প্রিয় সুখ-৮
_______________
হালকা হলুদ দেয়ালে রাজার মত বসে থাকা খোদাই কৃত ঘড়িটা টং টং করে বেজে উঠেছে।কাঁটা এসে থেমেছে নয়টার মাঝে।নীহারিকা চোখ তুলে একবার তাকিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে উঠে বলল,’ মিতু আপু মামা কি বিয়ে করতে যাবে না?’
মিতু আপু তখন খুব মনোযোগ দিয়ে ছবি তুলছিলেন।নীহারিকার কথায় তার মনোযোগ নষ্ট হয়েছে।তাই কড়া গলায় বললেন,’ যাবে না কেন?অবশ্যই যাবে।তোর কেন মনে হচ্ছে যাবেন না?’
নীহারিকা ঘড়ির দিকে ইশারা করে বলল,’ দেখ কটা বাজে।রাত নটা।এখনো তাদের কারো পাত্তা নেই।এতসময় আগে রেডি করিয়ে রাখার মানে কি?’
‘ সবাই কারো জন্য যেন অপেক্ষা করছে।তোর এত তাড়া কিসের?তাড়া হলেও আমার হত যদি সেখানে স্বপ্নের মত কেউ থাকত।’
‘ আপু বিরক্ত লাগছে।যাওয়ার হলে যাবে।না যাওয়ার হলে বলে দিবে।এভাবে অপেক্ষা ভালো লাগে না।আই হেট ইট।’
‘ হইছে এত ঢং করতে হবে না।যাওয়ার জন্য লাফাচ্ছিস কেন?পছন্দের কেউ আছে ওই বাড়িতে।’
‘ মাথা খারাপ তোর?আমি তো ওই বাড়িতেই যাইনি এর আগে।’
মিতু আপু মুখ ফঁস করে শ্বাস নিয়ে বললেন,’ ওহ সেটাও ঠিক।চল ছবি তুলি।মন ভালো হয়ে যাবে।আচ্ছা আজ কি তোর বেশি মন খারাপ?’
নীহারিকা বলতে চেয়েছিল,’ হুম খুব মন খারাপ।আজ আকাশে মেঘ।বৃষ্টি নামি নামি।আমার কেমন যেন লাগছে।মনে হচ্ছে ঘাম হচ্ছে।বুক ধুকধুক করছে।প্রতিবৃষ্টিতেই মানুষটাকে ভেবে ভেবে আমার এমন হয়।’
কিন্তু সে বলল না।অদ্ভুত প্রশ্ন করে মিতু আপুকে চমকে দিল সে।জিজ্ঞেস করল,’আপু তুই কি কখনো প্রেম করেছিস?এটার টেস্ট কেমন বলতে পারবি?’
মিতু আপু অবাক হয়ে বললেন,’ তুই এখনো প্রেমের টেস্ট জানিস না?আবাল না কি?এত বড় মেয়ে প্রেমের টেস্ট জানিস না?মান ইজ্জতে পানি মারার ইচ্ছে মনে হয়।’
‘ আরে যে প্রশ্ন করেছি সেটা বল।’
‘ মাত্র সাত আট টা করেছি মনে হয়।ঠিক মনে করতে পারছি না।’
নীহারিকা বিস্ময়ে বুক চেপে বেরিয়ে এলো।এত গুলো?প্রেম হবে একটা।যাকে ভালোবাসা যাবে তার সাথেই হবে প্রেম।গভীর অনুভুতির লেনদেন।
সিঁড়ির উপরে বসেছিল নীহারিকা।তার পাশে কেউ এসে বসল মনে হচ্ছে।মাথা কাত করে ভ্রু উঁচিয়ে সে দেখল সেই হার্টের রোগী।জাওয়াদ হেসে বলল,’ তুমি একা একা বসে আছ কেন?’
রেগে যায় নীহারিকা।নিষেধ করার পরেও তুমিতে চলেএসেছে! ভারী অসভ্য তো।গলায় এক চামুচ রাগ মিশিয়ে নীহারিকা বলল,’ আপনি আমাকে তুমি করে ডাকার সাহস কোথায় পেলেন?’
