প্রিয়_পৃথিবী 1

0
698

#প্রিয়_পৃথিবী
|১|
মেয়ের বাবা পনেরো লক্ষ টাকার নিচে কাবিন করবেন না। ছেলের বাবা দশ লাখের উপরে যাবেন না৷ টাকাটা বড়ো কথা নয়৷ বড়ো কথা হচ্ছে সম্পর্কে তারা ভায়রাভাই। তাই জেদ কারো থেকে কারো কোন অংশে কম নয়৷ দু’পক্ষের বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলের বাবা ইশতিয়াক রহমান মেয়ের বাবা নওশাদ শেখকে বললেন,

-” আত্মীয়ে আত্মীয়ে পরম আত্মীয় হতে যাচ্ছি ভাইসাহেব। দু’পক্ষের সিদ্ধান্তকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। ”

নওশাদ শেখ মেজো ছেলে সাইফুল্লাহের দিকে তাকালেন। সাইফুল্লাহ বাবা’কে ভরসা দিয়ে ইশতিয়াক রহমানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

-” খালুজান আত্মীয়ে আত্মীয়ে পরম আত্মীয় যখন হচ্ছিই কাবিন বিশ লাখ হলেও সমস্যা হওয়ার কথা না।”

এ কথার উত্তর ইশতিয়াক রহমান দেওয়ার পূর্বেই মেয়ের সেজো ভাই সু’আদ তীক্ষ্ণ সুরে বলে ওঠল,

-” কেন খালু পনেরো লাখ কাবিন করতে আপনাদের সমস্যা কী? আমাদের একটা মাত্র বোন, তার ওপর বয়স কম বিয়ে যে দিচ্ছি এই তো অনেক। ”

সু’আদের কথার ধরনে বেয়াদবি স্পষ্ট বুঝতেই বড়ো ভাই সাদমান ধমক দিলো তাকে। রগচটা সু’আদ আরো দ্বিগুণ রাগত কণ্ঠে বলল,

-” আমাকে না ধমকে খালুজানকে প্রশ্ন করো তার সমস্যা কী? ”

সু’আদের এই চরম বেয়াদবি কথাবার্তা শুনে ইশতিয়াক রহমানের চোখ,মুখ শক্ত হয়ে ওঠলেও তিনি শান্ত রইলেন। শান্ত গলায় নওশাদ শেখ’কে বললেন,

– ” দেখুন ভাইসাহেব ছেলে কিন্তু আমারও একটাই। কথা বাড়ালে কথা বাড়বেই আমি চাইছি সমঝোতা করতে। ”

নওশাদ শেখ পুনরায় মেজো ছেলে সাইফুল্লাহর দিকে তাকালেন। বড়ো ছেলে সাদমান বাবাকে চাপা স্বরে বললেন,

-” আব্বু খালুজান যা বলছে মেনে নিন। দশ লাখ টাকাই করুন। উনি যখন বলছেন উনারা যত কাবিন করবেন সবটা আজকেই পরিশোধ করে দেবেন ৷ এটা কিন্তু ভালো প্রস্তাব। ”

সাদমান’কে চাপা স্বরে ধমক দিলো সাইফুল্লাহ। বলল,

-” আমাদের বোনের বয়স কম। শয়তানের হাড্ডিটার কাছে ও’কে যখন বিয়ে দিচ্ছি আমাদের সব শর্ত মানতে হবে। ”

এদিকে সু’আদ আবারও তেজ দেখিয়ে বলল,

-” এত সমঝোতা তো আর ভালো লাগে না খালু। সমঝোতা করতে করতেই আজ এই পর্যন্ত আসা। ”

ইশতিয়াক রহমান আর সহ্য করতে পারলেন না। হাঁটুর বয়সী পোলাপানের তেজ আর কত সহ্য করা যায়? যেন সে ছেলে বিয়ে করাতে নয় ছেলের প্রাণ ভিক্ষা করতে এসেছেন৷ আর এরা তার বিনিময়ে তাকে নাকখোর দেওয়াবেন তারপর প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন৷ তেজ তারও কম নয়। সে একজন রাজনীতিবিদ। তার ইউনিয়নের দশটি গ্রামের চেয়ারম্যান হিসেবে যথেষ্ট সম্মানীয় ব্যক্তি সে। শুধুমাত্র ছেলের জেদকে প্রশ্রয় দিয়ে আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয় করতে রাজি হয়েছেন। এ পর্যন্ত যতটুকু সহ্য করা যায় করেছেন৷ কিন্তু এবার তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। তার দাঁড়ানো দেখে সাইফুল্লাহ বলল,

