প্রিয় নয়নতারা পর্ব ৬

0
85

#প্রিয়_নয়নতারা
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ষষ্ঠ

“ফাহিম কি তোর সাথে ফিজিক্যালি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছে, তারা?”
তারা চমকে তাকাল। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
“ঘনিষ্ঠ কিছু হয়নি। কিন্তু সে আমাকে ব্যাড টার্চ করেছে।”
কথাটা শুনেই নয়নের হাত দুটো তারার গাল থেকে সরে আসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। তারার থেকে পিছিয়ে গেল। তা দেখে তারার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। নয়নকে সরে আসতে দেখে তারা শব্দ করে কান্না করে উঠল। উঠে এসে নয়নের হাত দুটো আকঁড়ে ধরে বলতে লাগল,
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যাবে না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। হ্যাঁ, মানছি আমি ভুল করেছি৷ আমার তোমাকে আগেই সব কিছু জানানো উচিত ছিল। আমি তা করিনি এটা আমার ভুল। সব কিছু আমার ভুলে হয়েছে। আমার ভুলের জন্যই এতগুলো মানুষ সাফার করছে। আমি সব মেনে নিচ্ছি কিন্তু তুমি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো, প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ।”
তারা একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো বলে উঠল। নয়নের দৃষ্টি অন্য দিকে। চেহারার কাঠিন্যে ছাপ স্পষ্ট। তারার কথা শেষ হতেই নয়ন হাত ছাড়িয়ে নিল। তারা অবাক চোখে তাকাল নয়নের দিকে। তাহলে কি ফাহিম তারাকে ব্যাড টার্চ করেছে বলে, নয়ন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? তারার গলায় কান্নাগুলো ঝট পাঁকিয়ে আসল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কণ্ঠ স্বর থেকে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল তারা। অবাক পানে চেয়ে শুধু নয়নের দিকে। অবাক স্বরে বলে উঠল,
“তুমি আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে কেন নিচ্ছো, নয়ন ভাই?”
নয়ন চুপ রইল। কোনো উত্তর দিলো না। তারা এবার নয়নের দিকে তাকিয়ে হাসল। কেন হাসল জানেনা। এ হাসি খুশির নয়। আবার দুঃখের ও না। এটা তাচ্ছিল্যের হাসি। তারার নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। ফাহিমের হাতের ছোঁয়া মনে পড়তেই, শরীর শিউরে উঠল। নয়নের মুখটা হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আমার দিকে তাকাতে ঘৃণা হচ্ছে, নয়ন ভাই?”
নয়ন অবাক চাহনী নিক্ষেপ করল তারার দিকে। ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”
তারা আগের ন্যায় হাসল। বলল,
“অবশ্য, ঘৃৃণা হবারেই কথা। আমার মতো একটা মেয়েকে শুধু ঘৃণা করা যায়। ভালোবাসা যায়না। আমি ভালোবাসা ডির্জাভ করিনা তাইনা, নয়ন ভাই?”
নয়ন বুঝতে পারল, তারা কষ্টের থেকে কথাগুলো বলছে। তাই তারাকে শান্ত করতে তারার গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
“এসব কী বলছিস তুই? একদম এসব ফালতু চিন্তা ভাবনা মাথায় আনবি না।”
তারা নয়নের চোখে চোখ রাখল। পরক্ষণেই নয়নের হাত দুটো ছিটকে বলে উঠল,
“একদম ছুঁবে না আমাকে। একদম না৷ আমি খারাপ। আমার শরীরে পরপুরুষের বিশ্রি ছোঁয়া লেগে আছে। একটা ছেলের সাথে একই রুমে, একই বিছানায় ছিলাম। অপবিত্র আমি। কলঙ্কিত হয়ে গেছি। আমাকে তুমি ছুঁবে না। আমার মতো চরিত্রহীন, নির্লজ্জ মেয়েকে ছুঁয়ে তোমার হাত নষ্ট করো না, নয়ন ভাই। আমা…।”
তারার সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই নয়ন তারার গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিল। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে থা’প্পড় মে’রেছে। ব্যাথায় ডান পাশটা চিনচিন করে উঠল। মাথার মধ্যে ঘুরছে৷ নয়ন থা’প্পড় মে’রেই তারাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। তারার মাথাটা নিজের বুকে চে’পে ধরে বলে উঠল,