তিনি আবার হাসলেন।শুধু হাসির মাধ্যমে নিজেকে প্রমান করতে চাইছেন।নীহারিকা বিরক্ত হল।জাওয়াদ বলল,’আমি পারমিশন নিয়েই তুমি বলে ডাকছি।দুর্সাহস আমি কমই করি।তোমার ব্যাপারে তো আরো কম।’
‘ আমি তো আপনাকে অনুমতি দিনি।তাহলে কোথায় পেলেন অনুমতি?’রাগে নীহারিকার গাল নড়ছে।জাওয়াদ অবাক হয়ে ভাবে,মেয়েটাকে তুমি করে ডাকায় এত রাগ করছে কেন?এটা কি পাপ?তুমি করে ডাকা যায় না?
মৃদূ বাতাসে নীহারিকার দম ভারী হয়ে আসে।সে উঠে দাঁড়ায়।জাওয়াদ পকেট থেকে দামি ফোন বের করে বলল,’এখনি তুমি বলে ডাকার সেই অনুমতি দেওয়া ব্যক্তির সাথে তোমার কথা বলাচ্ছি।দাঁড়াও।তাও রেগে আগুন হবে না প্লিজ।’
কাকে যেন ফোন দিয়ে জাওয়াদ নীহারিকার দিকে এগিয়ে দেয়।একপ্রকার রাগ নিয়ে ফোন কানে নেয় সে।ঝাড়ি মেরে বলে উঠে,’ আপনার সাহস তো কম না আপনি আমাকে তুমি বলে ডাকার অনুমতি দিয়েছেন উনাকে?কেন?কে হন আপনি?এসব সাহস আবার দেখালে ভালো হবে না।’
ওপাশ থেকে হাসির কন্ঠ আসে।নীহারিকা আদো আদো ধরতে পেরে নিচু গলায় উচ্চারণ করল,’বাবা তুমি?’
নাফিস উদ্দিন হেসে নিলেন অনেক সময় নিয়ে।মনে হচ্ছে উনি খুব খুশি।আনন্দিত গলায় তিনি বললেন,’ শুনো ও জাওয়াদ।আমার বন্ধুর ছেলে।ওই যে তোমার মেজবা আংকেল আছে না উনার ছেলে।পেশায় নষ্ট হার্ট মেরামত কারি।’
নীহারিকা একবার চোখ তুলে দেখে নেয়।তারপর সরে আসে কিছুটা দূরে।কাঠিন্য ভরীয়ে সে বলল,’ এসব কি বাবা তুমি উনার বায়োডাটা আমাকে কেন দিচ্ছ?আগের বার টাকলা ডাক্তার নিয়ে এসে মন ভরেনি তোমার?আশ্চর্য!’
একপ্রকার রেগে গেল নীহারিকা।ডাক্তার পেশা তার সবচেয়ে অপছন্দের।এক ডাক্তারের জন্য সে পালিয়েছে।দেখা হয়েছে আর এক পাগলের ডাক্তারের সাথে।এখন আবার ডাক্তার?জীবনটা কি ডাক্তারময় তার!ওহ্
বাবা খুব সুরেলা কন্ঠে বললেন,’ আম্মা তুমি কি রাগ করছ?আবার পালিয়ে যাবে ভাবছ?’
‘ একদম তুমি করে বলবে না বাবা।আমি জানি তোমার মুড খুব ভালো তাই এমন সুন্দর করে কথা বলছ।আমার কিন্তু ভালো নেই।’
পিছনে ফিরে তাকায় নীহারিকা।দাঁড়িয়ে তার পিছনের দিকে এক মনে কি যেন দেখছে।নীহারিকা ভাবে,পিছনে কি হিরে ঝুলিয়েছে সে?আশ্চর্য!বাবাও সাই দিচ্ছে?এমনটা তো তার বাবা কখনো করে না।কোন ছেলেকে তার আশেপাশেই ঘেঁষতে দেয় না।এখন কি না নাম পরিচয় বলছে?নীহারিকা কৌতুহলি কন্ঠে জানতে চাইল,’ বাবা কাহিনী কি?’
