#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৫
ভোরের আসার কথা শুনে তিতাসের মা ও চাচী ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলেন। ভোরকে দেখে উনারা হাসলেন, খুশি হলেন।
অবশেষে মেয়েটা আসল। তবে ভোর একবুক কষ্ট চেপে বসে আছে একথা উনারাও অবগত। তবুও মেয়েটা নিদারুণভাবে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। যেন এই পৃথিবীর একমাত্র সুখী ব্যক্তি সে। যার জীবনে নেই কোনো দুঃখ কষ্ট এবং বিষাদের ছাতছানি। অথচ ওর অভ্যন্তরও রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত। আর
সেটার উপলব্ধিদাতা কেবল সে নিজে। তারপর উনারা হাসি মুখে ভোরের পাশে বসলেন, কুশল বিনিময় করলেন। বাসার সকলের খোঁজ খবর নিলেন। এভাবেই দু’এক কথা হতে হতে গল্পে মেতে উঠলেন। ভোরও ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি এঁটে উনাদের সঙ্গ দিতে লাগল।একটুপরে, খিলখিল হাসির শব্দে মুখোরিত হলো চারিপাশ। সেই সঙ্গে তৈরি হলো আনন্দমুখর পরিবেশ। যেখানে সবাই উপস্থিত। আজকে প্রায় অনেকদিন পর বাসায় আড্ডা জমেছে, জমপেশ আড্ডা। তাই চাচী উঠে নিজে গিয়ে হরেক রকমের নাস্তা বানিয়ে আনলেন। তিতাস আর রোজা সেগুলোর উপর হামলে পড়ল। কাড়াকাড়ি করে যে যার পছন্দের জিনিস তুলে নিলো। তখন চাচী ওদেরকে ধমকে থামিয়ে আস্তে ধীরে খেতে বললেন।সবাই খেতে খেতে দুইদলে ভাগ হয়ে লুডু নিয়ে বসল।তিতাসের বাবা আর ভোর একদিকে আর চাচী আর ওর মা এদিকে। আর রোজা হচ্ছে রেফারি। কোন দল খুব ঝামেলা করছে সে দেখছে। যে বেশি ঝামেলা করবে তাকে লাল কার্ড দেখানো হবে।তারপর খেলা
অনুযায়ী শুরু হলো তাদের মধ্যে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই। প্রায়
দেড় ঘন্টা পর তাদের খেলা সমাপ্ত হলো। তিতাসের মা এবং চাচী জিতেছেন। উনারা পঁচাচ্ছেন ভোরদের। তখন ফোনে কল আসায় ভোর বলল,
-‘মা, আমি গেস্ট রুমে যাচ্ছি। একেবারে ফ্রেশ হয়ে আসব।”
-‘আচ্ছা।’
একথা বলে সে কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে প্রস্থান করল। পিয়াসের রুমে গিয়ে ক্ষত দগদগে করার ইচ্ছে তার নেই। সে এমনিতেই অদৃশ্য অনলে দগ্ধ হচ্ছে। বুকচাপা কষ্টে গুমড়ে মরছে। মনে পাথর চেপে সে এখানে উপস্থিত হয়েছে।শুধুমাত্র তিতাসের মায়ের কাছে করা ওয়াদা পালনের জন্য। নয়তো এ বাড়িমুখো হতো না সে। ভোর রুমে যাওয়ার পরেও তিতাস থমথমে মুখেই বসে রইল। কারণ ভোরের হঠাৎ করে এখানে আসাটা ব্যাপারটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। তাছাড়া তাকে এখানে দেখলে অনেকেই বাঁকা নজরে দেখবে। হয়তো দু’একটা কটু কথাও শুনিয়ে দিতে পারে। আর না ভেবে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মেয়ে ভোর নয়। তবে ভোরকে নজরে রাখতে হবে নয়তো বিপদ অনিবার্য। তিতাস আর না বসে পিয়াসের রুমে তালা আঁটকে আসল। চাবিটাও নিজের কাছে রেখে দিলো। মূলত সে চাচ্ছে না ভোর ভুলেও সেখানে যাক। নতুবা অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হবে। ওর পরিবার সবার আগে ওর দিকে আঙুল তুলবে। অনেককিছুর জবাব তাকে দিবে। যা এই মুহূর্তে জানানো তার পক্ষে সম্ভবও নয়। এর চেয়ে সজাগ থাকা শ্রেয়। তবে সে নিশ্চিত, ভোর এখানে এমনি আসে নি। নিশ্চয়ই ওর মাথায় কিছু চলছে। নয়তো সে কিছু নিয়ে সন্দেহ করছে।
