#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সপ্তম
“দুদিন আগে নষ্টামি করতে গিয়ে সম্মানহানি করল। আর এখনেই দেখো মেয়ের মুখের থেকে হাসি যেন সরছেই না। নষ্ট মেয়ে একটা!”
“এসব চরিত্রহীন মেয়েকে বাসায় রাখাই উচিত না। এদের দেখে আমাদের মেয়েগুলো খারাপ হবে।”
তারার কানে কথাগুলো যেতেই তারা একবার মহিলাটার দিকে তাকাল। দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে তারার নামে নিন্দা, মন্দ করে যাচ্ছে। দুজনেই তারার প্রতিবেশী। আজ তনয়ার বিয়ে। সকালে সবাই তারাকে গায়ে হলুদ দিয়ে, গোসল করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেখানেই তারা সবার সাথে হাসি আড্ডায় মত্ত ছিল। সেদিনের পর মাঝে ৩/৪দিন কেটে গেছে। এই ৩/৪দিনে আহসান সাহেব বাদে বাড়ির বাকিরা স্বাভাবিক হয়েছে। সবাই তারার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। তারাও আগের মতো একদম স্বাভাবিক। যেন আগের মতোই রয়েছে সব। কিছু হয় নি। সেদিনের সবকিছু যেন দুঃস্বপ্ন। পাশের একজন মহিলা পুনরায় বলে উঠলেন,
“ফাহিমের মা-বাপ ভালো বলেই আজ এই মেয়েকে মেনে নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে কোনোদিন মানত না। অস’ভ্য মেয়ে একটা। এতদিন কত ভালো ভেবে এসেছিলাম। কিন্তু তলে তলে যে এই মেয়ে এত দূর কে জানত?”
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”
হুট করে তারার কণ্ঠস্বর মহিলা দুজন চমকে উঠলেন। আমতা আমতা করে দুজনেই সালামের উত্তর দিলো। তারা তাদের কাছে এসে দাঁড়াল। মুখ জুড়ে চওড়া হাসি। চোখ, মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই, এই মেয়ে কি কান্ড ঘটিয়েছিল। তারা হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,
“রাহেলা আন্টি, পপি আপু যেন কোথায়?”
তারার কথা শুনে রাহেলা বেগমের মুখ চুপসে গেলো। তার বুঝতে দেরি হলো না যে, তারা কেন এই প্রশ্ন করেছে। রাহেলাকে চুপ করে থাকতে দেখে তারা অপর পাশে ফিরে নাজমা বেগমকে প্রশ্ন করল,
“নাজমা আন্টি, অমিত ভাই এই কাজটা করল কিভাবে? নিজের ঘরে বউ, সন্তান রেখে অন্য একটা সুগার মাম্মিকে বিয়ে করল। ইশ! কি লজ্জার বিষয়! তা আন্টি আপনার বয়সী কাউকে আপনি পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছেন তো? সুগার মাম্মির তো আবার গুলশানে বাড়ি আছে শুনলাম। সেই লোভে হলেও আপনি মেনে নিবেন। যতই হোক, আপনি তো আবার লোভ সামলাতে পারেন না। ”
তারার কথা শুনে নাজমা বেগম রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকাল। গর্জে বলে উঠলেন,
“তারা, মুখ সামলে কথা বল।”
তারা হাসল। দাত কেলিয়ে বলল,
“আপনারা তো জানেন, আমি সব সামলাতে পারলেও মুখটা ঠিক সামলাতে পারিনা। কি যেন বলছিলেন, রাহেলা আন্টি? ‘আমাকে দেখে আপনার ছেলেমেয়ে খারাপ হবে’, তাইতো? তা পপি আপুকে কি আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম, বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য? শুনলাম, পপি আপু নাকি প্রেগন্যান্ট?”
রাহেলা বেগম আমতা আমতা করে বললেন,
“হ্যাঁ। ”
তারা আগের থেকে দ্বিগুণ খুশি নিয়ে লাফিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। খুবই ভালো খবর। তা আন্টি পপি কি শশুড় বাড়ি?”
রাহেলা বেগম কি বলবে ভাবছে। তার উপর তারা আবার বলে উঠল,
“ওহো, স্যরি! পপি আপুর স্বামী তো আবার তাকে পরকিয়ার অপবাদ দিয়ে আপনাদের বাড়ি ফেলে রেখে গেছে। আচ্ছা আন্টি, বাচ্চাটা আসলে কার?”
