেশি আপন। কে তোমার বাধ্য মেয়ে। সময় হলে ঠিক প্রমাণ করে দিব।

তখন শুভ্রতা বলে,

–“এতো বিড়বিড় করতে হবেনা, মন দিয়ে ভালো করে পড়াশোনাটা করো মুগ্ধতা। না হলে আমার মতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন বুঝতে পারবে, সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে শিখ। সম্পর্কের মূল্য দিতে শিখ।

–“অ্যা… আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো না। ভুল করেও আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করবে না আপু। এখনো আমার অনেক কিছু করার বাকী আছে। আমার অনেক স্বপ্ন গুলো সাজানোর বাকী আছে। তাছাড়া তোমার বিয়ের পরে পুরো বাড়িতে রাজ্যত্ব করবো আমি। এতো দিন ধরে যে দিনের অপেক্ষায় ছিলাম, অবশেষে সে দিন দেখতে পাবো। এতো কিছু রেখে কেন বিয়ে করতে যাবো এখনি।

তখন শুভ্রতা মলিন একটা হাসির রেখা টেনে বললো,

–“ঠিক আছে, আগে পড়াশোনা মন দিয়ে করো। তারপর সবকিছু করবে। কিন্তু কোন ভুল করা যাবেনা। ভুল মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও সাফল্য সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। মনে রাখবে জীবনে যে কোন সিদ্ধান্ত খুব ভেবে চিনতে নিতে হয়। তোমার একটি ভুল সিদ্ধান্ত’র জন্য, তোমার কাছের মানুষ গুলো কে যেন কষ্ট করতে না হয়। জীবনে চলার পথে অনেক মোড় আসবে। সে সময় তোমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তখন মুগ্ধতা মন খারাপ করে বলে,

–“আপু মুগ্ধতা তোমার মতো পারফেক্ট না। তুমি ইচ্ছে করলে সব পারবে। কিন্তু আমি? আমার কি ভুলের শেষ আছে।

তখন শুভ্রতা মুগ্ধতা কে আগলে ধরে বলে,

–“কোন মানুষ কখনো পারফেক্ট হতে পারেনা মুগ্ধতা। তার অবশ্যই কোন না কোন ক্ষুত থাকে। সময়ের সাথে সে ক্ষুত তারজন্য অভিশাপ হয়ে যায়। নিজেকে নিয়ে কখনো এমন করে কথা বলবে না। তুমি যেমন আছো নিজের মতো দিব্যি আছো।

তখন মুগ্ধতা শুভ্রতা কে জড়িয়ে ধরে বলে।

–“আমার আপু টা অনেক মিষ্টি। সে খুব ভাগ্যবান যে তোমাকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে। তোমার মতো পারফেক্ট লাইফ পার্টনার কয় জনের ভাগ্যে থাকে বলো। আমার এখন তাকে নিয়ে রীতিমতো হিংসা হচ্ছে। আমার শুভ্রতা আপু এতো পারফেক্ট তারজন্য একটা মি. পারফেক্ট দরকার ছিলো। কি বলো আপু তুমি?

শুভ্রতা মলিন মুখে বলে,

–“হুম।

তখন মুগ্ধতা মুখ তুলে তার বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,

–“কি হয়েছে আপু? তোমাকে এমন কেন লাগছে কেন। তুমি ঠিক আছো।

শুভ্রতার নীরবতা দেখে। মুগ্ধতা আবার বলে উঠে,

–“কোন কিছু লোকাচ্ছ তুমি আমাদের কাছে থেকে। বলোনা কি হয়েছে।

তখন শুভ্রতা মুখে মিথ্যা হাসির রেখা টেনে, বোনের গাল টেনে দিয়ে বলে,

–“কিচ্ছু না, বোকা মেয়ে। সব সময় নিজের এবং আশেপাশের মানুষ গুলোর খেয়াল রাখবে এবং যখন আমি থাকবে না, আমার শূন্যতা তুমি পূরণ করবে। কি করবে না?

