প্রিয় সুখ-৭

0
676

প্রিয় সুখ-৭
_______________
ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে একা রিক্সায় বসে নীহারিকা ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতে তার বাড়ি চলে এসেছে।নীল গ্রিলের গেটের সামনে আসতেই সে বলল,’চাচা এখানে থামিয়ে দিন।আর আপনি একটু অপেক্ষা করুন।আমি ভেতর থেকে টাকা নিয়ে আসি।’
দ্রুত পা ফেলে গেটে শব্দ করতেই নীহারিকার বুক কেঁপে উঠলো।ভয়ে শিউরে উঠে সে।না জানি সবাই কি করছে?এক বুক নিঃশ্বাস উড়িয়ে সে বাতাস থেকে একটু সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে ভিতরে পা রাখে।সাথে সাথে তার মনে হলো সিনেমার মত শুকনো পাতা এসে পড়ল তার পায়ে,বোরখার উপরে।মাথার উপরে।কাঁপা কাঁপা পায়ে এগোতে গিয়ে মনে পড়ে,বিমুগ্ধ বলেছিল হুট করে ঢুকে পড়তে।তাই সে অপেক্ষা না করে সাহস হৃৎপিণ্ডে ভর্তি করে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির দিকে।সামনে বিশাল খোলা জায়গা।বাবা এই জায়গা দিয় কেন যেন হাঁটতেও চায় না।নীহারিকা ভাবলো কলিং বেল চাপবে।কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না।সে সহজেই ভিতরে ডুকে পড়তে পারলো।সামনে তাকিয়ে খুব বিচলিত হয়ে সে দেখলো,সত্যি তার বাবা কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে উদাসীন দৃষ্টি উপরের দেয়ালে ফেলে বসে আছেন।চোখ বন্ধ।চোখের ভারী চশমাটা হাতের দু’আঙ্গুলের ভাঁজে নিয়ে কপালে এক হাত রেখে বসে আছেন তিনি।একপ্রকার ছুঁটে গিয়ে নীহারিকা তার বাবাকে চমকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে।সে কখনো বাবার বুক পেকেটে হাত দেয়নি।এখন কিভাবে দিবে?বিস্ফারিত চোখে উপর থেকে ঝুঁকে তাকান নাফিস উদ্দীন।হঠাৎ তিনি অনুভব করতে পারেন তার সাদা ফতুয়ার একপাশ জলে ভিঁজে যাচ্ছে।ভালো করে লক্ষ করে বুঝতে পারলেন এই নারী তার প্রিয় কন্যা।যে হারানো ছিলো কাল থেকে।অস্ফুট স্বরে তিনি উচ্চারণ করেন,’ নীহু আম্মা!’
মাথা তুললো না নীহারিকা।বাবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে শুধু বলল,’ দুঃখিত বাবা।আমি স্যরি।বিয়ে করতে চাইনি বলে পালিয়েছি।কিন্তু দুনিয়াটা খুব কঠিন তোমাকে ছাড়া।অনেক অনেক বেশিই কষ্ট দায়ক।আমি থাকতে পারিনি।টিকতে পারিনি।’
কি বলবেন,কি প্রকাশ করবেন,না কি রাগে ফেঁটে পড়বেন তিনি বুঝতে পারলেন না।সেই মুহূর্তে শুধু মনে হচ্ছিলো ‘পৃথিবী উল্টেপাল্টে যাক,তবুও আমার মেয়ে আমার থাক।’
দু’হাতে মেয়েকে তিনি শিশু বাচ্চার মত জড়িয়ে বলল,’ বললেই হতো।বিয়ে দিতাম না।কেনো না বলে চলে গেলি আম্মা?আমি তো একটুর জন্য দুনিয়া হারাতে বসেছিলাম?’
