প্রিয় সুখ-১০

0
621

প্রিয় সুখ-১০
_______________
আফিয়া বিলকিস মুখটা কুঁচকে রেখেছেন।পৃথিবীর নিয়ম মেয়েরা ভুল করবে,দোষ করবে।ধরা খেয়ে।মায়ের সামনে বসে থাকবে মাথা নিচু করে।এখানে নিজের মেয়ে এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে তার সামনে বসে আছে মনে হচ্ছে মেয়ে উনি নিজেই।সামনে তার মা বসে আছেন।নিজেকে শান্ত করে নীহারিকা বলল,’মা এই জাওয়াদের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল?’
মুখ ভর্তি শ্বাস ফুঁস করেই বের হয়ে আসে আফিয়ার।তিনি জানেন বিয়ের সময় নীহারিকা এই ছেলের ছবি দেখেনি।তাই প্রথমে চিনতে পারেনি।এতে তিনি পাত্তা দেয়নি।এখন ধরে ফেলল কিভাবে?মাথায় আসছে না।চারপাশে সাবধানের সহিত চোখ ঘুরিয়ে তিনি মেয়ের পাশে এসে বসেন।আদুরি গলা করে বলে উঠেন,’ শুন এসব পুরোনো কথা।এখন বলছিস কেন?তুই তো বিয়ে করিসনি।’
‘ করিনি সেটা বড় কথা নয় মা।উনি এখানে কি করছে?বাবা কিভাবে এলাও করছে?আমি সত্যি রেগে যাচ্ছি মা।বাবা যদি আবার উল্টোপাল্টা কিছু ভাবে আমি কিন্তু এবার পালালে আর ফিরে আসবো না।’
দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নীহারিকা।তবুও কেমন যেন রি রি করে রাগ মাথায় চড়ে বসছে।আফিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন,’ শুন জাওয়াদ এখানে উল্টোপাল্টা কিছুর জন্যেই আসেনি।তোর বাবার বন্ধু হয় ওর বাবা।অফিস কলিগ।সে হিসেবে অনেক বছরের পরিচয়।সেভাবেই বিয়ে ঠিক হয়।উনার ইচ্ছে ছিলো সম্পর্ক গভীর করবেন।তুই তখন তোর বাবাকে বলিসনি তুই রাজি না।তাই তোর বাবা মনে করেছে মেয়ে যখন কিছু বলেনি।তার মানে রাজি।পরে তুই তো একটা স্কেন্ডাল করে ফেলেছিস।তোকে যখন পাওয়া যাচ্ছিলো না তোর বাবা তো প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল।বিয়ে তখন নিজে থেকেই ভেঙ্গে দিয়েছিল।বলেছিল মেয়ে রাজি না।তো এখন কেন উল্টোপাল্টা কিছু করবে?তোর মতামতের গুরুত্ব দিবে উনি।এভাবে বলবি না।বাবা হয় তোর।আর জাওয়াদ এখানে শুধু তোর মামার বিয়েতে এসেছে।শহরের ছেলেমেয়েরা গ্রাম,গ্রামের বিয়ে সাদি দেখে না।তোর মামার বিয়ের কথা শুনে আফসোস করেছিল।তোর বাবা আমাকে বলে।আমিই তোর মামাকে দিয়ে ইনভাইট করাই।এতে তোর বাবার তেমন ভুমিকা ছিল না।শুধু শুধু রেগে যাচ্ছিস কেন?সমস্যা কি?দু’জনেই দু’জনকে চিনতি না।কখনো কথা হয়নি।পরিচয় নেই।তুই তো দেখিসনি পর্যন্ত।তাহলে এত হাইপার হচ্ছিস কেন?’
মা রিতিমত গমগমিয়ে রেগে উঠেছেন।নীহারিকা চুপসে যায়।এখন কিছু বলা মানেই বিপদ।সে দ্রুত মায়ের কোলে মাথা রাখে।তিনি মাথা সরিয়ে দিতে চায়।রাগ হচ্ছে খুব।মেয়েটা মনের কথা তো তেমন বলেই না।সব সময় নিজে নিজে কিছু বানিয়ে নিবে।
‘ মা তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘ তো রাগ করবো না?আগের বার ছেলেকে না দেখেই তুই বলে দিলি তোর বাবা তোর জন্য একটা কালো, মোটা, টাকলা ছেলে খুঁজে নিয়ে এসেছে।তুই কি তার সৎ মেয়ে?নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন কেন করবে?কত ভালোবাসে তোকে জানিস?
‘ জানি মা।আমার দোষ কোথায়?মিতা আপু তো আমাকে এটাই বলেছে।’
‘ শুনেই বিশ্বাস করে নিতে হবে??শুন তোর সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।সর তো।’
নীহারিকা দ্রুত উঠে বসে।দু’হাত মায়ের হাতে রেখে মুখটা মায়াবী করে বলল,’ স্যরি।স্যরি।আর এমন হবে না।কিন্তু এখন উনি এখানে কি করছে?’
‘ আবার এক কথা?সে কি এখানে বিয়ে করতে এসেছে?সে বিয়েতে এসেছে তোর মামার।’
‘ তাও কেন আসবে?আমার মামা উনার কি?’
‘ নীহারিকা এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’
‘ ওকে ওকে যাই থাকুক।কিন্তু আমার পিছনে পিছনে যাতে না ঘুরে।’মুখ অন্যদিকে নিয়ে কথাটা বলল নীহারিকা।
‘ তোর পিছনে মানে?’ অবাক হয়ে বলল আফিয়া।নীহারিকা কি বলবে খুঁজে পেল না।কথা ঘুরিয়ে বলল,’খিদে পেয়েছে।আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি।’
‘ তোর খাওয়ার প্রয়োজনও নেই।ঘুম থেকে উঠিসই তো দুপুরে।সকালে কিছু খেতে হবে কেন।যতসব।বস আমি আসছি।’
যেতে যেতে মা থেমে গেলেন।পিছনে ঘুরে বললেন,’ হ্যাঁ রে তুই যে বললি তাযিনকে চিনিস?সেটা সত্য?’