– ” হয় পনেরো লাখ কাবিন হবে নয়তো আমাদের বোন আমরা দেব না। ”

এ কথায় সমর্থন জানিয়ে সু’আদ বলল,

-” বিশ লাখ যে বলি নাই এটাই তো ভাগ্য। ”

ক্রোধে ইশতিয়াক রহমানের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কাউকে বিন্দু পরিমাণ সেটা বুঝতে না দিয়ে নওশাদ শেখ এবং মেয়ের বড়ো ভাই সাদমান শেখের দিকে তাকালেন। তারা নিরুত্তর হয়ে বসে আছেন। ইশতিয়াক রহমান আর সময় নষ্ট করলেন না৷ হাঁক ছেড়ে বললেন,

-” এই বিয়ে হবে না!”

ভিতরের ঘর থেকে পাত্রের বাবার এমন বাক্য শুনে পুরো ফ্ল্যাটে হট্টগোল বেজে গেল৷ ড্রয়িংরুমে থাকা পাত্রের ছোটো বোন পূর্ণতা ফোন করল পাত্র’কে। অর্থাৎ প্রিয়কে। বিয়ের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে ছাদে। সকল অতিথিরাই সেখানে উপস্থিত রয়েছে। খাওয়াদাওয়া সেরে তারা কেউ কেউ পাত্রের সঙ্গে ছবি তুলছে, কেউ বা রসিকতায় মশগুল। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো করেই বোনের ফোন পেয়ে ছুটে নিচে এলো প্রিয়৷ ড্রয়িং রুমে ছোটো বোন, মামাতো ভাই বোনদের থমথমে মুখের ভাব দেখে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল তার৷ কোনরকমে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পা বাড়ালো ভেতরের ঘরে৷ মুখোমুখি হলো সাইফুল্লাহর। যে কিনা শুরু থেকেই এই বিয়েতে অমত পোষণ করে আসছে। এক ঢোক গিলে বাবার দিকে উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে রইল প্রিয়। ইশতিয়াক রহমান বড়ো বড়ো পা ফেলে ছেলের সমানে এলেন। কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

– ” প্রিয় তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তুমি যা বলেছো তাই করেছি আমি৷ বাবা হিসেবে আমার কর্তব্য আমি করেছি৷ এবার ছেলে হিসেবে বাবার অপমানের জবাবটা তুমি দেবে। ”

ছেলেকে কথাগুলো বলে আর অপেক্ষা করলেন না ইশতিয়াক রহমান। ড্রয়িং রুমে গিয়ে শুধু স্ত্রীর বড়ো বোন অর্থাৎ পাত্রীর মা ফারজানা বেগমকে বললেন,

-” আপা আমার কোন ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন৷ আমার পক্ষে আপনার বাসায় আর এক মুহূর্ত থাকা সম্ভব না৷ ”

ফারজানা বেগম অনেক আকুতি মিনতি করেও ইশতিয়াক রহমানকে আটকাতে পারলেন না। ধীরে ধীরে ছেলেপক্ষের সকলেই ফ্ল্যাট ত্যাগ করলেন। রয়ে গেল শুধু পাত্র,পাত্রীর নানাবাড়ির লোকজন৷ বড্ড বিপদে পড়ে গেলেন তারা৷ কারণ পাত্র ইনান রহমান প্রিয় এবং পাত্রী পৃথিবী শেখ দু’জনই তাদের ভাগ্না,ভাগ্নি। পৃথিবীর মা ফারজানা বেগম ছুটে গেলেন প্রিয়র কাছে৷ সে প্রিয়কে বোঝানোর জন্য কিছু বলতে উদ্যত হতেই সাইফুল্লাহ আর সু’আদ বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। সু’আদ বলল,

-” তুমি কান্নাকাটি কেন করছো? এমনিতেই এই বিয়েতে আমরা কেউ রাজি ছিলাম না৷ বিয়ে ভেঙেছে বেশ হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার খালু নিজেই ভেঙেছে এই বিয়ে। এবার পৃথিকে খুব সহজেই সামলানো যাবে।”

সু’আদের এমন কথায় ক্রোধে ফেটে পড়ল প্রিয়৷ তড়াক করে সু’আদের কলার চেপেও ধরল। প্রায় মারামারি, কাটাকাটি হওয়ার মতো অবস্থা। তৎক্ষনাৎ প্রিয়র ফোন বেজে ওঠল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইশতিয়াক রহমান বললেন,

