প্রস্থান — ৬ষ্ঠ পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৯.
অসংখ্য, অগনিত লোকের সমাগম ড্রয়িংরুমে। খাওয়া শেষ করে সবাই এখানেই এসেছে, নতুন বউকে দেখতে। চিত্রার শুরুতে ভীষণ লজ্জাবোধ হচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ফিরোজ পাশে এসে বসায় স্বস্তি পেয়েছে। জড়তা কেটেছে এখন। একের পর এক লোক আসছে, নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলছে। চিত্রাও হাসিমুখে আলাপ করছে সবার সাথে। হঠাৎ দেখল, কয়েকজন অতিথি আসায় দাঁড়িয়ে গেল ফিরোজ। এগিয়ে গিয়ে একটা লোককে জড়িয়ে ধরল। পাশে মধ্যবয়সী একজন মহিলা, একটা অল্প বয়সী মেয়ে-কোলে ছোট বাচ্চা। লোকটার বয়স আনুমানিক ৪০ এর কাছাকাছি। ফিরোজের সাথে কথা বলে তাঁরা এগিয়ে আসছে।
চিত্রা দাঁড়ালো উজ্জ্বল চেহারা করে। সালাম দিলো সবার উদ্দেশ্যে। মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে এসে, থুতনিতে হাত রেখে সালামের জবাব দেওয়ার পর আহ্লাদ করে বললেন, “ভারী সুন্দর দেখতে তো নতুন বউকে! নাম কী তোমার, মা?”
চিত্রা অভিভূত হয়ে, সোৎসাহে বলল, “আমার নাম চিত্রা।”
“বাহ্! যেমন মিষ্টি দেখতে, তেমন মিষ্টি নাম! জানো, আমার মেয়েটাও ঠিক তোমার মতো দেখতে ছিল। অত সুন্দর মুখ! নামটাও খুব সুন্দর তেমনি। অথচ আজ কোথায় হারিয়ে গেছে সেই মেয়ে!” শেষের কথাটা বলে ভদ্রমহিলা কেমন উদাস হয়ে গেলেন!
চমকিত হলো চিত্রা। হারিয়ে গেছে মানে? কোথায় হারিয়ে গেছে? এই মুহূর্তে সে প্রশ্নটা করতে পারল না। অনুচিত মনে হলো।
ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ায় আগে একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার পর ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সুব্রতকে দেখছি না যে। ও কোথায়?”
আরেকদফা ভড়কালো চিত্রা। এই প্রথম সুব্রত ভাইয়ের অনুপস্থিতি কারোর নজরে পড়ল। গতকাল রাতে বাড়িতে আসার পর থেকে এক পলকের জন্যও ওই মানুষটাকে দেখতে পায়নি সে। সকালে প্রশ্ন করেছিল ফিরোজকে।
সে বলেছিল, “সুব্রত ভাই কোথায়? উনি কী বাড়িতে নেই?”
নামটা শুনেই যেন ফিরোজের চেহারা পালটে যায়৷ সে মুখ গোমড়া করে বলল, “তুমি আবার ওর কথা জিজ্ঞেস করছ। তোমার কী শিক্ষা হয়নি সেদিন?”