‘ মিথ্যা হতে যাবে কেন?’ কথাটা বলেই জিভ কাঁটে সে।বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলল,’ তেমন ভাবে না।কোথাও দেখেছি দেখেছি মনে হল।’
‘ ওর বন্ধুদেরও দেখেছিস দেখেছিস মনে হলো?’ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্নটা করলো তিনি। ‘ হুম হলো।এবার তুমি যাও।’
____________________
দক্ষিণের দিকের রুমটা বেশ বড়।তাদের তিনজনের জন্য উপযুক্ত বিছানার ব্যবস্থা রয়েছে।বাড়িতে আসলেই এক সাথে এই রুম দখল করে বসে তারা। সাধারণত নীহারিকা নিজের রুম শেয়ার করে না। শুধু বোনেদের সাথে করে। এখানের একটা জানালা সব সময় খোলা থাকে।বিশেষ কারণে বন্ধের ব্যবস্থা নেই।লোহার শিক রয়েছে লম্বা লম্বা ভাবে দাঁড়িয়ে।তার পাশেই বিশাল বাগান।আম গাছ,সুপারি গাছ,তাল গাছ।অনেক গাছের সমারোহ রয়েছে।চাঁদ উঠেছে তাল গাছের মাথার উপরে।এক পায়ে দাঁড়িয়ে গাছটির বিশাল পাতা।সে পাতা বাতাসের ঝাপ্টার তাড়নায় একদিক সেদিক উড়ে বেড়ায় উড়াল চন্ডীর চুলের মত।জানালার দিকের হাওয়ার মাঝে বিশেষত্ব রয়েছে।সামনেই বিশাল এক দীঘি।দীঘির কাজল কাল জল না হলেও ঘন সবুজে ঢাকা ভরাট জলরাশি।বিশাল দীঘিতে ছোট ছোট নৌকাও চলে।মাছ ধরার নৌকো।মাঝিদের বাড়ি দীঘির অপরপান্তে।দীঘির শীতল কোমল হাওয়া শরীরের অস্তিত্বকে শান্ত নিরব করে তুলে।মনে হয় এ বুঝি দুনিয়ার বেহেস্তের বাতাস।প্রতিরাতে জানালার নিচ বরাবর বসে পড়ে তিনজন।মাঝে মাঝে যোগ দিতে চায় ফাহাদ, প্রিয়ম, রাজ।কিন্তু তাদের ঘরের বাহিরে ধাক্কা দিয়ে এমন একটা ভাব নেয় মিতু আপু যেন তিনি এই গ্রামের রাজা।বয়সে বড় হলেও মিতু আপু দারুন মজাদার।জানালার নিচে বসে কখনো তারা গল্প করে ওমুক বাড়ির মেয়ের বিয়েতে কি হয়েছিল।তমুক বাড়ির মেয়ে কার সাথে পালিয়েছে।ওই বাড়িতে কে কে মারা গিয়েছে।নীহারিকা তো এখানে থাকে না।তাই সে জানে না এসব।আসলেই এক ঝুঁড়ি গল্প নিয়ে বসে তারা।গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে পাটিতেই ঘুমিয়ে পড়ে।কিন্তু যেদিন খুব ভয় হয় সেদিন আর তারা জানালার কাছে আসে না।এই জঙ্গলের কিছু বিশেষ ব্যাপার রয়েছে।তার মাঝে ভূত জ্বিনের ব্যাপারটা একটু প্রখর ভাবে কানে আসে।অস্পষ্ট শব্দের ফোয়ারা প্রায় শুনতে পাওয়া যায়।রোদের আলোর নিচে দীঘির জল যত সুন্দরীর স্নিগ্ধ চেহারার মত শীতল ঠিক ততই যেন ভয়ংকর রাতের আধারে তার বাতাসে দোল দোল করে উঠা পানির কলকল শব্দ।ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক তো বুকের মাঝে হাতুরি পিটিয়ে সারা রাত জাগিয়ে রাখার প্রকট ক্ষমতা নিজের মাঝে নিমজ্জিত করে রাখে।রাতের আধারের কালো অন্ধকারের হাত ধরে সব শব্দ একত্রিত হয়ে হাড়ে হাড়ে কাঁপন তৈরি করে।
‘ ঝম ঝম করে কিসের শব্দ হচ্ছে।কান খাড়া করে ফাবিহা একবার শুনে।না শুনার ভান ধরে।কিছুক্ষণ অন্যদিকে মন গায়েব করতে চেয়েও পারে না।আবার কানে আসে শব্দ।মিতু আপুর এক হাত নীহারিকার আর এক হাত খপ করে খুব শব্দ ভাবে খামছে ধরে সে।দু’জনেই ফিরে তাকায়।জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।ফাবিহা মুখটা আরো নিচুতে নিয়ে এসে ফিস ফিস করে শব্দ বের করে গলা দিয়ে,’আপু জঙ্গলে কেউ আছে।’
মিতু আপু শব্দ করে হেসে বললেন,’ তুই এখনো ডরাইল্লা ডার্পোক রয়ে গেলিরে ফাবু।’
‘ আপু সত্যি বলছি।বিশ্বাস না হলে তুই জানালা দিয়ে দেখ।’
মিতু আপু হেসে নিজের দূর্বলতা গোপন করতে চাইলো।কিন্তু পারলো না।নীহারিকা ফাবিহা দু’জনেই জানে তাদের চেয়েও মিতু আপু বেশি ভিতু।দু’জনকে ছেড়ে নীহারিকা উঠে দাঁড়ায়।প্রবল সাহস নিয়ে সে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়।সে যে ভয় পাচ্ছে না এমন নয়।সেও জানে ভুত না হলেও জ্বিন রয়েছে এই জঙ্গলে।মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়ে।আম গাছে কেউ আছে।নিচেও মনে হচ্ছে কেউ রয়েছে।নীহারিকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল,’চোর আপু।’
সাথে সাথে দু বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চাপা চিৎকার করে উঠে বলল,’ কোথায় কোথায়।আম্মা ও আম্মা।’
মুখ চেপে ধরে দুজনের নীহারিকা।কন্ঠস্বর খাঁদে ডুবিয়ে রেখে দ্রুত বলে,’ চুপ কর আপু।নিচে চোর।গাছ থেকে কিছু চুরি করছে।চল ধরি হাতে নাতে।’
‘ তুই পাগল হলি?’মিতু আপু লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল।নীহারিকা কান দিল না।দ্রুত ভারী নামাজের ওড়না বের করে নিল ট্রলি থেকে।মাথা প্যাঁচিয়ে হাতে ফোনের লাইট নিয়ে বলল,’ তোরা যাবি?’
