প্রিয়োসিনী পর্ব ১৬+১৭

0
439

#প্রিয়োসিনী
#নীরা_আক্তার
#পর্ব_১৬

গাড়ির সিটে মাথা লাগিয়ে হেলাল দেয় ইশা।শরীরটা ভিষন খারাপ লাগছে তার।বমি বমি পাচ্ছে।চোখ বন্ধ করে ইশা। অতীতে ডুব দেয় সে…..
“নওরিনের এই গল্পের নাম দেওয়া উচিৎ ছিলো বন্ধু যখন শত্রু….”কথাটা ইশা নিজে নিজেই বলে উঠে।
চোখের পানি বাঁধ মানছে না।
________

[ইশা ছোট বেলা থেকেই বেশ ইন্ট্রোভার্ট।সবার সাথে মিশতে পারতো না।ভিষন লাজুক আর অদ্ভুত স্বভাবের ছিলো সে।যেমন সবাই যেখানে মুভিতে হিরোর প্রেমে পড়তো ইশার তখন ভিলেনকে ভাল লাগতো।সবাই যেখানে ভালোটাকে ভালোবাসতো ইশা সেখানে খারাপটাকে ভালোবেসে ভালো বানানোর চিন্তা করতো ।স্কুলে বহু স্টুডেন্ট ইশার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতো, সে সিকদার বাড়ির মেয়ে কিনা কিন্তু তার কাউকেই প্রকৃত বন্ধু বলে মনে হতো না।

নওরিন তখন সবে সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো।একা একাই থাকতো। ইশার কেন যেন নওরিনকে খুব ভালো লাগে।তারপর তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়। গভীর বন্ধুত্ব যাকে বলে।

আমানকে ইশা ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতো।আমানের উগ্র স্বভাব গুলো ইশার ভালো না লাগলেও আমানের বাকিটা তার মনের মতোই ছিলো।হিন্দি মুভিতে যেমন নায়িকা একজন বখাটে ছেলের প্রেমে পড়ে ছেলেটাকে নিজের মতো করে নেয়, ঠিক তেমন করেই ইশাও চাইতো নিজের ভালোবাসা দিয়ে আমানকে নিজের মতো করে নিতে…..

আমানের প্রতি তার আবেগ অনুভূতি হয়তো আমান বুঝতে পারতো কিন্তু পাত্তা দিতো না বার বার ইগনোর করতো তাকে।এমনও দিন গেছে যেই দিনে আমান একবারটিও ইশার সাথে কথা বলে নি।ইশার ভীষন কষ্ট হতো।ইশার কষ্টগুলো কয়েকগুণ বেড়ে যেতো যখন সে আমানকে নোহার সাথে দেখতো।নোহা ছিলো আমানের সবচেয়ে প্রিয়ো বন্ধু।
ছোটবেলা থেকেই নোহা সবার কাছে এক্সট্রা এ্যাটেনশান পেতো যেটা ইশাকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিতো।তারউপর তার প্রিন্স চার্মিংও তাকে পাত্তা দিতো না…ইশার মাথায় যেন পাহাড় সমান বোঝা চেপে থাকতো।

এরই মাঝে এন্ট্রি নেয় নওরিন
ইশার বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবেই আমানের সাথে নওরিনের পরিচয় হয়।আমানও একটু একটু করে নওরিনের প্রতি দূর্বল হতে থাকে ইশার অজান্তেই।ইশা যখন ব্যপ্যারটা বুঝে তখন অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছিলো।
সেই দিন জন্মদিনের দিন যখন আমান সবটা কনফেস করে ইশার হৃদয়টা ভেঙ্গে হাজার টুকরো হয়ে যায়।তার জায়গা নওরিন নেবে এটা সে মানতে পারে না।সে নওরিনকে নানা রকম ভাবে বুঁঝিয়ে দেয় আমান তার যোগ্য নয়।নওরিনেরও আমানকে নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহের সৃষ্টি হয় না।

ইশা নিজের মতো করে সবটা সাজাতে থাকে।এরইমাঝে আমান নিজে থেকেই ইশার কাছে আসে।ইশার পছন্দের কিছু চকোলেট ইশার হাতে ধরিয়ে দেয়।ইশা প্রথমে খুশি হলেও পরে বুঝে যায় আমান আসলে নওরিনের সাথে কন্টাক্ট করার জন্য তাকে ব্যবহার করতে চাইছে।ইশাও সুযোগটা নিয়ে নেয়….