দু’জনে আর কথা বললো না।অনেক সময় নিয়ে জড়িয়ে বসে রইলো।ভিতর থেকে ভাঙ্গা গলায় এক মহিলা এসে দাঁড়ালো।তার তো নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস হচ্ছে না।তার মেয়ে যে!আবার তিনি কেঁদে উঠলেন।গগনবিদারী চিৎকার করে তিনি কাঁদছেন।গত একদিনে তার গলার অবস্থা খুবই খারাপ।এই চিৎকারে মনে হচ্ছে গলার সব রগ ছিড়ে যাবে।গেলে যাক!তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন না।একে একে বেড়িয়ে আসলো প্রিয়ম,পরিবারের বাকি সবাই।মেহমানরা তো এখনো আছে?কেউ কিছু বললো না নীহারিকাকে।সে ভেবেছিলো খুব মার না হলেও বকা খাবেই।কিন্তু সবাই এমন ভাবে তাকে গভীর আবেশে জড়িয়ে নিয়েছে যে তার মনটাকে অনুশোচনা নামক যন্ত্র না,আরো পাকড়াও করে বসে।সবাই যেভাবে কাঁদলো খুবই খারাপ লাগলো তার।একটা সময় চোখের পানি মুছতে মুছতে নাফিস উদ্দীন হেসে উঠে বললেন,’বিয়ে করতে না চাইলে করবি না।শেষ কথা।যখন করতে ইচ্ছে হবে করবি।বল কত সময় চাই?’
নীহারিকা বলতে চাইলো সারা জীবন।কিন্তু মুখে শুধু বলল,’ তোমার যখন মনে হবে আমি তখনই বিয়ে করবো বাবা।সামান্য একটা বিয়েতো তোমাদের জন্য করতেই পারি।মা আমি কালকে কিছুই খেতে পারিনি তেমন।খুব খিদে পেয়েছে খেতে দিবে?’
শেষের কথাটা যেন তার বাবা মায়ের কলিজায় গিয়ে বিঁধল।তাদের এক মাত্র আদরের কন্যা কাল থেকে না খেয়ে আছে?ইশ কি কষ্ট!বুকটা বোধ হয় ছিড়ে যাবে।আফিয়া বিলকিস মেয়েকে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন।চোখে রাগ নিয়ে নাফিস উদ্দীন বললেন,’ খাবার চেয়েছে। কান্না না।যাও আগে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো।তারপর ওর হিসাব হবে।’
নীহারিকা একটুও চমকালো না।প্রতিবারই কিছু ভুল করলে বাবা তাকে রুমে নিয়ে হিসাব নিকাশ করে।খুবই অদ্ভুত ধরনের হিসার।দরজা জানালা বন্ধ করে বসিয়ে রাখে তার সামনে।বাবার সামনে বসা মানে নীহারিকার ঘাম গলা কাধ বেয়ে গড়গড় করে গড়িয়ে পড়া ঘামের জন্ম।এছাড়া আর কিছুই না।তবুও তার বড্ড ভয় করে।প্রিয়ম এসে বোনকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।কাঁদছে!নীহারিকা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’ ওই লম্বু এমন ফ্যাঁসফ্যাঁস করে কাঁদছিস কেন?মেয়েদের মত?’
প্রিয়ম লম্বায় নীহারিকা না শুধু তার বাবাকেও ছাড়িয়ে।সে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নীহারিকা বলল,’ ঝুঁকে বয়।তা না হলে কথা বলবো না।’
প্রিয়ম ঝুঁকে দাঁড়ালো।তার চোখে পানি।নীহারিকা চরম আশ্চর্য।তার সব কথা শুনছে!কিন্তু প্রিয়ম তো অবাধ্য ভাই তার।যদি এক গ্লাস পানি দিয়ে যেতে বলে সে তখন সোজা জবাব দিবে,’তুই নিয়ে খা।’ এমন অসভ্য,ঘাড় বাঁকা ছেলেটি এতো ভালো হয়ে গেলো কিভাবে?ভেবে পায় না নীহারিকা।প্রিয়ম চোখ মুছে নিয়ে বলল,’ আপু শুন আমি আর তোর সাথে ঝগড়া করবো না।তর্কে জড়াবো না।যা বলবি তাই শুনবো।পানি তোর হাতের একদম কাছে থাকলেও এগিয়ে দিবো।সব কাজ আমি নিজেই করবো।তোর রুমের মশারিও টাঙ্গিয়ে দিবো।তবুও তুই আর কখনো বাড়ি ছেড়ে যাবিনা প্লিজ।’প্রিয়ম আবার জড়িয়ে ধরলো।দূরত্ব ভালোবাসার মানুষ গুলোকে আরো অনুভব করায়।তারা কতটা ভালোবাসতো তাদের প্রিয়জনকে।বাড়ি ভর্তি সবাই নীহারিকাকে এতো বড় একটা কান্ডের জন্য ক্ষমা করে দিয়েছে?বাবা মা কি সত্যি এতো উদার হয়?তারা কি ছেলেমেয়েদের পাহাড় সমান ভুলও ক্ষমা করে দেয়?রিক্সা চালক ঘরে ঢুকে বললেন,’ টাকা দিবেন না?’
