#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৫ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
বিদায় মুহুর্ত! তাহনা বোরকা আর হিজাব পড়ে রেড়ি হয়ে নিয়েছে যাওয়ার জন্য। এদিকে রিদও সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে রেড়ি হয়ে নিচে নামলো মাত্র। সবাই তাদের বিদায় দেওয়ার জন্য একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাহনা একে একে সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে। অনিক আর রিয়ার সামনে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ভালো থাকুন আপনারা। জীবনের সবচেয়ে আনন্দ মুহুর্ত কাটান। আসছি।’
অনিক বলে,
‘খুব মিস করবো তোমাদের তাহনা। আবার এসো।’
‘সুযোগ হলে আসবো ভাইয়া।’
রিয়া বলে,
‘তোমরা সারাজীবন সুখে থেকো তাহনা।’
তাহনা মুচকি হাসে। যেতে নিলেই অনু কোথা থেকে এসে তাহনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘তাহনা আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আমি যা করেছি, যা বলেছি তোমাকে সত্যি এগুলো আমার করা উচিৎ হয়নি। স্যরি তাহনা।’
তাহনা অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ এটাই অনেক। ভালো থেকো অনু।”
তাহনা অনুসহ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। রিদ আর তাহনার বাবাও সবার থেকে বিদায় নিয়ে তাদের গাড়িতে চড়ে বসে।
.
বাসস্ট্যান্ডে এসে তারা চট্রগ্রাম বাসের জন্য অপেক্ষা করে। কয়েকটা বাস যাওয়ার পর তাদের যাওয়ার বাসটি সামনে এসে দাঁড়ায়। রিদ তাহনা ও তাহনার বাবা বাসে উঠে বসে। রিদ তাহনা পাশাপাশি আর তাহনার বাবা অন্য সিটে বসে। রিদ একবার তাহনার দিকে তাকিয়ে দেখে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। রিদ তাহনাকে বিরক্ত না করে সিটে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। যাত্রী সব উঠলেই বাস চট্রগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
*
রাইশা আজ তার এক বান্ধবীর বাসায় এসেছে। তার বান্ধবী খুব অসুস্থ। তাই তাকে দেখতেই সে এসেছে। কিছুক্ষণ ওখানে থাকার পর সে তার বান্ধবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাদের বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
রাস্তার মধ্যে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে রাইশা। আজ তার কপাল খারাপ। একটা রিক্সাও সে পাচ্ছেনা। যেগুলো পাচ্ছে সবগুলোতেই লোকভর্তি। রাইশা হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে বারোটা বাজতে চলল। বাসায় যেতে দেরি হলে মায়ের বকা খাবে। একটা বিরক্তি চলে আসে রাইশার। সে আর রিক্সার জন্য অপেক্ষা না করে হাটা দেয়। দেরি হলে হোক। সে আজ হেটেই বাসায় যাবে।
রাইশার হাটার মাঝখানে হুট করেই একটা বাইক এসে থামলো ওর সামনে। রাইশা ওখানেই থেমে যায়। সে ভিষণ ঘাবড়ে যায়। বাইকের মধ্যে একটা ছেলেকে দেখে রাইশা আরও বেশি ভয় পায়। ছেলেটি বাইক থেকে নেমে হেলমেটটা খুলল। রাইশার ছেলেটার চেহারা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি রেখে রাইশার সামনে এসে বলে,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
রাইশা বিরক্ত নিয়ে বলে,
‘আপনি কি আমায় ফলো করছেন? আমি যেখানেই যাই সেখানেই আপনি উপস্থিত হয়ে যান। কিভাবে বলুনতো?’
ছেলেটা হাসতে হাসতে বলে,
‘আমার খেয়ে আর কাজ নেই আমি আপনাকে ফলো করবো?’
রাইশা বুকে দুহাত ভাজ করে বলে,
‘তাহলে আপনি এখানে কি করে?’
‘থানায় যাচ্ছিলাম। পথে আপনাকে দেখলাম একা একা হাটছেন তাই ভাবলাম কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা দেখি।’
‘সেদিন আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ।’
রাফি মুচকি হেসে বলে,
‘ইট’স ওকে। নেক্সট টাইম দেখেশুনে হাটবেন।’
‘আপনি থানায় যাচ্ছেন কেন?’
‘থানায় আমার বাবা থাকেন।’
আপনার বাবা কি ক্রিমিনাল?’
‘হোয়াট? আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার মিস।’
‘অহ স্যরি। তো আপনি যান।’
‘আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?’