-” আহ প্রিয়, আমার ছেলে তুমি। মেইন পয়েন্টে আঘাত না করে ভুলভাল আঘাত করতে যাচ্ছো? মন দিয়ে শোনো, বউমা এখনো পার্লার থেকে বের হয়নি। রূপের ছোঁয়া পার্লারের সামনে তোমার বাইক রাখা আছে। কী কী করতে হবে আশা করি ক্লিয়ার করে বলার প্রয়োজন নেই ? ”

নিঃশব্দে ফোন কেটে দিলো প্রিয়। উপস্থিত সকলের দিকে একবার করে তাকালো। নওশাদ শেখ মাথা নিচু করে বসে আছেন। সাদমান তার পাশেই চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সাইফুল্লাহের ঠোঁটে অসৎ হাসি স্পষ্ট। সু’আদ সরাসরি কলার উঁচিয়ে বলেই ফেলল,

– ” প্রিয় ভাই বলছিলাম আমি খালাতো ভাই আছো ভাই’ই থাকো। বোন জামাই হতে আইসো না। শুনলা না আমার কথা তুমি, শুনলাই না। এবার ঝাকানাকা ছ্যাঁকা খাও, বড়ো স্বাদ তাই না ভাই ? ”

হোহো করে হেসে ওঠল সু’আদ। ফারজানা বেগম সু’আদের অসভ্যপনা দেখে কষিয়ে একটা থাপ্পড় লাগালো। সাইফুল্লাহ গিয়ে ধরল সু’আদ কে। সাদমান এসে মা’কে শান্ত করার চেষ্টা করল। ফারজানা বেগম শান্ত হলেন না। স্বামীর ওপর তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় প্রিয় একটু শব্দও করল না। বরং ধীরেসুস্থে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এদিকে ফারজানা বেগম মান সম্মানের চিন্তা করতে গেলে ছেলেরা তাকে হাজারটা স্বান্তনা দিলেন। প্রিয় সম্পর্কে তাদের ছোট খালার ছেলে। এই বিয়েতে যত আত্মীয় স্বজন এসেছে সবাই তাদের নিজেদেরই লোক। তাই আহামরি সমস্যা হবে না। এসব বলেই ফারজানা বেগমকে স্বান্তনা দেওয়া হলো।
.
বধু বেশে প্রিয়র সম্মুখে উপস্থিত হলো পৃথিবী। তার কাছে এখনো বিয়ে ভাঙার খবরটা পৌঁছায়নি। তাকে দেখে প্রিয়র পাণ্ডুবর্ণ মুখটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল৷ চোখমুখে ভর করল একরাশ মুগ্ধতা। মুগ্ধ নয়নে চেয়েই সে পৃথিবীকে ইশারা করল বাইকের পেছনে বসতে৷ তখনি পৃথিবীর ফোন বেজে ওঠল। পৃথিবী বলল,

-” সেজো ভাইয়া ফোন করেছে। কথা বলে নিই? ”

সহসা বুকের ভিতর ধক করে ওঠল প্রিয়র। উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,

-” না ধরবি না। বাইকে ওঠ। ”

কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠল পৃথিবী। চোখদুটো নিমিষেই লাল বর্ণ ধারণ করল তার। প্রিয় পুনরায় কঠিন স্বরে বলল,

-” আমি বাইকে ওঠতে বলেছি। ”

পৃথিবী নাক ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে পেছনে তাকালো। তার সঙ্গে মামাতো বোন স্বর্ণা আর বান্ধবী লীনা এসেছে। ওদের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,

-” দেখেছিস আপু দেখেছিস লীনা কেমন রাগ দেখাচ্ছে। আমি কী করেছি? ”

থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্ণা আর লীনা। ইতিমধ্যেই ওদের কাছে খবর এসেছে। তাই ওরা তাড়া দিয়ে বলল,

-” আরে ভাইয়া কখন রাগ দেখালো। কয়টা বাজে দেখেছিস চারটা উনপঞ্চাশ! এজন্যই তাড়া দিচ্ছে আর তুই ভাবছিস রাগ দেখাচ্ছে। যা যা ওঠ। ”

আবারও পৃথিবীর ফোন বেজে ওঠল৷ প্রিয় দ্রুত বাইক থেকে নেমে ওর ফোন কেড়ে নিয়ে সুইচ অফ করে দিলো। পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রিয় স্বর্ণাকে বলল,