আমনকে নওরিনের জায়গায় তার নিজের একটা নাম্বার দিয়ে দেয় যেইটা কেউ জানতো না।আমান বোকার মতো সেটাকেই নওরিনের কন্ট্যাক্ট মনে করে খুশি হয়ে যায়।

এরপর শুরু হয় ছলনার পালা।আমান নওরিন মনে করে ইশার সাথে কথা বলতে থাকে। ইশাও আমানের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।মনে র গভীরে লুকিয়ে রাখা সব অনুরক্তি প্রকাশ করতে থাকে আমানে কাছে।একটু একটু করে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে থাকে আমানকে।প্রেমে পাগল আমান নওরিনের পরিচয়ে লুকিয়ে থাকা ইশার গভীর প্রেমকে সাদরে গ্রহন করতে থাকে।

ইশা এতোদিন যেই জায়গাটা চাইতো সেটা সে পেয়ে যায় আমানের আত্তা সত্তা সবকিছু তার দখলে।নোহার সাথেও আমানের একটা ডিস্টেন্স তৈরী করে দেয় সে।

ইশা নওরিন সেজে আমানকে আগেই মানা করে দেয় যেন তাদের সম্পর্কের কথা কেউ না জানে।এমনকি ইশাও না।জানলে হয়তো ইশার সাথে তার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাবে।আমানও জানতো ইশা তাকে পছন্দ করে। ইশা জানলে হয়তো নওরিনকে বিপদে ফেলবে এইসব চিন্তা ভাবনা করে সেও কাওকে কিছু বলে না।তারা সারা রাত দিন ফোনে কথা বলতো।ফোনের মাধ্যমেই তারা একটা ছোট্ট সংসার পাততে থাকে।আর আমানের যখন নওরিনরে সাথে সামনা সামনি দেখা হতো তখন ইশাও সাথে থাকতো।ইশা সাথে থাকায় আমানও নওরিনকে ইগনোর করার নাটক করতো।আর এই সবকিছু অজানা নওরিন মন থেকে আমানকে ইগনোর করতো যেটা আমান নাটক মনে করতো।

ইশা জানতো খুব দ্রুত সাগরের সাথে নওরিনের বিয়ে হয়ে যাবে।কারণ তখন নওরিন আর সাগরের বিয়ের কথা চলছিলো।ইশার ধরনা ছিলো আস্তে আস্তে যখন আমান ভাই তার জন্য পাগল হয়ে যাবে তখন সে আমানকে সব বলে দেবে।ততোদিনে নওরিনও বিয়ে করে নেবে।সব ঠিক হয়ে যাবে…….

কিন্তু ইশার সব পরিকল্পনায় সে নিজেই পানি ঢেলে দিয়েছিলো।ইশা এখনো হাত কামড়ায়
ইস্ যদি না সে সেদিন নওরিনের বিয়েতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতো…না আমান সবটা জানতে পারতো…….

আজো আমান মনে মনে এটাই মনে করে যে সে নওরিনের সাথে সম্পর্কে ছিলো। কেউ জানে না সত্যিই টা।কখনো জানবেও না।কিন্তু নোহা তো তাকে ধরে ফেলেছে….
এখন যদি আমান সবটা জেনে যায় সে ইশাকে ঘেন্না করবে খুব ঘেন্না করবে।আর নওরিন,দাভাই,বাবা মা তাদের রিয়াকশন কেমন হবে?
না ইশা কিছু ভাবতে পারছে না।

ইশা মনে মনে নওরিনের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে।আজ তার বোকামির জন্যই নওরিনের এতো কষ্ট…..কিন্তু.. কথায় আছে,
“Everything is fair in love and war” সে যা করেছে নিজের ভালোবাসার জন্য করেছে।এখানে কোনো অন্যায় নেই।নওরিনের জন্য খারাপ লাগলেও বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয় সে]