‘বাসায় যাচ্ছি। একটা রিক্সাও পেলাম না আজ। অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, বান্ধবীর বাসায় এসেছিলাম। এখন পড়ে গেলাম বিপাকে। হেটে হেটেই যেতে হচ্ছে।’
‘আপনি চাইলে আমি আপনাকে আপনার বাসায় ড্রপ করে দিতে পারি।’
‘তার প্রয়োজন নেই।’
‘আপনি এভাবে হেটে যেতে অনেক সময় লাগবে। তারচেয়ে চলুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’
রাইশা একটু ভেবে বলে,
ঠিকাছে, চলুন।’
রাফি হেলমেটটা মাথায় লাগিয়ে নেয়। রাইশা বাইকে উঠে বসে। রাফিও বসে তারপর বাইক স্টার্ট দেয়।
.
বাসার সামনে আসতেই ওদের বাইকের সামনে একটা গাড়ি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। রাইশা ভয় পেয়ে যায়। এটা তো তার বাবার গাড়ি। রাইশা দেখে তার বাবা গাড়ি থেকে নামছেন। উনি সামনে তাকাতেই রাইশা আর রাফিকে দেখতে পান। রাইশা বাইক থেকে নেমে যায় তাড়াতাড়ি। মিস্টার আফজাল শেখ রাগান্বিত হয়ে ওদের কাছে আসেন। রাইশা শুধু ভয়ে ঢোক গিলছে। মিস্টার আফজাল শেখ রাইশাকে প্রশ্ন করেন।
‘তুই বাইকে? তাও একটা ছেলের সাথে? কি ব্যপার?’
রাইশা আমতা আমতা করে বলে,
‘আ..আসলে আব্বু আমি মানে ওই..’
ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়ে রাইশার গালে। মিস্টার আফজাল শেখ নিজের মেয়েকে চড় মেরেছেন। রাফি হতভম্ব হয়ে যায়। রাইশার চোখ থেকে পানি বের হচ্ছে। আফজাল শেখ বলেন,
‘কলেজে পাঠাই পড়াশোনা করার জন্য, বান্ধবীর বাসার নাম করে ছেলেদের বাইকে ঘোরা হচ্ছে?’
রাফি এবার এগিয়ে এসে বলে,
‘আংকেল আপনি ভুল বুঝছেন।’
‘তুমি চুপ করো। আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলছি।’
‘কিন্তু আপনি তো ভুল বুঝছেন, ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘তুমি যাও এখান থেকে।’
রাইশার বাবা কড়া ধমক দিলেন রাফিকে। শক্ত করে রাইশার এক হাত চেপে ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় তাকে। এদিকে রাফি ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ভুল আমারই। আমিই ওনাকে জোর করেছিলাম আমার বাইকে উঠার জন্য। এখন ওনার বাবা ওনাকে কি করবেন আল্লাহই জানেন। উনি তো আমার কোনো কথাই শুনলেন না।’
রাফি মন খারাপ করে বাইক নিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
মিসেস ফাবিহা টিভি দেখছিলেন। এমন সময় রাইশাকে টানতে টানতে তার বাবা ভিতরে নিয়ে আসেন। মিসেস ফাবিহা উঠে দাঁড়ান। এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেন।
‘কি হয়েছে? ওকে এভাবে টানছেন কেন?’
আফজাল শেখ উত্তেজিত হয়ে বলেন,
‘তোমার মেয়ে কলেজের নাম করে বান্ধবীর বাসার নাম করে কোথায় যায় জানো?’
‘মানে? কোথায় যায়?’
‘ছেলেদের সাথে বাইকে ঘুরে বেড়ায়। তোমার মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে।’
রাইশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
‘আব্বু তুমি ভুল বুঝছ। উনি আমার সিনিয়র, রিক্সা পাচ্ছিলাম না বলে বাইকে লিফট দিয়েছিল জাস্ট।’
‘তোমার কি গাড়ির অভাব পড়েছিল? কোন সাহসে তুমি অন্য ছেলের বাইকে ঘুরে বেড়াও? লোকজন দেখলে কি বলবে তোমার ধারণা আছে? আমার মান সম্মান তুমি নিচে নামাতে যাচ্ছ।’
‘আব্বু প্লিজ আমি ক্ষমা চাইছি, বিশ্বাস করো আর কখনো এমন হবে না।’
‘উপরে যাও।’
রাইশা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। মিসেস ফাবিহা বলেন,
‘মেয়েটার সাথে এমন বিহেভ করা কি ঠিক হয়েছে? কতটা কষ্ট পেয়েছে ও।’
‘ওর বোঝা উচিৎ ওর বাবার কতটা সম্মান আছে এই সমাজে। একবার বদনাম হয়ে গেলে সব শেষ।’
এই কথা বলে উনিও চলে গেলেন। মিসেস ফাবিহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
*
চারঘন্টা পথ অতিক্রম করে চট্রগ্রাম এসে থামলো তাহনাদের বাসটি। দশ মিনিট জ্যামও ছিল। বাস থেকে নেমে তাহনার বাবা একটা সিএনজি করে চলে গেলেন। তাহনা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিদ একটা সিএনজি এনে তাহনাকে বলে,
‘উঠে বসো। আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ইতে ফিরতে হবে।’
তাহনা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। রিদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হলো তাহনা? কি ভাবছ?’
