#প্রিয়_পৃথিবী
|৩|
গভীর রজনীতে মেয়ের বিষণ্ণবদনখানি দেখতে পেয়ে বুকটা হুহু করে ওঠল ফারজানার। সস্নেহে মেয়ের মাথায়, মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-” আমি জানি তুই ঘুমাসনি। ”
মা’য়ের কাছে ধরা পড়েও একটুখানি লজ্জিত হলো না পৃথিবি। কেন হবে লজ্জিত? সে কী বাংলা সিনেমার হিরোইন নাকি? প্রিয় যতই তাকে নায়িকা বলে আখ্যা দিক না কেন, আসলে সে তো নায়িকা নয়। নায়িকা না মানে সে অভিনয়েও পটু নয়, বরং খুবই অপটু। তার এই অপটুত্বতা দেখেই তো প্রিয় তাকে ভালোবেসেছে। যে কোন উপায়ে বিয়ে করে হালাল করেছে তাদের সম্পর্কটাকে। সেই প্রিয়র পৃথিবী যে অভিনয় পারে না। প্রিয়র পৃথিবী অভিনয় হীন নায়িকা। প্রিয়র পৃথিবীর দ্বারা অভিনয় সম্ভব না।
বদ্ধ চোখেই ফুঁপিয়ে ওঠল পৃথিবী। ফারজানা বেগম মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-” তোকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে দেখতে আমিও কবে জানি চলে যাই। তোর বাবার কাছে। ”
এবার পৃথিবী শব্দ করে কেঁদে ওঠল। বলল,
-” তুমি চলে যেও না আম্মু। আমাকে একেবারে এতিম করে দিও না। ”
ফারজানা বেগমের দু-চোখ বেয়েও অশ্রুপাত ঘটল। বলল,
-” জেদ খুব খারাপ জিনিসরে পৃথি। ওরা ভাবছে জেদ করে তোর ভালো করবে। কিন্তু ভালো করতে গিয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ”
পৃথিবী কিছু বলল না। ভাইদের নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগছে না। তাদের কথা চিন্তা করতেও বুকটা বিষিয়ে ওঠছে। চিন্তা হচ্ছে শুধু প্রিয়কে নিয়ে। যোগাযোগ বিহীন প্রিয় স্থির থাকতে পারছে তো? নাকি তারই মতো অস্থির হয়ে আছে? প্রিয়র খুব রাগ, খুব জেদ অথচ এ’কদিন যোগাযোগ ছাড়া ঠিকি নিজের রাগ, জেদ দমিয়ে রেখেছে। এর পিছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। পৃথিবী জানে তার প্রিয় যতই রাগি হোক, জেদি হোক কিন্তু বিবেকবোধ প্রবল। তাছাড়া ফারজানা বেগমকেও সে খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। পৃথিবী যেমন বাবা হারিয়েছে তেমনি ফারজানা বেগমও স্বামী হারিয়েছেন। এই করুণ সময়টায় ফারজানা বেগমের কাছে পৃথিবীর থাকা প্রয়োজন। এজন্যই প্রিয় স্থির রয়েছে, শান্ত রয়েছে। স্পষ্টই বুঝতে পারল পৃথিবী। মনের ভিতর প্রিয়কে নিয়ে হাজারো কল্পনা, জল্পনা চলতে থাকলো। একসময় সেই কল্পনার রাজ্যে সকল বিষণ্নতাদের নিষ্পত্তি ঘটে উঁকি দিল তাদের দু’জনার অনুভূতির রাজ্যের সূচনার দিনটি।
***
সালটি ছিল ২০১৯। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। পৃথিবীর স্কুল ছিল নানাবাড়ির কাছাকাছি। তাই সেখানে থেকেই স্কুল জীবনের পড়াশোনার ইতি টেনেছে। তার একমাত্র খালামুনি ফাতিহা, তার শশুর বাড়িও নানাবাড়ির অতিনিকটে। ফাতিহার স্বামী ইশতিয়াক রহমান অর্থাৎ তার চেয়ারম্যান খালু সম্পর্কে তার চাচাতো মামাও হয়। ফাতিহা, আর ইশতিয়াকের লাভ ম্যারেজ। খালামুনির বাড়ি কাছাকাছি হওয়াতে সেখানেও বেশ আসা, যাওয়া চলতো। প্রতিটি মানুষের জীবনেই স্কুল জীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়৷ স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীরও তাই ছিল। ফলসরূপ নিজের বাড়ির তুলনায় স্কুল