প্রীতিলতা আসবে বলে(পর্ব ২১+২২

0
624

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
সিজন :২
পার্ট : ৮ + বোনাস

দেখতে দেখতে দুইমাস পার হয়ে গেছে ৷ আয়ান চারুর পরীক্ষা কিছুদিন পরেই ৷আয়ান আর চারু নিজেদের পড়া নিয়ে ব্যস্ত ৷আয়ানের কড়া আদেশ চারুকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে ৷নইলে চারুকে বাবার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেবে ৷এই কথা শুনে চারুর কিছুদিন আগে সেই কি কান্না ৷সেই দিন চারুকে মানাতে কত কি করতে হয়েছে আয়ানের ৷চারুকে সোনা ,জান ,পাখি কত কিছু বলেছে তার শেষ নেই ৷ সিনিয়র বউকে শাসন করতে যেয়ে নিজেই সোজা হয়ে গেছে ৷

চৌধুরী বাড়ীতে চারু আসার পর আনন্দের শেষ নেই ৷ আয়ানের বাবাও চারুকে নিজের মেয়ের মতোই আদর করে ৷আর মমতা বেগম সারাদিন চারুর কি লাগবে তা নিয়েই ব্যস্ত ৷চারুর যেন নিজের মা বাবার কথা এখন আর মনেই পরে না ৷এরকম শ্বশুড় শ্বাশুড়ী থাকলে যে কোনো মেয়ে সুখী হয় ৷

বিকেল পাচঁটা বাজে ৷চারু পড়া শেষে করে রান্নাঘরে চলে গেল ৷এক কাপ চা এখন তার খুব দরকার ৷আয়ান বাড়ীতে নেই ৷তার নাকি কাজ আছে তাই বাইরে গেছে ৷চারু এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় দাড়ালো ৷চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চারু নিচের দিকে তাকালো ৷চারু দেখতে পেল দ্বীপের হাতে একটা মোটা দড়ি আর কাঠের একটা বড় টুকরা ৷চারু ঐ দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন ৷তারপর দেখলো দ্বীপ একটা বড় বাবলা গাছের কাছে গেল ৷ তারপর কাঠেঁর টুকরোটা নিচে রেখে দড়িটা নিয়ে উপরে উঠে গেল ৷ চারু দ্বীপকে উপরে উঠতে দেখে দৌড়ে গেল ৷বাবলা গাছে অনেক বাবলা হয়েছে ৷ফল গুলো পেকে অনেকটা লাল বর্ন ধারন করেছে ৷ চারুদের কলেজের পাশেও একটা বাবলা গাছ আছে ৷চারু ঐ গাছ থেকে অনেক বাবলা খেয়েছে ৷পাকা বাবলা খেতে বেশ মিষ্টি ৷উপরের ছোলা হালকা টান দিলেই উঠে যায় ৷তারপর ভেতরে থাকে সাদা খইয়ের মতো ফল ৷ ভেতরটা খইয়ের মতো সাদা তাই অনেকে খইয়া বাবলাও বলে ৷পাকা বাবলার বিচি অনেক কালো হয় ৷এই বিচি দিয়ে ছোট বাচ্চারা মালা গাথে ৷এই বিচি কয়েক বছরেও নষ্ট হয় না ৷

যেহেতু চারু বাড়ীর বউ ৷তাই সে গাছে ওঠে না ৷কিন্তু যেই দেখলো দ্বীপ গাছে উঠছে ৷তখনি সে দৌড়ে গেল ৷ চারু গাছের নিচে দাড়াতেই দ্বীপ তার দিকে তাকালো ৷তারপর মুচকি হাসলো সে ৷ চারুর সাথে বেশ ভাব জমে গেছে তার ৷চারু দ্বীপকে বলল

গাছে কেন উঠেছো ভাই ৷যদি পরে যাও ৷

গাছে ওঠা আমার পক্ষে কোনো ব্যাপার না ভাবিমা ৷ এর থেকেও বড় বড় গাছে আমি উঠতে পারি ৷

এই অসময়ে গাছে কেন উঠলে ৷

আপনার জন্য দোলনা বানাতে ৷ মাঝে মাঝে এখানে এসে বসবেন ৷দেখবেন খুব ভালো লাগবে ৷দ্বীপ একটা বড় ডালের উপর থেকে দড়িটা ফেলে দিল ৷ দ্বীপ গাছ থেকে নেমে যাবে ৷তখন চারু বলল