“আর একবাদ যদি নিজেকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিস, তাহলে আমার থেকে বেশি খারাপ কেউ হবে না।”
তারা থামবার পাত্রী না৷ নয়নকে দুই হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল,
“আমাকে ছাড়ো। আমাকে ছুঁবে না তুমি। ছেড়ে দাও আমাকে। আমি এত কলঙ্ক নিয়ে কী করে বাঁঁচব? আমাকে সবাই চরিত্রহীন মেয়ে বলেই জানে। আমার জন্য আমার বাবা এখন বাইরে মুখ দেখাতে পারবে না। সবাই বাবাকে দেখলেই বলবে৷ ‘আহসান সাহেবের’ ছোট মেয়ে চরিত্রহীন। এত অপমান, লাঞ্চনা, কলঙ্ক নিয়ে আমি সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারব না, নয়ন ভাই। আমি ম’রে যাব। যতবার ফাহিম ভাইয়ের বিশ্রি ছোঁয়ার কথা মনে পড়ে ততবার আমি ঘৃণা, লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। এত এত যন্ত্রণা নিয়ে আমি বাঁচব কিভাবে?”
কাঁদতে কাঁদতে তারার হেচকি উঠে গেছে। নয়নের চোখের কোনেও পানি। তারাকে শান্ত করতে নয়ন আরো শক্ত করে তারাকে আকঁড়ে ধরল। এবার তারা নয়নের শার্ট দুই হাতে খামচে ধরে শব্দ করে কান্না করতে লাগল। নয়ন তারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“অন্য একজন তোকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে বলে, তুই বাজে হয়ে গেছিস। অপবিত্র হয়ে গেছিস। কে বলল তোকে?”
তারা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠল,
“আজকে থেকে সবাই তাই বলবে।”
নয়ন দুই হাতে তারার চোখের পানিটুকু মুছে দিল। তারার গালে আলতো করে হাত রাখল। বলল,
“আমার দিকে তাকা।”
তারা আঁখি তুলে তাকাল। নয়ন অশ্রুসিক্ত সেই আঁখি পানে চেয়ে বলে উঠল,
“তোকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে তো কী হয়েছে? অন্য একজনের স্পর্শে তুই বাজে হয়ে যাবি? কখনোই না। আমার তারু আমার স্পর্শ ছাড়া সর্বদাই কুমারী।”
বলেই নয়ন তারার কপালে চুমু খেলো। তারা খুশিতে ডুঁকরে কেঁদে উঠে নয়নকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙে নয়ন বলে উঠল,
“চল আমার সাথে।”
বলেই নয়ন তারার হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। মাঝ পথে থেমে গিয়ে প্রশ্ন করল,
“জিজ্ঞেস করলি না, ‘কোথায় যাচ্ছি’?”
তারা হাসল। বলল,
“আপনার উপর আমার ভরসা আছে।”
নয়ন প্রতিউত্তরে হাসল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে জাহানারা বেগমকে দেখতে পেয়ে সোজা বলে উঠল,
“আম্মু, আমি তারাকে বিয়ে করব। আজ, এখন, এই সময়ে।”
নয়নের কথা শুনে জাহানারা বেগম আর তারা দুজনেই যেন আকাশ থেকে পড়ল। জাহানারা বেগম পাউরুটিতে জেলি মাখছিলেন, নয়নের কথা শুনে হাত থেমে গেলো। বিস্মিত স্বরে বললেন,
“কী বললি?”
“আমি তারাকে বিয়ে করব।”
জাহানারা বেগমের হুঁশ আসল। জোরে বলে উঠলেন,
“কী বলছিস তুই? বিয়ে করবি মানে? বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি?”
নয়ন পাত্তা দিল না সেসব কথায়। নিজের মতো করে বলে উঠল,
“তুমি তারাকে ভালোবাসো, আম্মু?”
“এটা কেমন প্রশ্ন? তারা আমার মেয়ের মতো। ওকে ভালোবাসব না তো কাকে ভালোবাসব?”
“তাহলে তারার ক্ষতি হোক তা কি তুই চাও?”
জাহানারা বেগম থেমে গেলেন। উত্তর দিলেন না। নয়ন পুনরায় প্রশ্ন করল,
“ফাহিমের সাথে বিয়ে করে মেয়েটার জীবন নষ্ট হোক তা কি তুমি চাও?”
এবারো তিনি চুপ রইলেন। নয়ন মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“তোমার ছেলে তোমার মাথা নিচু করবে না, আম্মু। একটু ভরসা করো আমাকে। আমি তোমার সম্মান নষ্ট হতে দিব না। তুমি যদি আমার পাশে না থাকো, তাহলে আমি এক পাও এগিয়ে যেতে পারব না, আম্মু। থাকবে না আমার পাশে?”
জাহানারা বেগম ছেলের কথায় ভরসা খুঁজে পেলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“থাকব। তুই ছাড়া আমার ভরসা করার কেউ নেই আর।”
“তাহলে আমি যা করব ভেবে নাও সবার ভালোর জন্যই করব।“