“উনার নাম শুনলে তুমি সবসময় ক্ষেপে যাও কেন বলো তো? তোমার কী হিংসা হয় উনাকে?” মজার ছলেই প্রশ্নটা করল চিত্রা।
“হ্যাঁ, হয়। তুমি আমার স্ত্রী। আমাকে নিয়ে না ভেবে তুমি আরেক লোককে নিয়ে কেন ভাবো এত? এটা আমার একদম পছন্দ না। আর আমি চাই না আমার স্ত্রী আমার অপছন্দনীয় কোনো কাজ করুন।”
পরবর্তী কথাটা বলার আর দুঃসাহস দেখায়নি চিত্রা। এই মানুষটার রাগকে সে ভয় পায়। সাথে সেদিন এটাও বুঝেছিল, ফিরোজের সামনে সুব্রত ভাইয়ের নাম নেওয়া যাবে না। সে যে সত্যি সত্যিই হিংসে করে, তেমনটা না। হিংসুটেরা কখনো নিজের হিংসের কথা স্বীকার করে না। এদের যতবারই জিজ্ঞাসা করা হবে, এরা অস্বীকার যাবে। যে স্বীকার যাবে, আসলে সে মন থেকে হিংসুটে নয়। ওটা শুধুই বলার প্রয়োজন বলে বলা।
ফিরোজের কথায় ভাবনা ভঙ্গ হলো চিত্রার। ভদ্রমহিলার প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলল, ” বাড়িতে নেই। একটু আগে বাইরে গেল।”
চিত্রা আচমকা বলে উঠল, “না না, ঘরেই আছে বোধহয়। আমি তাকে ঘর থেকে বেরোতে দেখিনি এখন পর্যন্ত।”
ফিরোজ ভদ্রমহিলার দিকে প্রথমে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাল, এরপর চিত্রার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকাল। চিত্রা বুঝতে পারল, আচমকা কথাটা বলে সে ভুল করেছে। ফিরোজ ক্ষিপ্ত হয়েছে তাঁর উপর। চারিদিকে অনেক লোকজন বলে কিছু বলতে পারছে না শুধু। নাহলে খুব ঝাড়তো!
ভদ্রমহিলা বিদায় নিয়ে উপরের দিকে যাওয়ায় জন্য পা বাড়ালে উনার ছেলে বলে উঠল, “কোথায় যাচ্ছ, মা? দাওয়াত দিয়েছিলেন উনারা; শুধুমাত্র দাওয়াত রক্ষা করতেই এসেছি। আমাদের কাজ শেষ, এবার বাড়ি চলো।”
ভদ্রমহিলা ছেলেকে ঈষৎ ধমক দিয়ে বললেন, “আহ! আরিফ, একটু আস্তে বল। কেউ শুনলে কী ভাববে?” ছেলে আবার কিছু বলার আগেই তিনি নিজের বউমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বউমা, তুমি ওকে নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করো। আমি একটু উপর থেকে আসছি।”
বাচ্চা ছেলেকে কোলে রাখা মেয়েটা বলল, “মা, আমারও মনে হয় এবার আমাদের যাওয়া উচিত।”
ছেলের বউকেও একই সুরে ধমক দিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “আমি জানি আমার কী করা উচিত।” আর কাউকে বলার সুযোগ না দিয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন তিনি। উনার ছেলে আর বউমা কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন, আরও গেস্ট আসছে বলে।
পুরো ব্যাপারটাই চিত্রার সামনে হলো। কথাগুলো শুনে বিস্ময়ে তাঁর চক্ষু কপালে! কিছুক্ষণ আপন মনে ভেবে সে তাকালো ফিরোজের দিকে। ফিরোজ যেন মনের কথা বুঝে গেল। আগেই সতর্ক করল। “না, একদম না। চুপচাপ বসে থাকো।”
“একটা প্রশ্ন করব শুধু। প্লিজ।” চোখ ছোট ছোট করে, অনুনয়-বিনয় করল চিত্রা।
ফিরোজ নিজের জায়গায় শক্ত থেকে, ফিসফিস করে বলল, “বললাম তো না।”
“প্লিজ। লক্ষীটি! একটা প্রশ্ন করব শুধু।” এত আহ্লাদ করে বলার পরও যখন ফিরোজ কাবু হলো না, তখন নারীলোকের অস্ত্রটা প্রয়োগ করল চিত্রা, খপ করে ফিরোজের হাতটা ধরে ফেলল। চোখে চোখ রেখে, ঠোঁট জোড়া সামান্য ফুলিয়ে, নাক কুঁচকে বলল, “প্লিজ।”
“আচ্ছা।” হাল ছেড়ে দিলো ফিরোজ। এর পরেও পরাজয় স্বীকার না করলে ক্ষতিটা যে নিজেরই, তা সহজে বুঝে গেল। নিশিরাতে ওই ভয়াবহ শাস্তিটা ভোগ করতে চায় না কোনো স্বামী-ই!