ভাই আমাকে কয়েকটা বাবলা দাও না ৷

আপনি বাবলা খাবেন ভাবিমা ৷বেশি খেলে কিন্তু পেট ব্যথা করবে ৷তাই আপনি বেশি পাবেন না ৷দ্বীপ চার পাচঁটা বাবলা চারুর জন্য ছিড়ে নিল ৷তারপর নিচে এসে চারুর হাতে দিল ৷ চারু বাবলা খাচ্ছে আর দ্বীপের দোলনা বানানো দেখছে ৷ বয়সে ছোট হলেও কেমন বড়দের মতো কাজ করছে ৷ দ্বীপ দোলনা বানানো শেষ করে বলল

ভবিমা এবার আপনি দোলনায় বসুন ৷আমি হালকা করে ধাক্কা দিচ্ছি ৷চারু দৌড়ে দোলনায় বসে পড়লো ৷আর দ্বীপ মুচকি হাসছে ৷তার মনে চলছে অন্য কিছু ৷চারু বসতেই দ্বীপ দোলনাটা অনেক পেছনে নিয়ে গেল তারপর জোড়ে ধাক্কা দিল ৷ দ্বীপ জোড়ে জোড়ে দোলনা ধাক্কা দিচ্ছে ৷আর চারু ভয়ে চিৎকার করছে ৷ চারুর চিৎকার শুনে ওর শ্বাশুড়ী দৌড়ে এলো ৷আয়ানো বাড়ীতে চলে এসেছে ৷আর চারু জোড়ে জোড়ে চিৎকার করছে নামার জন্য ৷ চারুর শ্বাশুড়ী একটা লাঠি নিয়ে দ্বীপের দিকে আসছে ৷ আয়ান দৌড়ে এসে দোলনাটা ধরলো ৷ চারু ভয়ে আয়ানকে জরিয়ে ধরেছে ৷আর আয়ানের মা দ্বীপকে লাঠি দিয়ে কয়েকটা বারি দিল ৷কিন্তু দ্বীপ সেই সবে পাত্তা দিল না ৷সে মাটিতে বসে হা হা করে হাসছে ৷দ্বীপ হাসতে হাসতে বলল

এখন কেমন লাগছে হ্যা ৷আমাকে এভাবে দোলনায় বসিয়ে যখন ধাক্কা দিতি তখন আমিও ভয়ে চিৎকার করতাম ৷তোকে তো কিছু বলতে পারবো না ভাই ৷ তাই ভাবিমা কে দিয়ে আজ শোধ নিলাম ৷দ্বীপ হাসতে হাসতে লুটুপুটি খাচ্ছে ৷আয়ান দ্বীপের দিকে বাকাঁ হেসে বলল

আজ কাল অনেক পাজি হয়ে গিয়েছিস ৷দাড়া তোর ব্যবস্থা করছি আমি ৷আয়ান কথা গুলো বলে দ্বীপকে কাতুকুতু দিতে লাগলো ৷আর দ্বীপ সে তো হাসতে হাসতে শেষ ৷

চারু বেশ ভয় পেয়েছে ৷দ্বীপকে যতটা ভালো ভেবেছিল ৷সে আসলে অতটাও ভালো না ৷বড্ড পাজি সে ৷একদম আয়ানের মতো ৷দুই ভাই তার জীবনটা শেষ করে দিল একেবারে ৷

ছয় দিন পার হয়ে গেছে ৷ আজকাল দ্বীপ আর চারুর কাছে আসে না খুব ৷ছেলেটা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকে ৷চারু দ্বীপের চোখে ভয় দেখতে পায় ৷চারুর কেন যেন মনে হয় দ্বীপ কিছু বলতে চায় ৷চারুর কেন যেন মনে হয় দ্বীপ ভালো নেই ৷ আর মিহানকে তার বড্ড অদ্ভুত লাগে ৷ছেলেটা সবার থেকে আলাদা ৷কারো সাথে কথাই বলে না ৷ আয়ানকে যে মিহান দেখতে পারে না তা বেশ বুঝতে পারে চারু ৷