দু’জনেই না বলতে চাইলো।কিন্তু বললো না।বোনকে তো আর একা ছেড়ে দিতে পারে না।দু’জনেই জড়ো সড়ো হয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।নিঁখুত শব্দ বিহিন পা বাড়াতে বাড়াতে নীহারিকা হুশিয়ারি করে বলল,’ মামাকে কেউ ডাকবি না বলে দিলাম।’
ফাবিহা বলল,’ কেন রে?’
‘ আগে ধরি তারপর ডাকবো।চেঁচাবিনা ফাবি।আর মিতু আপু তুই যদি চিৎকার করিস তাহলে হাত পা বেঁধে পুকুরে ফেলে দিবো বলে দিলাম।’
রেগে যাওয়ার ভাব নিয়ে মিতু আপু বলল,’ থাপড়ামু অসভ্য।আমি তোর বড় না ছোট।’
‘ আপাততো চুপ কর আপু।’

শব্দ বিহিন ভাবে পিছনের দরজার লক খুলে ফাবিহা।এসব লুকুচুরির কাজে সে ওস্তাদ।লুকিয়ে সে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যায়।রাতে খাবার লুকিয়ে খাওয়ার তো তার অভ্যাস।জঙ্গল দেখেই বুক শুঁকিয়ে কাত হয়ে গিয়েছে।ফাবিহা চিকন চিকন গলায় বলল,’ অপেক্ষা কর তোরা।আমি আসছি।এক মিনিট যেতে লাগবে একমিনিট আসতে লাগবে।’
দৌড়ে এসে হাজির হয় ফাবিহা।তার হাতে ছুরি দেখেই ভয় পেয়ে যায় বাকি দু’জন।চোখ রাঙ্গায়ে মিতু আপু বলল,’ ওই পাগল ছুরি নিয়ে এসেছিস কেন?’
‘ যদি চোর আক্রমন করে তাই।’ফাবিহা হাসার চেষ্টা করলো।কিন্তু হাসতে পারছে না।ভয়ে হাত পা গরমের দিনে জমে গিয়েছে।
জঙ্গলের মাঝে মানুষ হেঁটে সুরু রাস্তা তৈরি করেছে।ঘাস উঠে আছে।কিন্তু ছোট ছোট।মানুষের পায়ের নিচে পিষে গিয়েছে তারা।হাতের বাম দিক থেকে ফিসফিস শব্দ আসে।অন্ধকারকে অপেক্ষা করে চাঁদের জ্বলন্ত শুভ্র আলোর সাহায্যে তারা উপস্থিত হয় আম বাগানের কাছে।অবয়ব দেখা যাচ্ছে অনেক গুলো শরীরের।একের সাথে অপর জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্টে।নীহারিকা গাছের নিচ বরাবর দাঁড়াতেই দেখে মৃদূ মৃদূ পরিচিত মুখ।চোরের মুখ পরিচিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।সে আরো ভালো করে দেখতে যাবে পায়ের নিচে কারো পা পড়ে।সাপ মনে করে ভয়ে শিউরে উঠে চিৎকার করতে যাবে তখনই শক্ত কঠিন ভয়ংকর একটি হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের ভাঁজে তার নরম কোমল গোলাপ পাঁপড়ির নেয় সৌন্দের্য্যে মুন্ডিত ঠোঁট জোড়া বাঁধা পড়ে।মুহূর্তেই চোখ হয়ে উঠে উতপ্ত আগুণের নেয় ঝলমলে।বিস্তর রাগে ক্রদ্ধে শরীর কেঁপে উঠে।শব্দ করে মুখ ছাড়াতে চায় সে।হাত দু’টি শক্ত করে ধরে পিছনে কেউ।নিঃসন্দেহে বিপদজনক লোক!হাত ছিটাতে শুরু করে নীহারিকা।চাঁদের আলোর স্নিগ্ধ ছোঁয়া এসে পড়ে মুখে।কেউ যেন খুব গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।এত গভীর ভাবে কারো দৃষ্টি সে অনুভব করেনি।শান্ত একজোড়া গভীর তলের চোখ।অসম্ভব গভীরে ডুবা চোখের ভাষা।চমৎকার এক অনুভুতি ছোঁয়াতে।নীহারিকা মিতু আপুকে খুঁজে।তারা কোথায়।তাকে খুঁজচ্ছে না কেন?ফাবিহা ফোনের সফেদ রশ্নী ছুড়ে মারে মুখের উপরে।ক্ষনিকের মাঝে আবিষ্কৃত হয় তাযিনের মুখশ্রী।স্বাভাবিক হয়ে সে মুখ চেপে ধরে আছে।মিতু আপু দ্রুত এগিয়ে এসে ছাড়াতে চেয়ে বলল,’ তাযিন ভাই ছেড়েদিন।ও নীহু।আমাদের নীহু।’
সে ছাড়লো না।আরো শক্ত করে ধরে মুখের চোয়াল।ব্যথায় কুঁকড়ে যায় নীহারিকার মুখ।হরিণীর মত চোখজোড়া আরো ব্যাকুল হয়ে উঠে।বাঘের থাবায় পড়া হরিণীর মত ছটফট এক দৃশ্য অল্প সময়ে সবাইকে স্তব্ধ করে তুলে।শান্ত গাছের উপর থেকে চোরা ভাষায় বলল,’ ওই হালারা লাইট মার।বা* আর কতক্ষণ জুল্লা থাকন লাগবো।’
ফাবিহা লাইট এবার শান্তর মুখ বরাবর মেরে কাট কাট গলায় ডাকল,’ চোর!!।’
সাথে সাথে খেপে দৃষ্টি নিচের দিকে দিয়ে শান্ত বেকুব হয়ে কিছু সময় ফাবিহার দিকে তাকিয়ে থাকে।মুখে ক্রদ্ধের ছড়াছড়ি নীহারিকার।ফাবিহা মৃদূ চিৎকার করে বলল,’লজ্জা করে না বন্ধুর নানুর বাড়িতে এসে চুরি করতে?খোদা রক্ষা করো চোরের হাত থেকে।’
শান্ত উপর থেকেই বলল,’ চুরি কি আপনার গাছ থেকে করছি?’