চিত্রা আনন্দে চোখ বুজে ফেলল। এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে, মৃদুস্বরে জানতে চাইল, “উনারা কারা?”
অনুমান করতে পারছিল ফিরোজ, প্রশ্নটা এমনই হবে। তাই চট করে জবাবটা দিয়ে দিলো। বলল, “উনারা আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড।”
চিত্রার বিশ্বাস হলো না। সে আগের থেকেও শান্ত হয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ফ্যামিলি ফ্রেন্ড! তাহলে উনি তোমার বাবা-মাকে না খুঁজে সুব্রত ভাইকে খুঁজবে কেন?”
“বাবা-মায়ের সাথে নিশ্চয়ই আগে দেখা হয়েছে।”
“এটা সত্যি না। উনাদের সাথে সুব্রত ভাইয়ের কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে নিশ্চয়ই। কথা শুনে বুঝতে পেরেছি আমি।”
ফিরোজ সহসা নিঃশব্দে হেসে ওঠে বলল, “তুমি দেখি পুরো ডিটেকটিভ হয়ে গেছ।” বলে চিত্রার হাতটা কচলে দিলো আলতো করে!
চিত্রা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “কথা ঘোরানোর চেষ্টা করো না।”
মুখ কালো করল ফিরোজ। একবার ওই আরিফ নামের ছেলেটার দিকে তাকালো। এরপর আবার চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “উনারা তোমার সুব্রত ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক।”
আর কোনো শব্দব্যয় করল না চিত্রা। করতে পারল না আসলে। হতবিহ্বল হয়ে বসে রইল সে!
দুতোলায় গিয়ে সেই চেনা ঘরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করলেন মহিলা। ভিতর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো সঙ্গে সঙ্গে।
“কে?”
“সুব্রত, আমি। রুশার মা।” বাইরে থেকে জবাব দিলেন, রুশার মা।
এরপর ক্ষণকালেই দরজাটা খুলে গেল। রুশার মা দেখলেন, লম্বা আর অগোছালো দাড়ি-চুলে ঘেরা মুখমন্ডলের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। পরণে শার্ট আর ট্রাউজার। ওকে দেখে তাঁর চোখ ছানাবড়া হলো। দীর্ঘ ৬ বছর পর দেখছেন উনি। কত পরিবর্তন ছেলেটার! অবশ্য ৫ বছর জেল খাটা এক আসামীর মধ্যে এইরকম পরিবর্তন দেখতে পাওয়া খুব অস্বাভাবিক না! কিন্তু জেল থেকে বেরিয়েছে প্রায় ১ বছর হলো; তবুও নিজেকে গোছাতে পারেনি।
নিজেকে সামলে নিয়ে রুশার মা বললেন, “ঘরে আসতে বললেন না?”
“ঘরে?” জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুব্রত। সে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ঘোরের মতো লাগছে।
“আমার মেয়েটা থাকলে অবশ্য জিজ্ঞেস করতে হতো না। ও নিজেই আমাকে টেনে ঘরে নিয়ে বসাতো।”
সুব্রত বিরক্ত হলো। দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল, “আসুন।”
ভিতরে ঢুকলেন রুশার মা। চারিদিকে দেখতে দেখতে তিনি বললেন, “সবাই অনুষ্ঠানে, আর তুমি এখানে?”
“অফিসের কাজ করছিলাম বসে বসে।” বিছানার চাদরটা টেনে, ঠিক করে দিলো সুব্রত। “আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না।”
রুশার মা বসলেন। সুব্রতর দিকে চোখ ফেরালেন আবার। “সেদিন তোমার কাকা এত করে অনুরোধ করলেন যে, না করতে পারিনি।”
“আচ্ছা।” ভীষণ অস্বস্তিতে মাথাটা সামান্য ঝাঁকালো সুব্রত।
রুশার মা বললেন, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো।”
“না না, আমি এভাবেই ঠিক আছি।” জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সুব্রত। একবার বাইরে তাকিয়ে আবার চোখ ফেরালো প্রাক্তন শ্বাশুড়ির দিকে!