দুপুরের পর চারু নিজের ঘরে বসে ছিল ৷আয়ান কিছু বই কিনতে দোকানে গেছে ৷তখন চারুর ঘরে প্রবেশ করলো দ্বীপ ৷ছেলেটার চোখের নিচে কালি পড়েছে ৷আজকাল যেন ঘুমায় না সে ৷ দ্বীপ মুচকি হেসে চারুর হাত থেকে চিরুনী নিয়ে চুল আচড়াতে লাগলো ৷চুল আচড়াতে আচড়াতে বলল

ভাবিমা জীবনটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র ৷যেখানে প্রতি মুহূর্ত যুদ্ধ করতে হয় ৷ আপনাকে আমি কখনোই ভাবির চোখে দেখবো না ৷আপনি আমার কাছে মায়ের মতো ৷একটা কথা মনে রাখবেন সব সময় ৷এই জীবন থাকতে আপনার কেউ কিছু করতে পারবে না ৷ আপনাকে কিছু করার আগে আমাকে খুন করতে হবে ৷ সাবধানে থাকবেন সব সময় ৷ভালো মুখোশের আড়ালে শত্রুর অভাব থাকে না ৷ মাঝে মাঝে নিজের বাবাও শত্রু হয়ে যায় ৷মাঝে মাঝে নিজের ভাইও শত্রু হয়ে যায় ভাবিমা ৷ চারুর চুল বেনী করে দিল দ্বীপ ৷তারপর চিরুনীটা পাশে রেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবে ৷তখন চারু বলল

তোমার কি হয়েছে ভাই ৷আজকাল খুব একটা কথা বলো না আমার সাথে ৷

দ্বীপ ছলছল চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে বলল

আমার কিছু হয় নি ভাবিমা ৷আমি একদম ঠিক আছি ৷দ্বীপ চলে গেল ঘর থেকে ৷দ্বীপের জল ভরা চোখ দুটো যেন অনেক কথা বলল চারুকে ৷ কিন্তু তা পড়তে যেন পারলো না সে ৷

রাত একটা বাজে ৷সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে আছে ৷কিন্তু একটা ছেলে হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে পরে আছে ৷ তার চোখ দুটো লাল ৷শরীর বেয়ে ঘাম ঝড়ছে ৷নিজের চুল হাত দিয়ে চেপে ধরেছে সে ৷ সে কিছু একটা চাইছে আর আকুতি মিনতি করছে ৷কিন্তু তার বাবা আর ভাই তাকে দিচ্ছে না ৷একটু পর ছেলেটার সামনে তার বাবা বসলো ৷হাতে থাকা প্যাকেট থেকে একটু সাদা পাউডার মেঝেতে রাখতেই ছেলেটা পাগলা কুকুরে মতো সেখানে ঝাপিয়ে পড়লো ৷সাদা পাউডারের মতো গুড়ো গুলো নাক দিয়ে শুকতে লাগলো ৷কিছুটা আবার মুখের মধ্যে দিল ৷কিন্তু এতেও তার নেশা কমলো না ৷নিজের বাবার পা জরিয়ে ধরে কাদঁতে কাদঁতে বলল

আমাকে এভাবে রোজ কষ্ট দিও না বাবা ৷আমি আর পারছি না ৷তুমি ওটা কেন আমাকে প্রথমে দিলে ৷এখন আমি এটা ছাড়া থাকতে পারি না ৷আমার মাথা কাজ করে না ৷দাও না বাবা প্লিজ আমাকে ৷ ও বাবা দাও না আমাকে ৷আমি পারছি না আর ৷ ছোট বাচ্চা ছেলেটা বাবার পা ধরে কাদঁতে লাগলো ৷সে জানে তার কান্না কেউ শুনবে না ৷পাশেই তার মায়ের ঘর তবুও সে শুনবে না চিৎকার ৷কারন তার মা যে গভির ঘুমে তলিয়ে আছে ৷তার বাবা যে রোজ রাতে মাকে অঙ্গান করে ৷তারপর তাকে এভাবে অত্যাচার করে ৷ আর ভাইয়ের ঘর বেশ দূরে ৷সেও যে শুনবে না তার কান্না ৷দ্বীপ বাবার পা ধরে কেদেঁই যাচ্ছে ৷কিন্তু তার পাষান বাবার মন গলাতে পারলো না ৷ দ্বীপের চুল ধরে সে দাড় করালো ৷তারপর বলল