জীবনটা ওখানেই কেটেছে বেশি। সেবার পৃথিবীর পড়ালেখা নিয়ে সবাই খুব সিরিয়াস হয়ে পড়ে। সামনে পরীক্ষা। নানাবাড়িতে ছোটো তিনটে মামাতো ভাই রয়েছে। তাদের পাল্লায় পড়ে একেবারেই পড়াশোনা হচ্ছিল না। তাই ফারজানা সিদ্ধান্ত নিল পরীক্ষার পূর্বে দু’মাস এবং পরীক্ষা চলাকালীন এক মাস পৃথিবী ফাতিহার বাড়িতে থাকবে। এমন সিদ্ধান্ত হতেই পৃথিবীর বাবা এসে পৃথিবীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। তিন মাস মেয়ে অন্যের বাড়িতে থাকবে তাই তার আগে একবার মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন৷ নভেম্বর মাস থাকায় তখন আবার পৃথিবীর ছোটো ভাই সাউদের জে এস সি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। ফারজানা বেগমও ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ছেলেগুলোও একেক কাজে মহা ব্যস্ত। নওশাদ শেখ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। বিধায় তার স্কুলের কিছু জরুরি কাজ পড়ে যায়৷ পৃথিবীকে খালামুনির বাসায় দিয়ে আসার মানুষের সংকট পড়ে খুব৷ এ খবর ফাতিহা যেদিন শুনে সেদিন বিকেলেই প্রিয়কে পাঠিয়ে দেয়।
একজন হেডমাস্টারের মেয়ে হিসেবে পৃথিবী খুবই পানচুয়াল। যা চেয়ারম্যানের ছেলে হওয়ার সুবাদে প্রিয় একদমই নয়৷ পৃথিবী খুবই শান্ত স্বভাবের। পাঁচ জন মেয়ের আড্ডা মহলে থাকলেও প্রয়োজনের বাইরে একটা, দু’টোর বেশি কথা সে বলবে না। বললেও সেসব কথা খুব মেপে মেপে বলবে। তার সবচেয়ে পছন্দনীয় কাজগুলো হচ্ছে, ঘুমানো, চুপচাপ বসে থাকা, চারপাশের মানুষ, প্রকৃতি সমস্তই মুগ্ধ চোখে দেখা,আর বই পড়া। প্রিয় ঠিক তার বিপরীত স্বভাবের। প্রচণ্ড দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে সে। যদিও বাহ্যিকভাবে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। প্রথম দেখায় যে কেউ বলতে বাঁধ্য, এমন ছেলে লাখে একটা পাওয়া যায়। দেখতে সুন্দর, অতিরিক্ত স্মার্টনেস, পাশাপাশি চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে, মাঝেসাঝে প্রয়োজনের তাগিদে মারপিটও করতে দেখা যায়, এলাকার ছেলেরা প্রিয়ভাই বলতে অজ্ঞান, সবমিলিয়ে যেন সোনায় সোহাগা। এরজন্য অবশ্য তার দাম্ভিকতার শেষ নেই। সে যখন হাসবে সবাইকে হাসিয়ে ছাড়বে, সে যখন রাগবে সবাইকে কাঁদিয়ে ছাড়বে। রেগে গেলে অতি প্রিয় জিনিসকেও তুচ্ছ করতে বিন্দু দ্বিধাবোধ তার মধ্যে থাকে না। প্রিয়কে নিয়ে পৃথিবীর ভাইদের সমস্যা থাকার এটাও একটা কারণ। যাইহোক সেদিন, প্রিয় পৃথিবীকে নিতে আসে। ফারজানা তাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে বলে, পৃথিবী রেডি হয়ে আসছে। প্রিয় ভাবল, মেয়ে মানুষ রেডি হতে ব্যাপক টাইম নেবে তাই ফোনে কথা বলার জন্য বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। ইদানীং খুব টের পাচ্ছে সে একটা জঘন্য শ্রেণীর মেয়ের সঙ্গে জরিয়ে পড়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই গার্লফ্রেন্ডকে অর্থাৎ উষাকে কল দিয়ে বিশ্রি ভাষায় কিছু গালি বের করবে করবে ভাব এমন সময় পৃথিবী এসে বলল,
-” ভাইয়া আমি রেডি। ”
পেছন থেকে ফারজানা বেগম এসে বলল,
-” প্রিয় আস্তে বাইক চালাবি, দেখিস পৃথির যেন ঠান্ডা না লাগে। সবদিক খেয়াল রেখে যাবি, পৌঁছেই আমাকে ফোন দিবি। ”