‘ না আমার নানুর বাগান এটা।’
‘ তাহলে উনাকে ডেকে নিয়ে আসুন।সে চোর বলুক আই ডোন্ট কেয়ার।কিন্তু আপনি বললে খবর করে দিবো।’
‘ কি কি খবর করবেন?হ্যাঁ?এখনি নানুকে ডাকছি।শহরের চোর কোথাকার।’
‘ সেটা নিচে নেমে দেখাবো।আগে আম পেড়ে নি।ওই অর্পন লাইট মারবি?না কি নিচে নেমে জুতার বাড়ি দিমু।’
অর্পন লাইট ছুড়ে মারে।মুহিব পাশে শিকরের উপরে বসে আছে।মুহিতা তিশার পাশে।সবাইকে দেখে কিছু সময়ের জন্য নীহারিকার ছটফটানি বন্ধ হয়ে যায়।সবাই দলবল বেঁধে চুরি করতে এসেছে?তাও এত রাতে?আম চুরি?নীহারিকার মাথায় ডুকছে না অসভ্য ছেলেটা তার মুখ কেন ধরে রেখেছে।হাত গুলোও হাতের বাঁধনে।মিতু আপু এবার জহুরি চোখে তাকিয়ে বলল,’ ভাইয়া আপনিও উনাদের সাথে চুরি করতে এসেছেন?’
তাযিন সহজ গলায় উত্তর দিল,’ না।চুরি দেখতে এসেছি।বন্ধুদের একা ছাড়া আমার নিয়মের খেলাপ।’
এত কঠিন কঠিন কন্ঠে কথা কেন বলে মানুষটা বুঝতে পারে না মিতু আপু।এ তাদের ভাই?মিতু আপুর বিশ্বাস হয় না।তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলেন,’ শুনুন ভাইয়া আপনি কাল আপনার দলবল স্যরি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নানুর অনুমতি নিয়ে আম পেড়ে খাইয়েন।বললেই নানু নানুর সব গাছ আপনাকে দিয়ে দিবে।এবার নীহুকে ছাড়ুন।’
রুড গলায় তাযিন বলল,’ আমার পায়ে পাড়া দিয়েছে কেন?’
‘ ও দেখেনি।’
‘ সেটা আমার সমস্যা না কি উনার?’
‘ কারোরই না।এতো অন্ধকারে কিভাবে দেখবে বলুন?’
হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে তাযিন।কেউ অন্ধকারে তেমন টের পেলো না।নীহারিকা ঠিকই ব্যথার অনুভুতি গিলে নিলো।রাগে সে আরো হাত মোচরাতে শুরু করল।এত রাগ কিসের?আশ্চর্য।গম্ভীর গলায় সে বলল,’ তাহলে এত অন্ধকারে বাহিরে কেন এসেছেন?’
‘ খচখচ শব্দ শুনে ভয় পেয়ে এসেছি।ভাইয়া আপনি ওকে ছাড়ুন তারপর কথা বলুন।’ মিতু আপু হাসার চেষ্টা করল।এই মানুষটার সামনে হাসাইতো যাচ্ছে না।তবুও তিনি আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে।কেউ একজন বলেছিল চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই।তাযিন হাতটা হঠাৎ করে ছেড়ে দিল।মুখটাও ছেড়ে দিল।অনেক সময় পরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে ভালো করে নীহারিকা।রেগে সে বলল,’ এত রুড কেন আপনি?ওহ আমার হাত।’
হাত দেখার চেষ্টা করে অন্ধকারে ব্যর্থ হয় নীহারিকা।মিতু আপুর ফোনের লাইট নিচের দিকে।সে দিকে তাকিয়ে সে লক্ষ করে মোটা মুটি মাঝারি সাইজের একটা গর্ত।নির্ঘাত তার পা ভিতরে তলিয়ে যেত।ব্যথা পেত সে।তাযিন পা টা না রাখলেই তার পা অল্প হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হত।অবাক বিস্ফারিত চোখে তাকায় নীহারিকা।তাযিন শরীর সোজা করে গাছের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ভদ্র ভাবে বলল,’আমি সত্ত্বাটাই অদ্ভুত।’
মৃদূ হাসলো সে।চাঁদের আলোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে মুক্তর মত জ্বলে উঠল সেই হাসি।শান্ত এর মাঝে গলাগাল দিয়ে বলল,’ ওই হারাম খোর আম ধরছ না ক্যান?এত কষ্টের ফল আমার।’
নীহারিকা শীতল গলায় বলল,’ আপনারা চুরি করতে এসেছেন কেন?এসব তো আমাদেরই গাছ।’
তিশা ঘুম কাঁতর কন্ঠে বলল,’ ভাই আর বলিও না ওই বলদের এই মুহূর্তে আম চুরি করে খেতে ইচ্ছে করেছে। সে জীবনেও এ কাজ করেনি। তাই প্রচুর আগ্রহ। বিলাতি বান্দর তো। সবাইকে ঘুম থেকে তুলে সে নিয়ে এসেছে।শান্ত তুই কি শান্তি দিবি না?’
