প্রিয় তুই পর্ব ২৯

0
820

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_২৯

এখন সকাল আটটা বেজে চার মিনিট। ব্যস্তমুখর এ জীবনে সবাই যে যার কর্মে ব্যস্ত। তিতাসের বাবা নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়েছেন। গতরাতে উনি অনেক বড় ডিল সাইন করেছেন।
এবার আশা করা যাচ্ছে ভালো কিছু’ই ঘটবে। সব বাঁধা বিঘ্ন
পেরিয়ে নতুনভাবে সবটা শুরু করতে পারবেন। এতদিন উনি জানতেন, বাবারা ছেলেদেরকে অনুপ্রেরণা জোগান। ছেলের কাঁধে হাত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেন।একবার
ব্যর্থ হলে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে সহায়তা করেন। কিন্তু তিতাস সেটা উল্টো করে দেখিয়ে। উনি সত্যি সত্যি মনোবল হারিয়ে ফেলেছিলেন, এসব ঝামেলায় সবকিছুকে হেলাও করতেন। কিন্তু তিতাসের একটা মেসেজ উনাকে নতুন উদ্যোগে চেষ্টা করার ইচ্ছে জাগিয়েছে। উনি বুঝেছেন উনার ছোট ছেলেটা উনার পাশে আছে, শক্তি রুপে। এতে যেমন নিজের কাজের প্রতি উনি মনোবল ফিরে পেয়েছেন, তেমনি মনের জোরও।
উনি চলে যাওয়ার পরে ভোর আর রোজা মিলে ফলের জুস
বানিয়ে গ্লাসে রাখল। দু’জন গল্প করতে করতে সিদ্ধ ডিমের
খোসা ছাড়াল। তিতাসের আম্মু রান্নাঘরে পরোটা ভাজছেন।
রোজা আর ভোর খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। এবার তিতাস আসলেই তারা খেতে বসবে। ইতিমধ্যেই ভোর গিয়ে তিতাসকে দুইবার ডেকেও এসেছে। কিন্তু তিতাস গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার গুলোতে নজর বুলাচ্ছে, বিরবির করে পড়ছে। হাতে কলম তুলে নিয়ে খাতায় অগোছালোভাবে কীসব লিখছেও।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঘড়িতে সময় দেখে একেবারেই রেডি হয়ে নিলো। এবার নিচে গিয়ে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়বে। এসব ভেবে সে শরীরে পারফিউম স্প্রে করে চুলগুলো ব্রাশ করল।
নিজেকে পরিপাটি দেখে ঘুরতেই দেখে ভোর দাঁড়িয়ে আছে।
তিতাসের মা তাকে পুনরায় পাঠিয়েছেন। তিতাস ওকে দেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কপালের মাঝখানে চুমু এঁকে মৃদু হাসল।
তারপর ভোরের নাক টেনে বলল,

-”’বেস্ট অফ লাক’ সিনিয়র বউ। শুভ হোক আপনার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত।'”

-”একথা তো আপনাকে বলা উচিত ডাক্তার সাহেব।”

-”তো বলুন নিষেধ করেছে কে?”

ভোর জবাব না দিয়ে তিতাসের শার্টের কলার ঠিকঠাক করে পকেটে এক হাজার টাকা গুঁজে বলল,

-”সাবধানে যাবি, সাবধানে ফিরবি, অপেক্ষায় থাকব আমি।”

তিতাস তৃপ্তির হাসির হেসে সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। আজ সে ভীষণ খুশি। অনেকদিন পর নিজেকে কেমন হালকা মনে হচ্ছে। শরীর জুড়ে অন্যরকম অনুভূতির আভাস পাচ্ছে। সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। চারপাশের সবকিছু রঙিন লাগছে। নব্য রুপে জীবনটাকে রংধনুর মতো রাঙাতে বড্ড ইচ্ছে জাগছে।
এসব ভেবে তিতাসের ওষ্ঠের কোণে হাসি ফুটল। সেই সঙ্গে দেখা গেল তার চোখে তৃপ্তির চাহনি। ভোর এবার তিতাসকে তাড়া দিয়ে নাস্তা করতে যেতে বলল। অতঃপর দু’জনে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়েছে, তখন ভোর থেমে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

-”সত্যিই কি তোর ছাব্বিশটা গফ ছিলো?”

-”হুম, মিথ্যে বলতে যাবো কেন?”

-”এতগুলোকে সামলাতে পারতি?”

-”আমি সামলাতে যাবো কেন, আজিব।”

-”তো তোর গফদের অন্য কেউ সামলে দিতো?”

-”ওরে হিংসুটে বউ রে আপনি যা ভাবছেন তা নয়।”

-” তাহলে? ”

-”গফ মানে কি শুধু প্রেমিকাকেই বোঝায়?”

-”তা নয় তো কি?”

