প্রিয়তার প্রহর (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৮

0
68

#প্রিয়তার_প্রহর(২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (৮)

দুপুরের শেষ সময়। রোদটা একটু কমেছে। আরহাম ঘুমিয়েছে। রোজ দুপুরে এই সময় ঘুমায় ছেলেটা। প্রিয়তার ঘুম পেলেও সময় হয় না ঘুমোনোর। শপে যাওয়ার জন্য তৈরী হয় প্রিয়তা। গোসল করে হালকা মিষ্টি রঙের সুতির কামিজ জড়িয়ে নেয় গায়ে। ভেজা চুল গুলো ছেড়ে চওড়া ওড়না নিয়ে ঢেকে রাখে। চোখের নিচে কাজল দিয়ে আরহামের কপালে চুমু খায়। পার্স হাতে নিয়ে বের হয় ঘরের বাইরে। শপে হেঁটে যেতে প্রিয়তার আধঘন্টার বেশি সময় লাগে। প্রথম প্রথম আরো বেশি সময় লাগতো। ঘন্টা দেড়েক সময় চলে যেতো। এখন হাঁটার অভ্যেসটা ভালো মতো হয়েছে। পয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে যায়। মাসের শেষের দিকে যখন টাকা হাতে কম থাকে, তখনই হেঁটে ফিরে প্রিয়তা। বাকি দিনগুলোয় বাসে যাতায়াত করে।

স্টেশনের আশপাশে মানুষজন ভরতি। আজকে বাস কম আসছে। মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের হাতে ফোন। সময় কাটানোর জন্য ফোনটাকে ব্যবহার করছে তারা। বাস এলেই তারা ফোনটা রেখে তড়িঘড়ি করে বাসে উঠতে চাইবে। প্রিয়তার এসব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এসব সে দেখে আসছে অনেকদিন ধরে। এই সময়টায় যারা যাতায়াত করে তাদের প্রায় সকলের সাথেই প্রিয়তার ভালো পরিচয় আছে। মাঝে মাঝেই কথা হয়।

ভাবনা চিন্তার মাঝেই প্রিয়তার অতি নিকটে এসে থামে সাদা-কালো বাইক। রোদের ক্ষীণ আলোয় চিকচিক করছে বাইকটা। প্রিয়তা বিচলিত হয় প্রথমে। ভয় পেয়ে যায় আচমকা এমন আগমনে। হেলমেট খুলে প্রহর। প্রহরকে দেখে সস্তি মেলে প্রিয়তার। শ্বাস ফেলে। প্রহর হাসে প্রিয়তার এহেন অভিব্যক্তি দেখে। বলে,

” আপনি ভয় ও পান? বাব্বাহ্! ইটস মিরাকেল।

প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। অন্যসময় হলে লোকটাকে তাড়িয়ে দিত প্রিয়তা, হেলাফেলা করতো। কিন্তু গতকাল থেকে লোকটা তার মনের মাঝে এমন ভাবে গেঁথে নিয়েছে নিজেকে যে প্রিয়তা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি। দমে গিয়েছে সে। লোকটার প্রেমে পড়েছে। প্রহরের এহেন বাক্যে রাগ দেখানোর মিছে অভিনয় করল প্রিয়তা। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,

” তো ভয় পাবো না? ভূতের মতো শব্দ করে ধুরুম করে সামনে এসে পরলে যে কেউই ভয় পাবে। আমি কি রোবট? যে ভয় পাবো না?

প্রহর পুনরায় হাসে। হয়েছে কি ছেলেটার? আজ একটু বেশিই হাসছে না? একটু বেশিই প্রফুল্ল লাগছে না ছেলেটাকে? প্রিয়তার এমন মিছে অভিনয় দক্ষতার কাছে ধরে ফেলে প্রহর। বলে,