‘ না।আমি নামের বিপরীতে কাম করতে পছন্দ করি।বাপ মারে যাইয়া ধর।নাম শান্ত কেন রাখছে।রাখা উচিৎ ছিল অশান্ত।তাহলেই শান্ত হইতাম।’
শান্ত নিজের মুহিতের গেঞ্জিতে আম ভর্তি করে নিয়েছে।অর্পনের আর তাযিনের টি-শার্টে হাত দেওয়া মানে গলায় হাত দেওয়া।তিশার ওড়না দিয়ে দু’টি টিশার্ট ভালো করে পেঁচিয়ে কাঁধে তুলে নেয় শান্ত।ভারী মিষ্টি ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বলল,’আরে চিনি চিনি নীহারিকা যে।শুনো তোমাকেও দিবো।কষ্ট করে এসেছ প্রতিদান দেওয়া উচিৎ।কি বলো সবাই।’
কেউ কিছু বলল না।শান্ত নিজে নিজে বকবক করে সামনের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।নীহারিকা মৃদূ ভাবে বলল,’ ভাইয়া এদিক দিয়ে আসুন।সবাই উঠে যেতে পারে।’
অর্পন তীর্যক চোখে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনারা পিছন দিক থেকে এসেছেন?’
‘ হুম।চলুন এবার।’
চলার সময় নীহারিকা একটু পিছিয়ে বলল,’মিষ্টার অপর্ন আপনার কি দু’বছর আগের কিছু মনে আছে?’
পা থেমে যায় অর্পনের।চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে।হঠাৎ চোখের দিকে এমন ভাবে তাকায় নীহারিকা চমকে উঠে।মৃদূ দূরত্বে সরে গিয়ে অর্পন বলল,’সে তো অনেক কিছু মনে আছে।আপনি কিসের কথা বলছেন?’
নীহারিকা কিছুই বলল না।হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।দূর থেকে আঁবছা শুনতে পেল,’পৃথিবীর মানুষের কি একজীবনের সব মনে থাকে?থাকলেও কি সে তা প্রকাশ করে?’

ভোরের ছোঁপ ছোঁপ রক্তিম ছাপ পড়েছে চারপাশে।নামাজের বিছানায় বসে নীহারিকা এক দৃষ্টিতে বাহিরের বাহারি রূপের সূর্যকে উঠে আসতে দেখছে।সারা রাত তার ঘুম হলো না।ভাবতে ভাবতে সে পাহারের গভীর গর্তে তলিয়ে গিয়েছে।তবুও জীবনের একটি পাতা সে জোড়া লাগিয়ে দিতে পারছে না।বার বার বিছিন্ন হয়ে পড়ছে।হয় তো বিছিন্ন হতে হতেই জুড়ে যাবে ভাগ্য।তাযিন?না বিমুগ্ধ?না কি উভয়?এক মানুষের দুই রূপ হয়?দুই রকম আচরন!মৃদূ ঠোঁট বাকিয়ে সে হাসলো।আসলে কি চায়?তার ভালো না কি খারাপ?হাত গুলো সামনে নিয়ে এসে নীহারিকা দেখে।কব্জি জোড়া লাল বর্ণের আঙ্গুলের ছাপে রূপান্তরিত হয়েছে।গর্ত থেকে বাঁচিয়ে হাত রাঙ্গীয়ে দিল।কি আজব মানুষ!
________________
সবাই মিলে মেলায় যাবে।গ্রামে প্রতি দুই তিন মাস পর পর মেলা হয়।নীহারিকা আগেই বলে দিল সে যাবে না।মা এমন ভাবে চোখ বড় করে তাকাল মনে হচ্ছে এক বিন্দু পানিতে ভালো করে চুবিয়ে তাকে গিলে খাবে।আফিয়ার এমন দৃষ্টির কারণ তাযিন।সে বিনীত কন্ঠে প্রচন্ড ভদ্র সুরে ছোট আন্টিকে বলল,’ছোট আন্টি গ্রামটা কেমন?আমি আগে কখন গ্রামে আসিনি।শুধু আমি না এরাও আসেনি।যদি ঘুরার ব্যবস্থা করা যেত।’
মা দ্রুত হেসে বললেন,’ আরে সমস্যা নেই মিতুরা তোমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।এই জানো মেলা হচ্ছে উত্তর পাড়ায়।’
বেশ মনোযোগী ভাব নিয়ে তাযিন বলল,’ ও তাই না কি।তাহলে তো যাওয়া উচিৎ।’
‘ অবশ্যই।আমি এখনি ওদের ডাকছি।’
পৃথিবী ভদ্র ছেলেদের।অভদ্রের বিন্দুমাত্র কদর নেই।কিন্তু কেউ কি জানে এই মানুষটা ভদ্র স্বভাবের অভদ্র লোক একটা!নীহারিকা রেগে রেগে তৈরি হয়।সাদা কুর্তিতে মুক্তোর পুতির কাজ।নিচের অংশে পালকির মত দৃশ্য।গাছের লতাপাতা তৈরি।সাদা নেটের উপরে দারুন সুন্দর দৃশ্যপট।সম্পূর্ন সাদা হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে।সাথে মিতু আপু আর ফাবিহা।সবার জামা একুই।আসার সময় মা তিনবোনের জন্য পছন্দ করে কিনেছে।তিন বোন যখন এক সাথে বের হল সবাইকেই আলাদা ভিন্ন মনে হলো না।নীহারিকার হিজাবের লম্বা অংশ পিছনে ঝুলে পড়েছে অনেকটুকু।মা এগিয়ে এসে ঝাড়ি দিয়ে বললেন,’ এটা এত লম্বা রেখেছিস কেন?পছনের কেউ যদি উষ্ঠা খায়?’