বসার কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা বললেন, “ফিরোজের বউটা একদম রুশার মতো সুন্দরী দেখতে, তাই না?” মেয়ের মুখটা কল্পনা করে তাঁর চোখ ভিজে এলো।
সুব্রত কিছু বলতে পারল না। ফিরোজের বউকে এখনো ভালো করে দেখেনি সে। যতবার দেখা হয়েছে, পরিস্থিতিটাই ভিন্নরকম ছিল। তাই সে মাথা নুইয়ে চুপ করে শুনতে লাগল।
“তোমার হাল এইরকম কেন? লোকজনকে দেখাও, যে তুমি খুব কষ্টে আছো? এইসব করে কী লাভ? সত্যিটা তো মিথ্যা হয়ে যাবে না।”
রুশার মা হঠাৎ ধরা গলায় বললেন, “যদি তুমি আমার মেয়েটাকে একটু শান্তি দিতে, তাহলে আজ ও এই জায়গায় উপস্থিত থাকতো। আমাদের এভাবে ভেজা চোখ নিয়ে মেয়ের স্মৃতি খুঁজতে হতো না। আনন্দ নিয়ে মেয়ের সুখের ঠিকানা দেখতে আসতাম। যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে নিজে থেকে আমাদের সবাইকে
ঘরে এনে বসাতো। বিয়ের পর যখন এলাম, আমাকে বসিয়ে চা দিলো। গরমকাল ছিল বলে ফ্যান ছাড়ল। এরপর এসিও। সবার খোঁজখবর নিতো। আমার খুব আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে, তোমার হাতে মেয়ের হাতটা তুলে দিয়েছিলাম আমি।”
সুইচবোর্ডে হাত রেখে ফ্যান ছেড়ে দিলো সুব্রত।
রুশার মা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে বললেন, “রুশার বাবাকে বলেছিলাম আসতে। শুনে উনি খুব রেগে গেলেন আমার উপর। রুশাকে কবর দেওয়ার সময় লোকটা বলেছিল, এ জীবনে আর তোমার মুখদর্শন করবেন না। এই প্রতিজ্ঞা উনি ভাংতে চান না, তাই আসেননি। বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে, নামাজ পড়ে, মোনাজাতে উনি কখনো তোমার মোঙ্গল কামনা করেননি। যে ছেলে তাঁর একমাত্র মেয়ের খুনী, তাঁর ভালো চাইবে, এমন ক্ষমাশীল-দয়াশীল উনি ছিলেন না কখনোই। ভদ্রলোক নিজের মেয়েকে যতটা ভালোবাসতেন, তোমাকে ততটাই ঘৃণা করেন।”
“ভালোবাসা” শব্দটা শুনে খুব হাসি পেলো সুব্রতর! অনেক কষ্টে এউ ধরনের বেয়াদবি থেকে নিজেকে সংযত রাখল।
রুশার মা বেরিয়ে যাওয়ার আগে একটা আশ্চর্য কান্ড করলেন। ভদ্রমহিলা আচমকা সুব্রতর সামনে হাটু মুড়িয়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, “আমরা কেউ ভালো নেই, সুব্রত। গত ৬টা বছর ধরে আমরা জ্বলছি৷ খেতে বসলে মেয়েটার মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারি না। দাও না, দাও না আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে। আর কিচ্ছুটি চাই না। শুধু আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দাও।”
সুব্রত কোনো জবাব দিতে পারল না। নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ভদ্রমহিলার দিকে। এরপর সানগ্লাসটি বের করে চোখে দিলো। মানুষের চোখের জল আড়াল করার সবচেয়ে বড় দুটো মাধ্যমটির একটি হলো সানগ্লাস!