তারপর রাত বাড়লে সবাই একসঙ্গে খেতে বসলেন। টেবিল ভর্তি হরেক রকমের পদ। তিতাস নিজের মতো করে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বাকিরা চুপচাপ। শুধু চামচের টংটাং শব্দ হচ্ছে। আর সবার মনে চলছে একটাই ভাবনা, একটাই নাম, পিয়াস। একপর্যায়ে পিয়াসের জন্য ওর মা শব্দ করেই কেঁদে ফেলছেন। পিয়াসের চেয়ারটা ফাঁকা দেখে উনি চোখে পানি আঁটকাতে পারলেন না। উনাকে কাঁদতে দেখে কেউই আর মুখে খাবার তুলতে পারলেন না। ভোরও চোখ মুছতে মুছতে উঠে চলে গেল। এমনিতেই এখানে আসার পর থেকে বিয়ের দিনে কথা বারংবার মনে পড়ে যাচ্ছে। কষ্টও বাড়ছে।
এই ড্রয়িংরুম, এই মানুষগুলো, এইসব সাজানো গোছানো আসবাবপত্র, সবই আছে। শুধু যার ভরসাতে এসেছিল সে নেই। ভোর রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদেই ফেলল। একটা মেয়ের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার তার স্বামী।
আর সেই অলংকার পাওয়ার পরপরই হারিয়েছে সে। কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে ভাবনায় ডুবে গেল।
ওদের বিয়ের দিনের ঘটনা……!
সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ের সাজে লাজে রাঙা হয়েছিল ভোর। ভাবি আর বান্ধবীদের দুষ্টু কথাবার্তায় গাল দু’টোতে ছড়িয়েছিল রক্তিম আভা। চোখে ছিল স্বামী নামক মানুষটাকে নিয়ে রঙিন একরাশ স্বপ্ন। হাতভর্তি মেহেদী দিয়ে মাঝে লিখেছিল পিয়াসের নাম। মেহেদী রং গাঢ় দেখে সবাই বলেছিল, সে বর সোহাগি হবে। বর তাকে ভালোবাসার শুভ্র চাদরে মুড়িয়ে রাখবে। একথা শুনে সে মনে মনে বলেওছিল, ‘আমিন, আমিন, আমিন।’
বিয়ের দিন বধূ বেশে যখন পিয়াসের পাশে বসেছিল। তখন ওর সব বন্ধুরা সিটি বাজিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল।
সে লজ্জায় নতজানু হয়ে কাঁপছিল। ডাক্তারাও লজ্জা পায়,
এ কথা সে প্রমাণ করেছিল। ওর সকল অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে সুখ উপলব্ধি করছিল। তখন পিয়াস মৃদু হেসে বলেছিল, ‘তুমি নামক পুতুলটা আজ থেকে আমার, একান্ত শুধুই আমার।’
পিয়াসের বলা কথাটা ভোরের কানে এখনো বাজে। মনে হয় সে তার আশেপাশেই আছে। তারপর বাবা- মা যখন বিদায় দিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন। চলন্ত গাড়িতেও কাঁদছিল সে। তখনো ওই স্বামী নামক মানুষটা তাকে সযত্নে আগলে রেখেছিল। কতগল্প বানিয়ে হাসানোর বৃর্থা চেষ্টা করেছিল।
তারপর যখন নব্য স্বপ্ন সাজিয়ে এই বাসাতে পা রেখেছিল,
তখন নতুন বউ দেখতে অনেকেই ভীড় জমিয়েছিল। নিয়ম পালনে বড়রা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন পিয়াস মৃদু স্বরে বলেছিল,