নাফিস উদ্দীন শব্দ করে হাসলেন।সেই হাসি উৎসবের মত শুনালো নীহারিকার কানে।একটু থেমে বেশ উৎফুল্ল মনে তিনি বললেন,’ তেমন কাহিনী নেই।প্রথমত আমি তোমার জন্য কোন টাকলা ছেলে পছন্দ করিনি।এসব তোমার ভুল ধারণা।দ্বিতীয়ত জাওয়াদ আমার বন্ধুর ছেলে।বন্ধু আমার আফসোস করে বলেছিল তার ছেলে কখন গ্রামের বিয়ে দেখেনি।তাই আমি তোমার মামার বিয়েতে পাঠিয়ে দিয়েছি।ছেলেটা একটু দেখুক।শুনো ওর একটু খেয়াল রাখবে।বেশি আশেপাশে যাওয়ার দরকার নেই।দূরে থেকে কথা বললেই হবে।’
বেশ রেগে নীহারিকা গলা ছেড়ে বলল,’ আমি পারবো না বাবা।’
তিনি উল্টো বললেন,’ বেশি পারতে হবে না।অল্প হলেই চলবে।আমি কিন্তু তোমার নানুর বাড়ির অনেক তারিফ করেছি।তুমি কি চাও সে তারিফ খোঁয়া যাক?তাহলে কিন্তু তোমার আম্মুরই সম্মান যাবে।খুব সেনসিটিভ সে।হার্টের ডাক্তার তো।খুব যত্ন করতে বলবে তোমার আম্মুকে।শুনো..
বাবার শেষের কন্ঠ খুব শক্ত শুনালো।নীহারিকা বুঝতে পেরেছে এই ছেলে বাবার খুব প্রিয় কেউ।তা না হলে বাবা এত পাত্তা দিত না।খুব রেগে আগুন হয়ে সে ফোন কেটে দেয়।জাওয়াদ নীহারিকাকে নিজের কাছে আসতে দেখে মৃদূ কন্ঠে বলল,’ কথা হয়েছে?’
একটু ভেবে নীহারিকা বলল,’ আপনার না হার্টের প্রবলেম বলেছিলেন?’
বেশ হাসি খুশি হয়ে জাওয়াদ বলল,’ তা তো হয়েছেই।এই যে বুকের এ পাশেই।’সে বাম পাশে হাত রাখল।নীহারিকা রাগ সামলে বলল,’ তাহলে হসপিটালে চলে যান।আপনি নিজেই তো ডাক্তার।আর এখানে থাকলে একদম বিরক্ত করবেন না।’
‘ কেন বিরক্ত করলে কি হবে?এভাবে তাকাচ্ছ কেন?’
নীহারিকার ইচ্ছে করছে ফোনটা ছুড়ে দিতে।উপরে তুলে সে ছুড়েও দিতে নিল।আর রাগে গজগজ করতে করতে বলল,’আপনি আমার বাবাকে কিভাবে ইমপ্রেস করেছেন??’
জাওয়াদের তেমন গায়ে লাগলো না।বেশ হেসে সে বলল,’ ফোন ভাঙ্গবে?ঠিক আছে ভেঙ্গে দেও।অলরেডি আমাকেই ভেঙ্গে দিয়েছ।এটা তো সামান্য ফোন।’
‘ আপনাকে আমি আমার আশেপাশে দেখতে চাই না।’
ফোনটা সিঁড়ির উপরে রেখে নীহারিকা হেঁটে ঘরের দিকে যাওয়া শুরু করে।হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে বলল,’ আপনি করে ডাকবেন।তুমি করে ডাকলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।’
জাওয়াদ হেসে বলল,’ আপনি তো দেখছি পুরাই আগুন।আপনার আশেপাশের মানুষ গুলোকে কি এভাবেই জ্বালিয়ে দেন?আমার মত?’
শেষের কথা শুনার আগেই নীহারিকা চলে গিয়েছে।
_____________
বাতাস বেড়ে গিয়েছে।জানালা গুলো ধপধপ শব্দ করতে শুরু করেছে।অন্ধকার আকাশ জুড়ে কালো ছায়া আত্নার মত ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি নামিয়ে দিল।নীহারিকা জানালার পাশে দাঁড়ালো।বৃষ্টি ছুঁয়ে সে দেখতে শুরু করে। ইশ কি সুন্দর!প্রতি ফোটা ছোঁয়ায় সে কারোর অদ্ভুত স্পর্শ অনুভব করে।মা ছুটে আসে।উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে।গায়ের শাড়ি এলোমেলো হয়ে পড়েছে।আঁচল বিশাল লম্বা করে নিচে ঝুঁলছে।চুল গুলো কোন মতে হাত খোঁপা করে তিনি যেন ছুটতে ব্যস্ত।এত খুশি কেন আজ তিনি?নীহারিকা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।মায়ের কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।চোখ গুলো খুশিতে চকচক করছে।হিরের মত।ঠোঁটে কি মিষ্টি হাসি।অনেক অনেক বছর পরে যেন তিনি হাসছে।কারণ কি?উৎস কি?নীহারিকা ডান হাতে মায়ের কপালের ঘাম মুছে দিতে শুরু করলো।শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিল।উত্তেজনায় তার মায়ের ঠোঁট কাঁপছে।অনেক অবাক হয়ে সে বলল,’ কি হয়েছে মা।তুমি এমন করছ কেন?আমাকে বলো?কি হয়েছে?’
