#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১২ )
রাত নয়টা বেজে আঠারো মিনিট। অন্ধকারে নিমজ্জিত শহর। শাই শাই করে ছুটে চলেছে বাস। বাসের একদম সামনে এলইডি টিভি লাগানো। বাংলা ছবি চলছে সেখানে। প্রিয়তার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। বাসের জানালা দিয়ে ব্যস্ত নগরী দেখতে ভালো লাগছে তার। মন খারাপের এই সময়ে অন্ধকার শহর দেখতে জমকালো লাগছে। প্রিয়তার কোলে বসে আছে আরহাম। ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। বাসে উঠলেই ছেলেটার নাকি ঘুম পায়। ফোস ফোস করে শ্বাস ছাড়ছে সে। প্রিয়তার ডান পাশে বসে আছে প্রহর। আঁখি যুগল প্রিয়তাতে নিবদ্ধ। প্রিয়তা মেয়েটার চোখেমুখে একরাশ মায়া। তাকালেই কেমন ঘোর লেগে যায়। অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় মেয়েটার দিকে। অত্যন্ত সুন্দর এই পুষ্পের মন খারাপ আজ। বাবার এহেন অসুস্থতায় মেয়েটা মিইয়ে গেছে। বুঝতে দিতে চাইছে না মন খারাপের দিক। কিন্তু প্রহর কি অবুঝ? সে খুব ভালোভাবেই বুঝে প্রিয়তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা। আরহামের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রহর প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,
” কিছু খাবেন?
প্রিয়তা এক পলক তাকায় প্রহরের পানে। ছেলেটার চিন্তিত কণ্ঠস্বর সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। বলে,
‘ উঁহু। খাবো না কিছু।
” শরীর খারাপ লাগছে? লেবু পাতা আর আচার এনেছি কিন্তু।
” লাগবে না।
প্রহর আরহামকে প্রিয়তার কোল থেকে নিয়ে নিজের কোলে বসায়। প্রিয়তার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় জড়িয়ে নেয়। প্রিয়তা আবেগাপ্লুত হয়। কণ্ঠ জোরাল হয় মেয়েটার। কাঁপা কাপা কণ্ঠে বলে ওঠে,
” আব্বু সুস্থ হয়ে উঠবে তো?
” আগে আমরা ওখানে যাই। গিয়ে দেখি উনি কেমন আছেন। দেখলে বুঝতে পারবো উনি সুস্থ হবেন কিনা। আপনাকে আমি কোনোরুপ মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চাই না প্রিয়তা।
____
না বলেকয়ে ইহানের আগেই থানা থেকে ফিরেছে তানিয়া। বাড়ি ফিরে চুপচাপ শুয়ে আছে সে। ইহানের ঘরে নয় বরং শাশুড়ির ঘরে শুয়ে আছে মুখ ফুলিয়ে। ইলমা বেগম তানিয়ার পাশে বসে তাসবিহ্ পাঠ করছেন। বেশ ভালোমতোই জ্বর এসেছে উনার। চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছেন না। তবুও আড়চোখে তাকাচ্ছেন তানিয়ার দিকে। ছেলের বউয়ের এমন মলিনতা মেনে নিতে পারলেন না তিনি। এমন চুপচাপ থাকার স্বভাব যে তানিয়ার নেই তা তিনি ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছেন। বন্ধুসূলভ ভঙ্গিতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” ইহান বকেছে?
তানিয়া পাশ ফিরে তাকায় শাশুড়ির দিকে। মুখ ফিরিয়ে পুনরায় শুয়ে থাকে। একটু সময় নিয়ে বলে ওঠে,
” উনার বকাবকির ধার ধারি আমি?