-”আমি সেই গফের কথা বলি নি। গফ মানে গার্ল ফ্রেন্ডকে বুঝিয়েছে। যাদেরকে খাঁটি বাংলায় বলে বান্ধবী, সহপাঠী। আপনারা মেয়েরা আসলেই একটু বেশিই বুঝেন। বারংবার প্রমাণ দেন, আপনাদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে। নিজে থেকে কিছু বোঝার চেষ্টা তো করবেনই না।আবার কেউ সঠিক বোঝাতে চায়লে তা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উল্টো বুঝে বসে থাকেন।আপনিই
ভাবুন,সত্যি সত্যিই ছাব্বিশটা প্রেমিকা থাকলে ডাক্তারী পড়া হতো আমার? মেডিকেলের বই কী আসলেই এতটা সোজা?
তাছাড়া এসব করে বেড়ালে বাবা আমাকে আস্ত রাখত?গফ মানে আমি বান্ধবীকে বুঝি। তাই কেউ জিজ্ঞাসা করলে গফ বলে তাদের পরিচয় করায়। আমরা গফ’রা একথা জানেও।
এছাড়া চিপায় গিয়ে হাতাহাতি করার সম্পর্ক এদের কারোর সঙ্গে গড়া হয় নি আমার। যদি এমন করতাম ভাইয়া চাপকে সোজা করে দিতো।কারণ ভাইয়া এসব করত না আমাকেও
নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তবে মজা করে দু’একজনকে ডেয়ার টেয়ার নিয়ে ফুল দিয়েছি, চিঠি দিয়েছি। এসব কথা
আমার বাবা-মাও জানে। উনাদের রাগাতে ইচ্ছে করে এমন করতাম। এসব ছাড়া আমি খুব ভদ্র ছেলে। এমনকি আমার
বউটাকে পোড়া ঠোঁটে চুমু খাবো না ভেবে রেগুলার সিগারেট খাই না। তবে টেষ্ট মনে রাখতে মাঝেমধ্যেই দু’চার টান দিয়ে ফেলি। আর হ্যাঁ, গতরাতে যেসব কথা বলেছেন ভুলেও আর উচ্চারণ করবেন না। শুধু একটা কথা স্মরণে রাখবেন, এই তিতাস আপনাকে কখনো মিথ্যা বলবে না, কখনো না। তাই কিছু জানার অথবা বলার থাকলে সোজা-সাপ্টা বলবেন।”

-”হুম।”

-”এক কাজ করুন আপনিও চটজলদি রেডি হয়ে আসুন। দু’জন এক সঙ্গে বের হই।”