মাথার মধ্যে ভনভন করতে থাকা অশ্রাব্য গালিগুলো বহুকষ্টে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ফোনটা দ্রুত কেটে দিল প্রিয়। তারপর খালামুনিকে ভরসা দিয়ে পৃথিবীকে বাইকে ওঠে বসতে বলল। পৃথিবীও চুপচাপ তার পেছনে ওঠে বসল। তারপর বিদায় নিয়ে দ্রুত বাইক স্টার্ট দিল প্রিয়। পেছন থেকে ফারজানা বেগম পুনরায় বলল,
-” প্রিয় আস্তে চালাস একদম তাড়াহুড়ো করবি না৷ আমি কিন্তু পৃথির কাছে পরে শুনব। ”
শুরুতে প্রিয় আস্তেই বাইক চালাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে দেয়। মায়ের কথার অবাধ্য হওয়াতে পৃথিবী কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,
-” আম্মুর কথার অবাধ্য হচ্ছো কেন? ”
প্রিয় সহসা বাইকের স্পিড কমিয়ে দিয়ে দুষ্টুমির ছলে বলল,
-” চেক করে দেখলাম তুই ইহজগতে আছিস নাকি পরপারে চলে গেছিস। ”
কথাটির মানে পৃথিবী বুঝতে পারল না। তাই অনেস্টলি জিজ্ঞেস করল,
-” মানে? ”
-” মানে হচ্ছে আমার খুব সন্দেহ হয় তোর দেহে প্রাণ আছে কিনা! ”
এবারও পৃথিবী কিছু বুঝতে পারল না৷ তবুও পুনরায় প্রশ্ন করল না৷ আপনমনেই কথাগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করল। এদিকে বার বার প্রিয়র ফোনে কল আসতে শুরু করায় হঠাৎ বাইক থামিয়ে দিয়ে প্রিয় বলল,
-” পৃথি দু’হাতে কান চেপে ধর। ”
পৃথিবী স্থূলবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রিয় আবারও বলল,
-” কানে চেপে ধর যাতে আমার কথা শুনতে না পাস।”
পৃথিবী একইভাবে বসে রইল। প্রিয় অধৈর্য হয়ে বলল,
-” আরে গাঁধি দু’হাতে কান চেপে ধর। যাতে আমার কথাগুলো তোর কান অবধি না পৌঁছায়। যদিও কথাগুলোর মানে তুই বুঝবি না৷ বাই এনি চান্স একটা, দুটো বুঝে ফেললে সর্বনাশ ঘটে যাবে। ”
কল রিসিভ করার পূর্বে প্রিয় নিজেই পৃথিবীর একহাত তুলে কানে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী নিজেই দু’হাতে নিজের দু’কান চেপে ধরল। প্রিয় নিশ্চিন্তে সামনে ঘুরে ফোন রিসিভ করল। তার একহাত দ্বারা বাইকের হাতলটি শক্ত করে চেপে ধরা। আরেকহাত কানে ফোন চেপে ধরা অবস্থায় আছে৷ পৃথিবীর দৃষ্টি হাতলে থাকা সে হাতটির দিকে স্থির৷ সে গুণতে ব্যস্ত প্রিয়র হাতে কব্জিতে পড়া রাবার ও সুতোর ব্রেসলেটগুলোকে। গুণে বুঝল সেখানে এক ডজন অর্থাৎ বারোটি চিকন ব্রেসলেট রয়েছে। ধবধবে ফর্সা ত্বকে কালো লোমযুক্ত কব্জিতে ব্রেসলেটটা বড্ড বেশি মানানসই লাগছে। যদিও তার বাবার ভাষায় এসব কোন ভদ্র,সভ্য ছেলেরা পড়ে না৷ তবুও প্রিয়র হাতটা ভীষণ ভালো লাগল তার। এ মূহুর্তে বাবা সামনে থাকলে সে ঠিক বলতো, ” আব্বু এটাকে অসভ্যতা না ধরে ফ্যাশন ধরলে ক্ষতি কী ? ”
ব্রেসলেট, প্রিয়র হাতের মাধুর্য, বাবার করা মন্তব্য সবমিলিয়ে যখন ভাবনার অতল গভীরে পৃথিবীর মন হারিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সে ক্ষণেই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া, লজ্জায় লাল হয়ে শরীরে ঘাম ছেড়ে দেওয়া প্রিয়র উচ্চারিত বাক্যগুলো কানে বাড়ি খেতে লাগল,