” আপনি রোবট নন। পাথর। আর এই পাথরে ফুল ফুটিয়েছে প্রহর।

প্রিয়তা মুচকি হাসে। আলতো করে কিল বসায় প্রহরের বাহুতে। প্রহর বলে ওঠে,

” চলুন তবে।

অন্য দিন হলে প্রিয়তা যেত না। কিন্তু আজকের দিনটাই বোধহয় অন্যরকম। কোনোরুপ ভনিতা না করে প্রিয়তা উঠে বসে বাইকে। ওড়নার অংশ কোলে রাখে। দুরত্ব বজায় রেখে বসে। হেলমেট মাথায় বেঁধে নেয়। প্রহরের কাঁধে হাত রাখে আলতো ভাবে। বাইকের গ্লাসে প্রিয়তাকে দেখে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় প্রহর। দ্রুত গতিতে বাইক চালায়। পাকা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে শাই শাই করে চলে দুজন মানব-মানবী। প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। কাঁধে রাখা আলতো হাতের স্পর্শ গাঢ় হয় তার। কাঁধে চাপ প্রয়োগ করে প্রিয়তা। বলে ওঠে,

” আরেহ্! ধীরে, ধীরে চালান। পরে যাবো। আল্লাহ্!

প্রহর হাসে শব্দ করে। বাইকের গতি কমায় না। উচ্চস্বরে বলে ওঠে,

” আমাকে জড়িয়ে ধরে বসুন প্রিয়তা। নইলে সত্যি সত্যি আপনাকে ফেলে দিবো।

” আপনি আমাকে ফেলে দিতে পারবেন? সন্দিহান চোখে তাকায় প্রিয়তা।

” কেন পারবো না? কষ্ট দিবো, ব্যথা দিবো। আবার নিজেই যত্নআত্তি করে সুস্থ করে তুলবো। মাঝে মাঝে একটু আদর..

” আহ্ প্রহর। বাজে কথা বলবেন না। স্পিড কমান। ভয় লাগছে আমার।

” আমাকে জড়িয়ে ধরুন। কথা দিচ্ছি বাইকের গতি কমিয়ে ফেলবো।

প্রিয়তা শোনে। ধীরে ধীরে কাঁধে থাকা হাতটা নামিয়ে ফেলে। প্রহরের পিঠ জড়িয়ে ধরে এক হাতে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয় প্রিয়তা। মুখ চিবুকে গিয়ে ঠেকে। মূর্ছা যায় প্রিয়তা। শরীর কেঁপে ওঠে। হৃদপিণ্ডে অযাচিত আওয়াজ ঝংকার তোলে। হাসে প্রহর। প্রিয়তার কোমল, রক্তিম মুখের আদলে মোহিত হয়। এক হাত দিয়ে প্রিয়তার অপর হাতে হাত রাখে। প্রিয়তা মিইয়ে যায়। লজ্জা কাটাতে বলে,

” আপনি কি করে জানলেন আমি এসময় বের হবো?

” আপনার অন্তস্থলের ধকধক আওয়াজ ও আমি শুনতে পাই প্রিয়তা। আপনার মুভমেন্ট জানবো না?

প্রিয়তা চুপ থাকে। লোকটা যে এতটা অসভ্য তা তো জানতো না প্রিয়তা। আগে তো কখনো লোকটাকে এমন মনে হয়নি। দায়িত্ববান, ব্যক্তিত্ববান, সুদর্শন পুলিশ হিসেবেই প্রিয়তা লোকটাকে চিনতো। এখন লোকটা অভদ্র হয়েছে। উন্মাদ প্রেমিক হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা প্রথম প্রেম বুঝি এমন হয়? এমন লজ্জা লাগে? প্রথম প্রেমের অনুভূতিতে এত ঝাঁঝ কেন? এত আনন্দ কেন হয়? জানে না প্রিয়তা। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয়। আশপাশে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে প্রিয়তা। এটা তো শপে যাওয়ার রাস্তা নয়। প্রহর তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? প্রিয়তা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

” অ্যাই, আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? উল্টোদিকে যাচ্ছেন কেন?

” আমাদের প্রেমটাকে মাখো মাখো করতে যাচ্ছি।

” আশ্চর্য!

” শপে আর যেতে হবে না আপনাকে। টিউশন করবেন শুধু। আমার বউকে আমি এত মানুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দিবো না। আমার হিংসে হয়।

” আমি চাকরি টা করবো না? টিউশন দিয়ে চলবে আমার? টিউশনিতে কয় টাকা পাই?