ভোর তিতাসের দিকে একবার তাকিয়ে হেসে দ্রুত রেডি হতে গেল। তারপর দু’জনে নাস্তা সেরে একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়ল। আজ থেকে ভোরও হসপিটালে যাবে, রোগী দেখবে। তিতাস নিজেই একথা গতপরশু জানিয়েছে। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ ভোরের অজানা। এ ছেলেটার কখন কী মনে হয় তার বোধগম্য হয় না। তবে রবিনের পরিবর্তে তার জন্য সহকারী হিসেবে রেখেছে মিজানকে।সে তিতাসের খুব কাছের বিশ্বস্ত একজন। রবিনের কথা জিজ্ঞাসা করাতে বলেছে, সে নাকি কিছুদিন বাবার সঙ্গে থাকবে। অফিসে খুব চাপ তাই বাবাকে সাহায্য করবে। তাই এই ব্যাপারে ভোরও আর কিছু বলে নি। কারণ ওর বাবার পরে বর্তমানে তিতাসই তার জন্য নিরাপদ কেউ। আর যায় হোক তিতাসের দ্বারা তার কোনো ক্ষতি হবে না, একথা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। আর ওর জুনিয়র বর একজন দায়িত্বশীল পুরুষ। সে জানে পরিবারটাকে কীভাবে
আগলে রাখতে হয়।
এসব ভেবে ভোর ওর রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।রোগীর চাপ বেশি থাকায় সময়ও অতিবাহিত হতে থাকল। ভোরের
হসপিটালে আসার কথা জানতে আয়মানেরও সময় লাগল নি। একথা শুনেই সে তাৎক্ষণিক ছুটে এসেছে।রোগীর চাপ রেখে ভোর এখন তার সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিবে না নিশ্চিত। এজন্য একগুচ্ছ গোলাপ হাতে এসি গাড়িতে বসে ভোরের অপেক্ষায় সে। সেই সঙ্গে নানান পরিকল্পনা করে সে
কিছু ভাবছে আর কুটিল হাসছে। এই ভোর মেয়েটা সত্যিই বড্ড বোকা। সে আপনজনদের খুব বেশি ভরসা করে, ফলে ঠকেও বেশি। এই যেমন, ওর বাবার থেকে কিছু ইঙ্গিত পেয়ে
তিতাসদের বাসায় এসেছিল। এবং পিয়াসের মৃ/ত্যু/র জন্য তিতাসকে সর্বপ্রথম সন্দেহ করেছিল। তবে তিতাস যে ধূর্ত, ভোরের পরিকল্পনা বুঝে ফেলেছিল। পরে ভোরের অজান্তেই বাসার সকলকে যেভাবেই হোক বিয়ের জন্য রাজি করাতে বলে। তখন উছিলা হিসেবে সারাও নোংরা কথা বলে সুযোগ করে দেয় তিতাসের মাকে। আর ভোর তিতাসের মায়ের এত
ইমোশনাল কথা শুনে আবেগী হয়ে নিজে তিতাসকে বিয়ের কথা বলে। আর তিতাসও তখন লুফে নেয় ভোরের প্রস্তাব।
আর এখানে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় ভোরের বাবা। উনাকে প্রায় দেখা যেতো, তিতাসের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। হোক সেটা, কোনো রেস্টুরেন্ট অথবা নিরিবিলি কোনো স্থান। উনি
কীভাবে যেন তার উদ্দেশ্যে ধরে ফেলেছিলেন। এজন্য উনি নিজেই তিতাসকে তাড়া দিতেন ভোরকে বিয়ে করার জন্য।
পরিশেষে মেয়ের বিয়ে দিয়ে যাওয়ার পথে সে নিজেই গাড়ি
এক্সিডেন্ট করিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল পিচ ঢালা রাস্তায় উনাকে পি/ষে ফেলতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি। কিন্তু পরে যখন ভোরের বাবার বাঁচার সম্ভবণা দেখা দিলো, তখন সে নার্সকে টাকা খাইয়ে উনার অক্সিজেন মাক্সটা খুলে মৃ/ত্যু/র দুয়ারে পাঠিয়ে দিলো। আর ভোরের মা ধকল সামলাতে না পেরেই অক্কা পেয়েছে। আর উনার মৃ/ত্যুে/র পর সে মিশানকে এটা বুঝিয়েছে, ভোরের জন্যই এমন হয়েছে। কী দরকার ওখানে গিয়ে তিতাসকে বিয়ে করার, সে বিয়ের কথা না বললে ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই ওখানে যেতেন না। আর এমন মর্মান্তিক কিছু ঘটতোও না। একথা শুনেই সে রেগে ভোরকে শেষবার তাকে মাকে দেখতেও দিয়েছিল না। এমনকি তিতাসকেও ওর মৃত ভাইয়ের কসম দিয়ে আঁটকে দিয়েছিল। হাস্যকর হলো, ভোর এবং তিতাসের বাসার সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে সে অবগত। তিতাসের চাচীর কাহিনীতেও সে ভীষণ মজা পায়,
ওই মহিলা আসলেই ধূরন্ধর। আহারে গো বেচারা তিতাস।
বোনটা মান সন্মানের ছিঁটেফোঁটা তো রাখেই নি। এখন চাচী
নিজের রুপ দেখাচ্ছে। শাহিনা যেহেতু তিতাসকে প্যারাতে রেখেছেই তাই এই কয়েকদিন সে বিশ্রামেই ছিল। বসে বসে তিতাসের বেগতিক অবস্থা দেখছিল, মজা নিচ্ছিল। বেচারা তিতাস আসলেই একটা চিজ বটে নয়তো এতদিনে সবছেড়ে ছুঁড়ে পালিয়ে যেতো। তিতাস উচ্ছন্নে যাক, ভোরকে পেলেই হবে তার। আর ভোর যেহেতু বাইরে বেরিয়ে এসেছে এবার খপ করে ধরে উড়াল দিবে দেশের বাইরে। তবে আজই এটা করা যাবে না, পাখি কেবল বের হয়েছে, একটু ডানা ঝাঁপটে উড়ুক। তারপর নাহয়..!!

রোগী দেখে ভোর তিতাসের অপেক্ষা বসে আছে। এতক্ষণে তিতাসের চলে আসার কথা। ওর কথা ভুলে আবার কোথাও চলে গেছে নাকি কে জানে। সে তো আবার চঞ্চল পুরুষ।এক স্থানে মন বসে না তার।এসব ভেবে ভোর আর কিছুক্ষণ বসে কল দিলো তিতাসের নাম্বারে।তিতাস ওর কল কেটে মেসেজ করেছে, ‘বাইরে আসুন।’
ভোর হ্যান্ড নিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। মিনিট দুয়েক পরেই তিতাসকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। সে মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভোরের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। তার বাম হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। ফুল দেখে ভোরের ঠোঁটে হাসি ফুটল। রজনীগন্ধার সুভাষ তার ভীষণ প্রিয়। তাও যদি হয় জুনিয়র বরের থেকে তাহলে তো কথায় নেই। ভোরের তিতাসের দিক তাকিয়ে কেন জানি আজ মনে মনে বলেই ফেলল,
-”এই পাগল প্রেমিকটা শুধু আমার, একান্তই আমার।”

একথা বলতেই তার মুখশ্রী লাজুক রাঙা হয়ে উঠল। তখনই তিতাসের পাশ দিয়ে ছুটে গেল চলন্ত একটা বাইক। তিতাস ততক্ষণে গলায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সে গলা থেকে ওর হাত নামাতেই দেখে র/ক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে গলা বেয়ে। ভোরের জন্য আনা শুভ্র রজনীগন্ধার উপরে লাল র/ক্তে/র ফোঁটা।
তিতাস হাত থেকে তার হতবাক দৃষ্টি সরিয়ে ভোরের দিকে তাকাতেই দেখে ভোর জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার লুটে পড়েছে।

To be continue…………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here