বেশ কিছুক্ষণ ধরেই একটা মেয়েকে দেখছিল চিত্রা। চেনা চেনা লাগছিল তাঁর, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিল না। খটকা ছিল। ফিরোজকে জিজ্ঞেস করতেই পরিচয় জানা গেল। ফিরোজ বেশ তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ ওকে পর্যবেক্ষণ করার পর বলল, “ওর নাম রশ্মি। আমাদের পাশের বাড়িটা ওদের। এই প্রথম ওকে শাড়িতে দেখলাম। প্রথমে চিনতেই পারিনি।”
পরিচয় জানার পর সে-ও চিনতে পারল। সহসা দাঁড়াতে গেল সে। ফিরোজ সঙ্গে সঙ্গে হাত ধরে বলল, “কোথায় যাচ্ছ?”
চিত্রা ফিরোজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “একটু আলাপ করে আসি।”
“পরেও তো আলাপ করা যাবে। এখন কত গেস্ট আসছে। আর তুমি চলে যাচ্ছ।”
“ও তো আসছে না। আমি বরং যাই।”
ফিরোজ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলে সে এগিয়ে গেল। হঠাৎ খেয়াল করল, মেয়েটা চলে যাচ্ছে। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সদর দরজার বাইরে চলে এলো। মেয়েটা নিজের বাড়ির দিকেই এগোচ্ছে। ‘রশ্মি’ বলে পিছন থেকে ডকল সে।
আচমকা অপরিচিত কণ্ঠে নিজের নাম শুনে হতচকিত হয় রশ্মি। পিছন ফিরলে তাঁর চোখ দুটো বিস্ময়ে গোলাকৃতি হয়ে যায়!
চিত্রা রশ্মির সামনে গিয়ে, হাসতে হাসতে বলল, “তোমার সাথে আলাপ করতেই ওখান থেকে ওঠে আসছিলাম, হঠাৎ দেখি তুমি চলে যাচ্ছ, তাই বেরিয়ে এসে ডাকলাম।”
“আমার সাথে আলাপ করবেন?” ইতস্তত করতে করতে বলে রশ্মি। সয়ং নববধূ তাঁর সাথে পরিচিত হতে এত লোকের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, এটা যেমন তাকে গৌরবের স্বাদ দিচ্ছে, তেমন উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। সেদিন কী তাকে দেখে ফেলেছিল মেয়েটা? ওরা স্বামী-স্ত্রী একান্তে সময় কাটাচ্ছিল, আর সে ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল! কী নির্লজ্জ সে!
রশ্মির অবস্থা বুঝতে পেরে চিত্রা বলল, “আমি কিন্তু তোমাকে চিনি। আগে একবার দেখেছিলাম।”
খুব লজ্জাবোধ হলো রশ্মির; এই প্রথম যেন! লজ্জার সাথে উৎকণ্ঠা বিরাজমান। তাঁর ইচ্ছে করল এক ছুটে বহুদূর চলে যেতে। সে যদি একবার অনুমান করতে পারতো, ওই অন্ধকার ঘরে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে নববধূ দেখে ফেলতে পারে, তাহলে কক্ষনো দাঁড়িয়ে থাকতো না। তাকাতোও না। ছি: ছি: ছি:! কী না কী ভাবছে তাঁর সম্পর্কে!