তারা দরজায় কলিং বেল বাজাতেই, তনয়া এসে দরজা খুলে দিল। তারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, চিন্তিত স্বরে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলি তুই? সবাই কত চিন্তা করছিল জানিস?”
তারা হাসল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“এবাড়িতে তুমি ছাড়া আমাকে নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই এখন।”
বলেই তনয়াকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে আসল।।তনয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজা আটকে দিতে দিতে বলল,
“তাহলে আমাকেই বলে যাওয়া উচিত ছিল তোর। না বলে বাড়ির বাইরে পা রাখবি না। আশেপাশের মানুষ দেখলে কথা শুনাতে একবারও ভাববে না।”
তারা আগের ন্যায় হেসেই জবাব দিল,
“দোষ করলে কথা শুনাবে এটাই স্বাভাবিক। এতকিছু গায়ে মাখানোর সময় নেই আমার।”
তনয়া আর কথা বাড়াল না। জিজ্ঞেস করল,
“এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই?”
তারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে রিমা বেগম বলে উঠলেন,
“কোথায় আর যাবে খোঁজ নিয়ে দেখ আবার কোন ছেলের সাথে গিয়ে লেপ্টে ছিল।”
রিমা বেগমের কথা শুনে তনয়া গর্জে উঠে বলল,
“চাচি, এত বয়স হয়ে গেলো আর এখনো ভদ্র ভাষায় কথা বলা শিখলেন না?”
রিমা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“তনু, তোর বোনের মতো দেখছি তোরও উন্নতি হয়েছে। বড়দের কি করে সম্মান করতে হয় জানিস না? দুদিন পর শশুড় বাড়ি যাবি, তাদের সাথেও এভাবে আচরণ করবি নাকি?”
তনয়া গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিল,
“আমার শশুড় বাড়ির মানুষ আপনার মতো না, চাচি। তারা যথেষ্ট রুচিশীল, ভদ্র এবং শিক্ষিত।”
রিমা বেগম কিছু বলে উঠার পূর্বেই তনয়া তারার হাত ধরে হনহন করে রুমের দিকে চলে গেল। আর রিমা বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলেন।



পরের দিন সকালে ভোরে ঘুম থেকে উঠতেই তারার ডাক পড়ল। নিচে নেমে আসতেই দেখল ড্রয়িং রুমে বাড়ির সবাই উপস্থিত। নয়ন আর জাহানারা বেগম ও আছেন। তারা নেমে আসতেই আহসান সাহেবের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তা দেখে তারা কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিল। কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করল,
“আমাকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে, চাচ্চু?”
মোস্তফা সাহেব বলে উঠলেন,
“একটু অপেক্ষা করো। যা বলার ভাইজান বলবেন।”
আহসান সাহেব প্রতি উত্তরে বলে উঠলেন,
“এই মেয়ের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। তোদের যা কথা বলার আছে বলে নে। আমাকে এসবের মধ্যে ডাকবি না। আমি এই মেয়ের মুখ দেখতেও চাইনা।”
বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন। তারার চোখে কোনে পানি জমতে শুরু করেছে। মোস্তফা সাহেব বললেন,
“যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। এখন, সম্মান রক্ষার্থে ফাহিম আর তারার বিয়ে ঠিক করেছি আমরা সবাই মিলে। তাতে তোমাদের কারোর আপত্তি আছে?”
বাড়ির সবাই মোস্তফা সাহেবের সিদ্ধান্ত মেনে নিল। এবার তিনি তারাকে প্রশ্ন করলেন,
“তোমার কোনো আপত্তি আছে, তারা মা?”
তারা সাথে সাথে উত্তর দিল,
“যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করতে আবার কিসের আপত্তি, চাচ্চু?”
তারার উত্তর শুনে মোস্তফা সাহেব আর ফাহিম দুজনেই অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলেন। ফাহিম যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ও কি ভুল শুনল? শিওর হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল,
“তোর সত্যিই কোনো আপত্তি নেই, তারা?”
তারা হাসল। ঠোঁট জুড়ে হাসি। বলল,
“একদম না। ”
ফাহিমের বিশ্বাস হলো না। যে মেয়ে কাল অব্দি ফাহিমকে সহ্য করতে পারছে না সে হঠাৎ এক রাতে কি করে বদলে গেল?

#চলবে

[এক লাইনের মন্তব্য করে যাবেন পারলেন। তাহলে লেখার আগ্রহ বাড়ে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here