প্রিয়াস অবাক হয়ে বলল,’ ওই তুই টাকা না দিয়ে চলে আসলি?’
নীহারিকা চোখ রঙ্গা করে বলল,’ তুই আবার আগের মত হয়ে যাচ্ছিস।থাপড়ামু বলে দিলাম।’
প্রিয়স হেসে দিলো।নিজের পকেট থেকে ভাড়া চুকিয়ে দিলো।নীহারিকা সেদিন খুব অবাক হয়েছিলো।কেউ তাকে প্রশ্নই করলো না সে কোথায় ছিলো?কি করছিল?একটা রাত সে গায়েব ছিলো।কেউ জানতেও চাইলো না।কিন্তু তার বিয়ের কি হলো সেটা সে জানতে চেয়েছিলো।কেউ কিছু বললো না।প্রিয় মানুষ গুলো কেন এত ভালোবাসে!
_________________
দু’টি বছর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে গেল।বৈশাখ গেল,আষাঢ় এল।শীতও চলে গেল।আবার বর্ষা ঝাপিয়ে এল পরিবেশ কাঁপাতে।ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে।নীহারিকার মধ্যকার অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে এসেছে এই বৃষ্টি।চাতক পাখির মত সে অপেক্ষায় বসে থাকে।কখন আসবে বর্ষা।কখন হবে আকাশ মেঘলা।বৃষ্টিরা কি নামবে ঝুমঝুমিয়ে।ঠিক সেদিনের মত কেউ কি অতি উৎফুল্লে ভেসে ভিজবে?নীহারিকা প্রতি বছর বৃষ্টিতে ছাদে উঠে ভিজে।সাথে সাথে তার খুব জ্বর হয়।জ্বরে পুড়ে ছাড় খাড় হয় শরীর।তবুও তার ভালো লাগে।সে পছন্দ করতে শুরু করেছে অপছন্দনীয় সেই বৃষ্টির আঘাতের মত শরীর ছুঁয়ে যাওয়া বিন্দু বিন্দু জলকে।পায়ে আঘাত নেই।সেই ক্ষত কত আগেই শুঁকিয়ে গিয়েছে।যে ক্ষত শুকোয়নি তা হচ্ছে সেই রাত!একটি রাত আজও তাকে খুব জ্বালায়।মনে করিয়ে দেয় একটি অদ্ভুত মানবকে।হঠাৎ হয়ে উঠা প্রিয় সুখ টুকুকে।নীহারিকা খুব জ্বলে তখন।হারানোর হাহাকার তাকে ঘ্রাস করে।ভাবে,মানুষটা যদি একবার হাত বাড়িয়ে দিত!শুধু একটি বার!তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?না হত না।পালিয়ে তো সে এসেছিলোই।না হয় সে বার সত্যি সত্যি পালিয়ে যেত।একটু ক্ষুদ্র পরিচিত মানুষের শক্ত মক্ত হাত খানি ধরে।কথা গুলো প্রথম কয়েক মাস ভেবে ভেবে বৃষ্টিকে বিদায় জানিয়েছে সে।তখন খুব কান্না পেয়ে বসতো।অবুঝের মত সে কেঁদে কেঁদে একাকার করে বালিশের উপরিভাগ ভিজিয়ে দিয়ে শান্ত হত।কি আবেগী ছিলো সে!সামান্য একটা ছেলেকে মনে ধরে সে কাঁদত।তার দেওয়া সেই রুমাল কেঁদে কেঁদে নাক টেনে পায়ে বেঁধে নিত।ঠিক যেমন সে বেঁধে দিয়েছিল।আহ তখন কি একটা শান্তি এসে তার শরীর প্রাণ আত্নাকে নিজের কোমল আলত হাতের স্পর্শ দিয়ে ছুঁয়ে যেত।তা সে বলে বুঝাতে পারবে না।সেই অনুভুতি গুলো খুব মনে পড়ে তার এখন।তখন মনে হত মানুষটা নিজেই এসে পা বেঁধে দিচ্ছে তার।কি আশ্চর্য আশেপাশে কেউ নেই?কেন নেই?নীহারিকা হন্নি হয়ে বারান্দায় আসে।তখন বৃষ্টির প্রবল বর্ষনের শিকার হয় তার হৃদয়।ফোঁটা ফোঁটা পানির দিকে তাকিয়ে সে ভাবে,আচ্ছা সে কি সত্যি প্রেমে পড়েছিল?না কি অন্য কিছু ছিলো?আবার ভালোবেসে ফেলেনিত?