নাজমা বেগম কাজের বাহানায় চলে গেলেন। রাহেলা ও তার পিছু পিছু ছুটল। তারা চলে যেতেই তারা শব্দ করে হেসে উঠল। পেছন ফিরতেই দেখল নয়ন তার খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। তনয়া তারার পাশে এসে দাঁড়াল। তারার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“একেবারে উচিত শিক্ষা হয়েছে। এদের মতো কিছু পাবলিকের কাজেই হলো অন্যের বাড়ি নিয়ে কানাঘুষা করা। নিজের ঘরের খবর নেই, আসছিল অন্যের মেয়েকে নিয়ে নিন্দা রটাতে। এদের মুখে আসলে এমন করেই ঝাটা মে’রে বিদায় করতে হয়।”
তারা মুচকি হাসল। তনয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুমিই তো শিখিয়েছো কোন পরিস্থিতিতে কি করে প্রতিবাদ করতে হয়।”
তনয়া হাসল৷ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
“নিজের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হয়। কিন্তু তুই পারিস না। ভুল করেছিস। মানুষের মিথ্যে হুমকিতে ভয় পেয়ে নিজের সম্মানে কালি লাগিয়েছিস। এটার মাশুল তোকে দিতেই হবে। কিন্তু তাই বলে মুখ বুঝে সব অন্যায় মেনে নিবি না। প্রতিবাদ করবি। সবসময় চুপ থাকলে হয়না। বুঝলি?”
“তুমি বুঝেছো আর আমি বুঝব না তা কি হয়?”
তনয়া হেসে তারার নাক টেনে বলল,
“হয়েছে, এবার আসুন। ওইদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বলেই গোসলের জায়গায় চলে গেল। তারা সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন ওর হাত টেনে ধরল। তারা পেছন ফিরে দেখল ফাহিম দাঁড়িয়ে আছে। ফাহিমকে দেখেই তারা এক গাল হেসে হেচকা টানে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। শান্ত স্বরে বলল,
“যেখানে সেখানে হাত ধরে টানাটানি করেন কেন, ফাহিম ভাই?”
ফাহিম প্রতিউত্তরে বলল,
“এখন তো তুই আমার বউ। তাহলে সমস্যা কোথায়?”
তারা আগের ন্যায় ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,
“উহু! বউ হয় নি এখনো। যখন বউ হবো। তখন দেখা যাবে।”
ফাহিম সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তুই আসলেই এই বিয়েতে রাজি? ”
“অবশ্যই। কেন কোনো সন্দেহ আছে নাকি?”
“না মানে..?”
“এত মানে মানে করবেন না, ফাহিম ভাই। এত ভাবতেও যাবেন না। দেখা যাবে এইসব ভাবতে গিয়ে আপনার মাথাটাই ঘুরে গেছে। তখন আমার কি হবে বলুন তো?”
শেষের কথাটা তারা বেশ ইনোসেন্ট ফেস করে বলে উঠল। তা দেখে ফাহিমের ঠোঁট জুড়ে সে কি হাসি! বলল,
“তুই থাকলে আমার কিছু হবেনা। আমি একদম ঠিকঠাক থাকব, জান। কিন্তু তুই না থাকলে আমি মরেই যাব রে, তারা।”
ফাহিম কথা শেষ করতে না করতেই তারা ফাহিমের মুখ চেপে ধরল। আঁতকে উঠে বলল,
“ফাহিম! এসব বলবে না একদম। তুমি এসব বললে আমার কষ্ট হয়।”
ফাহিম নিজের কানকে বিশ্বাস করতেই পারছে না। কি শুনছে এসব? তারা ‘তুমি’ বলে সম্মোধন করছে! আশ্চর্য!
“কি বললি?”
“হ্যাঁ! বিশ্বাস করো আমার অনেক কষ্ট হয়। তোমাকে তো অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার ভালোবাসা এতদিন পায়ে ঠেলে দূরে ফেলে দিয়েছি। নয়ন ভাইকে ভালোবেসেছিলাম। আর সে কি করল? আমাকে অবিশ্বাস করল। তোমাকে জড়িয়ে নোংরা কথা বলল। তার জন্যই আজকে আমাকে সবাই নোংরা মেয়ে বলে। এতকিছুর পরেও আমি তার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই এখন সব ভুলে শুধু তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই, ফাহিম। আমাকে ভালোবেসে রাখবে তো নিজের কাছে। আমার একটু সুখের প্রয়োজন। দিবে তো?”