বাইক থামায় প্রহর। নেমে যায়। হেলমেট খুলে প্রিয়তাও নেমে দাঁড়ায়। আশপাশে মানুষ তেমন নেই। রাস্তায় সারি সারি দোকান। খোলামেলা পরিবেশ। শাই শাই করে চলছে ভিন্ন ভিন্ন যানবাহন। চুল উড়ছে প্রিয়তার। প্রহর প্রিয়তাকে নামিয়ে দোকান থেকে দুটো লাচ্চি কিনে আনে। প্রিয়তার হাতে একটি দিয়ে অপরটি নিজের কাছে রাখে। বোতলের ছিপি খুলে চুমুক দিয়ে প্রহর বলে ওঠে,

” আপনি নিজের যোগ্যতায় উপার্জন করেন। এতে আমার বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু আমি চাই না আপনি শপে কাজ করুন। যতটা সময় আপনি শপে দেন ততটুকু সময় আপনি বাড়িতে পড়াশোনা করবেন। আরহামকে সময় দিবেন। বাকি সময়টুকু টিউশনি করবেন। আমরা কিছুদিন বাদেই বিয়ে করবো প্রিয়তা। আপনার সকল দায়িত্ব আমার। আরহামের দায়িত্ব ও আমি নিচ্ছি। আপনার স্বাধীনতা আমি কেড়ে নিচ্ছি না। আপনি চাকরি করবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, প্রতিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু তার আগে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। মন দিতে হবে পড়াশোনায়। এরপর না হয় অন্য চাকরিতে জয়েন করবেন। আগে বড় হন প্রিয়তা। এপর চাকরির কথা ভাবুন।

প্রিয়তা রাগে। ঠোঁট ফুলায়। কিছু একটা ভাবে। পরবর্তীতে আর কথা বাড়ায় না। প্রহর নিজেও তো প্রিয়তার জন্য অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করেছে। প্রিয়তা পারবে না? পারবে না লোকটার কথা রাখতে? নিজেকে সপে দিতে পারবে না প্রহরের নিকট? হেলমেট পরে আবার ও বাইকে ওঠে প্রিয়তা। হাসি হাসি মুখে বলে ওঠে,

” চলুন। বসের সাথে কথা বলে আসি।

প্রহর আপত্তি জানায়। প্রিয়তার বসে থাকা বাইকের অংশের দু পাশে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ায়। ঠোঁট গোল করে ফু দেয় প্রিয়তার ললাটে। ললাটে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো উড়িয়ে দেয়। দুষ্টু হেসে বলে,

” জি না ম্যাম। আমরা এখন ঘুরতে যাবো। পুরো এলাকা ঘুরবো। আর আপনি আমাকে জড়িয়ে রাখবেন। যতবার কোমর থেকে হাত সরবে ততবার চুমু খাবো। অনেক জ্বালিয়েছেন। আর সে সুযোগ দিবো না।

প্রিয়তা নুইয়ে পরে। লজ্জায় নত হয় আবার। শিরা উপশিরায় শীতল স্রোত বয়ে যায়। নাকের ডগা রক্তিম হয়ে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে,

” অসভ্য পুলিশম্যান।

________

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকার হচ্ছে চারপাশ। সূর্য ডুবে গেছে খানিকক্ষণ আগে। শীতল বাতাসে দুলে উঠছে সর্বাঙ্গ। শিরা-উপশিরায় নতুনত্বের ছোঁয়া গাঢ় হচ্ছে। এ বাড়িতে এসে তানিয়ার মোটেই অসস্তি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এ যেন তার নিজেরই বাড়ি। গত চারমাসে এই বাড়িটায় অনেকবার এসেছে তানিয়া। প্রত্যেকবার ইহানের কলিগ হিসেবে এলেও এইবার ইহানের স্ত্রী রুপে এ বাড়িতে এসেছে তানিয়া। এই অনুভূতিটা ভিন্ন। কেমন নতুন! তানিয়ার এখন কষ্ট হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই তো তাদের বাসা। অটো ধরলে আধঘন্টা লাগবে যেতে। তানিয়ার খানিক লজ্জাও লাগছে। নতুন বউ হিসেবে তার এ বাড়িতে কেমন ভাবে চলা উচিত? কেমন আচরণ করা উচিত?