আফিয়া বিলকিস মেয়ের শরীরে অনেকটা হেলে বলল,’ বুবু আসছে।আমার বুবু।’
বিস্মৃত চোখে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় নীহারিকা।বুবু বলে সবাই ডাকে তার বড় খালামনীকে।তিনি তো বাড়িতেই আছেন।আবার বুবু আসলো কই থেকে?নীহারিকা লক্ষ করছে সবাই কেমন ছুটা ছুটি করছে।খালামনী প্রায় কাঁদছে।মামা বিয়ের পাঞ্জাবীর হাতা খুব বাজে ভাবে ভাঁজ করছেন।নানু বসে আছেন শুধু উদাসীন হয়ে।রাসেল মামা এসে বললেন,’ বুবু চল।উনারা গেটের কাছে চলে এসেছে।আমাদের তাদের কাছে যাওয়া উচিৎ।অনেক বছরের ব্যাপার।পরিবর্তন বুঝবে না।’
‘ কে মামা?’ আগ্রহ দেখিয়ে বলল নীহারিকা।মামা হাসলেন।চাপা একটা কষ্ট প্রকাশ পেল।হঠাৎ সবার এত কষ্ট কেন হচ্ছে?অবাক সে।মামা নীহারিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’ তোর বড় খালামনী এসেছে।অনেক বছর পরে।অনেক বছর বুঝলি।’
চমকে উঠে নীহারিকা।চোখ মুখ কুঁচকে সে এমন ভাবে তাকায় যেন তেঁতো কিছু খেয়েছে।বিড়বিড় করে নিজে নিজে বলল,’ খালামনী তো একটাই।বড় আসলো কই থেকে?’
একটা হট্টগোল পড়ে গেল।ঝুম বৃষ্টি বাহিরে।ছাতা ছাড়াই সবাই ছুটে বাহিরে চলে যায়।নীহারিকা পা টিপে বাহিরে এসে অবাক হয়ে দেখে পুরো গ্রাম যেন তাদের বাড়ির গেটে ভীর জমিয়েছে।কিছুক্ষণ সে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর ধীরে ধীরে ভিজেই হেঁটে যায়।নানুকে সে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো।ছাতায় আর সে ঢুকেনি।নানু একটু এলোমেলো হাঁটছে।জামা ভিঁজে একাকার।গেট দূরে একটু।বাড়ি ছেড়ে হাঁটতে হয় অনেক।নীহারিকা ফিসফিস গলায় বলল,’নানুমনী এটা আবার তোমার কোন মেয়ে?যাকে জন্ম থেকে চিনি না?’
নানু গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে লাগল।বৃষ্টির পানিতে সেই কান্না ভারী আর্তনাদ শুনালো।চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইলো নীহারিকা।একটু পরে সে আবার জিজ্ঞেস করে,’কান্না থামিয়ে বলবে?’
‘ তোর বড় খালা হইছে গিয়া সে।আজ ৩০ বছর পরে আইতাছে।বুঝতে পারছস।’
নীহারিকা প্রশ্ন করতে চেয়েছিল ৩০বছর তিনি কোথায় ছিলেন,কেন দূরে ছিলেন,তারা কেউ জানে না কেন তার কথা,কি হয়েছিল?প্রশ্ন করার আগে আগেই তারা গেটের কাছে চলে যায়।কান্নার রোল পড়েছে কাউকে জড়িয়ে।নীহারিকা উঁচু নিচু হয়ে দেখতে চাইলো।পারলো না।এত ভীর!সে জীবনে কখনো দেখেনি।এটা তার আপন খালামনী?মায়ের আপন বোন?এক মায়ের পেটের?আশ্চর্য তারা জানতোই না?মিতু আপু কাঁদছে।নীহারিকা তাজ্জব হওয়া গলায় বলল,’ আপু তুই কাঁদছিস কেন?তাও এভাবে?’
‘ দেখ আম্মাও কাঁদছে।ছোট আন্টিও কাঁদছে।সবাই কাঁদছে।আমাদেরও কাঁদা উঁচিত।’
অবাক হয়ে নীহারিকা কয়েক মুহূর্ত শুধু তাকিয়ে রইলো।চোখ ঘুরিয়ে কয়েকবার সামনের দৃশ্য দেখে নিলো।আবার মিতু আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,’ সবাই কাঁদলে তোমার আমারও কাঁদতে হবে?’