এখন নীহারিকা খুব শান্ত হয়ে নিজের অনুভুতি গুলোকে শান্তির খাঁচায় বেঁধেছে।হুটরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে না সে।ভাবে না এত।ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।ব্যস্ততা জীবনকে পাল্টে দেয়।কিছু সময় ভুলিয়ে রাখে।তবুও রাতের খুব গভীর প্রহরে এসে নীহারিকার ঘুম চট করে ছুটে যায়।চোখের পাতা সে আর এক করতে পারে না।একটি রাতের অপরিচিত মানুষটার কথা ভাবে তখন।তার হাসি!হায় কি হাসে ছেলেটা!কখনো বিরক্ত হয় না।কখনো রেগে যায় না।সব সময় অতিশান্ত ভাব তার।রগচটা মানুষ না সে।একটা আপন সত্ত্বার মানুষ।
এখন নীহারিকার মাথায় আসে ছেলেটি হাত ধরেনি ভালো হয়েছে।তখন সে স্বার্থপর হয়ে পড়ত।পালিয়ে যেত।বাবা মা ভাই,পরিবারের বাকি সবার এত এত ভালোবাসা পেত না।যা হয় ভালোই হয়।
_____________
নীহারিকা তার নানুর বাড়ি এসেছে।তার ছোট মামার বিয়ে।ছোট/বড় তার অনেক ভাইবোন।খালাতো ভাই বোন আছে চারজন।দু’জনই তার বড়।একজন শুধু ছোট।গল্প করতে বসে ছিল তারা ছাদের উপরে।সাথে আছে পাশের বাসার আরো অনেক সমবয়সী ছেলে মেয়ে।গল্পের মহলে বসে নীহারিকা তার জীবনে একটি ভয়ংকর,সুন্দর,অদ্ভুত রাতের বর্ণনা তাদের শুনিয়েছে।গল্পের শেষে সে পানি খেতে যাবে ঠিক তখন ফাবিহা বলে উঠে,’সেই ছেলে জ্বীন ছিলো না কি ভুত।’
নীহারিকা বেশ বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,’ জ্বিন ভুত হতে যাবে কেন?মানুষই ছিলো।’
মিতু হেসে উঠে বলল,’ নামটা দারুন বিমুগ্ধ।আমি তো তার প্রতি বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম নীহু।’
‘ শুন আপু এত বিমুগ্ধ বিমুগ্ধ করবিনা।সামনে আসলে বুঝতি লোকটা ভারী অদ্ভুত আচরন করে।চমকাতে বাধ্য।’
নীহারিকা পানি খেয়ে নিলো।মিতু মুখটা খানিক কুঁচকিত করে আকাশের দিকে তাকালো।দু’হাত উপরে তুলে বলল,’আল্লাহ দেখা করিয়ে দেও।সত্যি বলছি নামাজ আর মিস দিবো না।তার দেখা দিয়ে দেও।’
ফাবিহা মিতু আপুর ছোট চার বছরের।নীহারিকার বড় এক বছরের।সে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ বিমুগ্ধ আমার।তুই হাত বাড়াবিনা বলে দিলাম।তাহলে আপু তুই যে ঠিক মত নামাজ পড়িস না এটা আম্মুকে জানিয়ে দিবো।
‘ তুই চুপ কর।লজ্জা করে না বড় বোনের মুখের উপরে কথা বলিস।সে আমার।বিমুগ্ধের কথা ভাবো সবাই।কি বুদ্ধি বল।ওহ আমি তো কাহিনী শুনেই ফিদা।’
নীহারিকা উঠে গেল।এদের বলেই যেন ভুল হয়েছে তার।ছাদ থেকে নেমে সোজা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতেই রাসেল মামা তাকে খুব আদরের সাথে কাছে ডাকলো,’নীহু কাম হেয়ার।’
হাসি মুখে মামার পাশে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,’ এত হেসে কাজ নেই।ওই যে তিনটি রুম রয়েছে সেগুলো গুঁছিয়ে দে।’
ভ্রু কুঁচকে নীহারিকা বলল,’ কেন মামা?সে সব রুম তো গোছানোই থাকে।আবার গোছাতে হচ্ছে কেন?’