ইশার গা গুলিয়ে উঠে।দম বন্ধ হয়ে আসে।গাড়ি দাড় করিয়ে রাস্তার পাশে নেমে যায়।ড্রাইভারের থেকে পানি চায়।কি অদ্ভুত গাড়িতে এক ফোটা পানিও নেই!
ইশা রাস্তার ধারেই গল গল করে বমি করে দেয়।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।ইশা সেখানে বসে হাস ফাস করছিলো।পাশেই ড্রাইভার দাড়ানো।তিনি বাড়িতে ফোন করে সবটা জানান।

ইমতিয়াজ সিকদার মেয়ের কথা শুনে বেড়িয়ে পড়ে।ইশারা তখন অনেকটা দূরে চলে এসেছে।

ইশার পাশে এসে একটা গাড়ি দাড়ায়।গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আমান।
-এক্সকিউজ মি,কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
ইশা ঢুলু ঢুলু চোখে আমানের দিকে তাকায়।আর ড্রাইভার আঙ্কেল অপরিচিত লোক দেখে বেশ আতঙ্কিত হন।ইশা আমানকে দেখে ঢুলতে ঢুলতে তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে…..

দুকদম যেতেই ইশা সেখানেই ঢলে পরে আমান ইশাকে খপ করে ধরে ফেলে…
এই যে মিস,ইশা রানি তুমি ঠিক আছো?

ইশার কোনো হুস নেই।আমান ইশাকে গাড়িতে তোলে।
ড্রাইভার ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আমানকে বাঁধা দিতে যায়।
–আমি আমান সিকদার ফোন করে বলে দাও আমি ইশাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।
–স্যার আপনার পরিচয়?
–আমান সিকদার।আমাকে ইন্ট্রোডিউস করানোর জন্য নামটাই যথেষ্ট! আমান আরেকটু থেকে বলে উঠে,
-ওয়েট তোমাকে বলতে হবে না আমি নিজেই বলে দিচ্ছি!
______________

অন্যদিকে,
ইসরাক নওরিনকে ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দেয়,
-দরজা বন্ধ করার দরকার কি?
-বউ পেটাবো…লোকজন যদি দেখে ফেলে বদনাম হয়ে যাবে,
-গায়ে হাত দিয়ে দেখুন আপনাকে সহ আপনার চোদ্দগুষ্টিকে জেলের ভাত খাওয়াবো লিখে নিন!
-খুব সাহস হইছে না তোমার?
নওরিন বিছানায় গিয়ে বসে,
-এমনিতেই আপনি একটা বুড়ো লোক।বয়সে আমার থেকে অনেক বড়।তারউপর কথায় কথায় চোখ রাঙ্গান।এরকম করলে আপনার সংসার আমি করবো না বলে দিলাম।
ইসরাক নওরিনের সামনে এসে দাড়ায়,
-তুমি আমানকে ফোন করেছিলে?ওর নাম্বার কোথায় পেলে?
নওরিন ইসরাকের দিকে বালিশ ছুঁড়ে দেয়,
–আবার শুরু করেছেন,আমান আমান উফ্ আমার খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নাই?নাকি আপনার খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নাই?সব সময় আমানকে নিয়ে পড়ে থাকেন!
-মিথ্যা বলো আমাকে?
-অসভ্য লোক নিজের বউকে বিশ্বাস করে না।আমি তো অসভ্য ইসরাক সিদারেররই নাম্বার জানি না। আর তো অসভ্য স্কয়ার আমান সিকদার।কলটা করবো কি করে?
ইসরাক মাথা চুলকায়
-সত্যি বলছো?আমায় ঠকিয়ো নওরিন।
আমি বেঈমানদের কখনো মাফ করি না।
নওরিন টেবিল থেকে ফুলদানি ফ্লোরে ছুড়ে মারে।
-এটা যদি আপনার মাথায় মারতে পারতাম তাহলে শান্তি পেতাম!হ্যা আমি বেঈমান কি করবেন করুন…
-নওরিন…আমায় রাগিও না বলে দিলাম!
-আপনি সব জেনে কেন বার বার নাটক করেন বলুনতো।সেদিন রাতে আপনি নিজে আমায় বাঁচিয়েছেন অথচ এতোবড় কথা কাওকে জানান নি কেন?
-আশ্চর্য কি জানাবো?
-সবাই কি ভেবেছে আপনি জানেন না?আমান যে আমার সাথে কিছু করে নি এটা আপনি কেন সবাই কে বলেন নি?
-আমি ভেবেছিলাম এতো টুকু বদনাম তুমি ডিসার্ভ করো!