-” তুই কী ভেবেছিলি চেয়ারম্যানের ছেলে বলে বাকিদের মতো তোকে খেয়েদেয়ে হাত, মুখ পরিষ্কার করে বসে থাকব? রাজনীতি করি বলে সবার মত নষ্ট মাইন্ড আমার? যদি তাই ভেবে থাকিস ভুল ভেবেছিস। পঁচা নর্দমায় আমার থুথু ছাড়া আর কিছুই পড়বে না। রাহাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভিডিও করে শখ মেটেনি? এমন আরো ভিডিও করার ইচ্ছে আছে নাকি? যদি থাকে বলিস, আমার পোলাপানের অভাব নাই! ”
আচম্বিতে বাইক থেকে নেমে পড়ল পৃথিবী। প্রিয় হকচকিয়ে গেল। ফোনের ওপাশে উষার কান্নার শব্দ শুনে প্রচণ্ড মাথা গরম হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল,
-” এরপর আমাকে ফোন দিয়ে দেখিস। একদম বাড়ি থেকে তুলে এনে রাহাত পার্টির কাছে ছেড়ে দেব! ”
উষাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চট করে ফোন কেটে উষার প্রতিটা নাম্বার ব্ল্যাকলিস্ট করে দিল৷ স্বস্তি সহকারে লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকাতেই চমকে ওঠল। থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। চোখ,মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। মুহূর্তেই খেয়াল হলো, সে ঠিক কী কী বলেছে। আফসোসের সহিত ছোট্ট করে বলল,
-” শীট! সব বুঝে ফেলছে! ”
কোনক্রমে আমতা আমতা করে পৃথিবীকে বুঝিয়ে বাইকে ওঠালো প্রিয়। বেশ ধীরে সুস্থে বাইক স্টার্ট দিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ইনিয়েবিনিয়ে অনেক কিছু বোঝালো। যার শুরুটা ছিল এভাবে,
-” শোন পৃথি আমি মোটেই খারাপ ছেলে না। যথেষ্ট ভালো ছেলে আমি। আরে আমি তোর খালাতো ভাই। মানে তোর যে মা তার বোনের ছেলে আমি। আমি খারাপ হতে পারি বল? ”
পৃথিবী চোখমুখ লাল করে মাথা নিচু করে বসে ছিল। প্রিয় আবারও বলল,
-” আমি ভেবেছিলাম তুই খুব ছোটো এগুলো বুঝবি না।”
পৃথিবী ছোট্ট করে একটি নিঃশ্বাস ফেলল। প্রিয় ওর থেকে কোন উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা না করে বলল,
-” অযথা আমাকে বাজে ভাববি তো কানের নিচে একটা দেব ফাজিল মেয়ে!”
এ পর্যায়ে পৃথিবীর চোখ বেয়ে পানি পড়ল। নাক টানার শব্দ শুনে প্রিয় টের পেল সে কাঁদছে। বুকের ভিতরটা চমকে ওঠল তার। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। কেন জানি সমস্তটা খুলে বলতে ইচ্ছে করল পৃথিবীকে। তবুও সবটা বলার পূর্বে বলল,
-” একশবার করে বললাম কান ধরে রাখতে। শয়তান মেয়ে! চুরি করে আমার অশ্লীল কথাগুলো শুনে এখন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস। ”
পৃথিবী একহাতে চোখের পানি মুছল। প্রিয় বলল,
-” মেয়েটা আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। সু’আদের বান্ধবী। ভেবেছিলাম ভালো মেয়ে ভদ্র,সভ্য। রিলেশন করার পর বুঝলাম হাড়ে বজ্জাত। দেখা করলেই চিপায়, চুপায় টানাটানি করতো। সুযোগ পেলেই গলায় ঝুলে পড়তো। অঙ্গভঙ্গি দেখেই বুঝতাম এই মেয়ে সুবিধার না। পরে খোঁজ খবর নিয়ে বুঝলাম সত্যি ভয়ানক প্রানী। আমি ভদ্র ঘরের ছেলে, এই মেয়ের সাথে আমার যায় না৷ তাই ছাড়াবার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই পারছিলাম না৷ শেষে ছাড়ার কারণগুলো উল্লেখ না করে পারলাম না। দু’মাসের গার্লফ্রেন্ড, ভালোবাসাটা জন্মায়নি নয়তো এত ভালো কথায় ছাড়ার পাত্র আমি না৷ যদি একটুও ভালোবাসা হতো তাহলে ওরে বুঝাই দিতাম আমি কী জিনিস!”