‘ ফাবিহাকে ডাক।সাথে মিতুকে।সব গুঁছিয়ে ফিটফাট কর।আজ তারা আসবে।’
‘ তারা টা কে মামা?আজ না তোমার আকদ।তোমার বউয়ের নাম তো সুমাইয়া।তারা কে?মা কে বলবো?নানুকেও বলবো?তুমি যে আবার প্রেম করছ যানে তারা?তাও আবার চাঁদ তারার সাথে?তাও আবার নিজের বিয়েতে নিয়ে এসেছ?ভারী আশ্চর্য মামা।’
‘ থাপড়ে গাল লাল করে দিবো।যা কাজ কর।তারা মানে কোন তারা না তাদের কথা বলছি।’
চোখ ছোট করে নিহারিকা বলল,’ মেহমান তো আসবে চারদিন পর থেকে।কারণ অনুষ্ঠান আরো পাঁচ দিন পরে।আজ তো আমরা আমরাই থাকবো।এই তাহারা কে মামা?’
রাসেল প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠলেন।মেয়েটা ছোট বেলায় বেশি ভালো ছিল।প্রশ্ন কম করতো।যা দেওয়া হতো চুপ করে করতো।এখন হয়েছে পুরোই উল্টো।ধমকের সুরে তিনি বললেন,’ যাবি তুই?না কি বুবুকে ডাকবো।’
‘ ভয় দেখাবে না মামা।একদম ভয় দেখাবে না।যাচ্ছি।’
নীহারিকা বিছানা গোছাতে এসে দেখে ইতিপূর্বে আরো লোক লেগে গিয়েছে রুম ঠিক করতে।কে যেন আসবে।তারা বেশি নয়।তিনজন মাত্র।কিন্তু বন্ধুবান্ধব ছাড়া না কি সে কোথাও যায় না।এই সেটা কে?নীহারিকা অবাক হয়ে ভাবে।তাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে রুম।এসব খবর নীহারিকাকে দিয়েছে ফাহাদ।তার ছোট আন্টির ছোট ছেলে।সব ঠিক করে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।সন্ধ্যায় মামার আকদ হবে।চারদিন পরেই যখন অনুষ্ঠান তখন এতো জলদি বিয়ে কেন করছে তার মামা সে বুঝতে পারছে না।আর বিয়ে যখন জলদিই করছে অনুষ্ঠান কেন চার’দিন পরে করবে?
_________________
আজ মেঘলা আকাশ বৃষ্টি হবে হয়ত।নীহারিকার মনটা খারাপ।সে দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পাড়ে।সন্ধ্যা নামি নামি।কিছুক্ষণ পরে সবাই মেয়ে পক্ষের বাড়ি যাবে।নীহারিকার গায়ে সবুজ জামা।সম্পূর্ন জামা ভর্তি কাজ।নেটের ওড়নায় ভারী পাথরের কাজ।চিকন চিকন জরির মত লাইন।মাথায় হিজাব বেঁধেছে সে।একপাশ অনেক বিশাল হয়ে ঝুলছে পিছনে।সবুজের সাথে মেয়েটা লাল হিজাব পড়েছে।আজ কি বিজয় দিবস?ছেলেটি পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।পুকুরে পাথর ছুঁড়ে নীহারিকা।শব্দ হয় দ্বিগুন।চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে নীহারিকা অবাক হয়।ছেলেটি তাকায়।মৃদূ আলো আসছে ঘরের বাহিরের লাইট থেকে।পুকুরের স্বচ্ছ সবুজ পানির উপরে সেই আলো চিক চিক করছে।বাড়িতে কিছু মানুষ জমা হয়েছে।এদের সবাইকে সে চিনে না।গ্রামে আসা হয় তার খুব কম।এই যেমন প্রতিবছরে একবার।তাও ডিসেম্বরে।শীতের সময়।থাকে সাত কি আট দিন।ছোট যখন ছিলো।তখন অনেক দিন থাকত তারা।এক মাসের মত।স্কুল বন্ধ হলেই মা ছুটত।নিজের গ্রামে।শহর যেন তার কাছে বিষাক্ত।চোখ বাঁকিয়ে তাকায় নীহারিকা।ছেলেটি এখনো তাকে দেখছে।সে কি ভুত?এভাবে দেখার কি আছে?উঠে দাঁড়ায় নীহারিকা।নানু বলে সন্ধ্যার হাওয়ায় অনেক কিছু ঘুরে।তাদের মধ্যের কেউ নয় তো?সে উঠে যায়।বাড়ির কাছাকাছি আলোর কাছে যেতেই পিছন থেকে ডাক পড়ে।ভয়ে শিউরে উঠে নীহারিকা।প্রকাশ না করে সে পিছনে ফিরে তাকায় একবার।মানুষটা কোমল গলায় ডাকে,’নীহারিকা।এই যে হ্যাঁ আপনাকে বলছি।’
নীহারিকা পিছনে ফিরে পুরোপুরি।দৃষ্টি রাখে ছেলেটির উপরে।অতিসুদর্শন ছেলে যে!এত সুন্দর ছেলে তাকে ডাকছে কেন?নামও জানে?নীহারিকা আস্তে করে বলল,’ কিছু বলবেন।’ছেলেটি যেন চমকে উঠে।এক ঝাঁক চমক নিয়ে সে বলল,’ আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?’