নওরিন মাথাটা গরম হয়ে যায়।

-আপনি আসলেই একটা অসভ্যলোক।শুধু আপনি কেন আপনারা সবগুলো এক।থাকবো না আপনার সাথে…..ডিভোর্স দিয়ে দেবো!
নওরিন দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।ইসরাক নওরিনের পেছন পেছন যেতে থাকে।
–আরে দাঁড়াও তোমার সাথে তো আরো কথা আছে আমার…সিরিয়াস কথায় এমন করলে ভালো লাগে না বলে দিলাম…

ইসরাক নওরিনের শাড়ির আচল ধরে টান দেয়।নওরিন টাল সামলাতে না পেরে ইসরাকের গায়ে এসে পড়ে।এমন সময় জিনাত সিকদার সামনে চলে আসে,ওনি ইসরাকের কাছেই আসছিলেন।হটাৎ এমন দৃশ্য চোখে পড়ায় মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠেন,
-দুদিন যেতে না যেতেই বউয়ের আচল ধরে ঘুরছিস!এই ছেলে মানুষ করেছি আমি?ছি!লজ্জা করে আমার!

ইসরাক কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।মাথা চুলকিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।এরই মাঝে আগমন ঘটে ইসরাকের ছোট চাচার।হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন তিনি।

-ইসরাক বাবা ইশা নাকি রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কোনো এক অচেনা লোক ইশাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে।
কথাটা শুনেই ইসরাক ভয় পেয়ে যায়।এদিকে জিনাত সিকদারের বুক কেঁপে উঠে।
ইসরাক ছোট চাচাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইশাকে খুঁজতে। জিনাত সিকদার সেখানেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।

নওরিন আর ছোট চাচী এসে জিনাত সিকদারকে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকে।

________

আমান ইমতিয়াজ সিকদারকে ফোন করে হাসপাতালের লোকেশন জানিয়ে দেয়।ইসরাক আমানের নাম্বারটা ব্লক করে রাখায় সে ইসরাকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না।বিধায় ইমতিয়াজ সিকদার কেই জানায়।ইমতিয়াজ সিকদার যতো দ্রুত সম্ভব আসার প্রতিস্রুতি দেন।অনুরোধ করেন ততোটুকু সময় যেন সে ইশাকে দেখে রাখে…..

হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ইশার জ্ঞান ফিরে।চোখ খুলেই আমানকে দেখে থমকে যায়।
-এটা স্বপ্ন নাকি সত্যিই?
আমান ইশার কাছে এগিয়ে যায়…
-কেমন আছিস ইশারানি?
ইশা মাথা নাড়ে।
-শরীর খুব বেশি খারাপ লাগছে?
ইশা এবারও মাথা নাড়ে।
-একটু অপেক্ষা কর বাড়িতে জানিয়েছি। সবাই আসছে।
আমান এতোটুকু বলেই ঘর থেকে বার হতে নিলে ইশা আমানকে ডেকে উঠে,
–আমান ভাই এতোদিন কোথায় ছিলে?একবারও কি আমার কথা মনে পড়ে নি?
-সবার কথাই মনে পড়েছে।
–আমি বিপদে পড়লে তুমি কি করে বুঝতে পারো?কি করে জানলে আমার এখন তোমাকে প্রয়োজন…
-ইশা পাগলের প্রলাপ বকিস না।সবটাই কাকতালীয়।
আমান সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

