প্রিয়াঞ্জনা এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই (পর্ব ১৭)

0
661

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৭

সকালের শুরুটা হয়েছে প্রিয়াঞ্জনার অভূতপূর্বভাবে। প্রিয় মানুষটা কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আলতো করে ডাকছে।
“প্রিয়াঞ্জনা, উঠবেনা?”

আজ ঘুম বোধহয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে প্রিয়াঞ্জনাকে। ঘুম জড়ানো কন্ঠেই উত্তর দেয়,
“হুম”
তারপর আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। শাহবাজ আর ডাকেনি। থাক, ঘুমাক। শাহবাজ ফ্রেশ হয়ে নেয়। বাজার করা দরকার। ডায়েরি থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে চিরকুট লিখে,
“বাজারে যাচ্ছি। ভয় পেয়ো না। ভালোবাসি।”
পড়ার টেবিলে রেখে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। ছাদের অর্ধেকই খোলামেলা। রেলিং এর পাশে বেশ কিছু গোলাপ ফুলের টব। পাখির কিচিরমিচির ভেসে আসছে দূর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় হঠাৎ করেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে শাহবাজের। তাড়াহুড়োয় শাহবাজ খেয়াল করেনি। মেয়েটি দ্রুত সিঁড়ির রেলিং ধরে ফেলে। সি গ্রীণ রঙের টি-শার্ট, কালো টাউজার পরনে একজন সুদর্শন পুরুষ নাদিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে,
“তুমি ঠিক আছো, খুকি?”

ধ্যাঁত! খুকি? নাদিয়াকে কি ছোট মনে হয়? নাদিয়া এখন কলেজে পড়ে। লোকটারও কোনো দোষ নেই। ও তো এখন ফ্রক পরে আছে। হালকা গোলাপি রঙের একটি ফ্রক। তাই হয়তো ছোট ভাবছে। নাদিয়া মুখ গোমড়া করে উত্তর দেয়,
“আমার নাম খুকি নয়। নাদিয়া।”

বাচ্চা মেয়েটির কথার ধরণ দেখে হেসে দেয় শাহবাজ। একদম প্রীতির মতো মেয়েটা।
“ঠিক আছে, নাদিয়া। তুমি ঠিক আছো তো?”
“জ্বি। আপনি কি আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া?”
“হ্যাঁ”
“মা ডাকছে আপনাকে। বলেছে আজকের নাস্তা আমাদের এখানে খেতে।”
“আমি তো এখন বাজারে যাচ্ছি। ফিরে এসে খেতে যাবো।”
“আচ্ছা”

শাহবাজ নিচে নেমে যায়। বাজার সামনেই। পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। নাদিয়া এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটার কন্ঠ এত সুন্দর! কিশোরী মনে হঠাৎ করেই নতুন অনুভূতি জাগ্রত হয়। শাহবাজ চলে গেলেও সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে নাদিয়া। ও বেশ চঞ্চল ধরনের মেয়ে। হলদে ফর্সা। একেবারে পুতুলের মতো। আদুরে। পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ায় সবাই তাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। শাহবাজের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানেনা সে। গত এক সপ্তাহ খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। শুধু জানে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ব্যস। নাদিয়া বিড়বিড় করে,
“নাদিয়া তবে কি তোর লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়ে গেলো! ও মাই গড! ভয়াবহ ব্যাপার!”

আর নিজের গোলাপ গাছ দেখা হলোনা ওর। মোহগ্রস্তের মতন সে নিজের ঘরে চলে আসে। শুয়ে পড়ে বিছানায়। হৃদপিণ্ড খুব দ্রুত লাফাচ্ছে। কি আশ্চর্য!

প্রিয়াঞ্জনা বেশ কিছুক্ষণ পরেই ঘুম থেকে উঠে। দু’হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভাঙে। এলোমেলো কোমড় সমান চুলগুলো খোঁপা করে নেয়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে শাহবাজ নেই। কোথায় গেলো? ঘুমের ঘোরে তখন কিছুই বুঝতে পারেনি। তখনই টেবিলে নজর যায় তার। চিরকুটে চোখ বুলিয়ে হাসি ফুটে উঠে ঠোঁটের কোণায়। ফ্রেশ হয়ে নেয় প্রিয়াঞ্জনা। ঘরে সাদা রঙ করা। বিছানা গুছিয়ে ঘরের বাইরে বারান্দায় বেতের সোফায় বসে প্রিয়াঞ্জনা। হাতে একটি বই। জহির রায়হানের শেষ বিকেলের মেয়ে। আপাতত করার কিছুই নেই। তাই সে বই পড়বে। স্বপ্নের মত লাগছে সবকিছু। বই পড়া হয়ে উঠেনা ওর। খালি পায়ে ছাদে বেরিয়ে পড়ে। আকাশটা কি যে সুন্দর লাগছে। শরতের আকাশ এমনিতেও অনেক সুন্দর থাকে। রেলিং এর কাছে টবে বেশ কিছু গোলাপ ফুলের গাছ লাগানো। কি সুন্দর ঘ্রাণ! এখানে পুকুর রয়েছে। প্রিয়াঞ্জনার বারান্দা থেকে যেমন শ্যাওলাঘন পুকুর দেখা যেতো ঠিক তেমনই। প্রিয়াঞ্জনা ভাবে শাহবাজকে নিয়ে যাবে পুকুর পাড়ে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরে। প্রিয়াঞ্জনা পিছন দিকে মাথা এলিয়ে দেয়।
“কই ভাবলাম চমকে উঠবে!”
“আমি আপনার পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম।”