” তাহলে মুখ ফুলিয়ে আছো কেন? এভাবে কিন্তু তোমাকে মানাচ্ছে না।
” উনি খুব বদমাইশ। আমাকে শুধু শুধু ধমকায়। আমি উনার সাথে কথা বলবো না আর।
হাসেন ইলমা বেগম। ইহানের কণ্ঠস্বর শুনতে পান। বেরিয়ে আসেন বাইরে। ইহানের ঘর্মাক্ত শরীর দেখে বলেন,
” এসি বা ফ্যান ছেড়ে ঘরে বোস।
ইহান আশপাশে চোখ বুলায়। মাথার ক্যাপ খুলে বলে,
” ক্ষুধা লেগেছে আম্মা। লাঞ্চে কিছু খাইনি।
” আমি খাবার দিচ্ছি।
ইহান বিরোধিতা করে। বলে,
” তানিয়াকে পাঠাও আম্মা। তুমি শুয়ে থাকো। তোমার শরীর ভালো নেই। রেস্ট করো।
ইহান ঘরে পৌঁছায়। হাত ঘড়ি খুলে রাখে ড্রেসিংটেবিলে। ইউনিফর্ম খুলে ঢিলেঢালা গেঞ্জি পরে নেয়। দরজার দিকে পুনরায় দৃষ্টি ফেলে। হাঁক ছাড়ে ইহান। তানিয়া ট্রে নিয়ে ঘরে আসে। মেয়েটার মুখ মলিন। অভিমানে জুবুথুবু হয়ে আছে। প্রাপ্তবয়স্ক মনে নানা রকমের দ্বন্দ্ব। ট্রে তে থাকা খাবারটা বিছানায় রেখেই ঘর থেকে চলে আসতে চায় তানিয়া । বাঁধা দেয় ইহান। বলে,
” খাবার দিয়ে চলে যাওয়া কোন ধরনের অভদ্রতা তানিয়া? যতক্ষণ না খাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ পাশে বসে থাকবে। কখন কি লাগবে জানতে চাইবে। এখন এটাও বলে দিতে হবে তোমাকে?
তানিয়ার নত মুখ উঁচু হয়। অপমানে থমথম হয় মুখমণ্ডল। কারো সামনে খাবার দিয়ে চলে যাওয়া উচিত নয়। এটা তানিয়ার মা ও বলতেন। উনি বলতেন “কাউকে খাবার দিয়ে কখনো দূরে চলে যাবি না। তাহলে খাবার দেওয়া ব্যক্তিকে অসম্মান করা হবে। সম্ভবত কুকুরকে খাবার দেওয়ার পর কোনো মানুষই কুকুরের সম্মুখে বসে থাকে না। আমরা মানুষরা কুকুরকে কোনরকমে খাবার দিয়েই সেখান থেকে চলে আসি। তাই কারো সামনে খাবার দিয়ে চলে গেলে সে নিজেকে কুকুরের ন্যায় মনে করে”। অভিমানে নত হওয়া তানিয়ার এ কথা মাথায় আসেনি। রাগের বশে ইহানের থেকে দূরে দূরে থাকার পণ করেছে সে। মনে থাকলে কখনোই এমনটা করতো না তানিয়া। ইহানের এমন আচরণে ভেঙে খান খান হলো মেয়েটার নরম সত্তা। শব্দ করলো না কোনো। বসে রইল খাটের এক কোণে। ইহান খেতে বসল। আড়চোখে তাকাল তানিয়ার দিকে। বলল,
” মুখ এমন করে রেখেছো কেন?
তানিয়ার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না। মলিন মুখেই বলে ওঠে,
” আমার মুখটাই অমন। কোনো সমস্যা?
শেষের বাক্যটুকু বলতে গিয়ে তানিয়ার রাগের পরিমাণ বাড়ল। কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পেল তার। ইহান বুঝল বিষয়টা। বলল,
” আবিরের সাথে দেখা করতে দিইনি বলে এত রাগ?
তানিয়া জবাব দেয় না। তানিয়ার এমন ফ্যাকাশে মুখশ্রী সহ্য হয় না ইহানের। বিরক্ত হয় খানিক। খাবার খাওয়ার ইচ্ছে মরে যায়। ভাতে পানি ঢেলে দেয় ইহান। তানিয়ার চাহনি গাঢ় হয়। ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। বিস্ময়ে ফেটে পড়ে। বলে,
” পানি ঢাললেন কেন? খাবেন না?
ইহান ঢকঢক করে পানি পান করে। খালি গ্লাসটা রেখে বলে,
” না। ইচ্ছে নেই।
” তো আন্টিকে বললেন কেন ক্ষুধা লেগেছে?