প্রিয় কথাগুলো শেষ করার দুমিনিট পর পৃথিবী বলল,
-” প্রিয় ভাইয়া। ”
প্রিয় কিছু টা চমকে বলল,
-” হ্যাঁ বল বল। ”
-” ভালো না বাসলে রিলেশন করেছিলে কেন? ”
-” ভালোবাসার জন্য। ”
-” তাহলে বাসলে না কেন? ”
-” তোর মাথায় দেখি গোবর ছাড়া কিছুই নেই। আমি ভদ্র ঘরের ছেলে অমন চরিত্রহীন মেয়েকে ভালোবাসবো নাকি? ছেলেরা অমন মেয়েকে ভালোবাসেনারে। অমন মেয়েকে ছেলেরা জাস্ট ইউজই করে। কিন্তু আমার সেসবে আসক্তি নেই। ”
-” কেমন মেয়েকে ভালোবাসে ছেলেরা? ”
-” শান্তশিষ্ট, ভদ্রসভ্য চরিত্রবান মেয়েদের। বুঝলি যুগটা খুব খারাপ এখন বিয়েসাদি করতে গেলে ঘোরবিপদে পড়তে হবে। ”
-” কেমন মেয়ে বিয়ে করবে তুমি? ”
পৃথিবীর এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল প্রিয়। এই প্রশ্নের উত্তর সে নিজেও সেভাবে ভেবে দেখেনি। কিন্তু পৃথিবীর মুড ঠিক করার জন্য কথা চালিয়ে যেতেই হবে৷ তাই ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলল,
-” এমন মেয়ে বিয়ে করব যে ফেসবুক চালানো তো দূরের কথা, ফোনই ইউজ করে না। এই মেয়েগুলা নিঃসন্দেহে ভালো। আমি শিয়র দিয়ে বলতে পারি এমন মেয়ে পেলে প্রতিটা ছেলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে। ”
সহসা ঠোঁটে হাসি ফুটলো পৃথিবীর। বাড়ির সামনে এসে বাইক থামিয়ে প্রিয় বলল,
-” আস্তে নাম, আম্মুকে বলবি আমি আধঘন্টা পর বাড়ি আসব৷ একটু কাজ আছে এখন আমার। আর শোন যা সব শুনেছিস ভুলে যাবি, একদম মনে রাখবি না। মাথায় রাখিস আমি ভদ্র ঘরের ছেলে। ”
কথাগুলো শুনতে শুনতেই নেমে দাঁড়ালো পৃথিবী। কাঁধের ব্যাগটা ভালোভাবে কাঁধে চেপে নিল৷ প্রিয় আবারও বাইক স্টার্ট দিল৷ হঠাৎ পৃথিবী ডাকল,
-” প্রিয় ভাইয়া… ”
ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো প্রিয়। আলতো হেসে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বলল,
-” কী? ”
কিছুটা লজ্জা পেয়ে নরম কণ্ঠে পৃথিবী বলল,
-” আমার বর খুব ভাগ্যবান হবে দেখে নিও। ”
কথাটি বলে আর অপেক্ষা করল না পৃথিবী। গেট পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল। কিন্তু প্রিয়? স্টার্ট দেওয়া বাইকটা সহসা থামিয়ে দিয়েছে সে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সে পথের পানে যে পথে পৃথিবী সেকেন্ড কয়েক আগে চলে গেল। পৃথিবীর ক্রন্দনরত মুখশ্রীর সে দৃশ্য, লজ্জা পেয়ে গাল দু’টো লাল হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দুচোখে গুলিবর্ষণের মত করে আঘাত করল তার। অনুভব করল শরীরটা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, নিঃশ্বাস ভারি হয়ে যাচ্ছে। সহসা অনুভব করল তার শরীর নীল বর্ণ ধারণ করছে। পৃথিবীর ঐ লাল বর্ণীয় মুখশ্রীর ধাক্কা খেয়েই নীল হয়ে যাচ্ছে সে৷ এ যেন লালের দর্শনে, লালের পরশে নীলের ফুঁসে ওঠা। অস্থিরচিত্তে পুনরায় বাইক স্টার্ট দিল প্রিয়। মেজাজ কেমন খিঁচে ওঠল তার। স্মরণ করল লজ্জামিশ্রিত মুখে পৃথিবীর বলা শেষ বাক্যটি,
-” আমার বর খুব ভাগ্যবান হবে দেখে নিও। ”
চলবে…ইনশাআল্লাহ
®জান্নাতুল নাঈমা
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ। যারা পড়ছেন সকলেই রেসপন্স করবেন এবং বেশি বেশি শেয়ার করবেন)