এরই মাঝে ইমতিয়াজ সিকদার হাসপাতালে উপস্থিত হয়।আমান তখন ইশার রুমের সামনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ছিলো।
আমানকে একমুহূর্ত দেখে তিনি থমকে যান।আমান ছলো ছলো চোখে ইমতিয়াজ সিকদারের সামনে গিয়ে দাড়ায়,ইমতিয়াজ সিকদার দুই হাতে তার কলিজার টুকরাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন।কপালে চুমু খান।বাবা মা মারা যাওয়ার পর এই ছোট্ট আমানকে তিনি কোলে তুলে নিয়েছিলেন।মাথায় করে রাখতেন তিনি।কখনো এতোটুকু কষ্ট পেতে দেন নি।নিজের ছেলে মেয়েদের চেয়েও আমানকে কয়েকগুন বেশি ভালোবাসতেন তিনি।সেই আমান এক বছর যাবত নিখোঁজ ছিলো।মরে গেছে না বেঁচে আছে সেই খবরটাও কারো জানা ছিলো না।একবছর পর ছেলেকে কাছে পেয়ে সাদরে গ্রহন করে নেন তিনি।
ততোক্ষণে ইসরাক আর ছোট চাচাও ইমতিয়াজ সিকদারের পাঠানো ঠিকানায় মানে হাসপাতালে পৌছে গেছে।আর তাদের পিছু পিছু নওরিন,নোহা আর জিনাত সিকদার।

হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে ইশার রুমের কাছা কাছি আসতেই আমানের সাথে দেখা হয়ে যায় সবার।আমান মুচকি হেসে ছলো ছলো চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে।নওরিনের সাথেও একবার চোখাচোখি ও হয়…
নওরিন প্রচুন্ড আতঙ্কে ইসরাকের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করে….ভয় করছে তার।

আমান মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়!ঐ দৃষ্টির আগুনে আর সে দগ্ধ হতে চায় না!

চলবে….
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

#প্রিয়োসিনী
#নীরা_আক্তার
#পর্ব_১৭
ইসরাক নওরিনের হাত ছাড়িয়ে আমানের কাছে এগিয়ে যায়।আমান ইসরাককে জড়িয়ে ধরে,
ইসরাকও ভাইকে সযত্নে আলিঙ্গন করে নেয়,
-চিন্তা করো না দাভাই, ইশা ভালো আছে!অনেকটা ট্রভেল করাই একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।এখন ঘুমিয়ে আছে।আমি তোমাকেই আগে ফোন করতাম তুমি তো আমার নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছো তাই বাধ্য হয়ে বড় আব্বুকে জানালাম।
ইসরাক একটু স্বস্তি পায়
-ভাই তুই কেমন আছিস?
-বেঁচে আছি।মরে যাই নি!আল্লাহ্ হায়াত রাখলে কারো ক্ষমতা নেই মেরে ফেলার।

আমান কথাটা বলেই নওরিনের দিকে তাকায়।নওরিন পেছনে গুটি শুটি হয়ে দাড়িয়ে আছে।নওরিন আমানের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।আমান নওরিনের দিকে তাকাতেই চোখা চেখি হয়ে যায়। নওরিন চোখ সরিয়ে নেয়।দৃষ্টি মেঝেতে স্থির করে। সে এক হাত দিয়ে আরেক হাতের তালু দলায় মালায় করছে কখনো আঙ্গুল মটকাচ্ছে!আমানের সামনে থাকতে ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে তার।।

ইসরাক আমানের কথাটা বুঝতে পারলেও কোনো রিয়াক্ট করে না।এখানে কথা বাড়ালে নওরিনেরই সন্মান যাবে।

ইসরাক জিনাত সিকদারকে নিয়ে ইশার কেবিনে চলে যায়।নোহা আর নওরিন পেছন পেছন যেতে থাকে। আমানের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আমান নোহাকে ডাকে,নোহা থেমে যায়।কিন্তু নওরিন থামে না সে নিজের হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় এক নিঃশ্বাসে ছুট লাগায় ইশার কেবিনের দিকে, যেন তাকে কোনো পাগলা ষাঢ় তাড়া করেছে।

নোহা পেছন ফিরে তাকায়,
কিন্তু কোনো কথা বলে না
-নোহা কথা বলবি না আমার সাথে?
-নো
-আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।
-আগে ছিলে এখন নেই।
-জানতে চাইবি না কেমন আছি?
-তুমি জানতে চেয়েছো আমরা কেমন আছি?
-খুব অভিমান করে আছিস?
-তোমার সাথে কি আমার মান অভিমানের সম্পর্ক?
-তাহলে কিসের সম্পর্ক
-কিছু না!