ইহান হাত বাড়িয়ে তানিয়াকে কাছে টানে। ভড়কে যায় তানিয়া। হতবাক চোখে তাকায় স্বামীর পানে। সলজ্জ চোখে অভিমান কেটে লজ্জার রেশ দেখা দেয়। ইহান ক্রূর হাসে। বলে,
” আবিরকে আমার সহ্য হয় না তানিয়া। তাই দেখা করতে দিইনি।
তানিয়া বাঁকা হাসে। ঘাড় ফেরায় সে। তাকায় না ইহানের দিকে। আবিরের সাথে দেখা করার ইচ্ছে তানিয়ার ছিল না। এমনকি দেখা করতে পারেনি বলে তানিয়া বেশ খুশি হয়েছে। কিন্তু তবুও ইহানের দিকে অভিমানী চোখে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে তানিয়ার। কেন যেন ইহানের সামনে অভিমানে করতে বেশ ভালোও লাগছে। মন চাইছে ইহান তাকে প্রাধান্য দিক। তার মন খারাপ দূর করার চেষ্টা করুক। অন্যদিকে ঘুরে উঠে দাঁড়াল তানিয়া। ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে আয়নায় ইহানকে দেখল সে। ঠোঁট চেপে ধরে বলে,
” যদি বলি দেখা করতে দেননি বলে আপনার উপর রাগ করিনি? তাহলে?
” তাহলে রাগ করার কারণ বলবে।
” আমায় মিথ্যে বলেছেন সেজন্য রাগ করেছি। আমার সাথে লুকোচুরি খেলেছেন তাই রাগ করেছি, আমার থেকে সত্য আড়াল করেছেন তাই রাগ করেছি। এখন? আর কিছু শুনতে চান?
” মিথ্যে বলেছি আমি?
” হ্যাঁ বলেছেন। গত এক বছর ধরেই বলে চলেছেন। আর কত অভিনয় করবেন ইহান?
ইহান থমকায়। তানিয়া কিসের কথা বলছে বুঝতে পারছে না সে। তানিয়ার কণ্ঠে ক্রোধ। কেমন অদ্ভুত হিংস্র চাহনির সম্মুখে পড়ে নাজেহাল হয় ইহান। জিভ দ্বারা ওষ্ঠাদ্বয় ভিজিয়ে বলে,
” অভিনয়?
” পুলিশের ট্রেনিং নেওয়ার সময় থেকে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। অথচ আমাকে এসব ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি। আমায় জানাননি। কেন? আমি ভেবেছিলাম আমাদের বিয়েটা হয়েছিল অনাকাঙ্খিত ভাবে। আপনি আমি দুজনেই ছিলাম পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু না। এর পেছনে তো ছিলেন আপনি। আপনি আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন। নিজেও রাজি ছিলেন। সবাইকে রাজি করিয়েছেন আপনি।
ইহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই শোনে তানিয়ার সব কথা। বলে,
” কে বলেছে তোমাকে?
” আমাকে আপনার অবুঝ বলে মনে হয় ইহান? আপনি অতটাও অসহায় মানুষ নন যে আন্টির চাপে পড়ে আপনি বিয়েতে অনিচ্ছা থাকা সত্বেও রাজি হবেন। আন্টি সবটা বলেছে আমাকে, আবিরও বলেছে। আর কিছুটা আমি আন্দাজ করেছিলাম। আপনার উপর খুব রাগ ছিল আমার। ভেবেছিলাম আপনার পছন্দের শার্ট প্যান্ট কেটে কুচি কুচি করে ফেলবো। প্যান্ট হাতে নিলাম। পকেট থেকে খচখচ আওয়াজ হলো। বের করে দেখলাম আমার পুরোনো ছবি। সাথে আমাকে নিয়ে লেখা চিঠি। এত কিছুর পর আপনি অস্বীকার করছেন যে আপনি মিথ্যে বলেননি? সারা রাত জেগে আমাকে দেখেন, আমার মাথায় হাত বুলান, হাতে চুমু খান। কি ভাবেন এসব আমি উপলব্ধি করতে পারিনি?
ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা খুব চতুর। মাত্র কয়েকদিন এ ঘরে থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার অজানা তথ্য বের করে ফেলেছে। এতগুলো কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলা উচিত ভেবে পায় না ইহান। বলে,
” ভালোবাসা প্রচণ্ড যন্ত্রণার হয়, জানো তানিয়া? এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে গিয়ে আমি বহুবার নিজেকে নিজে শাসিয়েছি। আঘাত করেছি নিজেকে। যখন তুমি ট্রেনিংয়ে ছিলে তখন তোমার চাকরি নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। টিকতে পারোনি প্রথমবার। মিইয়ে গিয়েছিলে তাই। বন্দি হয়ে গিয়েছিলে ঘরে। কান্নাকাটি করে গুটিয়ে নিয়েছিলে নিজেকে। সেসময় এসব বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। চুপ করে ছিলাম। তুমি চাকরি পাওয়ার পর ভেবেছিলাম তোমাকে সবটা জানাবো। কিন্তু বলবো বলবো করেও বলা হয়নি। তুমি আমাকে চেনো তানিয়া। অনুভূতি প্রকাশে আমি অক্ষম। কেমন অদ্ভুত লাগছিল নিজেকে। কিভাবে কি বলবো বুঝতে পারিনি। কি বলতে কি বলে ফেলবো এ ভয়ে বলাই হয়নি। এরপর যখন বলার সময় এলো, তুমি তখন সবটা গুছিয়ে নিলে, দেখতে পেলাম তোমার পাশে অন্য একটি মুখ। অন্য কারো বউ হবার ইচ্ছে তোমার চোখমুখে। ফিরে এসেছি। দমিয়েছি নিজেকে।
তানিয়ার বিস্ময় আকাশ ছোঁয়। ইহানের মতো মানুষ ভালোবাসতে পারে? অনুভূতি নামক বিষয়টি তার মধ্যে আছে? একজন নারীকে নিয়ে একান্তভাবে ভাবতে পারে ইহান? কই, কখনো তো বুঝতে দেয়নি তাকে। এমন ব্যবহার ও করেনি যাতে তানিয়া ধরে ফেলে। সবসময় রোবটের মতো থেকেছে লোকটা। ধমকে ধামকে রেখেছে তাকে। অথচ মনে মনে এসব বয়ে বেড়াতো ইহান? তানিয়ার হুট করেই রাগ বেড়ে যায়। জামাকাপড় বের করে আলমিরা থেকে। তেজী স্বরে বলে,
” চলে যাচ্ছি বাবার বাড়ি।
ইহান মুচকি হাসে। বলে না কিছু। তানিয়া পিছু ফিরে তাকায়। ইহানের মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়। ইহান বুঝতে পেরে বলে,
” সকালে যেও।
” আর কখখনো ফিরবো না এ বাড়িতে। একেবারের জন্য চলে যাবো। কথাটুকু বলেই তানিয়া লাগেজ খুলে বসে। রাগ দেখিয়ে ভাঁজ করে ছুঁড়ে ফেলে শাড়িসমূহ।
” আম্মা জানে?
” জানেন।
” আচ্ছা।
তানিয়া ঘাড় বাঁকায়। ইহানের হেলদোল না দেখে অবাক হয়। এই লোকটা তাকে ভালোবাসে? কই কথাবার্তায় তো বোঝা যায় না। এইযে সে চলে যেতে চাইছে, আটকানোর চেষ্টাও তো করতে পারতো ইহান। করলো না তো। তানিয়ার রাগ বাড়ে। ক্রোধে ফেটে পড়ে। ঝাঝাল স্বরে বলে,
” জিজ্ঞেস করবেন না কেন চলে যাচ্ছি?
” ইচ্ছে হয়েছে তাই যাচ্ছো। প্রশ্ন করবো কেন?
” আটকাবেন না?
” না।
তানিয়া ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তার রাগ দেখানোই বৃথা। হুট করে এমন করার কারণ নিজেও ধরতে পারল না তানিয়া। ক্রোধে চোখ থেকে চশমাটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে তানিয়া। ইহান অবাক হয়। এগিয়ে আসে সম্মুখে। প্রশ্ন করে,
” চশমা ভাঙলে কেন?