আড়ষ্টতায় জর্জরিত হয়ে মাথা নুইয়ে ছিল রশ্মি, নববধূর একটা কথায় স্বস্তি পেলো সে। মুখে হাসি টেনে তাকালো মুখের দিকে। সে বলেছে, “তুমি আমায় না দেখলেও সেদিন দুপুরে যখন তুমি বেড়ালগুলোকে খাবার দিচ্ছিলে, তখন এই বাড়িতে ঢোকার সময় তোমাকে দেখেছিলাম আমি। সেদিন ছিলে টি-শার্ট পরে। আর আজ শাড়ি। তাই প্রথমে চিনতে পারিনি।”
“ওহ্।” মৃদু আওয়াজ করে হাসল স্বল্পভাষী রশ্মি।
এদিকে চিত্রা বকবক করেই যাচ্ছে। “জানো, বেড়াল আমার খুব পছন্দের প্রাণী। ছোটবেলা থেকেই আমি বেড়াল পুষতাম। যখন দাদার বাড়িতে থাকতাম, তখন থেকে। বেড়ালটা প্রথমে দাদির ছিল। দাদি মারা যাওয়ার পর আমার হয়েছিল। সারাক্ষণ আমার সাথে থাকতো ও। আমার সাথে খেতো, গোসল করতো, এমনকি আমার সাথে ঘুমাতো। একদিন বাবাকে ঠাস করে কামড় মেরে দিলো। ব্যাস, বাবা তো রেগে ফায়ার। সেদিনই বস্তায় ভরে ওটাকে কোথায় যেন ফেলে দিয়ে আসলো। সারারাত কেঁদে-কেটে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি জানি না। সকালবেলা দেখি ব্যাটা আমার বুকের উপর শুয়ে আছে। বেড়ালটা কিন্তু মেয়ে ছিল। আমি মাঝে মাঝে ব্যাটা বলে ফেলতাম। এই শব্দটা মূলত বরিশালের লোকদের দখলে। ওরা নিজেদের অধিকারে এই শব্দটা ব্যবহার করে। সত্যি বলতে, আমার দাদার বাড়ি ছিল বরিশাল।” ঈষৎ লাজুক হাসি দিলো সে। “সেজন্য না চাইতেও কথার মাঝে এই শব্দ এসে পড়ে। রক্তের টান আছে কী-না! এরপর বেশ কয়েকবার ওটাকে খুব দূরে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে যেন পরদিনই হাজির হতো। কিন্তু একদিন হঠাৎ দেখি, ও আর আসলো না। বাড়ির আশপাশ খুঁজলাম, দেখি একটা গাছের নিচে মরে পড়ে আছে। অনেক বয়স ছিল ওর। শরীরে খুব লোম ছিল। সাদা লোম। এরপর ঢাকায় এসে বাবা আর কোনো পশু-পাখী পুষত্ব দেয়নি।”
একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল চিত্রা। আর রশ্মি মুখ ‘হা’ করে শুনছিলো কথাগুলো। কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করেছিল তাঁরা। আশেপাশের অনেকেই আড়চোখে দেখছিল আর নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছিল। কোনো বউকে বোধহয় বিয়ের পরদিন প্রতিবেশীর সাথে এভাবে কথা বলতে তাঁরা দেখেনি কখনো। আজ দেখে তাজ্জব বনে গেছে! রশ্মি নিজেও কিংকর্তব্যবিমুঢ়!
“আচ্ছা, তুমি বেড়াল খুব ভালোবাসো, তাই না?” আচমকা বকবক থামিয়ে প্রশ্ন করল চিত্রা।
রশ্মি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“খুব ভালোবাসো?”