তানিয়া বসে আছে ইলমা বেগমের পাশে। ইলমা বেগম মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কেঁদে যাচ্ছেন। তানিয়া চেষ্টা করেছে কান্না থামানোর। কিন্তু ইলমা বেগম থামছেন না। কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। তানিয়ার অদ্ভুত লাগছে। আজ তো তার কান্নাকাটি করার কথা। কিন্তু করছেন ইলমা বেগম। ইলমা বেগম কান্না করছেন তার স্বামীর জন্য। চোখ মুছে তিনি তানিয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,

” আজ ও থাকলে কতই না খুশি হতো। ছেলের বিয়ে নিয়ে অনেক উত্তেজিত ছিল লোকটা। ছেলের বউয়ের জন্য গয়না বানিয়ে রেখেছে দু বছর আগে। ও তোমাকে ছেলের বউ হিসেবে দেখে যেতে পারল না। ছেলের বিয়েটা দেখতে পারল না।

তানিয়ার মন খারাপ হলো। ইহানের আব্বা ভিষণ ভালো মানুষ ছিলেন। তানিয়াকে মেয়ের মতো দেখতেন। আজ এই বিয়েটায় উনি থাকলে বেশ আনন্দিত হতেন। তানিয়াকে মাথায় তুলে রাখতেন বোধহয়। তানিয়া ইহানের ঘরে ফিরে। ফোন তুলে নেয় হাতে। বিয়ের পরই ইহান চলে গিয়েছে। থানায় নতুন কেস এসেছে। বসে থাকার উপায় নেই। বিয়ের কার্য সম্পাদন হবার সাথে সাথেই ইউনিফর্ম পরে চলে গিয়েছে থানায়।

ইহানের নম্বরে ডায়াল করল তানিয়া। একটু সময় নিয়েই ফোন ধরল ইহান। আজকে ইহানের কণ্ঠ কেমন অন্যরকম লাগল তানিয়ার নিকট। সেসব নিয়ে মাথা ঘামাল না সে। একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বউসুলভ আচরণের সাথে বলে উঠল,

” কোথায় আপনি?

তানিয়ার এমন কথায় অপ্রস্তুত হলো ইহান। নিঃশব্দে হাসল। সে হাসি স্থায়ী হলো না বেশিক্ষণ। গাম্ভীর্য টেনে নিল। ভ্রু দ্বয়ের পাশে চুলকে নিয়ে বলে উঠল,

” কেন বলো তো? বের হচ্ছি থানা থেকে।

” তাড়াতাড়ি আসুন। আন্টি কান্না করছে।

” আম্মা কাঁদছে?

” হ্যাঁ। আঙ্কেলের কথা মনে পরছে উনার। জলদি আসুন। আসার পথে আন্টির জন্য ফুচকা, আইসক্রিম আনবেন।

” আজ তো বাড়িতে ঢের রান্না হয়েছে। এসব কেন?

” মেয়েদের এসব বাইরের খাবার খুব ভালো লাগে বুঝলেন। ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম এসব তো আমাদের প্রিয় খাবার। আপনি আনবেন মনে করে।

” আসছি।

” হুহ সাবধানে।

ফোন রাখে তানিয়া। শরীরে থাকা অলঙ্কার খুলে ফেলল। বেগুনি রঙের ঝকমকে শাড়ি বদলে সুতির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে পুনরায় ইলমা বেগমের পাশে বসে রইল। আধঘন্টার মাথায় ইহান ফিরল বাড়ি। হাতে কয়েকটা পলিথিন। ডাইনিং টেবিলে পলিথিন গুলো রেখে ইলমা বেগমের ঘরে ঢুকল ইহান। তানিয়া সরে দাঁড়াল। এখনও ইলমা বেগম কাঁদছেন। ইহান আম্মার পিঠে মাথা ঠেকায়। ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,

‘ কাঁদছো কেন আম্মা? মাথা ব্যথা করবে তো।

ইলমা বেগম ঢলে পরেন ছেলের বলিষ্ঠ বুকের মাঝে। শব্দ করে কাঁদেন। ছেলের মুখে চুমু দেন। বলেন,