-” তোরা যা। ”

তারপর পৃথিবীর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

-” তাড়া বুঝিস তাড়া? আমার তাড়া আছে জলদি বাইকে ওঠ। ”

পৃথিবীকে নিয়ে প্রিয় চলে গেল তাদের উপজেলার পরিচিত এক কাজি অফিসে৷ ইতিমধ্যে সমস্ত ঘটনা খুলে বলা হয়েছে পৃথিবীকে। সবটা শুনে মেয়েটা খুব কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক তাদের৷ সবে মাত্র মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে প্রিয়। পৃথিবী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আপাতত পড়াশোনা থেকে ছুটিতে আছে।

পৃথিবীর প্রতি অতিরিক্ত পসেসিভ থাকার কারণে চাকরির জন্য সময় নষ্ট করেনি প্রিয়। তার পূর্বেই পরিবারকে জানিয়ে দেয় সে পৃথিবীকে বিয়ে করবে৷ এতে তার পরিবার তেমন বিরোধিতা না করলেও পৃথিবীর চারভাইয়ের মধ্যে বড়ো তিনজন ঘোর বিরোধীতা করেছে। তারা আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা করতে নারাজ। মেজো ভাই ব্যক্তিগত দিক থেকেই প্রিয়কে পছন্দ করে না। যেহেতু তারা খালাতো ভাই তাই ছোটো থেকেই প্রিয়কে হাড়ে হাড়ে চেনে। তার ভাষ্যমতে প্রিয় শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট। অতিরিক্ত চালাক ছেলে। স্বার্থে আঘাত লাগলে কাউকে ছাড় দেয় না সে। যার ওপর রাগ হবে তার ওপর কীভাবে ঠান্ডা মেজাজে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করবে বোঝার উপায় নেই। সেজো ভাই সু’আদ আবার প্রিয়র প্রথম প্রেমের সাক্ষী। তারই এক বান্ধবীর সঙ্গে দু বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল প্রিয়র। তাই একমাত্র বোনকে এমন ছেলের কাছে দেবেনা। যার প্রাক্তন রয়েছে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর জেদের কাছে সকলকেই হার মানতে হয়েছিল৷ তবুও শেষ রক্ষা হলো না। সাইফুল্লাহ আর সু’আদের কুনীতির সঙ্গে পেরে ওঠল না প্রিয় পৃথিবী। বিয়েটা ভেঙেই ছাড়ল। তবুও হেরে যাওয়ার পাত্র প্রিয় নয়।

রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় যখন পৃথিবী অনেক সময় নিচ্ছিল প্রিয় বলল,

-” চিন্তা করিস না, বিয়েটা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। না হলে সামনের বছরই তোর ভাইদের ভাগ্না,ভাগ্নি গিফ্ট করে দেব। ”

পৃথিবী সে কথায় কান দিল না। ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতেই থাকল। প্রিয় জানে পৃথিবী থামবে না। তাই বলল,

-” সময় নষ্ট করিস না নামটা লিখে দে। বানান ভুলে গেছিস? মনে করিয়ে দেব? ”

এবার আরো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল পৃথিবী। পেছন থেকে প্রিয়র চাচাতো ভাই রুবেল হাসতে হাসতে বলল,

-” প্রিয় ভাই সিরিয়াস মোমেন্টেও তুমি পৃথি আপুরে ক্ষেপাবা। ”

প্রিয় এবার পৃথিবীর দিকে আরেকটু চেপে বসল। কানের কাছে মুখ নিয়ে নরম সুরে বলল,

-” তিনটা বছর অপেক্ষা করেছি পৃথি আজ যদি তুই আমার না হোস সারাজীবনের জন্য হারাবি আমাকে।”

কাঁদতে কাঁদতেই সাইন করে দিলো পৃথিবী। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সমস্ত ডকুমেন্টসের ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হলো সাদমানের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে। বিয়ে শেষে সর্বপ্রথম প্রিয় যে কাজটি করল তা হলো, সকলের সম্মুখে টোপ করে পৃথিবীর কপালে একটি এবং প্রথম চুমু খেল। লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল পৃথিবী। ছেলের কাণ্ড দেখে ইশতিয়াক রহমান হাসতে হাসতে গাড়িতে ওঠে বসলেন। প্রিয়র ভাই, বন্ধুরা বাইকে ওঠল গিয়ে৷ সকলের কাছেই বিষয় টা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল, বিয়ের দিন যার সাথে বিয়ে তাকে নিয়েই পালিয়ে যাওয়া, কাজি অফিসে ভাই,ব্রাদার্স নিয়ে বিয়ে করা আশ্চর্যজনকই বটে! তাই সকলে এক তালে বলতে শুরু করল,

