প্রেমনদীর মাঝি পর্ব ২

0
127

#প্রেমনদীর_মাঝি
#পর্ব_২
#মুসফিরাত_জান্নাত

“বাসর করা লাগবে তোমার রাইট?ওয়েট,তোমার শখ মিটাচ্ছি।”

কথাটা বলেই ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। বুকটা কেঁপে উঠলো আমার।আমি তো দুষ্টুমি করে ওসব বললাম।এখন কি রাগের মাথায় সত্যি সত্যি উনি এসব করবেন।এছছি!এবার কি হবে?

ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি চোয়াল শক্ত করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।চোখেমুখে প্রচন্ড রাগের আভা।এতো রাগ ওনাকে কখনো করতে দেখিনি আমি।এমনকি ওনাকে লোকসম্মুখে হাসির পাত্র বানানোর সময়ও এতো রাগ করেননি।এখন যে এভাবে রাগবে তা কল্পনায় ছিলো না আমার।বাবা একটা কথা বলেন,মানুষের রাগ যত বাড়তে থাকে মানুষ তত নিচে নেমে যায়।রাগের বসে মানুষ যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারে।কথাটা মনে হতেই আঁতকে উঠলাম আমি।তাহলে কি এবার ওনার বাসরের বস্তু হতে হবে আমাকে।আচ্ছা বাসরের শুরু হিসেবে কোন পদক্ষেপ উনি আগে নিবেন?এটা মাথায় আসতেই মস্তিষ্ক পুরাতন স্মৃতি জাগিয়ে তুললো আমার।ছোট বেলায় বাংলা নাটক সিনেমায় দেখতাম,বিয়ের রাতে বাসর ঘরে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে অনেকে।এছাড়া দরজায় ওঁৎ পেতে থাকতে দেখা যেতো কোথাও কোথাও।তারপর মুখ টিপে সবাই হাসতো।ওরা ঠিক কি কারণে ওমন করে তখন বুঝতাম না আমি।তাই এটা জানার আগ্রহও কম ছিলো না আমার।আপুদের জিজ্ঞেস করলে মুখ টিপে হেসে বলতো,ও তুই বুঝবি না।ওসব বড়দের ব্যাপার।তখন কৌতুহল আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গেলো।তখন থেকে টকে টকে থাকতে লাগলাম, কারো বিয়ে হলে আমিও লুকিয়ে থেকে বুঝবো ওরা কি দেখে মজা নেয়।এটা নিশ্চয়ই অনেক মজার কাহিনি।এমন ভাবনা চলতে চলতেই একসময় আমার ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো।আমিও যেনো একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।বাসর ঘরে বউ ঢুকিয়ে যখন সবাই গল্পে মশগুল ছিলো,তখন সবার আড়ালে আমি খাটের নিচে লুকিয়ে পড়লাম।তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন এরা বের হবে আর জামাই আই মিন ভাইয়া আসবে।ঘরে বর প্রবেশের পরই তো সবাই উঁকিঝুঁকি মা”রে দেখেছি।তো যথারীতি সময় গড়াতে লাগলো।একসময় সবাই বেরও হয়ে গেলে।যাওয়ার সময় ভাইয়াকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।তখন আমি কান খাড়া করে গভীর মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা বার্তা শুনতে লাগলাম।ওদের প্রেমের বিয়ে হওয়ায় কোনো রকম জড়তা ছাড়াই স্বাভাবিক আলোচনা করছিলো।একে অপরের স্বপ্ন পূরণের জন্য আনন্দ প্রকাশ করছিলো।ওই বয়সে ঠিক এতোটুকুই বোধগম্য হয়েছে আমার।তারপরে ওদের কথার ধরন বদলানোর সাথে সাথে আমার বোঝাতেও অক্ষমতা এলো।তখন বুঝলাম আপুরা ঠিকই বলেছে আমি এসব বুঝবো না।এতোক্ষণের কথায় হাসার মতো কিছু খুঁজেও পাইনি।এদিকে ঘুমও চলে আসছে।খাটের নিচে বেশি সময় থাকা সম্ভব নয়, তাই ভালোয় ভালোয় বের হয়ে এলাম।এসে খাটের দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।সাথে সাথে বললাম,ছিহ! ভাইয়া এসব কি করছো?তুমি কি ভিলেন নাকি?মুলত সিনেমায় ভিলেনদের নাইকাদের সাথে এমন খারাপ কাজ করতে এগোনোতে দেখা যায়।ঠিক তখনই নায়কের এন্ট্রি হয়।তাই আমিও ওই ভেবেই প্রশ্নটা করলাম।আমার এমন প্রশ্নে ছিটকে সড়ে গেলো ভাইয়া।ভাবিও লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। ভাবির অধরে নিজের অধর মিলানোর মুহুর্তে যে আমাকে দেখবে সেটা হয়তো ক্ষুনাক্ষরেও ভাবেনি তারা।চরম অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো দুজনে।তারপর ভাইয়া আমাকে ধমক দিতে গিয়েও কি মনে করে নরম স্বরে বললো,যদি আমি কাওকে কিছু না বলি তবে তিনিও ওই ঘটনার জন্য আমাকে শাস্তি দিবেন না।এটা শুনে বিনা দ্বিরুক্তিতে রাজি হয়ে গেলাম।কারণ ঘটনাটা আম্মুর কানে গেলে মা’র একটাও মাটিতে পড়তো না।তারপর আমাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো।মনে মনে চরম বিরক্তি নিয়ে চলে এলাম আমি।সাথে সিনেমায় যারা ওঁৎ পেতে থাকে ওদের আবা’ ল বলে বকা দিলাম।আর আমাকে এতোরাতে খুঁজে পেয়ে বকা দিলো আম্মু। কোথাও না পেয়ে অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।সে অনেক পুরোনো কথা।আচ্ছা এখন কি নিভৃত ভাইও ওই অধরের স্টেপ ধরেই এগোবেন?এগোনোটা অস্বাভাবিক নয়।এটাই হয়তো নিয়ম।আমার ভাবনার মাঝে নিভৃত ভাই একদম আমার কাছে চলে এলো।তৎক্ষনাৎ দুই হাতে নিজের ঠোঁট চেপে আড়াল করলাম আমি।তারপর হড়বড় করে বললাম,