“এই একটা প্রজাতির প্রাণীই শুধুমাত্র আমাকে পছন্দ করে। তাই আমিও ওদের সবচাইতে বেশি ভালোবাসি।”
“তোমার তো অনেকগুলো বেড়াল আছে। আমি যদি একটা চাই, আমাকে দেবে? কথা দিচ্ছি, একটুও কষ্ট দিবো না। অনেক আদরে রাখব। প্লিজ। প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ।”
চিত্রা এমনভাবে বলল যে, অভিভূত হলো রশ্মি৷ চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “বেড়ালের প্রতি আপনার এত ভালোলাগা দেখে আমার ভালো লাগছে।” এরপর সহসা অনুতপ্ত হয়ে বলল, “কিন্তু আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে, আমি আপনাকে কিছুই দিতে পারব না।”
চিত্রার মুখ মলিন হলো। রশ্মি আবার বলল, “কারণ এগুলো আমার কেনা বেড়াল নয়। এরা এখানকারই; আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকা বেড়াল। অনেকদিন আগের কথা, যখন আমি বিকেলে বাড়ির সামনে রোজ বসে থাকতাম; একদিন হঠাৎ দেখি একটা বেড়াল আমার পায়ের সাথে নিজের শরীর খুব ঘষাঘষি করছে। আমি ভয় পেয়ে যাই প্রথমে। বেড়ালটাকে তাড়াতে চাইলে ও যায় না। পেট দেখে মনে হলো, ওর খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ঘরে তখন যা ছিল, ওকে সেসব দিই আমি। ও খেয়ে চলে গেল। পরদিন আবার এলো একই সময়ে। আমি খাবার দিলাম। এক সপ্তাহ এভাবে চললে হঠাৎ দেখি ওর সাথে আরও একটা আসতে শুরু করেছে। এরপর আরও একটা। এভাবে ওদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ওরা গোটা বংশ নিয়ে হাজির হতো আমার সামনে। আমি বেরোলে আমার পিছনে একটা না একটা সবসময় থাকতো। আমারও ভালো লাগতো। ঘরের প্রায় সব খাবার ওদের দিতাম। এরপর যেটুকু থাকতো, আমি খেতাম। না থাকলে খেতাম না। এখন তো রোজ তিনবেলা করে আসে ওরা। সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যার আগে। যেটুকু দিই, ওটুকু খেয়ে চলে যায়। একেক সময় একেকজন আমাকে পাহারা দেয়। তবে ঘরের ভিতরে আসে না। ওই দেখো, বাইরে বসে আছে একটা।”
চিত্রা তাকিয়ে দেখল, রশ্মিদের বাড়ির সিড়ির ওখানে একটা বিড়াল বসে বসে এদিকেই নজর রাখছে। সে হাসিমুখে বলল, “বাহ্! দারুণ তো। পরেরবার যখন খাবার দিবে, তখন আমাকে ডাক দিবে। আমি দেখব।”
“আচ্ছা।” মেনে নিয়ে মাথা ঝাঁকাল রশ্মি। চিত্রা আবার বলল, “আমার নাম জানো তো? চিত্রা আমার নাম।”
কিছু বলল না রশ্মি। তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যাল করে। এত উৎসাহ নিয়ে আজ অব্দি কেউ তাঁর সাথে পরিচিত হতে আসেনি। এই মেয়েটাই প্রথম।
চিত্রা আবার বলল, “তোমার মোবাইল নম্বরটা দাও তো।”
“আপনারটাও দিন। সময়মতো ফোন করব তাহলে।”
“আপনি কেন? তুমি বলো।”
“কিন্তু আপনি আমার বড় হবেন।”
“তাতে কী? আমরা তো আজ থেকে বন্ধু।”
“বিড়ালের খাতিরে?” চোখ পিটপিট করে তাকালো রশ্মি।
চিত্রা প্রথমে ঠোঁট কামড়ে, এর ফিক করে বলল, “হুম, বেড়ালের খাতিরেই।”
রশ্মি মনেমনে ভাবল, সে যদি কোনোদিন বিখ্যাত কেউ বনে যায়, তাহলে এই মেয়েটিকে সে নিজের প্রথম বন্ধু হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিবে। আজ থেকে ১০০ বছর পরও যদি পৃথিবী অক্ষত থাকে, তাহলে সেই জেনারেশনের ছেলে-মেয়ে একটা ইতিহাসে জানবে, “বিশ্ববিখ্যাত রশ্মির প্রথম বান্ধবীর নাম চিত্রা!”
রশ্মির সাথে আলাপ শেষে ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে দেখল, সুব্রত ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকে দেখেই ভদ্রমহিলা আলিঙ্গন করে বললেন, “ভালো থেকো, মা। সবাইকে নিয়ে সুখে থেকো। ফিরোজ ভালো ছেলে৷ আমার বিশ্বাস ও তোমাকে অনেক সুখে রাখবে। আমার মেয়েটার মতো দুর্ভাগ্য নিয়ে তুমি জন্মাওনি বলে এমন ভালো স্বামী পেয়েছ। সুখী হও জীবনে।”
ফিরোজের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে তাঁরা বাড়ি ত্যাগ করলেন।
সেদিন চিত্রাদের বাড়িতে গেল ফিরোজ আর চিত্রা। নিয়মানুযায়ী সেখানে থেকে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসে তাঁরা।
১০.