” তোরা আব্বা আজকে তোদের একসাথে দেখলে খুব খুশি হতো তাই না রে? তোর বিয়ে দেখার কত স্বাধ ছিল ওর। ও কি দেখতে পাচ্ছে আমাদের? বল না। দেখতে পাচ্ছে? খুশি হয়েছে তো? ও তোকে বিয়ে দেয়ার কত চেষ্টা করছিল। দ্যাখ আজ ও নেই। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। ছেলের বিয়েটা দেখে যেতে পারল না।

ইহানের চোখ অশ্রুসজল হয়। চিকচিক করে ওঠে চোখের কার্ণিশ। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে আম্মার চোখের পানি মুছে দেয় ইহান। বলে,

” আব্বা আছেন। আমাদের মনের মাঝে আছেন। তুমি কাঁদবে না একদম। আব্বা কষ্ট পাবেন।

” কষ্ট পাবে?
সন্দেহ নিয়ে কথাটুকু বলেন ইলমা বেগম। উক্ত কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানিয়া এগিয়ে আসে। বলে,

” আঙ্কেল খুব কষ্ট পাবে আন্টি। আপনি, আমরা হাসিখুশি থাকলে আঙ্কেলও খুশি হবে। আপনি আর কাঁদবেন না প্লিজ।

ইহান উঠে বসে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। দৌঁড়ঝাপ বেশ ভালোই হয়েছে আজ। ডায়মন্ড শপ থেকে দুটো হীরের আংটি আর একটি নেকলেস চুরি হয়েছে। প্রথমে দোকানী চুরির বিষয়টা বুঝতে পারেনি। যখন বুঝেছে তখন চোর গায়েব। সিসি ক্যামেরায় ধরা পরেছে কিনা সেটাও জানে না দোকানী। সব দায়িত্ব দিয়েছে পুলিশকে। তানিয়ার ল্যাপটপের সাথে সেই ক্যামেরার অনেকটা অংশ কানেক্ট করে দিয়েছে ইহান। সিসি টিভি ক্যামেরার সব ফুটেজ তানিয়ার ল্যাপটপে রয়েছে। তানিয়াকে খাবারগুলোর কথা বলে ঘরে গেল ইহান। তানিয়া খাবারগুলো প্লেটে ঢেলে শাশুড়ির সম্মুখে দিল। তানিয়াকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলমা বেগম বললেন,

” তুমি এখন ঘরে যাও।

তানিয়া নারাজ। একজনকে খেতে গিয়ে এভাবে চলে যাওয়া যায়? তানিয়ার জন্যেও খাবার এনেছে ইহান। এখন সে খাবে না। ফ্রিজে রেখে দিয়েছে কিছু অংশ। বাকিটা ইলমা বেগমকে দিয়েছেন। উনার খাওয়া শেষ না হওয়া অব্দি কাছ থেকে চলে যাওয়াটা বেমানান। হাসি মুখে তানিয়া বলে উঠল,

” আপনি খান আন্টি। আমি এখানেই থাকি। সমস্যা নেই তো।

” আমার ছেলের কাছে যাও। দেখো গিয়ে কি কি লাগে। এখন তো তোমাকেই এসব দেখতে হবে। স্বামীর সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করতে হবে তাইনা?

অবাক হয় তানিয়া। বলে,
” উনি তো আমার বন্ধুই। উনাকে তো আমি বন্ধুর মতোই ট্রিট করি।

” তুমি তোমার স্যারকে বন্ধু ভাবো। স্বামীকে তো এবার বন্ধু ভাবতে হবে নাকি? ওর খেয়াল তো এখন তোমাকে রাখতে হবে। অনেক অজানা আলাপ করতে হবে।

তানিয়া মেনে নেয়। ধীর গতিতে ইহানের রুমে পা ফেলে। ইহান সবে গোসল করেছে। উন্মুক্ত রোমশপূর্ণ বুক। কোমরে সাদা টাওয়াল পেঁচিয়ে রেখেছে। চুল বেয়ে মুক্তোর ন্যায় পানির কণা ঝরছে। অপূর্ব লাগছে ছেলেটাকে।

ইহান ওয়ারড্রবের তাকে শার্ট খুঁজছে। ইহানকে এমন অবস্থায় দেখে বিব্রত হয় তানিয়া। উচ্চস্বরে পেছন থেকে শব্দ করে বলে ওঠে,

” আল্লাহ্!