‘ অবশ্যই হবে।এটাই নিয়ম।আরে কবিতা পড়িসনি।সকলের সুখে হাসবো মোরা কাঁদবো সকলের দুঃখে।’
‘ কবিতার লাইন ভুল বলেছ আপু।এটা হবে,সবার সুখে হাসব আমি,কাঁদব সবার দুঃখে।’
আপু খুব বিরক্ত হয়ে চক করে শব্দ করলেন।বললেন,’ কাঁদনা।ভুল ধরছিস কেন?কাঁদ।’
নীহারিকার কান্না আসছে না।সে কাঁদতেও পারলো না।উঁকিঝুঁকি দিয়ে সে খুব সুন্দর একটি মেয়েকে আবিষ্কার করে নিলো।কি সুন্দর গোল মুখ।নাকটা একটু চেপ্টা।তাতে কি চোখ গুলো সুন্দর।আরে এই চোখ!নীহারিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।বৃষ্টি বাড়তে শুরু করলো।মানুষ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলো।মামা চিৎকার করে বলে উঠল,’ বুবু তুই না আসলে বিয়ে করবো না বলেছি।এবার তো তুই এসেছিস বিয়ে করতে হবে তো।’
নীহারিকা দেখলো আবার কেউ চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ আরে সবাই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?ভিজে যাচ্ছে তো ছেলে মেয়েগুলো।চল ভিতরে নিয়ে চল।’
সবাই বাড়ি মুখি হলো।নীহারিকা উৎসুক জনগনের মত তাকিয়ে রইলো।চোখ বড় বড় করে।হাত পা শক্ত করে।চোখে পড়ে এক নারী।মায়ের পাশে।মায়ের মত অনেকটা।পাশে তাকিয়ে নীহারিকা আঁৎকে উঠে দু’পা পিছিয়ে যায়।বাড়ি খায় কারো শক্ত বুকের সাথে।মাথার ক্লিপ মনে হয় ভেঙ্গে গিয়েছে।তার ভ্রুক্ষেপ নেই।অবিশ্বাস্য চক্ষু তার।গমগমিয়ে আরো অনেকে বেরিয়ে আসে।নীহারিকা আরো চমকায়িত চোখে তাকায়।সবাইকে সে চিনতে পারছে।হাত কাঁপছে তার।বুক চিনচিন করে উঠছে।মাথা করছে ঝিঁমঝিঁম।সব কেমন অন্ধকার দেখছে।এই রাতের চেয়েও অন্ধকার।বৃষ্টির মাঝেও সে ঘামছে যেন।শরীর কাঁপতে কাঁপতে সে পড়ে যেতে নেয়।পিছন থেকে ধরে কেউ একজন।নীহারিকা একবার চোখ উপরে তুলে তাকিয়ে খুবই চেঁচিয়ে উঠে ডাকল,’ প্রিয়ম,রাসেল মামা আমাকে ধরুন।’
প্রিয়ম বোনের হাত ধরে।রাসেল মামা সব ফেলে ছুটে এগিয়ে আসে।দু’হাতে ধরে নীহারিকাকে।অবাক হওয়া গলায় বলেন,’নীহু কি হয়েছে তোর?শরীর খারাপ করছে?ওহ তুই তো বৃষ্টিতে ভিঁজতে পারিস না।সেটা কেউ খেয়াল রাখলো না কেন? ফাহাদ ধর।’
নীহারিকার মা এগিয়ে আসে।ভয়াত্নক কন্ঠে বলে উঠেন,’ কি হয়েছে তোর?এমন কাঁপছিস কেন?’
নীহারিকা আবেগী হয়ে হেসে ফেলল।কেউ বুঝলো না এর মানে।তাকে ধরে কোন মতে সোফায় বসিয়ে দেওয়া হলো।নিজের চুল ঝাড়তে ঝাড়তে কেউ একজন কর্কশ গলায় বলে উঠল,’ আপনাদের বাড়িতে মেহমান আসলে বুঝি বাড়ির মানুষ সেন্সলেস হয়ে পড়ে?’