প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের মুখোমুখি হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। আহ্লাদী সুরে বলে,
“কি এনেছেন আমার জন্য? চিপস্ এনেছেন?”

এই মুহূর্তটা শাহবাজ কত মিস করতো! বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে ক্লান্ত শাহবাজ যখন ফিরতো তখন এমনই ভাবে গলা জড়িয়ে ধরতো প্রিয়াঞ্জনা। আবদারও করতো ঠিক এভাবেই। পুরো আহ্লাদী একটা! শাহবাজের আদুরে বউ। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার নাকে নাক ঘঁষে বলে,
“এনেছি তো। মিষ্টি এনেছি। এখানে দিবো নাকি ঘরে গিয়ে?”

বলেই চোখ টিপে দেয়। ইঙ্গিত যাচ্ছে ঠোঁটের দিকে। প্রিয়াঞ্জনা একছুটে ঘরে চলে আসে। কি বেহায়া পুরুষ! শাহবাজ হা হা করে হেসে উঠে। বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘরে চলে আসে। টুকটাক যা প্রয়োজন সবই কিনে এনেছে। প্রিয়াঞ্জনার রান্নার হাত বেশ ভালো। আজ ভাবছে কোথাও ঘুরতে যাবে প্রিয়াঞ্জনাকে নিয়ে। কাল থেকে তো কাজে যোগ দিবে। তখন হয়তো প্রিয়াঞ্জনাকে আর বেশি সময়ও দিতে পারবেনা। প্রিয়াঞ্জনার হাতে বেশ কিছু চিপস, চকলেট তুলে দেয় শাহবাজ। অর্ধাঙ্গীর মুখের মিষ্টি হাসিটা বুকে শান্তি এনে দিচ্ছে তার।
“চাচি আমাদের খেতে ডেকেছে। চলো নাস্তা খেয়ে আসি।”
“হ্যাঁ, ফিরে রান্নার প্রিপারেশন শুরু করবো।”
“আজকে কোনো রান্না-বান্না নয়। আজকে আমরা বাইরে ঘুরবো। বাইরে খাবো।”

প্রিয়াঞ্জনা মলিন হেসে বলে,
“শাহ্, টাকা নষ্ট করাটা কি ঠিক হবে?”
“টাকা ভবিষ্যতে আসবে প্রিয়াঞ্জনা। আজকের দিনটা হয়তো আর আসবেনা। আমি বর্তমানে বিশ্বাসী। বিগত চার বছরের সংসারে আমরা প্রতিটি দিন যেভাবে কাটিয়েছি এখনও ঠিক সেভাবেই কাটাবো। হয়তো তোমাকে আগের মতো সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড নিয়ে যেতে পারবো না। ভালো শপিং মল থেকে কিছু কিনে দিতে পারবো না। ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়াতে পারবো না। কিন্তু আই প্রমিস আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আমি সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করবো। তুমি আমার অনেক সাধনার প্রিয়াঞ্জনা।”

শেষের দিকের কথাটা কেমন ভিজে যাওয়া কন্ঠে বললো শাহ্! বুকটা ছেৎ করে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। শক্ত করে শাহবাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমার কিছু চাই না তো। কেবল আপনি হলেই চলবে। আপনি যদি আমাকে নিয়ে গাছতলায়ও থাকেন শাহ্ আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার কেবল আপনাকে দরকার।”

বেশ কিছুক্ষণ চললো আবেগঘন মুহূর্ত। অতঃপর দুজনে নেমে এলো নিচে। বদরুজ্জামান সাহেব কলেজে চলে গিয়েছেন। নাজমা রুটি, আলুভাজি আর গরুর গোশত খেতে দিলেন। নাজমাকে দেখলে নিজের মায়ের কথা মনে হয় প্রিয়াঞ্জনার। বুকের কোথায় যেন হু হু করে উঠে। সুমনাকে একটা ফোন করা প্রয়োজন। প্রীতম যে সুমনার উপর অ ত্যা চা র চালাবে তা তার জানা। কিন্তু যদি পুলিশি ঝামেলা করে তার পরিবার! যদি সিম অন করলে জায়গা ট্রেস করে ফেলে! ভয় হয় প্রিয়াঞ্জনার। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না।

(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here