নোহা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না।সেখান থেকে চলে যায়।আমান কেবিনের বাহিরেই দাড়িয়ে থাকে।এই পরিবারটা একসময় তার জীবনের সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা ছিলো।অথচ আজকে এই লোকগুলোর সামনে দাড়াতেই তার ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে।পা দুটো কাপছে।শরীরে ঘাম দিচ্ছে।তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার দাভাই,তার সবচেয়ে কাছের মানুষ নোহা সবাই তাকে ইগনোর কারছে….!
কিন্তু কার জন্য?
আমান চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে।গাল বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পরে!উওরটা হলো,

“নওরিন”

আমান ভেতরে যায় না।দরজায় দাড়িয়ে থাকে।ইমতিয়াজ সিকদার আমানকে ডাকলেও সে ভেতরে যায় না।ইসরাক নিজেও চাইছে না আমান ভেতরে আসুক।কারন সেখানে নওরিনও ছিলো!
নওরিন আর আমানের মাঝে দুরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন!

কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে আমান সবার থেকে বিদায় নেয়,
–আমি আসছি।তোমরা ভালো থেকে
ইমতিয়াজ সিকদার চেঁচিয়ে উঠে,
-আসছি মানে কি?কোথায় যাবি তুই?
-বড় আব্বু আমি চলে যাচ্ছি!
-কোথাও যাবি না তুই আমার সাথে নিজের বাড়িতে যাবি।সিকদার বাড়ির ছেলে তুই। কোথায় না কোথায় থাকিস কিছু জানি না আমি!বাবা এবার তো বাড়ি চল।অনেকতো হলো।
আমান মুচকি হেসে উওর দেয়,
-না। আমায় ক্ষমা করো বড়আব্বু
ইমতিয়াজ সিকদার অভিমানের সুরে বলে উঠে,
–আমি কে হয় তোর আমার কথা কেন শুনবি!

আমান মাথা নিচু করে মুচকি হাসে,
-দাভাই আমি কি চলে যাবো?
প্রশ্নটা সে ইসরাককে করেছে।ইসরাক নওরিনের দিকে তাকায়।নওরিন চোখ মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে তার দিকে,সে কি উওর দেবে সেটা ভেবে হয়তো দম আটকে রেখেছে।

ইসরাক মুখ কালো করে উওর দেয়,
-তোর ইচ্ছে…..
আমান হেসে দেয়,
-বুঝতে পেড়েছি।সমস্যা নেই আমি চলে যাচ্ছি।

আমান চলে যায়।ইমতিয়াজ সিকদারও আমানের পেছন পেছন বেড়িয়ে যায়।
ইশা এখনো ঘুমিয়ে আছে।মাথার কাছে জিনাত সিকদার বসা আর অপর পাশেই নোহা আর নওরিন বসা।
ইসরাক দূরে একটা সোফায় বসে আছে,

ইসরাক ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য বেরিয়ে যায়।একটু পরেই নার্স এসে ইমার্জেন্সি ঔষধের একটা প্রেসক্রিপসান ধরিয়ে দেয়।নওরিন প্রেসক্রিপশান হাতে বেরিয়ে পড়ে।উদ্দেশ্য ইসরাককে খুজে সেটা দেওয়া।

নওরিন হাসপাতালের করিডোরে ইসরাককে খুজতে থাকে।ইসরাকের চিহ্নও নেই কোথাও। নওরিন পিছু হাটা দেয়।ইসরাককে ফোন করলেই তো হয়!!
বোকার মতো নিজের মাথায় নিজেই চাটি মারে,

নওরিন রুমের দিকে ফিরছিলো হটাৎ করে কেউ একজন নওরিনের হাত ধরে টান দেয়।
নওরিন চিৎকার করতে চাইলেও পারে না। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বার হচ্ছে না।সবগুলো শব্দ যেন গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে।তার সামনে আমান সিকদার দাড়ানো।যাকে সে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।

নওরিন চোখ মুখ খিচে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।আমানকে সজোরে দাক্কা দেয়,কিন্তু আমান এক ইন্ঞ্চিও সরে না,হাতটা শক্ত করে মুঠো করে নেয়,