সবাই তার দিকে তাকাল।নীহারিকা বাদে কেউ চিনতে পারল না।কামরুন শামা হেসে বললেন,’ আমার ছেলে।তাযিন শাহামাত।আর ও হচ্ছে মেয়ে নাওশিন আনজুম।এই হচ্ছে তোর মামা।এই খালামনী।আর উনি হবে তোদের ছোট আন্টি।’
দু’জনই খুব বিনোয়ী ভাবে সালাম করলো।তাক লাগানো চোখে তাকিয়ে আছে ছোটরা।হুট করে কথা থেকে তাদের খালা উদয় হয়েছে?সাথে আবার খালাত ভাই বোনও আছে।হঠাৎ অতর্কিতভাবে এই ঘটনাটা নিতে পারছে না কারো মস্তিষ্ক!কি অদ্ভুত!নীহারিকার সামনের সোফায় বসলো তাযিন।পানি খেতে নিয়ে মুখ ফঁসকে পড়লো নীহারিকার।বেশ অবাক হয়েই বলল,’ আপনার নাম তো বিমুগ্ধ।তাযিন কিভাবে হলো?’
বাড়ি ভর্তি সবাই চরম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নীহারিকার দিকে।নীহারিকার চোখ বিমুগ্ধের চেহারার দিকে।বিমুগ্ধ চোখ ছোট করে মুখে গাম্ভীর্য টেনে বলল,’ আপনি কিভাবে জানলেন?’
আকাশ থেকে পড়লো নীহারিকা।মিতু ফাবিহা বিস্মৃত গলায় বলল,’ এটাই বিমুগ্ধ??’
আফিয়া বিলকিস বললেন,’ তোরা কিভাবে জানিস?’
আঙ্গুল গুলো নীহারিকার দিকে।নীহারিকা শুকনো ঢোক গিলে ম্লান সুরে বলল,’ আমি উনাকে চিনি।’
বিমুগ্ধ বেশ আয়েশ করে বসে বলল,’ আপনি আমাকে চিনেন?কিভাবে?’
নীহারিকা উত্তেজিত গলায় বলল,’ আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’
‘ না পাড়ছি না।আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।আপনি কি দেখেছেন?’
নীহারিকা প্রবল আক্রশে ফেঁটে পড়ে।বলে কি না চিনে না?চোখ গরম করে সে বলল,’ভালো করে দেখে বলুন।উদ্ভটের মত কথা বলবেন না।’
সক্ট হওয়ার একটা ছাপ মুখে নিয়ে বিমুগ্ধ বলল,’আমার চোখ ভুল বলে না।স্মৃতি শক্তি প্রখর আমার।ভুলে যাওয়ার মানুষ নই আমি।’
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো নীহারিকা।স্থির দৃষ্টি।মস্তিষ্ক উলট পালট হয়ে যাচ্ছে যেন।মানুষটা তাকে চিনে না?কেনো এমন বলছে উনি?সে তো ঠিকই চিনতে পারছে।বাড়িতে ঢুকে বাকিরা।নীহারিকা অবাক হয়ে সবাইকে দেখে।কেউ যেন তাকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হচ্ছে না।খুব স্বাভাবিক কথা বলছে।নীহারিকা উঠে এসে বলল,’ তিশা আপু আপনি কি আমাকে চিনতে পারচ্ছেন?’
মেয়েটা বেশ অবাক হলো প্রথমে।তারপর হেসে বলল,’ স্যরি কে আপনি?অবশ্যই পরিচিত হলেই চিনে নিবো।’
হতবাক চোখে তাকাল নীহারিকা।
‘ আমি নীহারিকা।চিনতে পারছেন ওই যে ট্রেন?রাস্তা?হ..’
‘ আমি আগে কখনো আপনাকে দেখিনি।আরে বিমুগ্ধ দেখ এই মেয়ে কি বলে?তোর কি হয় ও??ও তুই নিজেই তো জানিস না।আজই তো সবার সাথে দেখা।’বলেই সবাই হাসা হাসি করতে শুরু করল।নীহারিকা পর পর অনেক বার প্রশ্ন করে।সবাই পুরো দমে না বলে দেয়।কেউ চিনতেই পারছে না তাকে। নিষ্কম্প স্থির চোখে সে তাকিয়ে থাকে।নিস্তব্ধতায় কাঁটে কিছু মুহূর্ত।বেশ আড়ষ্ট হয়ে আসা কন্ঠে সে বলল,’ একদমই চিনতে পারছেন না?’বিমুগ্ধ চোখ কটমট করে তাকাল।চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,আমি সত্যি আপনাকে চিনতে পারছি না।’
নীহারিকা অবাক হয়ে দেখল রাগে বিমুগ্ধের মুখের পাশ কাঁপছে থরথর করে।রেগে যাচ্ছে?কি আশ্চর্য এই লোক তো রাগে না? ধাতস্থ হয়ে নীহারিকা সোফায় বসে থাকে।তার মাথা কেমন যেন ঘুরছে।সে স্বপ্নে রয়েছে না স্বপ্ন তার সাথে রয়েছে।নীহারিকা দেখল তিশা আছে,অর্পন আছে,মুহিতা মুহিত,শান্ত সবাই আছে।সাথে অন্য একটি মেয়ে।একে বাদে বাকি সবাই তার পরিচিত।খুব পরিচিত।মা কাছে এসে নীহারিকাকে আদরী গলায় বললেন,’শরীর খারাপ করছে?কিছু খাবি?মাথা ব্যথা করছে কি?মনে হয় করছে।তাই তো কি সব বলছিস?’