-‘একটু কষ্ট হলেও এসব জ্বালাতন সহ্য করে নাও। আমাকে এখানে থাকতে দিবে না, কি সব মেয়েলি নিয়ম কানুন আছে নাকি। আমি উপরে যাচ্ছি, প্রয়োজনে কল দিও। ”
পিয়াসের সঙ্গে ওইটুকু তার বলা শেষ কথোপকথন। এরপরে মানুষটাকে পেয়েছিল, তবে মৃত। যখন চেঁচামেচি শুনে সেও উপরে গিয়েছিল। তখন সুগন্ধযুক্ত ফুলে সজ্জ্বিত বিছানায় পিয়াস উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। পরণে ছিল বিয়ের পোশাক।
আর হাতের মুঠোয় ছিল একমুঠো লাল গোলাপের পাপড়ি।সেগুলো শক্ত হাতের মুঠোতে পিষ্ট হয়ে নেতিয়ে নিজস্ব সুগন্ধ হারিয়েছিল। তখনো তার অন্য হাত থেকে গড়িয়ে যাচ্ছিল, লালরঙা র’ক্তে’র ধারা। সেই র’ক্তে’ ভিজে গিয়েছিল বিছানায় চাদর, আর স্বযত্নে হলুদ গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লিখা তার নাম। কত্ত সুন্দর করে পাপড়ি দিয়ে লিখেও ছিল, ‘পিয়াসের ভোর থেকো চিরন্তন।’ আর ভোর নামটার উপরে ছিল তার ‘কা’টা হাতখানা। আর র’ক্তে’ ভিজে গিয়েছিল ভোরের নাম।
হলুদ পাপড়ির উপর লাল র’ক্ত’ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। তা দেখে শিউরে উঠেছিল তার পুরো শরীর। সেই মুহুর্তে থমকে গিয়েছিল ওর পৃথিবী আর হারিয়েছিল সে সুখ নামক রঙিন অনুভূতি। সেদিন পিয়াস লাল র’ক্তে’ শুধু তার নামই ভেজায় নি, উপহারস্বরুপ দিয়েছে বিধবার তকমা, সঙ্গে কেড়ে নিয়ে গেছে ওর মুখে হাসি।
পূর্বের কথা ভেবে ভোর এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। তখন কেউ একজন বলে উঠল,
-”বেঁচে আছেন নাকি কাঁদতে কাঁদতেই মারা গেলেন?”
-”কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, এখান থেকে যা তিতাস।”
-”কফি বানিয়েছি, খাবেন?”
-”উফ, বিরক্ত করিস না, প্লিজ।”
-”ঝাল কিছু বানিয়ে দিবো?”
-”না।”
-”ফ্রিজে রসমালাই, আইসক্রিম, পেস্ট্রি আছে, আনি?”
-”বলছি তো না!”
-”তো কি খাবেন, আমার মাথা?”
-”দে।”
-”আগে বিয়ে করে নিলে ভালো হতো না? তৃপ্তিসহকারে খেতে পারতেন।”
-‘আমার ভালো লাগছে না। জ্বালাস না তো, রুমে যা।”
-‘আমি দিয়াশলাই নাকি যে জ্বালাব? আজব কথাবার্তা।”
-”তুই কি যাবি?”
-”নাহ।”
-‘এই তোরা দুইভাই আমাকে পেয়েছিসটা কি হ্যাঁ? আমি কি মানুষ না? আমার মন নেই, কষ্ট হয় না আমার? আমি কি খেলায় পুতুল?তোরা কেন আমাকে জ্বালাস, বলবি আমায়? কি রে বল, কি অপরাধে এভাবে পুড়ায় আমায়?”
একথা বলতে বলতে ভোর হাঁটুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। তিতাস নিঃশব্দে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বাড়িয়ে দিলো একমগ ধোঁয়া ওঠা কফি। ভোর নিলোও না, মুখ তুলে দেখলও না। সে কাঁদতে ব্যস্ত। আজ কেন জানি সে চোখের পানি আঁটকাতে পারছে না। হয়তো দগদগে ক্ষততে টান লেগেছে, ব্যথা বেড়েছে, এজন্য বোধহয়। তখন তিতাস মগটা পাশে রেখে বলল,
-”আপনি আসলেই খুব নোংরা প্রকৃতির মেয়ে ,ছিঃ!”
তিতাসের এ কথা শুনে ভোর অশ্রুসিদ্ধ চোখে মুখে তুলে তাকাল। চোখে বিষ্ময়! মানে কী? নোংরা, তাও আবার সে?