এবার একটু অবাক হয়ে নীহারিকা বলল,’এটা তো প্রথম দেখা,চিনবো কিভাবে?’
‘ আপনি চমকালেন না?’
‘ কেন?’
‘ এই যে আমি আপনার নাম জানি কিভাবে?’খুব আগ্রহ নিয়ে তাকালো ছেলেটি।নীহারিকা হাত দিয়ে হিজাব ঠিক করে নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিয়ে বলল,
‘ আমি সহজে চমকাই না।কারণ এর চেয়ে ভয়ংকর সব ব্যাপার আমার জীবনে ঘটেছে।চমকাতে চমকাতে আমি এখন এসব ছোট খাটো ব্যাপারে চমকাতে ভুলে গিয়েছি।’বিমুগ্ধের কথা ভেবে নীহারিকা মৃদূ হাসলো।হালকা আলোয় সেই হাসি এসে বজ্রের মত আঘাত করে হৃৎপিণ্ডে।ছেলেটি দু’হাতে বুক চেপে ধরে।উত্তেজিত একটা কন্ঠে কি যেন বিড়বিড় করলো।নীহারিকা তাজ্জব হয়ে বলল,’ আপনার কি বুকে ব্যথা করছে?হার্টে প্রবলেম আছে?’
অসম্ভব সুন্দর করে হাসতে চেষ্টা করলো ছেলেটি।নিজের হাসি ফুঁটিয়ে তুলে বলল,’এতো দিন ছিলো না।আজ এই মুহূর্ত থেকে আমি হার্টের রোগী।ভিষণ ভাবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত।আপনি কি সাহায্য করতে পারবেন?’
‘ আমি কিভাবে করবো?আমি ডাক্তার নই।ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ আপনার।’
নীহারিকাকে ব্যস্ত দেখালো।ছেলেটির ভালো লাগছে।ব্যস্ত চেহারার ছাপ মেয়েটিকে যেন আরো বহু গুণ সুন্দর করে তুলেছে।
‘ আচ্ছা আপনি কি সত্যি আমাকে চিনতে পারছেন না?’নিজেকে শুধরে আবার প্রশ্নটা করলো সে।নীহারিকা ভালো করে দেখেনিল।এত সুন্দর ছেলেকে তো সে জীবনেই দেখেনি।চিনবে কিভাবে?তীক্ষ্ন কন্ঠে সে জবাব দিলো,’ না।আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।’
‘ চেহারাটা ভালো করে দেখুন।চিনতে পারছেন এবার?’ ছেলেটি আলোর দিকে এসে দাঁড়ালো।ফর্সা গালে কালো খোঁচা দাড়ি।ঠোঁট গুলো কি সুন্দর!নীহারিকা চোখটা ভালো করে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,’ না।আমি আপনাকে একদম চিনতে পারছি না।এবং আমি নিশ্চিত চিনতে পারবোও না।আমি এটাও নিশ্চিত যে আপনার সাথে আমার কখনো দেখাও হয়নি।এবার যেতে পারি?’