‘ মা তুমি বিশ্বাস করো এদের সবাইকে আমি চিনি।আরে মা না চিনলে নাম জানবো কিভাবে?’
আফিয়া বিলকিসের মাথায় বাড়ি খায়।ঠিকই তো না চিনলে নাম জানবে কিভাবে?
তিনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন।কিন্তু সময়ের কারণে পারেনি।সবাই ছুটাছুটি করছে।এদিক সেদিক যাচ্ছে।বুবুর সাথে গল্প করছে।কাঁদছে।নীহারিকার প্রতি যেন মনোযোগই নেই।জাওয়াদ ঘরে ঢুকলেন কাক ভিজা হয়ে।তাকে দেখেই রাসেল মামা ব্যস্ত হয়ে বললেন,’ ইশ দোলাভাই কত করে বলেছে তোমার যত্ন নিতে।আমি ভুলেই গিয়েছি।আসলে অনেক বছর পরে বোনকে পেয়েছিত।তুমি কিছু মনে করো না।আমার সাথে চলো।’
সবাই ব্যস্ত হয়ে কাজে লেগে পড়েছে।মিতু আপু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন,’ তোর ভুল হচ্ছে রে নীহু ভুল।এই ছেলেকে দেখ কেমন রাগী রাগী গম্ভীর হয়ে বসে আছে।যেন সে মহা কি।এই লোক তো হাসতেই জানে না।অন্যদিকে বিমুগ্ধ না কি শুধু হাসতো।আমি না দেখেই ধরে নিয়েছি।তুই পারলি না?তোর মাথা মনে হয় গেছে।এই এই তুই প্রেমে পড়লি না তো?ওই বিমুগ্ধের?আসলে প্রেমে পড়লে সবাইকে পছন্দের মানুষের মত দেখতে লাগে।তোরও মনে হয় তাই হয়েছে রে।’
নীহারিকা জবাব দিলো না।বিমুগ্ধের দিকে সে নির্নিমেষ চেয়ে আছে।চোখ শক্ত করে।রাগী কন্ঠে নীহারিকা এবার বলল,’ আপনি আমাকে সত্যি চিনতে পারছেন না?’
বিমুগ্ধ চোখ তুলে তাকাল।পাত্তাই দিল না এমন ভাব নিয়ে আবার ফোনের স্কিনে চোখ রাখে।নীহারিকা কোমল গলায় বলে,’ আপনি আমার খালামনীর ছেলে?আমাকে বললেন না কেন?আমি তো ছবি দেখেই বলেছিলাম চিনা চিনা লাগে।ছবি হ্যাঁ ছবির কথা মনে আছে?আপনার ফোনের ছবি?’
বিমুগ্ধ বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,’ আপনি বেশি কথা বলেন।এত ছোট মেয়ে এত বকবক করে?ডিজগাষ্টিং।
নীহারিকা অসহায় গলায় বলল,’আপনি কি সত্যি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না?দু’বছর আগেই তো দেখা হয়েছিল।ভুলে গেলেন কিভাবে?’
তিশার দিকে তাকিয়ে বলল,’ আপু আপনি তো আমার চেহারাও দেখেছেন।আপনি ভুললেন কিভাবে?বাকিরা না হয় দেখেনি।আপনি তো দেখেছেন।’
তিশা আরো গভীর ভাবে দেখতে লাগলো।না সে চিনতে পারছে না।মৃদূ হাসতে চেয়ে বলল,’ স্যরি গো আমি সত্যি চিনি না।তা তোমার নাম কি?’
নীহারিকা বলল না।ছুড়ে দিল কুশন।জাওয়াদ এসে সবাইকে সোফার রুমে দেখে।বিমুগ্ধের দিকে তাকিয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠে বলল,’ তুমি এখানে??’