ভোর তড়িৎ গতিতে উঠে তিতাসের কলার ঝাঁকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
-‘কি? আবার বল? আমি কি?”
-”আপনি নোংরা।”
-”তোর সঙ্গে কি নোংরামী করলাম?”
-”একথা কখন বললাম?”
-”তাহলে নোংরা বললি কেন?”
-”এই যে নাক দিয়ে সর্দি বের হচ্ছে আপনার। সেটা পরিষ্কার না করে বার বার ফসফস করছেন, আবার তা টেনে গলায় নিয়ে কুত করে গিলে খেয়েও ফেলছেন। তাহলে আপনাকে নোংরা বলব না তো পরিষ্কার বলব?”
ভোর রাগে দুঃখে জবাব দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল। না এই ছেলে, চরম পর্যায়ের বেয়াদব, অসভ্য। এর সঙ্গে কথা বলায় বৃর্থা। এজন্য সে তিতাসের কলার ছেলে হনহন করে বাইরে চলে গেল। তখন ড্রয়িংরুমে বাকিরাও ছিলেন। উনারা স্বাভাবিকভাবে ভোরকে নিয়ে পুনরায় খেতে বসলেন। এবার
হাসি ঠাট্টা করেই সবাই খেলেন। আর তিতাস অদূরে দাঁড়িয়ে
বুকে হাত রেখে বড় সড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ল। পরদিন সকালে, সকাল আটটার দিকে তিতাস হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামল। চট করে বসে গোগ্রাসে খাবার গিলতে লাগল। ওর খাওয়া দেখে ওর বাবা বললেন,
-”আস্তে খাও, গলায় আঁটকে যাবে।”
-”বাঁধার আগে পানি ঢেলে রেডি করে রাখো।”
ছেলের কাজে ওর বাবা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘সব সময় ছটপটানি, এই তুই কি ডাক্তার? ডাক্তার হতে হয় শান্ত স্বভাবের, নরম সরম। ”
-” না, আমি সুইপার। এখন যাচ্ছি, একজনের ওয়াশরুম পরিষ্কার করতে। তার নাকি অর্ধেক কাজ সারতেই কমোড ব্লক হয়ে গেছে। আমি গিয়ে সেটা পরিষ্কার করলে সে বাকি কাজ সারবে।”
খাবার টেবিলের এমন কথা শুনে ওর বাবা মুখ কুঁচকে বসে রইললেন। এটা দেখে তিতাস ভ্রু কুঁচকে পুনরায় বলল,
-“এমন ভাব দেখাচ্ছ, মনে হচ্ছে ওয়াশরুমে যাওই না। অথচ কোষ্ঠিকাঠিন্যের রোগী হয়ে দিনের অর্ধেক সময় সেখানেই কাটাও। একথা কাউকে কখনো বলিনি আর বলবোও না।
তোমার ছেলে হয়ে এসব গোপন রাখা আমার গুরু দায়িত্ব। তাছাড়া লোক লজ্জারও একটা ব্যাপার আছে। নয়তো সেই কবেই তোমার ছবি দিয়ে পোষ্টার লাগিয়ে বলতাম, ‘ এই দেখুন এই জেলার দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য রোগী। তিনি
ওয়াশরুমে সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দোবোধ করেন। কমোড উনার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু। আপনারা দোয়া করুন উনাদের বন্ধুত্ব যেন স্মরণীয় হয়ে থাকেন।”
ছেলের এমন লাগামহীন কথার তোড়ে ওর বাবা উঠে চলে গেলেন। মূলত যেতে বাধ্য হলেন। বাকিরা উচ্চশব্দে হেসে খেতে লাগলেন। ভোর এখানে নেই, তার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। তিতাস খেয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে
হাঁটা ধরল। হঠাৎ’ই দাঁড়িয়ে গিয়ে প্যান্টের চেইন আঁটকে পা বাড়াতেই ভোরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভোরকে মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ কুঁচকানোর কারণ বুঝলও, আজব তাড়াহুড়োয় চেইন লাগাতে ভুলে গেছে। এখানে মুখটা এমন করার কী আছ?তিতাস কথা না বাড়িয়ে মেয়েদের মতো মুখ ভেংচিয়ে বেরিয়ে গেল।
To be continue……!!