চোখ বন্ধ করে পেছনে ঘুরে যায় তানিয়া। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। উদাম গায়ে ইহানকে এর আগেও সে দেখেছে। কিন্তু উন্মুক্ত শরীর আর টাওয়াল পেঁচানো অবস্থায় এই প্রথম লোকটাকে দেখে লজ্জায় মরিমরি অবস্থা তানিয়ার। ইহান তানিয়ার এমন উচ্চস্বর শুনে পিছনে ফিরে। বুঝতে পারে তানিয়ার এমন অভিব্যক্তি দেওয়ার কারণ। ভ্রু কুঁচকে ফেলে ইহান। বিরক্ত হয় খানিক। বলে,

” কী? চিৎকার করছো কেন?

” আপনি জামাকাপড় পড়ুন। ছিঃ!

চোখ ছোটছোট করে ফেলে ইহান। বিরক্ত হয়ে বলে,
” এমনভাবে বলছো যেন আমি কিছুই পড়ে নেই।

” হ্যাঁ কিছুই তো নেই শরীরে। টাওয়াল ছাড়া। অকপটে বলে তানিয়া।

ইহান কথা বাড়ায় না। এখন তর্ক করতে বালো লাগছে না তার। ইহান শার্ট আর প্যান্ট পরে নেয় ওয়াশরুমে গিয়ে। ফিরে আসে চুল মুছতে মুছতে। তানিয়া তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। ইহানকে দেখে বলে,

” আজকের দিনটা থানায় না গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হতো নাকি? আন্টি মন খারাপ করেছিল দুপুরে।

” অবশ্যই মহাভারত অশুদ্ধ হতো। তোমার মতো তো কুঁড়ে নই আমি।

” এত বড় কথা? আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। আমি অলস নই।

” তুমি যা তাই বলেছি। ডায়মন্ড শপে চুরি হয়েছে। সিসি ক্যামেরার সব ফুটেজ তোমার ল্যাপটপে। চেইক করো। সন্দেহজনক কিছু পেলে বলবে।

তানিয়া বিরক্ত হয়। ইলমা বেগমের সাথে একটু পর লুডু খেলার প্রতিযোগিতা আছে তার। এখন কি এসব কাজ করার সময়? দুদিন ছুটি নিয়ে তাহলে লাভ কি হলো? যদি বাসায় বসেই কাজ করতে হয়। ভেংচি কেটে তানিয়া বলে উঠল,

” পারবো না। আমার অনেক কাজ আছে। আপনার কাজ আপনি করুন। আমাকে খাটাচ্ছেন কেন?

” তানিয়া, কথা বাড়িও না। যা বললাম করো। কেসটা যত দ্রুত সলভড করতে পারবো ততই ভালো।

” আমি আপনার আন্ডারে এখন কাজ করছি না, আর আপনি এখন আমার স্যার ও নন। তাই এই ধমক-টমক চলবে না।

” বেশ! তো এখন আমি তোমার কি হই? বলো!

অপ্রস্তুত হয় তানিয়া। কণ্ঠে জড়তা কাজ করে। বলে,

” স্বা..স্বামী।

” তো এখন তোমার সাথে স্বামীসুলভ আচরণ করতে হবে তাই তো? ওকে! কাম। আমার বিবি, আসুন আপনাকে স্ত্রী হিসেবে ট্রিট করি।

তানিয়া ঘাবড়ায়। বিড়বিড় করে বলে,

” অসহ্য লোক কোথাকার।

শুনতে পায় ইহান। বাঁকা হেসে বলে,

” সেইম টু ইউ।

তানিয়া বিছানায় উঠে বসে। ল্যাপটপ অন করে। বিড়বিড় করে বকে যায় ইহানকে। পাত্তা দেয় না ইহান। আম্মার কাছে চলে যায়। মেয়েটার আশেপাশে থাকতে ভিষণ ভয় হয় ইহানের। কখন না জানি বুঝে যায় তার অনুভূতি।