ছেলেটি চমকালো।তার মত সুদর্শন ছেলের সাথে তো মেয়েটার কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে বাহানা দিয়ে কথা বলা উচিৎ।কিন্তু সে বলছে না।সাধারণের মাঝে অসাধারণ এই মেয়েটি তার হৃদয়ে ঝড় তুলছে ক্ষনে ক্ষনে।মুহূর্তে সে ঘায়েল করেছে তাকে।ঝড়ের হাওয়া তীব্র।তুমুল ঝড়।নাম কি দিবে এই ঝড়ের?সুনামি?না কি কালবৈশাখি ঝড়?টর্নেডো হতে পারে।
নীহারিকা পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে নেয়।ছেলেটি আবার পিছন থেকে ডেকে বলল,’ আমি জাওয়াদ।এবার নিশ্চয়ই বলবেন না,চিনি না।’
বিরক্তি প্রকাশ করে নীহারিকা বলল,’ আমি এবারো বলবো আমি আপনাকে চিনি না।’ আকাশ থেকে পড়লে মানুষের মুখটা যেমন হয়ে উঠবে ঠিক তেমন হয়ে উঠেছে জাওয়াদের মুখ।চরম অবাক হয়ে সে বলল,’ আপনি আমার নামটাও জানেন না?’
নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ দেখুন ভাইয়া আমি সত্যি এই জীবনে আপনার এবং আপনার নাম দু’টোই দেখিনি শুনিনি।এবার যেতে দিবেন প্লিজ।’
মুখটাকে একদম ছোট বাচ্চার মত করে নীহারিকা অনুমতি চাইলো।জাওয়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।নীহারিকা চলে যেতে নিবে সে আবার ডাকলো।মৃদূ মৃদূ কন্ঠে বলল,’ আমি কি আপনাকে তুমি করে ডাকতে পারবো?’
সোজা গলায় নীহারিকা বলল,’ না।ডাকতে পারবেন না।অপরিচিত মানুষের মুখে আমি তুমি শুনতে পছন্দ করি না।’
আর দাঁড়ালো না নীহারিকা।ছনছন করে কারো বুকে বর্ষণ শুরু করে হেঁটে চলে গেল সে।আর একবারো তাকালো না।তাতে কি।যে মুহূর্ত গুলো তাকিয়ে ছিলো তাতেই ধন্য জাওয়াদ।সত্যি সে ধন্য।জাওয়াদ লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে।তার চিৎকারে যেন বাড়িটাই দুলে উঠে।নীহারিকা অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।চিৎকার শুনে সে পিছনে ফিরে তাকায়।বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জাওয়াদ।বুকে কি সত্যি ব্যথা এই লোকের?না কি মাথা খারাপ?মামাকে জানাতে হবে।জাওয়াদের দুনিয়া যেন রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে উঠেছে।কন্ঠ গভীরে নেশা ঢেলে সে বলল,’ আপনি সত্যি অনেক সুন্দর।ছবির থেকেও হাজার গুন বেশি।আর একটু কথা বললে কি হত?চলে গেলেন কেন?ইশ কি চোখ,লাল মুখশ্রী।আচ্ছা আপনার মুখটাই কি লাল?না কি আলোকরশ্নি লাল করেছে?’
বুকে হাত ঘঁষতে ঘঁষতে ঠোঁট কামড়ে ধরে জাওয়াদ।আজ যদি না আসতো জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামি হত।ভয়ংকর বোকামী।ভাগ্যিস এসেছে।খুশিতে আত্নহারা গলায় সে আবার বলল,’আমার হৃদয়কে মিষ্টি ভাবে ব্যথিত করার জন্য আপনাকে চরম ভাবে পস্তাতে হবে নীহারিকা।’
__________
বিমুগ্ধ চরিত্রকে কেমন লেগেছে আপনাদের?মতামত জানাবেন।আর যারা বিমুগ্ধ চরিত্রকে অবাস্তব ভাবছেন বা পাগলাটে ভাবছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি সে অবাস্তব নয়।তাকে জানতে হলে আপনাদের গল্প পড়তে হবে।সেও সাধারণ মানুষ রূপে চরিত্র মাত্র।একটু রহস্যে ঘেরা।কিন্তু সেও সাধারণ।অবাস্তব জিনিস হলে আমি অবশ্যয় আপনাদের জানিয়ে দিতাম।
ধন্যবাদ।ভালোবাসা সকলকে।❤️
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here