ফাহিম যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছে। খুশিতে চোখের পলক পড়ছে না। মন চাচ্ছে তারাকে কোলে তুলে নাচতে। কিন্তু তারা যদি রেগেমেগে আবার বেঁকে বসে তাই নিজের ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখল। তারার গালে হাত রাখল। তারা অবশ্য একটু নড়ে উঠছে। কিন্তু কিছু বলল না। ফাহিম বলল,
“দিবো। তোকে আমি সব দিবো। তুই শুধু আমার থাকিস। আমি তোকে সব দিয়ে দিব। তোর জন্য আমার জানটাও হাজির রে, জান। অনেক বেশি ভালোবাসি তো।”
তারা প্রতিউত্তরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে উঠল,
“আচ্ছা, আমাকে ওইদিকে ডাকছে। আমি এখন যাই।”
ফাহিম মাথা নাড়াতেই তারা সেদিকে ছুটল। আর ফাহিম খুশিতে নিজে নিজেই নাচতে শুরু করল। তারা পেছন ফিরে ফাহিমের এহেন কান্ড দেখে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“শালা! পা’ঠা! তোর নাচানাচি কি করে বন্ধ করতে হয় তা আমি বেশ ভালো করে জানি।”
বলেই নিজের গাল ঘষতে লাগল। নিজের রুমের দিকে ছুটল। রুমে গিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে মুখ সাবান দিয়ে কয়েকবার ধুয়ে নিলো। নিজের ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই চোখ চড়ক গাছে। অবাক স্বরে বলল,
“আপনি? এখানে?”
নয়ন এতক্ষণ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমি। কেন ফাহিমকে আশা করেছিলি বুঝি?”
তারা চুপসানো মুখে উত্তর দিলো,
“ছিহ! না। ওই গা’ধারে কেন আশা করব? হালায় এক নাম্বার লুচ্চা। যখন তখন গায়ে হাত দেওয়া শুরু করে। বিরক্তিকর!”
নয়ন তারার মুখের রিয়েকশন দেখে ঠোঁটে চেপে হাসল। কিন্তু তারাকে বুঝতে দিলো না। তারার হাত ধরে টেনে এনে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারার দুই পাশে হাত রেখে, তারার মুখের উপর ঝুঁকতেই, তারা চোখ বন্ধ করে নিলো। বুকের ভেতর হৃদ যন্ত্রটা লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। তারা জিভ দিয়ে কয়েকবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। নয়ন মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তারার দিকে চেয়ে আছে। হুট করে তারার গালে জোরে কামড় পড়তেই তারা ব্যাথায় চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথে নয়ন তারার ঠোঁট জোড়া নিজের করে নিলো। অনুভূতির স্রোতে ভেসে গেলো দুজন। তারা নিজের অজান্তেই নয়নের শার্ট খামচে ধরেছে। নয়নের সাথে নিজেও তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নয়ন তারাকে ছেড়ে দিয়ে, তারার কানে কানে বলে উঠল,
“গালের কামড়টার কথা মনে রাখিস। আর একবার যদি ফাহিম তোকে ছুঁয়েছে, তাহলে পরের বার এমন জায়গায় কামড় দিব যে, কাউকে দেখাতে পারবি না।”
বলেই তারাকে সাইড করে দরজা খুলে শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। তারা আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাল ঘষছে। দৌড়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই দেখল, গালে কয়েক দাঁতের ছাপ স্পষ্ট। সেই সাথে লাল হয়ে আছে। দেখেই তারা চিন্তায় পড়ে গেলো। এই মুখ নিয়ে এখন বাইরে বের হবে কি করে? মনে মনে নয়নের গুষ্টি উদ্ধার করে বলে উঠল,
“আইছে এখন ঢং করতে। নিজেই বিয়েতে রাজি হতে বলল, নিজেই ফাহিমের সাথে ঢং করতে বলল। আর এখন সব দোষ আমার হয়ে গেলো।”
বলেই খাটের উপর ধপ করে বসে পড়ল। গাল হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগল, কি করে রুমের বাইরে যাবে?
#চলবে
[দুঃখিত, নানু বাসায় ছিলাম। তাই সময় করে লিখে উঠতে পারি নি। ক্ষমা করবেন। ইন শা আল্লাহ রেগুলার দিব।]