প্রিয় তুই পর্ব ২২

0
566

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_২২

তিতাস তার পরীক্ষা শেষে ফুরফুরে মেজাজে গেল ফুলের দোকানে। পরীক্ষা হয়েছে মন মতো। এজন্য মন একটু বেশি ভালো। সে দোকানে গিয়ে লাল গোলাপ ও রজনীগন্ধা ফুল কিনল। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। ভোর এই প্রথম মুখ ফুটে তার কাছে কিছু চেয়েছে। তাই না দেওয়া পর্যন্ত মন অস্থির অস্থির লাগছে। পরীক্ষার খাতায় লিখতে লিখতেও ভেবেছে
সঙ্গে আর কী কী দিবে। আর কী পেলে ভোর খুব খুশি হবে?
কাজল নাকি চুড়ি? মনমতো কিছু পেলে ভোর আবেগী হয়ে কী তাকে জড়িয়ে ধরবে? নাকি জুনিয়র ভেবে মুখ ভেংচিয়ে বলবে, ‘খবরদার আমার পটাতে আসবি না। ছোট ছোটোর মতোই থাক। নয়তো থাপ্পড়ে তোর প্রেমিকগিরির শখ ঘুচিয়ে দিবো।”
যদিও একথা সে বলতেও পারে। রাত দিন যেই হারে পঁচায় তাতে বলাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এসব ভেবে সে গোলাপ
ফুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। গোলাপ ওর মায়ের ভীষণ পছন্দ। গোলাপ পেলে উনি ছোট বাচ্চাদের মতো ভীষন খুশি হয়। আনন্দ যেন উপচে পড়ে উনার পুরো মুখজুড়ে। খুশিতে ফুলগুলোর সুগন্ধ নিতে থাকেন বার বার। আর সেই দৃশ্যটুকু মন ভরে দেখে সে। আগে মাঝেমধ্যেই পিয়াস হুটহাট ফুল এনে ওদের মাকে দিতো। তিতাস একদিন বেশ বিরক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করেছিল,

-”ফুল না এনে খাবার আনলেও তো পারো ভাইয়া?”

-”উহুম, আম্মু খাবারের চেয়ে গোলাপই বেশি পছন্দ করবে।গোলাপ পেয়ে উনি খুশি হয়ে যেই হাসিটুকু দেয়। সেই হাসিটা অমূল্য ভাই, অমূল্য। এটার সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় না।”

এরপর থেকে সেও হুটহাট ফুল কিনে ওর আম্মুকে উপহার দিতো। এতে উনি খুশি হয়ে অশ্রু ঝরাতেন। আর এখন ভোর এবং ওর আম্মু এই দু’জন নারীর স্থান তার কাছে সবকিছুর
ঊর্ধ্বে। তার হাসির কারণ, বাঁচার কারণ। তাই তাদের মুখে হাসি ফুটাতে ছুটে এসেছে ফুল কিনতে। ফুল দেখে যদি তার প্রিয় মানুষ দু’টো কিঞ্চিৎ হাসে তাহলেই তার সব কষ্ট স্বার্থক।এসব ভেবে সে বাইক নিয়ে চলল বাসার পথে। না জানি ঠোঁটে ব্যথা নিয়ে ভোর তাকে কত গালি দিয়েছে। এখন গিয়ে ব্যথা উপশমের কিছু একটা করতে হবে। প্রয়োজনে পুনরায় কা’ম’ড় বসাবে ভোরের ওই মিষ্টি অধরে। আর উপহারস্বরুপ কিল, ঘুষি, থাপ্পড়, যায় ভাগ্যে জুটুক সাদরে গ্রহনও করবে।
তাছাড়া, সিনিয়র বউয়ের গোমড়া মুখ তার আবার ভালো লাগে না, মন কাঁদে, হৃদয় পুড়ে। দেহখানা অস্বস্থিতে ভুগে।
এসব ভাবতে ভাবতেই তিতাস দ্রুত ব্রেক কষে ভ্রু কুঁচকে
তাকিয়ে রইল। ওদের গাড়ি দেখে মুখে গালি এনেও গিলে ফেলল। এভাবে কেউ পথ আঁটকায় আর একটু হলেও তো
সে ছিঁটকে পড়ত। ততক্ষণে গাড়ির ড্রাইভার তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে বলল,