“খবরদার,ভুলেও আমার ঠোঁটে আপনার ঠোঁট মিলানোর চেষ্টা করবেন না।ওই সুপার গ্লু ঠোঁটের ছোঁয়া পেলে আমারও ঠোঁটে আঠা লেগে যাবে।আর চিরতরে আটকে যাবে দুই ঠোঁট।তারপর ইহজনমে আর কোনো কথা বলতে পারবো না আমি।”

আমার কথা শুনে আরও রেগে গেলেন উনি।ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,

“হোয়াট রাবিশ!”

কথাটা বলে অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকালেন উনি।ভেতরটা এক লহমায় কেঁপে উঠলো আমার।কিন্তু বাহিরে প্রকাশ করলাম না।কণ্ঠে তেজ মিশিয়ে বললাম,

“শোনেন এমন ভাবে তাকানোর কিছু নেই।আঠার চেয়ে রাবিশ অনেক ভালো।এটলিস্ট সাবান পানিতে ধুলে চলে যায়।”

এবার উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

“তোমার আইডিয়া হলো কি করে আমি তোমার সাথে ওসব করবো!”

কথাটা উনি রেগে বললেও স্বস্তি মিললো আমার।বুঝে গেলাম ধারণা সঠিক নয়।মুখ থেকে হাত সড়িয়ে হাঁফ ছাড়লাম।তারপর হালকা হাসার চেষ্টা করে কিছু একটা বললাম,

“কারো আইডিয়াতে কিছু যায় আসে না।না করলে দুজনের জন্যই ভালো।”

কথাটা যেই না শেষ করলাম তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।আমার থেকে সড়ে গেলেন উনি।তারপর নিজেকে সংযত করে দরজা খুলে দিলেন।ঘরে ঢুকলো নিশি।নিভৃত ভাইয়ের ছোট বোন।নাম নিশি হলেও ওর চেহারা মোটেও রাতের ন্যায় অন্ধকার নয়।চকচকে গায়ের রঙ।এজন্য ওকে পূর্ণিমা নিশি বলে ডাকি আমি।কড়া পূর্ণিমার রাত যেমন আলোকিত ও মনোমুগ্ধকর,নিশির চেহারাও তেমন মুগ্ধকর।এক দেখায় প্রেমে পড়ার মতো।নিশি ওনার দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলো।হাতে রাখা দুধের গ্লাসটা আমার হাতে দিয়ে বললো,

“ধরো এটা।সায়ান ভাইয়া বললো ঝামেলা হচ্ছে বলে।তাই নানুমনি দিয়ে পাঠালো।তাছাড়া এটা নাকি বাসর রাতের নিয়মের মধ্যেও পড়ে।”

কথাটা শুনে আড়চোখে নিভৃত ভাইয়ের দিকে তাকালাম আমি।কেমন অসহায় দেখাচ্ছে ওনাকে।লজ্জা,অস্বস্তি,রাগ মিলেমিশে একাকার অবস্থা ওনার। আমার দিকে তাকিয়ে আরও ফুঁসে ওঠলেন উনি।আমি তখন না ডাকাডাকি করলে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না ওনার।এই মুহুর্তে ঠিক কেমন অনুভুত হতে পারে একটা পুরুষ হিসেবে হয়তো উনিই অনুভব করছেন।ব্যাপারটা দেখে বেশ হাসি পেলো আমার।সানন্দে গ্লাসটা গ্রহণ করলাম আমি।আমাকে গ্লাসটা নিতে দেখে চোখে অগ্নি ঢেলে তাকালেন আমার দিকে।তারপর নিশির দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন,

“রাত বিরাতে এসব কি তামাশা চলছে এ বাড়িতে …”

কথাটা উনি সম্পূর্ণ করতে পারলেন না।তার আগেই আরেকটা তামাশা করে ফেললাম আমি।ঘরে রাখা চেয়ারে বসে ঢকঢক করে দুধটা খেয়ে ফেললাম।সাথে সাথে ওরা দুজন ব্যাপক ভরকে গেলো।আমি যে এমনটা করবো তা কল্পনাতেও ছিলো না তাদের।বাসর ঘরে বরের জন্য নিয়ে আসা দুধ বউ সাবাড় করে এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটলো।তারা চরম আশ্চর্য হয়ে তাকালো আমার দিকে।নিশি থতমত খেয়ে বললো,

“এটা কি করলে তুমি?”