‘ মা ফালতু বকবে না।আসি।’
নীহারিকা মাকে হালকা জড়িয়ে ধরল।তারপর সদর দরজার কাছে আসতেই আনজুম খুবই দুঃখ প্রকাশ করে বলল,’ তোমরা সবাই একুই রকম জামা পেলে কই?’
ফাবিহা ঢং করে বলল,’ছোট খালামনি দিয়েছে।’
সাথে সাথে ঠোঁট উল্টে নিল আনজুম।মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,’ ছোট আন্টি আমি কি তোমার মেয়ে না?আমারটা কই?’
মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’ আগে তো তোমাকে দেখিনি
তাই কিনতে পারিনি।পরের বার থেকে চার মেয়ের জন্য একুই হবে।’
মেয়েটি ভারী ভালো।ভাইয়া বজ্জাত একটা।আড়চোখে নীহারিকা দেখল কই সেই ভদ্র জাতের অভদ্র পুরুষ!হাত ঘড়িটা এমন ভাবে ঠিক করছে যেন মেলায় না অফিসের গুরুত্বপূর্ন মিটিং করতে যাচ্ছে।মেরুন টিশার্ট।কালো প্যান্ট।মন্দ না দেখতে।যদিও আপাততো নীহারিকার অসহ্য লাগছে।মিতু আপু সবচেয়ে বেশি সেজেছে।এত সুন্দর দেখাচ্ছে যে সবাই কয়েক মিনিট থ হয়ে রইল।ঠোঁটে লাল লিপস্টিক।কপালে টিপ।চুল গুলো বুকের এক পাশে বিনুনি করা।চোখের নিচে গাঢ় কাজল।উপরে গোল্ডেন সেড।অস্থির সৌন্দর্য!নীহারিকা সাজতে পছন্দ করে।কিন্তু মুডের উপরে ভিত্তি করে সেই সাজ।এখন মুড খারাপ তাই সাজও শূর্ন্যের কোঁটায়।
জাওয়াদকে রুম থেকে নীল শার্টে বের হতে দেখেই মাথা গরম নীহারিকার।ফাবিহা বলল,’ ভাইয়া আপনার তো পায়ে ব্যথা।’
‘ তুমি কি সাথে নিতে চাচ্ছো না?’
‘ আরে না না।কিন্তু আপনার যদি অসুবিধা হয়।’
তিনি ছোট করে বড় উত্তরে বললেন,’ হবে না।’

গ্রামের রাস্তা মাটির।আঁকাবাঁকা।মেঠোপথ।পাড়ি জমাতে হবে অল্প কিছু পথ।গাড়ির প্রয়োজন নেই একদম।বাড়ি থেকে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটলে দশ মিনিট লাগবে।কিন্তু সবাইকে অবাক করে তাযিন মামার বাইক খুঁজে নিল।সেটা করে সবার সামনে দিয়ে সাই সাই করে চলে গেল।একে বারে একা।মানুষটা এত স্বার্থপর যে মাথা ধরে যায় দেখলে।এর চেয়ে তার বিমুগ্ধ অনেক ভালো ছিল।তার?নীহারিকা অবাক হয়ে যাচ্ছে।সে কি বিমুগ্ধের চরিত্রের প্রেমে পড়েছে??না কি চেহারার?প্রেমে পড়তে যাবে কেন?ছিঃ।
মাঠে বিশাল আয়োজন।রাস্তা জুড়ে অনেক মজা হয়েছে।সবার সাথে গল্প মজায় কখন যে পথ শেষ টের পাওয়া পর্যন্ত যায়নি।অনেক গুলো দোকান দেখা যাচ্ছে।তবে ভীর আছে অনেক।প্রিয়ম এসে আগে আগে নীহারিকার হাত চেপে ধরে বলল,’আপু তুই এদিক দিয়ে হাঁট।’সাথে সাথে রাজ ফাহাদ এসে বোনেদের হাত এমন ভাবে ধরল যেন কেউ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় জিনিস।ব্যাপারটায় বাকিরা অবাক হয়ে পড়ে।আনজুম বলল,’তোমরা তো আমারও ভাই।আমার হাত ধরছ না কেন?’
হেসে উঠে তার হাতও ধরল।হাঁটতে হাঁটতে নীহারিকা লক্ষ করল কেউ তার ডান পাশে চেপে হাঁটছে।পাশে তাকিয়ে সে চমকে উঠে।তাযিন অন্যপাশের ছেলেদের সাথে বাজে ভাবে ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে।তার পাশে না থাকলে এই সব ধাক্কায় সে শেষ।এখনো ধাক্কা লাগছে অল্প।কিন্তু সে ইচ্ছে করে নীহারিকার গায়ের সাথে লাগতে চাচ্ছে না।নিজেকে সরিয়ে রাখতে চায় সে।কিন্তু ধাক্কার কারণে পাড়ছে না।
চুড়ির দোকানে এসে মিতু আপু সুন্দর সুন্দর চুড়ি দেখে লোভী হয়ে পড়ে খুব।আপু বরাবরই অলংকার প্রিয়।এমন কি নিজের সাথে তাদেরও পড়তে বাধ্য করে।লাল চুড়ি হাতে নিয়ে তিনি নিজের জামার সাথে মিলিয়ে হাসছিলেন।কথা থেকে যেন হুট করে সামনে এসে পড়ে একটি ছেলে।মিতু আপুর হাসি ধূলোর সাথে মিলিয়ে যায়।রাগে মুখটা থমথম হয়ে উঠে।রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে গালে।মিতু আপু কখনো রাগে না।জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েও তাকে হাসতে দেখেছে নীহারিকা।শুধু শাহিন ভাইয়াকে সহ্য করতে পারে না।একদমই না।ছেলেটির নাম শাহিন।দেখা মাত্র আপু অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে।সবাই তার পিছনে পিছনে।
চুড়ির দোকান দখল করে শুধু নীহারিকা দাঁড়িয়ে।তার কিছু চুড়ি পছন্দ হয়েছে।সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে।সামনে একটা আয়না।চারপাশে বাহারি সুন্দর সুতোর কাজের আয়না তার আরো পছন্দ হয়ে বসে।মুখের সামনে আয়না ধরতেই সে আচমকা চমকে উঠে।পিছনে তাযিন দাঁড়িয়ে।সে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।চোখে চোখ পড়তেই সমস্ত শরীর শীতল হয়ে উঠে।হাড়ের প্রতিটি খন্ড খন্ড রোমাঞ্চকর হতে শুরু করে।এমন ভাবে কেউ তাকায়?গরম হাওয়ার সাথে অদ্ভুত অনুভুতি শিহরণ দিয়ে এসে গায়ে লেপ্টে শুভ্র রঙ্গে মিশে যেতে শুরু করেছে।চোখ গুলো এত গাম্ভীর্যতায় ভরাট কেন?মানুষটাকে আবিষ্কার করার অসীম ক্ষমতা কেন যেন তার চাই।আচ্ছা সে কি অলীক কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠছে!