-দেখুন এটা একটা হাসপাতাল প্লিজ ঝামেলা করবেন না।আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
-তাতে তোমারই জাত যাবে!যতোটুকু সন্মান তোমায় দা ভাই দিয়েছে সেটাও এখানেই বিসর্জন হয়ে যাবে।
-ওনি জানলে কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না।শেষ করে দেবে আপনাকে
-নাটক করছো?আমার সবটুকু শেষ করে এখন ড্রমা হচ্ছে?
-কিসের নাটক?
–আদর্শ বউ হওয়ার নাটক।কি করে পারো বলতো?আল্লাহ বোধয় নিজের হাতে তোমায় এই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে।
-কিসের ক্ষমতা
-পুরুষ মানুষের মন ভুলানোর ক্ষমতা। ছলনাময়ী বেঈমান নারী।তুমি শুধু মুখের কথায় যেকোনো পুরুষকে বশ করতে পারো।আমাকেও করেছিলে এখন দাভাই কে করেছো।
–মুখ সামলে কথা বলুন!অসভ্য অভদ্র লোক।
-সামলেই তো রেখেছি নিজেকে,নয়তো কখন তোমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিতাম!
-প্লিজ যেতে দিন!যা কথা বলার আপনার ভাইয়ের সামনে বলবেন!
আমান নওরিনের হাতটা নিজের বুকে রাখে,
-এই জায়গায় আঘাত করেছিলে তুমি।তোমার জন্য পাগল উন্মাদ এক প্রেমিকের হৃদয়কে ভেঙ্গে শত সহস্র টুকরো করে দিয়েছিলে তুমি।তুমি সেই নারী যাকে আমি হৃদয়ের এই জায়গায় লালন করেছিলাম। তুমি সেই বেঈমান নারী যে সেই হৃদয়কেই ভেঙ্গে দিয়েছিলে।তোমার কোনো যোগ্যতা নেই আমার দাভাইয়ের বউ হওয়ার।শুধু ভাই কেন…পৃথিবীর কোনো প্রেমিক পুরুষকেই তোমরা ডিসার্ব করো না।তুমি নিজে থেকে আমার দাভাইয়ের জীবন থেকে চলে যাবে না কি আমি তোমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবো?

কথাগুলো বলতে বলতে আমান স্বজোড়ো দেয়ালে ঘুসি দেয়।নওরিন কেঁপে উঠে।আমানকে পাশ কাটিয়ে ছুট লাগায় কেবিনের দিকে।

কেবিনে এসে হাপাতে থাকে।নোহা এগিয়ে আসে
-কি হয়েছে নওরিন?
-আমা….
নওরিন বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়।এদিকে সেদিকে চোখ বুলায়।জিনাত সিকদার কোথাও নেই।
-শ্বাশুড়ি মা কোথায়?
-বম্মা তো তোমার সাথে সাথেই বেরিয়ে গেলো।তুমি তো ফোন নিয়ে যাও নি। এতো বড় নার্সিং হোমে ফোন ছাড়া দাভাইকে কি করে খুঁজে পাবে শুনি?

নওরিন হাপাতে থাকে।ততোক্ষণে ইশারও জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান ফিরেই ইশা আমানকে খুঁজতে থাকে,নোহা ভ্রু কুচকে তাকায় ইশার দিকে,
-এতো কিসের পিরিত?
–আমান ভাই কোই?
– জানো নওরিন আমার মনে হয় আমাদের সিকদার বাড়ির প্রত্যেকের রক্তে পাগলামো আছে।একাকজন একাক করকম পাগল প্রেমিক -প্রেমিকা।গিনেস বুকে নাম দেওয়া উচিত আমাদের চার ভাই বোনের।

নওরিন ভ্রু কুচকে তাকায়। ইশা কেঁদে দেয়,
–আমান ভাই আমাকে না বলেই চলে গেলো?
নোহা মুখ বাকিয়ে উওর দেয়,
-তোকে বলার প্রয়োজন মনে করে নি তাই বলে নি!তুই কে যে তোকে বলে আদর করে দিয়ে যাবে!
ইশা আরো জোরে কেঁদে উঠে,

এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে জিনাত সিকদার আর তার পেছন পেছন ইসরাকও আসে।
ইশাকে কাঁদতে দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠেন,
-কাঁদিস কেন শরীর খুব বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?