-” হিপ হিপ হুররে, প্রিয় ভাই ইজ রকস। ”

পৃথিবীর কান্না কমে এসেছে। তবে চোখমুখে আতংকের ছাপ স্পষ্ট। প্রিয় ওর হাত ধরে আবার বাইকের কাছে নিয়ে গেল। সে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-” আমার খুব ভয় করছে। ”

প্রিয় মেজাজ কিছুটা খারাপ করে বলল,

-” জানি, নতুন করে জানানোর কিছু নেই। বাইকে ওঠ। ”

পুরো রাস্তায় কেউ কারো সঙ্গে কথা বলল না। মাঝেসাঝে প্রিয় শুধু মিররে নববধূতে দৃষ্টি বোলালো। আর মাত্র কয়েকঘন্টা তারপর তার পৃথিবীতে মত্ত হবে সে। আনমনে হেসে ওঠে হঠাৎ প্রিয় ডাকল,

-” পৃথি। ”

-” হু। ”

– ” আজকের রাতটার জন্য শুধুমাত্র আজকের রাতটার জন্য তিন বছরে একটা চুমুও তোকে আমি খাইনি৷ সমস্ত দুঃশ্চিতা কালকের জন্য তুলে রাখ প্লিজ। আজকের রাতটা কোনক্রমেই নষ্ট করিস না। ”

সহসা হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল পৃথিবীর। বাবা, ভাইদের টেনশন মাথা থেকে উড়ে গিয়ে স্মরণ হলো – কিছুক্ষণ পূর্বে ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে যেসব অনুভূতিতে তার হৃদয় সিক্ত হয়ে ছিল পুনরায় সেসবে বিভোর হয়ে গেল সে। ভয়, উত্তেজনায় বুকের ভিতরটা দুরুদুরু কাঁপতে শুরু করল। প্রিয়র কাঁধে রাখা হাতটি ধীরে ধীরে সরিয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিল প্রিয়৷ পৃথিবীও চোখমুখ খিঁচে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রিয় ‘ইয়াহু’ বলে চিল্লিয়ে ওঠল। পৃথিবী লজ্জায় মিইয়ে তার পিঠ জড়িয়ে পড়ে রইল।

ইশতিয়াক রহমান খোশমেজাজে ছেলে এবং ছেলে বউ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছালেন ঠিকি কিন্তু স্বস্তি নিয়ে বসতে পারলেন না। খবর এলো নওশাদ শেখ স্ট্রোক করেছেন। এ খবর শুনে ঠিক যেভাবে প্রিয় পৃথিবী চেয়ারম্যান বাড়িতে এসেছিল একই ভাবে ছুটল সদর হাসপাতালের দিকে। চার ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পৃথিবীকে বাবার মুখ দেখতে দেবে না। পৃথিবী পৌঁছানোর পাঁচ মিনিট পূর্বেই নওশাদ শেখের অবস্থা ভীষণ খারাপ হতে থাকে। সদর হাসপাতাল থেকে তাকে ট্রান্সফার করা হয় ঢাকা মেডিকেলে। অ্যাম্বুলেন্স অবদি আর নিতে পারেনি মারা গেছেন নওশাদ শেখ! নওশাদ শেখের মৃত্যুতে তার চার ছেলে অনেক বড়ো একটি সত্যি লুকিয়ে গেলেন। তা হলো তিনি পৃথিবীর বিয়ের কথা শোনার পরে নয় আগেই স্ট্রোক করেছেন৷ কিন্তু পৃথিবীকে জানানো হলো, প্রিয়র পাঠানো তাদের বিয়ের ডকুমেন্টস দেখেই স্ট্রোক করেন তাদের বাবা৷ একমাত্র মেয়ের করা এতবড়ো ভুল সহ্য করতে পারেননি তিনি৷ ফলাফল সরূপ তারা পাঁচ ভাইবোন আজ পিতৃহারা!

চলবে…ইনশাআল্লাহ

®জান্নাতুল নাঈমা

[কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ। তবে হ্যাঁ কোন ইউটিউবার গল্প নেবেন না৷ সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করে দিলাম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here