তানিয়া উত্তর দেয় না। সামনের প্রতিবিম্ব ঘোলাটে লাগে। দেখতে পায় না কিচ্ছু। হাতরে ইহানকে পায় কাছে। জড়িয়ে ধরে ইহানের বাহু। বলে,
” ইচ্ছে হয়েছে, তাই ভেঙেছি।
” অদ্ভুত ইচ্ছে।
তানিয়া দূরে সরে। এগুতে পারে না। মেঝেতে থাকা টুলের সাথে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পরে মেঝেতে। মাথা ঠুকে মেঝেতে। ধপাস শব্দ হয় ঘরটায়। ব্যথায় কুকিয়ে উঠে তানিয়া। আহ্ জাতীয় শব্দ বেরোয় মুখ থেকে। ইহান ব্যতিব্যস্ত হয়। দ্রুত তানিয়ার হাত ধরে। বিচলিত ছেলেটার চিন্তা হয় ভিষণ। ভয়ার্ত হয় চেহারা। প্রিয় মানুষের আর্তনাদে বুকে হাতুরি পেটানোর ন্যায় বিস্ফোরণ হয়। তানিয়ার কোমরে হাত রাখে। চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
” তানু! সাবধানে হাঁটতে পারো না? ইশশ।
তানিয়া গুঙিয়ে ওঠে। ললাটের কোণা ফুলে ওঠে। ওঠার চেষ্টা করে নিজের বলে। ইহানের শীতল হাত কোমরে পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে তানিয়া। রাগী স্বরে বলে,
“ধরবেন না আমায়। ছাড়ুন।
ইহান ছাড়ে না। হাতের বল প্রবল হয়। পাঁজোকোলে তুলে নেয় তানিয়াকে। ধীরে সুস্থে নামিয়ে দেয় বিছানায়। ললাটের ব্যথা বুঝতে পারে। তানিয়ার চোখ ঘোলাটে হয়। প্রচণ্ড আফসোসের সুরে বলে,
” চশমা না পড়লে কিচ্ছু দেখতে পারি না। ধ্যাত।
” আর কোথায় আঘাত পেয়েছো? দেখাও আমায়।
পিঠের মাঝ বরাবর ব্যথা পেয়েছে তানিয়া। কি করে বলবে ইহানকে? ইলমা বেগম ঘুমিয়েছেন। এখন কে মালিশ করে দিবে তাকে? ইহান যদি মালিশ করতে চায়? উঁহু। এত লজ্জা তানিয়া নিতে পারবে না। মাথায় হাত রেখে তানিয়া বলে,
” আর কোথাও না। কোথাও না।
ইহান হাসে। মলম লাগিয়ে দেয় কপালে। চুমু খায় মেয়েটার কানের লতিতে। শিরশির করে ওঠে তানিয়ার দেহ। লজ্জায় রাঙা হয় মুহূর্তেই। শিরা উপশিরা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। চেপে ধরে ইহানের হাত। রাগ দেখিয়েও দেখাতে পারে না। বৈধ সম্পর্কের টানে বোধহয় জড়তাও হারায়।
_______
রাত সাড়ে দশটার দিকে নিজ শহরে ফিরে প্রিয়তারা। নিজ এলাকায় এসে প্রিয়তা আনন্দিত হয়। মুক্ত বাতাসে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। আরহামের ঘুম উড়ে গেছে। নিজ শহরে ফিরে ছেলেটার খুশি উপচে পড়ছে। প্রহর আরহামের হাত ধরে এগোয় হাসপাতালের দিকে। সদরের বড় হাসপাতাল এটা। হাসপাতালের চারদিকে সাদা ইউনিফর্ম পরে নার্স আর ডক্টররা ঘুরাঘুরি করছে। মানুষজনে ভরতি এই হাসপাতালে কোথাও একটা শূন্যতা। প্রিয়তার মন খারাপ হয়। নির্দিষ্ট কক্ষে পৌঁছে প্রিয়তা এগুতে পারে না। থমকে যায় সে। প্রহর আশস্ত করে তাকে। আরহামের হাত মুঠোয় নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে প্রিয়তা। ফিনাইলের গন্ধে গা গুলিয়ে আসে তার। প্রহর বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কক্ষের সাদা বিছানায় শুয়ে আছে মধ্য বয়স্ক লোক। অক্সিজেন মাক্স দিয়ে মুখের অর্ধাংশ ঢাকা। প্রিয়তার বাবার মুখ চিনতে অসুবিধে হয় না। পাশেই চেয়ারে বসে থাকা মহিলাকে দেখে জ্বলে ওঠে তার গা। সর্বাঙ্গে ভয়াবহ রাগ ঝেঁকে বসে। পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে আসে ছোট বিছানার সামনে। আরহাম উত্তেজিত কণ্ঠে ডেকে ফেলে।
” আব্বু।
আরিফ ততক্ষণাৎ চোখ মেলে। পাশেই নিজের ছেলেকে দেখে উত্তেজিত হয় আরিফ। অক্সিজেন মাক্স খুলে ফেলে দ্রুত। আরহামকে কাছে ডাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কেমন আছো বাবা?