কেন রে খুব কষ্ট হচ্ছে এখন ৷তোর আমি এমন হাল করবো যা ভাবতেও পারবি না ৷আগে তোকে শেষ করবো ৷তারপর আয়ানকে দেখবো ৷আর শোন আজ তিনমাস ধরে প্রতিরাতে যেই সাদা গুড়োটা তুই খাস ৷এটার নাম হেরোইন ৷এটা তুই কোনো দিন ছাড়তে পারবি না ৷ তুই এখন একটা নেশাখোড় হয়ে গেছিস ৷আমার ছেলে হয়ে ঐ আয়ানের পক্ষে থাকিস ৷তুই শুধু দেখ আমি কি করি ৷আর তুই যদি কিছু বলিস কাউকে ৷তাহলে তোর মাকে আর ভাইকে একদম শেষ করে দেব ৷

দ্বীপ বাবার পা জরিয়ে হাউমাউ করে কাদঁতে লাগলো ৷তারপর বলল

বাবা আমাকে তুমি মেরে ফেলো ৷কিন্তু মায়ের কিছু করো না ৷তুমি যা বলবে আমি তাই খাবো ৷

ছোট দ্বীপের কথা গুলো শুনে ওর বাবা আর ভাই মিহান হাসলো ৷দ্বীপের হাতে ওর বাবা হেরোইনের প্যাকেটটা দিতেই সে খাবলে নিল ৷তারপর মেঝেতে রেখে তা খেতে লাগলো ৷হাতে নিয়ে শুকতে লাগলো ৷ কয়েক মাস ধরে এভাবেই চলছে সব ৷ছোট দ্বীপ ভয়ে কিছু বলতে পারছে না কাউকে ৷ সে জানে না কেন তার বাবা আর ভাই তাকে ভয় দেখায় ৷কেন তারা আয়ানকে দেখতে পারে না ৷সে শুধু জানে বাবা খুব খারাপ ৷বাবা ভালো মানুষের আড়ালে একজন শয়তান ৷বাবার জন্যই এখন সে একজন ড্রাগ এডিক্টেড ৷এটা ছাড়া এখন সে আর থাকতেই পারবে না ৷ তবুও দিন শেষ ভালো থাকার অভিনয় করতেই হয় তাকে ৷ সে এখন নিরুপায় ৷আজকাল এটার হেরোইন এর প্রতি তার নেশা বাড়ছে ৷ সে শেষ হয়ে যাচ্ছে ৷তবুও সে ভালো থাকার চেষ্টা করবে ৷নিজের মা আর ভাইয়ের জন্য এইটুকু তার করতেই হবে ৷

বোনাস

সকালে সবাই নাস্তা করতে টেবিলে বসে আছে ৷কিন্তু দ্বীপ আসে নি ৷তাই মমতা বেগম ছেলেকে ডাকতে গেছেন ৷ছেলেটা আজকাল অনেক ঘুমায় ৷আগে রোজ পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো ৷ কিন্তু বিগত কয়েক মাস যাবত নামাজ পড়ে না ৷দ্বীপ নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিল ৷মমতা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ৷ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে ৷মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে ৷চোখের নিচে কালো হয়ে যাচ্ছে ৷ মমতা বেগম ছেলেকে পরম আদরে ডাক দিলেন ৷

আমার বাবা দ্বীপ সোনা ৷আমার মানিক উঠে পড়ো ৷এত বেলা করে ঘুমাতে হয় না বাবা ৷মায়ের ডাকে কিছুটা চোখ মেলে তাকালো সে ৷তার চোখে যে বড্ড ঘুম ৷কিন্তু সে কাউকে বলতে পারছে না সমস্যার কথা ৷দ্বীপ মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ৷কিন্তু কোনো কথা বলল না ৷মমতা বেগম ছেলেকে বলল

মুখ ধুয়ে খেতে আয় ৷সবাই বসে আছে যা তাড়াতাড়ি ৷দ্বীপ মাথা নেড়ে হ্যা সম্মতি জানালো ৷তারপর কোনো রকম উঠে ওয়াসরুমে চলে গেল ৷

খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছে ৷দ্বীপও খাচ্ছে মাথা নিচু করে ৷ হঠাৎ করেই দ্বীপের বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

মমতা আমি ভাবছি দ্বীপকে হোস্টেলে দিয়ে দেব ৷আজকাল বেশ পড়ায় ফাকিঁ দিচ্ছে তোমার ছেলে ৷তাই আমি ওকে হোস্টেলে দিব ভাবছি ৷

মমতা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল আমিও তো তাই দেখছি ৷তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো ৷

আয়ান খাবার খেতে খেতে বলল বাবা দ্বীপকে হোস্টেলে দিও না ৷একা একা থাকবে কিভাবে ও ৷আর কিছুদিন পর আমার পরীক্ষা শেষ হবে ৷তখন না হয় আমি নিজেই ওকে পড়াবো ৷

দ্বীপের বাবা মিঃ চৌধুরী ছেলের মাথা হাত বুলাতে বুলাতে বলল আমার দ্বীপ এতটাও ছোট নয় আয়ান ৷ও ঠিক থাকতে পারবে সেখানে ৷সে তো ভালো ছেলে তাই না দ্বীপ ৷কথাটা বলেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বাকাঁ হাসলেন তিনি ৷এদিকে দ্বীপের শরীর থেকে ঘাম বেড়িয়ে গেছে ৷সে জানে তার সাথে কি হতে চলেছে ৷তার বাবা তাকে ছাড়বে না ৷সে তার বাবার কথা শোনে নি ৷এবার তাকে চরম যন্ত্রনার শিকার হতে হবে ৷ দ্বীপ কোনো কথা বলল না ৷দরকার হলে নিজের জীবন দিয়ে দেবে ৷তবুও সে বাবার কথা মতো কোনো ক্ষতি করবে না কারো ৷ কোনো রকম খেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল সে ৷স্কুলের জন্য রওনা দিতে হবে তার ৷

দুপুরের পর জানালার কাছে বসে আছে চারু ৷তার মনটা ভালো নেই ৷আয়ান চারুর মন খারাপ দেখে বলল

এভাবে বসে আছো কেন ৷

দ্বীপ চলে গেলে বড্ড একা একা লাগবে আমার ৷ছেলেটাকে যেতে না দিলে হয় না ৷

আয়ান চারুকে এক হাতে জরিয়ে ধরে বলল

একদম মন খারাপ করবেন না ৷হয়তো বাবা ওর ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷কাল বিকেলে ওকে নিয়ে যাবে ৷ আপনি মন খারাপ করবেন না চারুলতা ৷ এবার পড়তে বসুন আপনি ৷পাচঁ দিন পর পরীক্ষা শুরু তাই পড়তে বসুন ৷ আয়ান চারুর কপালে একটা চুমু দিয়ে উঠে গেল ৷

বিকেল চারটা বাজে ৷চারু তার শ্বাশুড়ীর সাথে নাস্তা বানাচ্ছে ৷ দ্বীপ পেছন থেকে এসে মমতা বেগমকে জরিয়ে ধরলো ৷মমতা বেগম মুচকি হেসে বলল

আমার ছেলেটা হঠাৎ এভাবে জরিয়ে ধরলো কেন ৷

দ্বীপ মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল পানি খেতে এসে ছিলাম মা ৷অনেক দিন তোমার কাছে আসা হয় না ৷বলা তো যায় না কখন কি হয়ে যায় ৷দ্বীপ পানির জগ নিয়ে চলে গেল ৷ মমতা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো ৷আজকাল অদ্ভুত আচরন করে সে ৷

বিকেলের নাস্তা খেতে দ্বীপ আসে নি ৷মিহান সব সময় নিশ্চুপ থাকে ৷নিজের মায়ের সাথেও কথা বলে না সে ৷চারুর ঘরে মন টিকলো না ৷তাই সে বাইরে পা বাড়ালো ৷বাগানের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে দেখলো দ্বীপ একটা গাছের গোড়ায় বসে আছে ৷ চারু আস্তে আস্তে দ্বীপের পেছনে গিয়ে দাড়ালো ৷চারুকে অবাক করে দিয়ে দ্বীপ বলল