-”তিতাস ভাই, আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে খুঁজছি।”
-”কেন, কি হয়েছে?”
-”ভাবি ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে। বড় মেডাম নতুন
হসপিটালে নিয়ে গেছেন। আর আপনাকে যেতে বলেছেন।”
-”কখন পড়েছে?”
-”সকালে আপনি বের হওয়ার পরপরই।”
-”বাসায় ফিরেছে এখন?”
-”না।”

তিতাস ভুলেও আর একটা শব্দও ব্যয় করল না। সে দূরন্ত গতিতে চলল হসপিটালের দিকে। ড্রাইভার মিথ্যা বলছে সে বুঝে গিয়েছে। কারণ সামান্য কথা বলার সময় উনার কন্ঠ প্রচন্ড কাঁপছিল। বাসার বুয়া থেকে শুরু করে মালি অবধি তাকে কেন জানি ভয় পায়। তারা যখন মিথ্যা বা অন্যকিছু লুকাতে চায় তখন তারা এভাবে তোতলায়। আর সেও অতি বুঝে যায় মিথ্যার রাখঢাক। তাছাড়া এখন ড্রাইভারের দৃষ্টি নড়বড়ে। সচারাচর মিথ্যা বলার সময় কারো দৃষ্টি যেমনটা থাকে ঠিক তেমন। আর মানুষ সত্য লুকাতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। অর্থাৎ ভোরের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে।রবিন পইপই
করে ড্রাইভারকে বলে দিয়েছে একথা বলার। যেন টেনশনে তিতাস দূর্ঘটনা না ঘটিয়ে বসে। আর মায়ের কথা বলা যাবে না কারণ মা ভক্ত ছেলে সে। না জানি একথা শুনবে সে কী করবে। এদিকে, অজানা ভয়ে তিতাসের মুখ শুকিয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপছে। এমনটা হয়েছিল ওর আম্মুর অসুস্থতার সময়। বার বার মনে হতো আম্মুকে হারিয়ে ফেলবে, চিরতরে
একা হয়ে যাবে। তবে এখন ভোর কথা শুনে বুক শূন্য শূন্য লাগছে। চিনচিন ব্যথা অনুভব বুকের বাঁ পাশে। না জানি সে এখন কেমন আছে? কি অবস্থায় আছে?এসব ভেবে তিতাস বাইকের স্পিড বাড়িয়েও কাজ হলো না। কিছুদূর গিয়ে বাঁধা পড়ল বিশাল জ্যামে। রাগে দুঃখে টেনশনে সে খামছে ধরল নিজের মাথার চুল। আর এই পথ ছাড়া বিপরীত পথও নেই। এখন যেতে হলে তাকে জ্যাম ছুটার অপেক্ষা করতে হবে। না জানি ওদিকে কী অবস্থা।তিতাসের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে
গেল। সামনেই পরিচিত এক প্রতিবেশীর দোকান আছে। সে প্রতিবেশীর দোকানের সামনে বাইক রেখে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল। এই জ্যাম দুই ঘন্টাতেও ছুটবে নাকি সন্দেহ। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হলো ভোরের তাকে প্রয়োজন, তাকে করুণ সুরে ডাকছে। তার সঙ্গ কামনা করছে। এসব ভেবে সে দৌড় শুরু করল। তাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে কতজন বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। অতঃপর দৌড়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে দেখে দুটো মালবাহী ট্রাক উল্টে পড়ে আছে। আর এজন্যই জ্যাম বেঁধেছে। তিতাস জ্যাম পেরিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে বসল। তখন ড্রাইভারের থেকে গাড়িটা নিলেও সমস্যায় পড়ত। না নিয়েই ভালো করেছে। তারপর পনেরো মিনিটের মধ্যে হসপিটালে পৌঁছে, সে রিসিপশন গিয়ে জিজ্ঞেস করে তিনতলায় চলে গেল। সেখানকার চেয়ারে রবিন মাথায় হাত রেখে বসে ছিল। এতক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে কেবলই বসেছে।হঠাৎ তিতাসের দিকে চোখ পড়তেই ছুটে এসে কিছু বলার আগে তিতাস বলল,

-”ভোর কোথায়? ঠিক আছে সে?”
-”ওটিতে।”
-”সিরিয়াস কিছু?”
-”আসলে ঘুম..।”

তখন একজন নার্স এসে রবিনের হাতে ওষুধের লম্বা লিস্ট ধরিয়ে চলে গেলেন। আর বলে গেলেন দু’জন পেশেন্টেরই অবস্থা খারাপ। দু’জনে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে এর পরপরই আরেকটা মেডিসিন খেয়েছেন। ফলে তাদের র/ক্ত চলাচল অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। একপর্যায়ে নাক মুখ দিয়ে র/ক্ত বেরিয়ে তাদের শরীর এখন র/ক্তশূন্য। রবিন যেন আরো সাত থেকে আট ব্যাগ র/ক্ত জোগাড় করে রাখে। নয়তো বিপদ অনিবার্য। একথা বলে নার্স ওটিতে ছুটলেন।তখন তিতাস প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-”নার্স আর কাদের কথা বলল রবিন? কারা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে?”