জাওয়াদ এসে দাঁড়ায় পাশে।চোখ ঘুরিয়ে নীহারিকা তাকায় পাশে।একবার দেখে দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে আয়নায় তাকায়।কোথায় গেল?পাছনে ফিরে নীহারিকা খুঁজল।পেলোনা।মুহূর্তের বৃষ্টি যেন!
‘ আমাকে খুঁজচ্ছ?’
নীহারিকা দোকানদারকে প্রশ্ন করে আয়নার দাম কত।একহাজার টাকা শুনেই অবাক নীহারিকা।এত দামের কি আছে?কিন্তু আয়নার চারপাশে হাতের কাজ সাথে পাথরের সাজের জন্য দাম বেশি বলায় সে তর্ক করলো না।আয়না মায়ের খুব প্রিয়।তিনি আয়না দেখতে ভালোবাসেন।তাদের বাসায় মায়ের রুমজুড়ে মোট ছয়টা আয়না রয়েছে।এটা মাকে গিফট করবে।টাকা বেশি নিয়ে আসেনি।ভেবেছে বেশি কিছু তো কিনবে না।যা ছিল সব দিয়ে আয়না আর আপুদের জন্য কিছু জিনিস কিনলো সে।যেমন,মিতু আপুর খুব প্রিয় সাজের জিনিস।ফাবিহার খুব প্রিয় লাল ওড়না।আর নতুন ভাবে আসা বোনের জন্য নুপুর,তিশা আপু আর মুহিতা আপুর জন্য কিনেছে ঝুমকা।শুধু রূবাইদা বাদ।মেয়েটাকে সহ্য হয়না।পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দুই সত্ত্বা।ভালো,খারাপ।নীহারিকার খারাপ সত্ত্বা তাযিনের গার্লফ্রেন্ডকে পছন্দ করে না।তাই সে তাকে বাদ দিয়েছে।চুড়ি অনেক আছে ভেবে নীহারিকা আর চুড়ি কিনলো না।জাওয়াদ মন খারাপ করে বলল,’ তুমি আমাকে ইগ্নোর করছ?’
খারাপ লাগল নীহারিকার।তাই সে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,’ না না।আসলে আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কম কথা বলি।’
‘ তাহলে পরিচিত হই?’ চোখ ছোট করে বিনীত ভঙ্গীতে বলল জাওয়াদ।নীহারিকা কথা কাটিয়ে বলল,’মেলা কেমন লাগছে ঘুরে দেখে বলবেন কিন্তু।’
সে আর দাঁড়ালো না।মিতু আপুর কাছে এসে দাঁড়ায়।মিতু আপুর পাশে শাহিন ভাই হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।একটা সময় তিনি বললেন,’কথা কইবি না?’
আপু সাথে সাথে ঠাস ঠাস করে নিজের হাতের কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে ফেললেন।দ্রুত হাত ধরে নীহারিকা দেখল হাত কেঁটেছে কিছুটা।সবাই হতভম্ব।ফাবিহা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’শাহিন ভাই আপনি জান দয়া করে।সামনে থেকে জান।’
‘ যামু গা মিতুয়া!’
মিতু আপু রেগে বললেন,’ হ যান গা।এহনি সামনে থেইক্কা যান।’
তাযিন শান্ত চোখে তাকিয়ে সব পর্যবেক্ষন করে বলল,’বাসায় চলুন সবাই।আর থাকতে হবে না।আর আপনিও আপনার গন্তব্যের পথে যাত্রা করুন।’
___________________
মেলা তো ঘুরা আর হলো না।সবার চলে আসতে হলো বাসায়।তবে আসার সময় মজার ঘটনা স্বরূপ দেখা গেল প্রিয়ম বাইক চালিয়ে মিতু আপুকে নিয়ে এসেছে।তাযিন নীহারিকাদের সঙ্গী হয়েছে।নীহারিকা অবাক হয়ে ভাবে,নিজে ড্রাইভ করে নিয়ে আসলে কি হত?’
তবে সারা পথের বিরক্তি ছিল রূবাইদা আপু।কথায় কথায় পায়ে ব্যথা।পা শেষ।সব শেষ।হায় হায়ই টাইপের ব্যাপার।
রাতে ঘুমতে এসে নীহারিকা নিজের রুমে আবিষ্কার করল একটি সোনালী বক্স।আগ্রহীত হয়ে সে বক্স খুলেই চরম অবাক।বক্স ভর্তি সব তার পছন্দের চুড়ি।এক রঙ্গের দুই ডজন ভেলভেট চুড়ি করে।চিকনচিকন ভেলভেট চুড়ি গুলো এক সাথে অসম্ভব সুন্দর দেখতে লাগছে।মিতু আপু বা ফাবিহা রেখেছে নিশ্চুয়ই।কারণ তারা জানে নীহারিকার ভেলভেট চুড়ি পছন্দ।সব চুরি দেখে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে উঠে নীহারিকা।এত এত খুশি হয়েছে যে ঠিক করেছে কাল নয় আজই মিতু আপুকে বা ফাবিহাকে তার গিফট দিয়ে দিবে।মিতু আপু রুমে আসে মন খারাপ করে।আজ মিতু আপুর মনটা জঘন্য খারাপ।ভালো করার প্ল্যান করেছে দুইবোন মিলে।এসেই তিনি বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।নীহারিকা অন্তর ঢালা খুশি নিয়ে বলল,’অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু তোকে।’
‘ কেন?’ অবাক হয়ে বলল মিতু আপু।’
‘ চুড়ির জন্য।’
‘ কিসের চুড়ি?’