পেছনে কেন দাড়িয়ে আছো ভাবিমা ৷পাশে এসে বসো ৷একটু কথা বলি তোমার সাথে ৷

চারু দ্বীপের পাশে বসে পড়লো ৷দ্বীপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল

আপনাকে তুমি করে বলতে আমার ভালো লাগে ভাবিমা ৷মনে কিছু করো না ৷তোমাকে বড্ড আপন লাগে তাই তুমি করে বলছি ৷

চারু মুচকি হেসে বলল তুমি যেভাবে ডেকে খুশি ভাই ৷আমি কিছু মনে করি নি ৷একটা কথা বলবে ভাই ৷

ভাবিমা বলে ফেলো ৷আমি চেষ্টা করবো উত্তর দিতে ৷

তুমি কি করে বুঝলে আমি তোমার পেছনে আছি ৷

আপন মানুষের উপস্থিতি যে বুঝতে পারে না ৷সে আবার কেমন মানুষ বলতে পারো ৷আর সেখানে আপনি তো মা সমতূল্য ৷আমাকে ডায়না এই রকম প্রশ্ন করতো আগে ৷আমি কিভাবে তার উপস্থিতি বুঝতে পারি জানতে চাইতো ৷অনেক চালাক মেয়েটা ৷

ডায়না কে ভাই ৷কিছুটা অবাক হয়ে দ্বীপকে প্রশ্ন করলো চারু ৷

দ্বীপ কিছুটা হেসে বলল আমরা একই ক্লাসে পড়ি ৷এক কথায় খুব ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা ৷কিন্তু এখন আর কথা বলি না ৷

কেন কথা বলো না ৷সে কি কিছু বলেছে ভাই ৷

সে কিছু বলে নি আমাকে ৷সময় বদলে গেছে ভাবিমা ৷এখন আমার জীবনটা আর আগের মতো নেই যে ওর সাথে কথা বলবো ৷একটা খারাপ মানুষের সাথে ওর কথা বলা মানায় না ৷তোমায় একটা কথা বলবো ভাবিমা ৷

হুমম বলো ৷

যদি কখনো খবর আসে আমি মরে গেছি ৷ কিংবা খবর আসে আমি নেশা করি ৷ তখন কি তোমার খারাপ লাগবে ৷আমার জন্য কাদঁবে তুমি ৷নাকি আমাকে সবার মতো ভুল বুঝবে ৷ নাকি নেশাখোড় বলে ঘৃনা করবে ৷

দ্বীপ মা ডাকছে ৷ভেতরে চল ৷হঠাৎ করেই গম্ভীর একটা কন্ঠে দ্বীপ পেছনে তাকালো ৷মিহান দাড়িয়ে আছে ৷আজ তার রক্ষা নেই বাবার হাত থেকে ৷মিহানের চোখ আর চেহারা দেখে ভয়ে দ্বীপের গলা শুকিয়ে গেল ৷ তার হাত পা অনবরত কাপঁতে লাগলো ৷ তার সব কথা মিহান শুনেছে এটা নিশ্চিত ৷

চলবে…..

প্রীতিলতা আসবে বলে
লেখিকা :আফরিন ইসলাম
সিজন :২
পার্ট : ৯

দুই মাস পার হয়ে গেছে ৷আয়ান আর চারুর পরীক্ষাও শেষ ৷দ্বীপকে হোস্টেলে রেখে আসা হয়েছে দুইমাস আগে ৷তারপর আর সে আসে নি ৷আয়ান যেতে চেয়ে ছিল দ্বীপকে দেখতে ৷কিন্তু ওর বাবা যেতে দেয় নি ৷

রাত ঘড়ির কাটায় নয়টা বাজে ৷ চারু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ৷ আয়ান কিছুক্ষন আগে বাইরে থেকে এসেছে ৷আয়ান বিদেশ যাবে লেখাপড়া করতে ৷ আর চারু মেডিকেলের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দেবে ৷আয়ান ঘরে এসে দেখলো চারু বাইরে তাকিয়ে আছে ৷আয়ান চারুর পাশে যেয়ে দাড়ালো ৷ চারুর কোনো দিকে মন নেই ৷সে বাইরের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত ৷ তার পাশে যে আয়ান দাড়িয়ে আছে সেই খেয়াল নেই তার ৷আয়ান শান্ত গলায় বলল