মুগ্ধতা শুভ্রতার কথার মানে বুঝতে পারলো না। শুধু বোঝার চেষ্টা করলো। তখন নিঃশব্দে বললো,

–“হুম।

মেয়েদের এমন অবস্থা দেখে তার বাবা নাহিদ সাহেব বললেন,

–“মুগ্ধতা তুমি ভেতরে যাও। শুভ্রতার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

–“ঠিক আছে আব্বু।

মুগ্ধতা চলে যায়। তখন শুভ্রতা তার বাবার কাছে এসে বলে,

–“কি হয়েছে আব্বু, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোন কিছু বলবে।

তখন শুভ্রতার বাবা বলে,

–“শুভ্রতা আমার কি কোন ভুল হয়েছে মা। বিয়ের কিছুদিন বাকী মাত্র, কিন্তু একটা কথা আমাকে কেমন তারা করে বেড়াচ্ছে। বিয়ের পাকা কথা দেবার আগে তোমার কাছে একবার জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল আমার। কিন্তু আমার মেয়েদের প্রতি, এতো বিশ্বাস আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। যে বিশ্বাস এর জোরে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তারপর সময়ের সাপেক্ষে মনে হচ্ছে আমি আমার শুভ্রতার উপর জোর করে কোন কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না’তো। আমার কথা রাখার জন্য আমার মেয়ে কি বিয়েতে মত দিচ্ছি। না’না রকমের প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিচ্ছি। যে প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। সে প্রশ্নের উত্তর শুধু তুমি দিতে পারবে মা। আমি জানি এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু কথা গুলো জানা খুব প্রয়োজন মা। তুমি কোন চিন্তা করোনা বাবা সব সামলে নিবে।

অপরাধী কন্ঠে কথাগুলো বলে তার বাবা,

পলকহীন ভাবে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ্রতা । কি বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর নীরবতা কাটিয়ে শুভ্রতা বলে,

–“আব্বু তুমি আমাকে অনেক বিশ্বাস করো না? কখনো তোমার শুভ্রতা তোমার বিশ্বাস ভাঙ্গলে সহ্য করতে পারবে তুমি?

তখন নাহিদ সাহেব জোর গলায় বলে,

–“আমার মেয়েরা কখনো আমার বিশ্বাস ভাঙ্গবে না, বিশেষ করে আমার বড় মেয়ে।

যে বাবা তাকে এতো ভালোবাসে। এতো বিশ্বাস করে তাকে কিভাবে কষ্ট দিবে। ভাবতে শুভ্রতার বুকের ভেতর টা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। তখন শুভ্রতা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার চোখ গুলো কেমন টলমল করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে তখন বলে,

–” আমার আব্বু কোন ভুল করতে পারেনা। তোমার যেমন তোমার মেয়েদের প্রতি অনেক বিশ্বাস আছে। আমাদের ও তোমার প্রতি অনেক বিশ্বাস আছে। আমাদের জন্য যেটা করবে তুমি আমাদের ভালোর জন্যই করবে। সব সময় সেরা থেকে সেরা’টা বেছে নিবে তুমি তোমার দুই রাজকন্যার জন্য। তুমি অযথা কোন চিন্তা করোনা তো। তোমার জন্য দেখো ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। এরকম করলে তোমাদের ছেড়ে কিভাবে যাবো বলো?

তখন শুভ্রতার বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,

–” বাঁচালে মা তুমি আমাকে।

তখন শুভ্রতা দ্রুত সেখানে থেকে স্থান ত্যাগ করলো। অশ্রু ভেজা চোখে নিজেকে সামলানোর মিথ্যা চেষ্টায় মগ্ন হলো।
____________________

এখন কি হবে ছেলে পক্ষ এসে গেছে। কাজী বিয়ে পড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু মেয়ে কোথায়? মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এমন সময় এরকম একটা খবর কারো পরিবারের জন্য অবশ্যই শোকের ছায়া। এখন কিভাবে সবকিছু সামাল দিবে এসব ভাবতে শুভ্রতার বাবা অসুস্থ হয়ে যায়। সকলে তাকে নিয়ে বন্ধ রুমে ব্যাস্ত। সবার মুখে স্পষ্ট চিন্তার রেখা। তখন তাদের কাজিন অনু শুভ্রতার রুম থেকে একটা চিরকুট নিয়ে এসে বলে।

–” আপুর রুম থেকে এই চিঠিটা পাওয়া গেছে।

চিরকুট টা দেখে সবার মনে কোন আশার আলো দেখা গেলেও। মুহূর্তের মাঝে সবকিছু কেমন বিলীন হয়ে গেল। যখন অনু চিঠি টা পড়তে শুরু করলো।

#প্রেমময়_পিপাসা
#স্বপ্না_ফারিন
#পর্বঃ১

#চলবে…

(অনেক দিন পড়ে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। কেমন হয়েছে অবশ্যই জানাবেন। আপনাদের রেসপন্স এর উপর ভিত্তি করে পরের পর্ব দেয়া হবে। হ্যাপি রিডিং)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here