‘আপনার মা বাবা কি বলবেন? আমার খুব ভয় করছে রিদ ভাইয়া।’
‘আমি আছিতো। টেনশন নিও না চলো।’
তাহনা সিএনজি তে উঠে বসে। রিদ তাহনার পাশাপাশি বসতেই সিএনজি চলতে শুরু করে।
.
প্রায় আধা ঘণ্টা পর সিএনজি এসে থামে রিদের বাড়ির সামনে। রিদ তাহনা নেমে যায়। রিদ ভাড়া মিটিয়ে তাহনার হাত ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকে।
দরজার সামনে নিজের ছেলেটা একটা বোরকা পড়া মেয়ের সাথে দেখে বিস্মিত হলেন মিসেস ফাবিহা। মিস্টার আফজাল শেখ বসে ভসে খবর শুনছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর তাকানী দেখে নিজেও দরজায় তাকালেন। মিসেস ফাবিহা উঠে রিদের সামনে গেলেন। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘একি রিদ তুই এটা কাকে নিয়ে এলি সাথে?’
রিদ নিচু হয়ে বলে।
‘আমি বিয়ে করেছি মা।’
মিসেস ফাবিহা দু পা পিছিয়ে গেলেন। আফজাল শেখ টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তাহনার মুখ হিজাব দিয়ে বাধা থাকায় কেউ তাকে চিনতে পারেনি। মিস্টার আফজাল শেখ রিদের সামনে এসে বলেন,
‘এটা কি সার্কাস চলছে? বোন একটা ছেলের সাথে বাইকে বসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ভাই? সে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। আমার ছেলেমেয়েদের এতো অধপতন কি করে হলো?’
রিদের মা রিদকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই কাকে বিয়ে করেছিস রিদ? এই মেয়েটা কে?’
‘ও তোমাদের পরিচিত মা। আমি তোমার জন্যই ওকে বিয়ে করেছি। আমার মনে হয়েছে তোমার খেয়াল ওর থেকে কেউ ভালো রাখতে পারবে না। আর আমি ওকে জোর করে বিয়ে করেছি মা। ওর কোনো দোষ নেই।’
‘কিন্তু তুমি কাকে বিয়ে করেছ সেটা তো বলো।’
আফজাল শেখ এর চ্যাঁচামেচির শব্দে রাইশা উপর থেকে নিচে নেমে আসে। নিচে এসে দেখে তার ভাই একটা বোরকা পড়া মেয়েকে নিয়ে এসেছে।
রিদ তাহনাকে বলে তার মুখের বাধন খুলতে। তাহনা সেটা খোলার সাথে সাথেই সবাই চমকে যায়। রাইশা অবাক হয়ে বলে,
‘তাহনা আপু তুমি?’
তাহনা কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না। বারবার শুধু রিদের দিকে তাকাচ্ছে। মিস্টার আফজাল শেখ বলেন,
‘তুমি তাহনাকে পছন্দ করো আগে বললেই পারতে, জোর করে ওকে বিয়ে করার কি ছিল? আমাদের বললেই হতো।’
‘আমার ভুল হয়েছে বাবা।’
মিসেস ফাবিহা বলেন,
‘রিদ তুই এটা কেন করলি? ও একটা অনাথ মেয়ে।’
মিস্টার আফজাল শেখ ধমক দিয়ে বলেন,
‘ফাবিহা! কি হচ্ছে? অনাথ বলে কি ও মানুষ না? রিদ? যাও তাহনাকে নিয়ে ভিতরে যাও।’
রিদ তাহনার হাত ধরে তাকে রিদের ঘরে নিয়ে গেল। রাইশা অনেক খুশি হয়েছে, ফাইনালি তার ভাই একটা মিষ্টি মেয়েকে বিয়ে করলো।
চলবে…