বিমুগ্ধ চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,’আপনি এখানে কি করছেন?আপনিও কি আমার আত্নীয় হন?’
‘ আমি এবাড়ির কিছু নই।তুমি নীহারিকাদের কি হও?’
বিমুগ্ধ প্রশ্ন করে জানতে চাইলো,’ নীহারিকা কে?’
জাওয়াদ হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,’ও।’
‘ জানি না।আমি আজ প্রথম দেখেছি।তাই বুঝতে পারছি না কি হয় উনি?’
বিমুগ্ধ কথাটা বলে নীহারিকার দিকে কোণা চোখে তাকাল।হতভম্ভ নীহারিকা।এরাও একে অপরকে চিনে?অথচ তাকেই চিনল না?পৃথিবী এত ছোট কেন?সবাই কোন না কোন ভাবে জুড়ে যাচ্ছে কেন?জাওয়াদ বেছে বেছে নীহারিকার পাশেই বসলো।যদিও একটু দূরে।নীহারিকা এবার পুরো দমে রেগে বলল,’ আপনি ফাইজলামু পেয়েছন?আমাকে চিনতে পারছেন না?আমাকে?’
সবাই অবাক হয়ে আবার নীহারিকার দিকে তাকায়।রাগে রিঁ রিঁ করছে নীহারিকার শরীর।গলা কাঁপিয়ে সে বলল,’চেহারা দেখেও বুঝতে পারছে না?’মুখের উপরে আঙ্গুল ঘুরালো সে।বিমুগ্ধ চমকের চোখে তাকাল।মেয়েটা রেগে যাচ্ছে কেন?শান্ত চোখে তাকিয়ে সে কন্ঠ নরম করে বলল,’আপনি বসুন তো।খুব রেগে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে?আমি যদি না চিনে থাকি কিভাবে বলবো চিনি?’বিমুগ্ধ উঠে গেল।সাথে গেল তার দলবল।জাওয়াদ হেসে উঠে সোফায় হেলান দিয়ে বলল,’ আমাকে তোমার চিনার কথা।অথচ আমাকে চিনলে না।অন্যদিকে মিষ্টার তাযিন বলছে তোমাকে চিনে না।তুমি উঠে পড়ে লেগেছ চিনিয়ে দিতে।সমস্যা কি?’
জবাব না দিয়ে নীহারিকা চোখ রাঙ্গীয়ে তাকাল।তারপর উঠে হন হন করে চলে গেল ভিতরে।ঢুকে সে দেখল বিমুগ্ধ সবার সাথে বসে পরিচিত হচ্ছে।চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে নীহারিকা ভাবছে সে কি সত্যি ভুল দেখছে?সব ভুল?এই তো হাসছে।নীহারিকা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে মিল পাচ্ছে না।এই ছেলে হাসে মুচকি।নম্র ভাবে।কথা বলে খুবই ভদ্র সুরে।হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাচ্ছে।গম্ভীর হয়ে বসে পড়ছে।কম খুব কম কথা বলছে।একুই দেখতে মানুষ হয়ে এত ভিন্ন কেন?নীহারিকার চোখে চোখ পড়ে।কেঁপে উঠে ভিতরের অস্তিত্ব।কিছু আছে!হ্যাঁ কিছু তো আছেই।চোখ তো আর মিথ্যা বলে না।দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় বিমুগ্ধ।নীহারিকা ভেবে পাচ্ছে না কি হচ্ছে তার সাথে।কি হবে সামনে?এত পরিচিত মানুষকে চিনতে সে ভুল করবে?মারাত্নক গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলল,’আপনি সত্যি আমাকে চিনেন?কেন এমন মনে হচ্ছে আপনার?কেন?’
বিস্মৃত চোখে নীহারিকা তাকিয়ে রইলো বিমুগ্ধের দিকে।মানুষটা সত্যি তাকে চিনতে পারছে না।একটুও পারছে না।সামান্যও কি পারছে না?কি একটা অদ্ভুত মানুষ এই ছেলে।চিনা যাচ্ছে না।ধরতে পারছে না।এত অদ্ভুতুড়ে কেন মানুষটা?
‘ আমার এই জীবনে নীহারিকা নামক কাউকে আমি চিনি না।আপনাকে কিভাবে চিনবো?
____________________
জাওয়াদ নামটা আমি আগের পর্বে জওয়াদ লিখেছি।দুঃখিত।
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..