রবিন এবার ধীরে ধীরে পুরো ঘটনা তিতাসকে খুলে বলল।
তিতাস নিশ্চুপ হয়ে শুনে সেখানকার চেয়ারেই বসে পড়ল। ওর শরীর যেন ক্ষণিকেই শক্তিহীন হয়ে গেল। একফোঁটাও শক্তি পাচ্ছে না সে উঠে দাঁড়ানোর। তবে এবার সে নিশ্চিত তার মা আর ফিরবে না। আর হয়তো দেখতে পাবে না সেই প্রাণখোলা হাসি মুখখানা। দোষ করলে কেউ চোখ রাঙিয়ে শাষণ করবে না। তার বোধহয় দেওয়াও হবে না সদ্য কেনা গোলাপ গুলো। অন্তত সে তো জানে তার মায়ের শরীরিক অবস্থা। আর নাক মুখ দিয়ে র/ক্ত বের হওয়া মানে মোটেও
সাধারণ ব্যাপার নয়। এমনিতেই উনি অসুস্থ। তখন তিতাস উঠে দাঁড়িয়ে ওটির দিকে পা বাড়িয়েও পিছু ফিরে বলল,

-”আচ্ছা রবিন, আমি আগে কার কাছে যাবো বলো তো? না মানে, মায়া নাকি মমতার কাছে?”

তিতাসের কথা শুনে রবিন ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। এই ছেলে আসলে কি দিয়ে তৈরি সে বুঝে না। পিয়াস যখন মারা গেল, তখন সবাই কেঁদে নিজেদের কষ্ট কমাচ্ছিল।আর এই ছেলে নিশ্চুপ হয়ে বসে সবার কান্না দেখছিল। পিয়াসের দা’ফ’ন করে সবাই ফিরে আসলেও সে ফিরেছিল না। পরে
ভাইয়ের ক’ব’রের পাশে বসে ছোটদের মতো চিৎকার করে কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। অথচ পরদিন বাসায় ফিরেছিল স্বাভাবিকভাবে। যেন তার কাছে সব স্বাভাবিক। আর এই মুহূর্তে তাকে এত শান্ত দেখে রবিন বিষ্মিত। কারণ তার এত শান্ত থাকাও ভয়ের কারণ। হয়তো তিতাস এতক্ষণে কিছু আন্দাজও করেছে। যদিও আন্দাজ করাটাই স্বাভাবিক। কেননা দিনের বেলায় ঘুমের ওষুধ ভোর কিংবা তার মা খাবেন না। খাওয়ার প্রয়োজনও দেখছে না। তাহলে নিশ্চয়ই কেউ খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে। তাছাড়া আজকের খাবার বানিয়েছিল বুয়া। মূখ্য কথা বুয়ার এতটা দুঃসাহস হওয়ার কথা নয়। তাহলে এখানে নিশ্চয়ই তৃতীয় ব্যক্তির প্ররোচনা রয়েছে। তিতাস ততক্ষণে উত্তরের আশায় না থেকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চলেও গেছে। ডাক্তার তাকে জানাল, তার মায়ের অবস্থা একটু বেশিই শোচনীয়। তিতাস নিজেও ইটার্নি ডাক্তার তাই ডাক্তার খোলাখুলি কথা বলল। তারপর দিন পেরিয়ে রাত হলো। তিতাস এবং রবিন রক্ত জোগাড় করতে ব্যস্ত। তিতাসের বাবাও দেশে ফেরার জন্য ফ্লাইটে উঠে পড়েছেন।

কিন্তু তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে ‘ সারার মৃত্যুর খবর। সেই সঙ্গে প্রতিটি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ” রাতপরী সারার নিজ বাসায় সারাসহ শাওন নামের এক যুবকের
লা/শ উদ্ধার।”

To be continue………….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here