______

ফিরতে ফিরতে বেশ খানিকটা লেইট হলো প্রহর আর প্রিয়তার। জ্যামের কারণে রাস্তায় যাতায়াত করা কষ্টকর। পুরো এলাকা টহল দিয়েছে তারা। ফুটপাতের খাবার খেয়েছে, আনন্দ করেছে। এমন দিন প্রিয়তার কাছে যেন নতুন। এভাবে কোনো পুরুষের সাথে ঘুরাঘুরি করেনি প্রিয়তা। তন্ময়ের সাথেই ভাব ছিল প্রিয়তার। কিন্তু সে তো প্রেমিক ছিল না প্রিয়তার। ছোটবেলায় আব্বু-আম্মুর সাথে প্রিয়তা অনেক ঘুরেছে। ভারতেও গিয়েছিল দু বার। সিলেটের কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় যে ঘুরেছে তার হিসেব নেই। আরহাম ভূমিষ্ঠ হবার পর আরিফ বেশ খুশি ছিলেন। বিরাট আয়োজন করেছিলেন বাড়িতে। পুরো এলাকার মানুষ ডেকে খাইয়েছিলেন। সেইসব দিনগুলো আজ অতিত। সেসবের সাথে বর্তমানের কোনো মিলই নেই।

কিছুদূর গেলেই বাড়িতে পৌঁছাবে প্রিয়তা। কিন্তু রাস্তায় ছোটখাটো জ্যাম বেঁধেছে। প্রিয়তা অবাক হয় খানিক। এ রাস্তায় সহজে জ্যাম লাগে না। আগে কখনো দেখেনি সে। আজকের দিনেই এমন হতে হলো? সন্ধ্যে ঘনিয়েছে তো।

বাইকে বসে থাকতে গিয়ে প্রহর ও বিরক্ত হলো। নেমে পরল বাইক থেকে। দেখতে চাইল জ্যাম লাগার কারণ। সামনে এগিয়ে প্রহর দেখতে পেল দুজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লোহার লাঠি। পুলিশের পা ধরে কাঁদছেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক। প্রহরের বাবার বয়সী হবে লোকটা। চুল আর দাড়িতে পাঁক ধরেছে। নির্জীব চেহারা লোকটার। প্রহরের দেখাদেখি এগিয়ে এলো প্রিয়তা। বুঝতে পারল জ্যাম বাঁধার আসল কারণ। বয়স্ক লোকটি তার অটো মেইন রাস্তায় উঠিয়েছে। যা আইনের ভাষায় অন্যায়। তাই পুলিশ এই লোকটার অটো লক করে দিয়েছে। তাদের সাথে নিয়ে যাচ্ছে অটোটা। বয়স্ক লোকটি তার অটো না নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের পা ধরে অনুনয়-বিনয় করেছেন। পুলিশ লোকটা তাই লোহার হাতল দিয়ে প্রহার করল লোকটার পায়ে। কুঁকড়ে উঠলেন বয়স্ক লোকটি। প্রহর নিশ্চুপ থাকতে পারল না। সে ট্রাফিক পুলিশ নয়। তবে রাস্তায় কখনো কোনো সমস্যা হলে প্রহর দায়িত্বের সাথে সে সমস্যার সমাধান করে এসেছে। এজন্য উপরমহলের বস রা বেশ খুশি। আজকাল যেখানে পুলিশরা চেয়ারে বসে বসে ঝিমোয় সেখানে প্রহর ট্রাফিক পুলিশের কাজ গুলোও করছে অলসতা ছাড়াই।

প্রহর এগিয়ে আসে। পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে,

” লোকটাকে এভাবে মারছেন কেন? জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিন। অটো নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

পুলিশ লোকটা বিরক্ত হলো। প্রহরের দিকে তাকিয়ে লোহার হাতলটি চওড়া করে বাঁধা দিল প্রহরকে। বলল,

” সামনে আসবেন না। কাজ চলছে। সরুন।

” আপনি তো ঠিক করছেন না এটা। দৃঢ় কণ্ঠ প্রহরের।

বেজায় রেগে গেল লোকটা। বলল,

” তুই পুলিশ নাকি আমি পুলিশ? আমারে ঠিক ভুল বুঝাইতে আসস? থানায় টানতে টানতে নিয়া লকাপে ভরে দিমু একদম। সর।