ইশা মাথা নাড়ায়
–আম্মা আমান ভাই কোই?আমান ভাই-ই তো আমাকে নিয়ে আসলো।আমি কেমন আছে মা জেনেই চলে গেলো?আমাকে একবার বলেও গেলো না!

জিনাত সিকদার ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,
–আমান কোথাও যায় নি এখানেই আছে।তাই না নওরিন?
নওরিন চোখ মুখ কালো করে তাকায়,
-একটু আগেই তো তুমি আমানের সাথে কথা বললে।ও বোধহয় তোমার সাথে কথা বলার জন্যই বাহিরে অপেক্ষা করছিলো….সবার সামনে বলতে চাইছিলো না!

নওরিন অবাক চোখে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।তিনি যে তাকে খারাপ ইঙ্গিত দিয়ে কথাগুলো বলছেন তা সে বেশ বুঝতে পারছে।
“ছিহ্”
মনে মনে নওরিন শ্বাশুড়ি মায়ের কথা বলার ভঙ্গীকে ধিক্কার জানায়।একজন নারী হয়ে একজন নারীর দূর্বলতাতে শব্দ দাড়া আঘান করছেন তিনি।
নওরিন শ্বাশুড়ি মায়ের চোখে চোখ রাখে,স্পষ্ট স্বরে বলে উঠে
–আমি নিজে থেকে ওনার সাথে কথা বলতে যাই নি।ওনি নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন।
জিনাত সিকদার তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠেন,
-হ্যা তুমি তো নিজে থেকে কিছুই করো না সব অন্যকেউ করে আর দোষ হয় তোমার।যেমন আগের কোনো কিছুই তুমি করো নি!এটাই বলবা তো?

কথাটা বলেই তিনি নওরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইসরাকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন,
–আব্বা তুমি হা করে দাঁড়ায়ে আছো কেন?নওরিনের হাত থেকে প্রসক্রিপশানটা নাও আর বোনের জন্য ঔষধ নিয়া আসো।দেখো না তোমার ভাই-বোন কতো কষ্ট পাচ্ছে।তাদের আঘাতে তো তোমাকেই মলম লাগাতে হবে।তুমি মা বড়!

কথাগুলো অর্থ ইসরাক না বুঝলেও নওরিন বেশ বুঝতে পারছে।

ইসরাক বিষ্ময় কাটিয়ে নওরিনের দিকে এগিয়ে আসে।নওরিনের হাত থেকে ছো মেরে কাগজটা নিয়ে নেয়।
–আমানের থেকে দূরে থাকো।কথা বলোনা ওর সাথে।আমি কিন্তু সহ্য করবো না।

ইসরাক বেরিয়ে যায়।নওরিন অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে ইসরাকের যাওয়ার দিকে।
জিনাত সিকদার ইশার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে।এতো রাতে ইশাকে আর ছাড়বে না তারা।ইশাকে হাসপাতালেই থাকতে হবে।

জিনাত সিকদারের শরীর খারাপ লাগছে।ইমতিয়াজ সিকদার স্ত্রী কে নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।হাসপাতালে নওরিন আর নোহা থাকবে।ইসরাক নোহাকে বাবা মায়ের সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দেয়,
-এখানে এতো লোকজন না থাকায় ভালো।চাইলে নওরিনও যেতে পারে।বোনের সাথে সে একাই থাকবে।
ইশাও তাতে সম্মতি জানায়।নওরিনকে চলে যেতে বলে।তার ধারনা নওরিন না থাকলে আমান হয়তো আসবে।অন্তত একবার আসবে।

কিন্তু নওরিন বাড়ি যায় না।ইশাকে একা ফেলে সে যাবে না। ইশার সাথে নওরিন আর ইসরাক থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

নোহাও যেতে চায় না।সে মনে করছে এই মুহুর্তে তার এখানে থাকা প্রয়োজন কিন্তু ইসরাকও নাছর বান্দা জোর করে নোহাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।কাল পরীক্ষা আছে তাই বেশি সময় দিয়ে লিখতে পারলাম না।চেষ্টা করবো আগামী পর্ব একটু বড় করে দিতে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here