আমি দাঁত কপাটি করে বললাম,

“খাবার জিনিস দাঁড়িয়ে খেতে নেই।তাই বসে দুধ পান করলাম।এবার গ্লাসটা নিয়ে বিদায় হও।”

নিশিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলাম।আমার এমন আচরণে নিভৃত ভাইয়ের লজ্জাবোধ হয়তো একটু কমলো।নিশির এ ঘরে দুধের গ্লাস রেখে যাওয়াটাই চরম লজ্জার হতো ওনার জন্য।উনি না দুধ না খেলেও অন্যরা ভাবতো খেয়েছে।তাই এখনই সে পর্ব চুকে যাওয়ায় স্বস্তি পেলেন উনি।মুলত ওনাকে লজ্জা থেকে রেহাই দিতেই অনিচ্ছা সত্বেও এমন কাজ করলাম আমি।ওনার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কল্পনা করতেই কেমন যেনো লাগছিলো আমার।তাই মায়া হলো খানিকটা।আমার এই মায়ার দৌলতে ওনাকে বিব্রত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করায় নিজের রাগও কমিয়ে নিলেন উনি।তাই বাকি রাতটা আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই কেটে গেলো।

পরদিন সকাল হতে না হতেই বউভাতের আয়োজনের ব্যস্ততা বাড়লো।আবারও নতুন সজ্জায় সজ্জিত করা হলো আমায়।চেনা আত্মীয়ের ভীরে অচেনা আত্মীয়দের মুখও পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলো।নিভৃত ভাইয়ের বাবার পক্ষের কাওকে চিনতাম না আমি।ওদেরকে চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে এখন।নিভৃত ভাইয়ের টিচার্স গ্রুপ,ফ্রেন্ড সার্কেল ও কিছু কলিগ অনুষ্ঠানের দাওয়াত কবুল করায় ওনাদের সাথেই ব্যস্ত রয়েছেন তিনি।অপরদিকে স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে আমাকে।সবাই এসে বউ দেখছে,সালামি দিচ্ছে, ছবি তুলছে এই ব্যপারটা একেবারে বিষিয়ে তুললো আমাকে।আমার মতো ছটফটে মেয়ে যে কখনো টানা এতোক্ষণ বসে থাকবো তা কল্পনায়ও ছিলো না।তবুও জীবন মাঝে মাঝে কতো কল্পনাতীত কাজই না করে বসে।এই যে আজ আমি ওনার বউ এটাও তো কল্পনাতীত।চরম হৈ হুল্লোড়ে প্রকৃতিতে স্থিরতা নেই।সেই অস্থিরতা আমার মাঝেও এসেছে।কেবলি সময় গুনতে নিলাম কখন অনুষ্ঠান শেষ হবে।আজ আনুষ্ঠানিকতার নিয়মানুযায়ী বাবার বাড়িতে যাবো আমরা।তাই দোয়া করছিলাম যেনো তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়।হটাৎ এর মাঝে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত ঘটনা ঘটে গেলো।কোথাও যেনো বা’জ পড়ে চুরমার করে দিলো সব।ধাক্কা লাগলো সবার হৃদয়ের দেওয়ালে।হতবুদ্ধি হতে বাধ্য করলো সবাইকে।নিভৃত ভাইয়ার আব্বু মানে আমার খালু মিয়া যাকে মৃ’ত ভেবে এই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো তিনি হুট করে যেনো উদয় হলেন।পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আমার খালু।প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় আগে জাহাজ ডুবিতে মা’রা গিয়েছে খালুজানদের শীপের অনেকে।সেই জাহাজে তিনিও ছিলেন।জাহাজ ডুবির পর অনেকের লা’শ পাওয়া গেলেও কয়েক জনের লা”শ পাওয়া যায় নি।তার তালিকায় খালুজানও ছিলেন।অনেক খোঁজাখুজি ও প্রতিক্ষার পরও যখন এতোদিনে কোনো হদিস মিললো না ওনার, তখন সবাই ভেবেই নিয়েছিলো উনি হয়তো সাগরের তলায় চলে গিয়েছেন।সেই মানুষটি যে এ ভাবে জীবিত হয়ে ফিরে আসবে,তাও আবার এমন পরিস্থিতিতে তা কল্পনাও করে নি কেও।ওনাকে গত ভেবে যে ওনার শত্রুর মেয়েকে এ বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে এ ব্যাপারটাকে ঠিক কিভাবে নিবেন উনি তাই নিয়ে তটস্থ হলো সবাই।একটা চোরাবালির টানে পড়ে গেলো যেনো।নিয়তি যেন এক নষ্ট খেলায় মত্ত হলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here