প্রহর রেগে যায় খানিক। ক্রোধটুকু গিলে ফেলে। নিজেকে সংযত রেখে বলে,

” যতদূর জানি আইনে এমন নিয়ম নেই যে অটো থানায় নিয়ে যেতে হবে। জরিমানা নেওয়াই এনাফ।

বয়স্ক লোকটি বলে উঠল,
” গাড়ি নিয়া যাইক সমেস্যা নাই। কিন্তু নিয়া গেলে আর তো আর গাড়ি পামু না। আমার নতুন গাড়ি।

প্রহর বলে উঠল,

” জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিন। আর কখনো এই ভুল উনি করবেন না। মেইন রাস্তায় উঠবেন না।

পুলিশ লোকটা ততক্ষণাৎ বাজে ভাষায় গালি ছুঁড়ে দিল প্রহরকে উদ্দেশ্যে করে। প্রহর থমথম চোখে তাকায়। জ্বরে ওঠে সর্বাঙ্গ। প্রিয়তা এগিয়ে এলো। পুলিশের এমন ভাষা শুনে গা গুলিয়ে উঠল তার। গাঢ় কণ্ঠে গর্বের সাথে বলে ওঠল,

” আপনি জানেন উনি কে? কার সাথে কথা বলছেন আপনি? আপনার চেয়ে আইনটা উনি বেশ ভালোই বুঝেন।

চিৎকার করে পুলিশ লোকটা বলে উঠল,
” কে ও? কি করবো ও আমার? বা*ল ছিড়বো?

প্রিয়তা তেজী কণ্ঠে বলে উঠল,
” আজওয়াদ ইশতিয়াক। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? তার সামনে দাঁড়িয়ে অন্যায় করছেন আবার তাকে গালিও দিচ্ছেন?

চোখ বড় বড় হয়ে গেল লোকটার। নামটা শুনে ভয়ে কাবু হল খানিক। তবুও উচ্চস্বরে বলল,

” উনি সিলেটের থানার বড় অফিসার। এইখানে উনার নাম চলবো না।

প্রিয়তা হাসে। বলে,
” সরি টু সে, আপনি হয়তো জানেন না উনি এখন সাভারের থানায় ট্রান্সফার হয়েছেন।

পুলিশ লোকটা ততক্ষণাৎ অটোতে চাবি ঘুরিয়ে অটো আনলক করল। একটি কাগজে কিছু লিখে এগিয়ে দিল বয়স্ক লোকটার দিকে। বলল,

” আপনার জরিমানা হয়েছে পাঁচশ টাকা। টাকা দিয়ে অটো নিয়ে যান।

বয়স্ক লোকটা সময় ব্যয় করল না। টাকাটা দিয়ে অটো নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। পিছু ফিরে তাকালেন না একদম। পুলিশ লোকটা মাথা নত করে বলল,

” সরি স্যার। আর হবে না।

প্রহর কথা বাড়ায় না। গাড়িগুলোকে ঠিকঠাক মতো সরিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করে বাইকে বসে। প্রিয়তাও নত মুখে পেছনে বসে। মনে মনে হাসে প্রহর। বলে,

” এটা তো কেবল শুরু প্রিয়তা। আপনি নিজেই আমাকে চাকরিতে জয়েন হতে বলবেন। সমাজের অন্যায় গুলো কেবল আপনার চোখে পরুক। আপনি মানতে পারবেন না সেসব। আমায় ফিরতে বলবেন। আমি অপেক্ষায় রইলাম।

প্রিয়তা মাথা নত করে মলিন মুখে বলে ওঠে,
” আইনে যখন এমনটা নেই তাহলে উনারা কেন অটো নিয়ে যাচ্ছে?

” অটোগুলো নিয়ে ওরা নিলামে তুলবে। মানে বিক্রি করবে। টাকা পাবে। এজন্যই। এটাকে বলে বিজনেস।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ।

[ বানানে অসংখ্য মিস্টেইক হতে পারে🙂 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here