প্রিয়তা আরিফের চোখের কোণে জমা অশ্রুধারা খেয়াল করে। খানিক ভালো লাগে বিষয়টা। আরহাম বাবার প্রশ্নের উত্তর দেয়,
” ভালো আছি আব্বু।
প্রিয়তার দিকে তাকায় আরিফ। এতদিন পর সন্তানদের মুখ দেখে হুহু করে কেঁদে উঠে সে। প্রিয়তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। প্রিয়তা কাছে আসে না। দূর থেকেই স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
” এখন ঠিক আছেন?
প্রশ্নটুকু করতে কণ্ঠ কাঁপল প্রিয়তার। আব্বুকে সে এখনো ভালোবাসে। এভাবে লোকটাকে শুয়ে থাকতে দেখে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তার। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে বুক। কলিজা ফেটে আর্তনাদ আসছে। প্রিয়তার জ্বলন টের পায় না কেউ। ঠোঁট চেপে ধরে রাখে প্রিয়তা। আরিফ উত্তর দেয়,
” এখন তোমাদের দেখে ভালো লাগছে মা।
মা শব্দটা শুনে প্রিয়তা কেঁপে উঠে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় বাবার বুক। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয় প্রিয়তার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে সে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
” ভালো আছেন শুনে ভালো লাগল। আমাকে দয়া করে মা সম্বোধন করবেন না। ক্যামেরার সামনের শুটিং টা ঠিক ভালো লাগে না। অভিনয় বুঝতে পারি আমি।
আরিফের হাসি থেমে গেল। নিভে গেল হাস্যজ্জল মুখ। থমথমে হলো চেহারা। প্রিয়তা হাসল মিটিমিটি। মজা পেল কিছুটা। দীপা উঠে এলো বসা থেকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
” এখন আসার সময় হলো তোমাদের? বাপ মরলে কি বাঁচলেই বা কি তাইনা? মরে গেলেই বুঝি খুশি হও।
প্রিয়তা রাগতে চায় না। কথা এড়িয়ে যায়। বলে,
” হঠাৎ স্ট্রোক করল কিভাবে?