চারুলতা আপনার কি মন খারাপ ৷

চারু আয়ানে দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ৷আয়ান দেখলো চারুর চোখে পানি ৷আয়ান চারুর দুই গালে হাত রেখে বলল

কি হয়েছে চারু ৷আপনার চোখে পানি কেন ৷আমি কি কোনো ভুল করেছি ৷নাকি কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে আপনার সাথে ৷

চারুর যেন এতটুকু ভরসা খুব দরকার ছিল ৷ চারু আয়ানকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো ৷তারপর হু হু করে কেদেঁ দিল ৷আয়ান অস্থির কন্ঠে বলল

কি হয়েছে বলুন না চারু ৷আপনি দয়া করে এভাবে কাদঁবেন না ৷আপনি কাদঁলে আমার অনেক কষ্ট হয় ৷বলুন না কি হয়েছে ৷

চারু কাদঁতে কাদঁতে বলল আমি এতটাই খারাপ আয়ান ৷দাদু আমার সাথে একবারও দেখা করতে আসে নি ৷আমি কি সত্যি অনেক বড় পাপ করেছি ৷দাদি একা আসে কেন ৷দাদু কেন আসে না ৷আমার বড্ড কষ্ট হয় আয়ান ৷

আয়ান চারুর মাথায় চুমু দিল ৷তারপর বলল ও তাহলে এই ব্যাপার ৷ঠিক আছে আমি সব ঠিক করে দেব ৷আমার চারু আমাকে বিশ্বাস করে তো ৷

চারু আয়ানের দিকে তাকিয়ে হ্যা বোঝালো ৷ আয়ান চারুর চোখের পানি মুছে দিল ৷তারপর হুট করেই চারুকে কোলে নিয়ে নিল ৷চারু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হঠাৎ কোলে নেওয়ায় ৷তারপর বলল

আমাকে কোলে কেন নিলেন আয়ান ৷আয়ান চারুর কথায় পাত্তা দিল না ৷সে চারুকে নিয়ে হাটতে লাগলো ৷আর চারু আয়ানকে বারবার নামাতে বলতে লাগলো ৷আয়ান চারুর কথায় পাত্তাই দিল না ৷ সে হেটেই চললো ৷আয়ান চারুকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে এলো ৷আয়ানদের বাড়ীর পাশেই একটা বড় দীঘি ৷দিঘীর পাশে ঘাট বাধা ৷আয়ান চারুকে ঘাটের সিড়িতে বসিয়ে দিল ৷ আর চারু সে আয়ানকে দেখছে ৷আয়ানও চারুকে দেখছে ৷দখিনা হাওয়ায় চারুর খোলা চুল উড়ে যাচ্ছে ৷রুপালী চাদেঁর আলোয় চারুকে বড্ড সুন্দর লাগছে ৷আয়ান চারুর কাছ থেকে সরে গেল না ৷বরং চারুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো ৷ চারুর একটা হাত আয়ান নিজের মাথায় রাখলো ৷তারপর বলল

মাথায় হাত বুলিয়ে দিন চারু ৷

চারু আয়ানের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো ৷কোথায় একটু প্রেম ভালোবাসার কথা বলবে তা না ৷এই ছেলেকে দেখ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ৷চারু মনে মনে কথা গুলো বলল ৷

তখনই আয়ান বলল প্রেম ভালোবাসার কথা এখনই বলতে চাই না চারু ৷সময় হোক বলবো৷

আয়ানের দিকে চোখ বড় বড় করে চারু তাকিয়ে রইলো ৷বাজে লোক একটা মনের কথাও বুঝে ফেলে ৷

অপর দিকে ফ্লোরে পরে আছে দ্বীপ ৷ তার আশেপাশে কিছু লোক আছে ৷ দ্বীপের হাত পা বাধাঁ ৷সামনেই তার বাবা বসে আছে ৷তার হাতে একটা সিরিজ ৷ দ্বীপের বাবা একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলল

কি রে হেরোইন খেয়েই তোর এই অবস্থা ৷ আর এই সিরিজ যদি তোর দেহে দেই তাহলে কি হবে ৷

দ্বীপ কাদঁতে কাদঁতে বলল আমার শরীরে এইটা দিও না ৷ আমার খুব কষ্ট হয় বাবা ৷তোমার দুইটা পায়ে পড়ি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও ৷এখানে আমি থাকবো না ৷

তোকে ছেড়ে দিলে আমার ড্রাগসের ব্যাবসা কে সামলাবে ৷ তোকে কি এমনি এমনি আমি নেশা দেই হ্যা ৷তুই এই নেশার জন্য পাগলা কুত্তা হয়ে যাবি ৷চাইলেই ছাড়তে পারবি না ৷আর তুই এখন কোথায় জানিস ৷ তুই এখন বেশ্যাদের কুঠিরে ৷বেশ্যা কি জানিস ৷যারা টাকার বিনিময়ে অনেক লোকের সাথে থাকে ৷ মেয়ে তুলে আনা হয় এখানে ৷আমার লোকেরা সহজ সরল মেয়েদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে এখানে নিয়ে আসে ৷ আর ওরা সারা জীবনের জন্য এখনে রয়ে যায় ৷নারী পাচার করি আমি ৷ড্রাগসের ব্যবসা করি আমি ৷কত টুকু জানিস আমার ব্যাপারে ৷নিজের স্বার্থে শুধু তোকে নেশা দেওয়া না ৷আরো অনেক কিছু করতে পারি আমি ৷নিজের স্বার্থে মা বাবাকে খুন করেছি ৷এমনকি নিজের আপন ছোট ভাইকেও ৷তাহলে তোকে নেশা করাতে আমার হাত কেন কাপঁবে বল ৷আমার ড্রাগস তুই সামলাবি ৷আর এই পতিতা পল্লী সামলাবে মাহিন ৷আমার শুধু টাকা চাই টাকা ৷খুব দরদ না আয়ানের প্রতি ৷ওর বাপকে যেভাবে মেরেছি ৷ওকেও ঐ ভাবেই মারবো আমি ৷ আমার কথা না শুনলে তুইও মরবি ৷

দ্বীপের শরীরে সিরিজ দিয়ে অন্য নেশা দেওয়া হয় এখন ৷দ্বীপ চিৎকার করতে লাগলো ৷কিন্তু তার চিৎকার শোনার কেউ নেই এখানে ৷আজ দুইমাস এই বদ্ধ ঘরের বন্দি সে ৷তার দিন শুরু হয় নতুন নতুন নেশা দিয়ে এখন ৷আর রাত শেষ হয় নেশা দিয়ে ৷প্রতিদিন নিজের বাবাকে সে আবিষ্কার করে নতুন করে ৷তার কি দোষ সে জানে না ৷শুধু এতটুকু জানে সে কোনো খারাপ কাজ করবে না ৷দ্বীপ নিজের চোখ বন্ধ করলো ৷

ফ্লোরে পরে রইলো সে ৷আজ সকালে নিজের হাত নিজেই কেটেছে হেরোইন এর জন্য ৷নেশা যখন বেড়ে যায় ৷তখন দ্বীপ নিজের মাঝে থাকে না ৷একটা পাগলে পরিনত হয় ৷ আগের থেকে এখন অনেক কালো হয়ে গেছে সে ৷পাতলা লাল টকটকে ঠোট গুলো বর্নহীন হয়ে গেছে ৷ শরীরে খামচির দাগ ৷নিজের শরীর খামচে রাখে নি সে ৷ মাথার ঘন কালো চুল গুলো এখন এলোমেলো ৷নেশার জন্য মাথার অর্ধেক চুল টেনে ছিড়েই ফেলেছে ৷ রোজ ঘুম থেকে উঠে তার একটাই কাজ খাওয়া আর নেশা করা ৷গাজাঁ এখন তার অন্যতম সঙ্গী ৷রোজ একটু একটু করে তাকে নেশা দেওয়া হয় ৷কেননা তার সহ্য ক্ষমতা কম ৷

আজ একদিন দ্বীপ ঘুমিয়ে আছে ৷নেশার রেশ কাটে নি তার ৷কিন্তু কেউ একজন তাকেই ডেকেই চলেছে ৷দ্বীপ চেয়েও চোখ খুলতে পারছে না ৷মাথাটা কেমন যেন করছে তার ৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here