‘ তুই রাখিসনি তো কে রাখল?ফাবিহা?’
নীহারিকা চুড়ি দেখায়।মিতু আপু একদম জানেনা এমন ভাবেই বলল,’ আমরা কেউ করিনি।কারণ আমি আর ফাবিহা তোর জন্য কিনা গিফট তো কাল দিবো ঠিক করেছি।চুড়ি কেউই কিনিনি।আলাদা কিছু কিনেছি।’
‘তাহলে এগুলো কে দিল?’
বক্স হাতে নীহারিকা বসে রইল।মিতু আপুও ভাবছে।তার মন ভালো হয়ে উঠেছে কিছুটা।একটা সময় সব চুড়ি নিচে ঠেলে দিয়ে একটা সাদা ফকফকে কাগজের দেখা মিলল।চিঠি নয়।চিরকুট রাখা!ভাজ খুলে দ্রুত মিতু আপু।নীহারিকা টেনে নিয়ে বলল,’ আপু তোর লজ্জা করে না বোনের চিরকুটে হাত দিতে।’
মিতু আপু এক গাল হেসে বলল,’ না করে না।আমার তো লজ্জাই নেই।দে পড়ি।’
‘ এই না আমিই পড়ে শুনাচ্ছি।’
লুকিয়ে নীহারিকা একবার পড়তে গিয়ে বলল,’আপু তোর বা ফাবিহার জন্য যদি হয়??’
‘ ভেলভেট চুড়ি দু’জনই অপছন্দ করি।’
‘ সে জানে না মনে হয়।’
‘ তোর মাথা হয়।কেঁচাল মারা বন্ধ কর।পড় তাড়াতাড়ি।আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
অবাক হয়ে নীহারিকা বলল,’ কেন কেন?’
‘ পড়ার জন্য।শুরু কর।’ ফাবিহা এসে হাজির হতেই মিতু আপু মুখ চেপে বলল,’ একটা কথা বললেই ওয়াসরুমে ঘুমাইতে দিমু।আগে পড়া শেষ হোক।
চাপে পড়ে নীহারিকা ভাজ খুলে।বুকটা চিনচিন করে উঠে।যেন চিরকুট থেকে এক বুক হাওয়া এসে মুখে আঁচড়ে পড়ছে।জানালাটা খোলাই আছে।নীহারিকার চুল সত্যি সত্যি হাওয়ায় তালে দুলছে।
শুরুতে কোন সম্বোধন নেই।মিতু আপু বিরক্তি নিয়ে বলল,’কি বা* যুগে এসে পড়লাম।চিঠি লিখতে বসে সম্বোধনের কথা ভুলে যায়।কেউ কেউ কিছু সম্বোধনই করে না।পড় পড়।বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।আল্লাহ হু আকবার।’ মিতু আপুর ভাব এমন যেন যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।হেসে ফেলল নীহারিকা।ঠোঁটে সূর্যের কিরণের নেই হাসি রেখে সে পড়ল,

“ তোমার ওই স্বপ্নচক্ষু দুটি আমার দারুন প্রিয়
এই দীর্ঘ জীবনদ্দশায় আমি এত সৌন্দর্যে ডুবা চক্ষু আগে কখনো দেখিনি।আকাশের নক্ষত্রগুলোর নেয় অদ্ভুত জ্বলন্ত ক্ষমতার চক্ষুজোড়া আমাকে তথ্য ভাণ্ডারের সন্ধান দিচ্ছে।
তুমি কি জানো,তোমার ওই চক্ষুজোড়া আমার সামনে তোমার হৃদয় নামক বস্তুটিকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করছে!
যা মুহূর্তে আমি পড়ে নিচ্ছি।সাবধান!চক্ষুলুকিয়ে রাখতে শিখো।ভাষা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকো।
আচ্ছা তুমি কি চক্ষুপড়তে জানো?হৃদয়ের সবচেয়ে বিপদজনক,তথ্য ফাঁসকারী এই চক্ষু কিন্তু।”?
____________________
গল্পটি পরিবার নিয়ে।পরিবারের মানুষ,তাদের দুঃখ কষ্ট ভালোবাসা জড়িয়ে থাকবে গভীর ভাবে।বড় পরিবারে অনেক মানুষ অনেক ভাই বোন থাকে।তাদের সবার জীবনে ঘটে আলাদা আলাদা সব ঘটনা।পরিবারে থাকে অতিত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ,সাথে থাকে কিছু অজানা রহস্য। পরিবারের সব মানুষ হয় আলাদা ব্যক্তিত্ববান।তাদের মাঝের কেউ হাস্যকর,কেউ মজাদার,কেউ রাগী,তো কেউ দুঃখি।সাথে কেউ থাকে রহস্যময়।পৃথিবীতে যেমন হাজারো সত্ত্বার মানুষ থাকে পরিবারেও থাকে।এটি সহজ গল্প হয়ে উঠবে সবার কাছে।প্রথমে সবই কঠিন থাকে।বিমুগ্ধ সবচেয়ে অদ্ভুত চরিত্র।এই গল্পের ভিত্তি সে।তাই ওকে এমন করে সাজানো হয়েছে।পড়তে পড়তে তার সাথেও মানিয়ে যেতে পারবেন পাঠকরা।ইনশাআল্লাহ।ধন্যবাদ সবাইকে।
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here