” চাকরিতে অনেক ঝামেলা চলছে। সেসব নিয়ে টেনশন করতে করতেই তো স্ট্রোক করল।
” আপনি থাকতে উনার এত চিন্তা কিসের? এত সুন্দরী বউ আপনি। মনের মতো স্ত্রী পেয়েছেন উনি, সংসার করছেন স্বাধীন ভাবে। চাকরি নিয়ে এত চিন্তা করার কোনো মানে হয়? যা টাকা পয়সা আছে তাতে তো চলে যাওয়ার কথা।
আরিফ থামতে বলে দীপাকে। প্রিয়তাকে ডাকে। অনিচ্ছায় বাবার কিছুটা কাছে আসে প্রিয়তা। আরিফ থেমে থেমে বলে,
” আমি তোমাদের সাথে খুব অন্যায় করেছি। তুমি হয়তো কখনোই আমাকে মাফ করতে পারবে না। কিন্তু আমি আমার কাজে অনুতপ্ত। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার নেই। পাপ করার ফল আমি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। হয়তো বাচবো না বেশিদিন। আরহামের ভবিষ্যত নিয়ে আমি ভেবেছি প্রিয়তা। ছেলেটার একটা সুখের জীবন হোক আমি তাই চাই। আমি তোমাকে চিনি। তুমি কোনদিন আমার সহায়-সম্পত্তি নিবে না। তোমাকে বারবার বলেও আমি আমার কাছে নত করতে পারবো না। কিন্তু আরহাম? আরহাম ছোট। ওর জীবনের কঠিন ধাপগুলোতে ও এখনো পৌঁছাতে পারেনি। কোথায় গিয়ে থামবে ও? আমি কি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো না? আমি আমার অর্জিত সম্পদের কিছু অংশ আরহামের নামে লিখে দিয়েছি। দয়া করে সেগুলো নাও প্রিয়তা। আমাকে ক্ষমা করো।আমার ছেলেকে আমার সম্পদ ভোগ করতে দাও। ছেলেটাকে ভালো রাখার জন্য এতটা কঠোর হয়ো না প্রিয়তা।
হু হু করে পুনরায় কেঁদে ফেলল আরিফ। চোখের পানিতে ভিজে গেল কপোল। নিস্তেজ হতে লাগল সে। প্রিয়তার হাত জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইল। প্রিয়তার মন গলে। সরাসরি দেখায় না ভঙ্গুর হৃদয়ে জমা কষ্টের রেশ। কিছু বলতে পারে না প্রিয়তা। আরিফ পুনরায় বলে,
” আমার বিশ্বস্ত উকিলের কাছে সব কাগজপত্র রেখেছি। তুমি আরহামের হাতে দিয়ে দিও। যতদিন না ও প্রাপ্তবয়স্কে উপনীত হয় ততদিন সবকিছুর খেয়াল রেখো।
” আরহামের কিচ্ছু চাই না। এসব ভুলে আপনি নিজের চিকিৎসা করান।
” আমি চাই প্রিয়তা। দয়া কর। আরহামকে ওর অধিকার বুঝে নিতে দাও।
প্রহর এগিয়ে আসে এইবার। আরিফের দিকে তাকায়। আরিফের প্রশ্নবিদ্ধ চোখ দেখে প্রহর বলে,
” আমি আপনার মেয়ের হবু জামাই। আপনার সব কথাই শুনেছি বাইরে থেকে। প্রিয়তা আমার বাড়িতে এক কাপড়ে আসবে। আপনার সহানুভূতির পরোয়া আমার হবু বউ করবে না। প্রেমিকা যে সন্তানদের চেয়ে বড় হয় এটা আমি আগে কখনো দেখিনি। শুনেছি পৃথিবীর কোথাও নাকি খারাপ বাবা নেই। কিন্তু আপনি? আপনি প্রিয়তাকে দুনিয়াতে এমন সব তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছেন যে প্রিয়তা পাথর হয়েছে। আঘাতে আঘাতে ক্ষয়ে গেছে মেয়েটা। এখন সম্পত্তি দিয়ে দায় কমাচ্ছেন? ফিরিয়ে দিতে পারবেন প্রিয়তার পাঁচ বছরের আনন্দ? ফিরিয়ে দিতে পারবেন প্রিয়তার কিশোরী বয়সের সময়টা? পারবেন ওর চোখের পানির মূল্য দিতে?
আরিফ কিছু বলতে পারে না। দীপার মুখের দিকে তাকায় প্রিয়তা। মহিলার চোখে অজস্র রাগ দেখতে পায় প্রিয়তার প্রতি। এতক্ষণে চেতে উঠে মহিলা। রাগী কণ্ঠে বলে,
” সব সম্পত্তি ওদের দিলে আমার কি হবে? আমার কথা ভাববে না তুমি? এই ছেলেমেয়ের দরদ এতদিন কোথায় ছিল হ্যাঁ? কাবিনের সব টাকা দেবে আমায়। নইলে পা কেটে ঘরে বসিয়ে রাখবো। তখন টাকা কিভাবে ওদের পিছনে ওড়াও আমিও দেখবো।
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
[খুব দ্রুত লিখেছি। কি লিখেছি নিজেও জানি না🙂]