নিয়ের প্রায় সপ্তাহ খানিক পর একদিন, রাত করে বাড়িতে ফিরল ফিরোজ। এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে চিত্রাকে দেখতে না পেয়ে ঘরে চলে এলো। কিন্তু চিত্রা ঘরেও নেই। প্রথমে বাথরুম চেক করল, এরপর ব্যালকনি; চিত্রার দেখা নেই! নিরাশ হয়ে বিছানায় বসে হাত থেকে ঘড়ি খুলতে লাগল সে।
ফিরোজ ঘড়ি খুলে যখন পাশে রাখতে যাবে, তখনই চিত্রা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে পিছন থেকে ফিরোজের দুই চোখ চেপে ধরল।
ফিরোজ চমকে উঠল, “এ-কি! কী করছ? হাত সরাও?”
চিত্রা ভার গলায় বলল, “হাত সরাব না।”
“হাত না সরালে দেখব কীভাবে?”
“এমনিতে মনেহয় তুমি খুব দেখো? কচু দেখো! যদি দেখতে পেতে, তাহলে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালে বুঝতে পারতে, খুব রাত হয়েছে, একজন অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য।”
“ওহ্! এই কথা।” বলে নিজেই চোখ থেকে চিত্রার হাত সরিয়ে ওর দিকে ঘুরে বসল ফিরোজ। ওর চিকন হাত দুটো নিজের প্রশস্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে চড়ুই পাখির মতো আলতো ভাবে আদর করতে করতে বলল, “সরি। আসলেই খুব দেরি হয়ে গেছে। রাতের খাবার খেয়েছ তুমি?”
“খাবো না? তোমার জন্য বসে থাকবো নাকি? এই দেখো, এত খেয়েছি যে একেবারে ৩ তিন ইঞ্চি ফুলিয়ে ফেলেছি৷” এই বলে পেটের সামনে থাকা ওড়নার অংশটুকু সরি পেটটা দেখাল চিত্রা।
একপলক দেখে ফিরোজের মনে হলো, চিত্রা সারাদিন কিছু খায়নি। সে অনুতপ্ত হয়ে বলল, “আর হবে না।” দুই হাত কানে রাখল সে। “এই দেখো, কান ধরছি।”
চিত্রা মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, “তুমি বলেছিলে, ছুটির এই ক’দিন আমাকে খুব সময় দিবে। অথচ দেখো, সেই তোমার কাজ। সকালে খেয়ে বেরিয়েছ, আর এখন এলে।”
“সরি বললাম তো।” এরপর সে নড়েচড়ে বলল, “আচ্ছা, তোমাকে একটা সুসংবাদ দেই। খুব শীঘ্রই আমরা হানিমুনে যাচ্ছি।”
‘হানিমুন’ আশ্চর্য হলো চিত্রা। ‘হানিমুন, এত তাড়াতাড়ি’। সে হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে বলল, “মাত্রই বিয়ে হলো। এক সপ্তাহ হয়েছে মাত্র। আর তুমি এখনই পরিবারের থেকে বিচ্ছেদ হতে চাইছ। এখনো তো সংসার মানেই বুঝলাম না। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, ভাসুর, এদের সাথে যে আত্মিক সম্পর্ক হওয়া উচিত, সেটা শক্তই হলো না। এইসময় আলাদা হয়ে গেলে আমার সাংসারিক জীবন অপরিপূর্ণ থাকবে।”
হেসে উঠল ফিরোজ। বলল, “আশ্চর্য! আমরা আলাদা হবো কেন? আমরা তো জাস্ট হানিমুনে যাবো। ছুটি শেষ হতে আর খুব যে দেরি নেই। এটাই তো সময় হানিমুনে যাওয়ার। আর তুমি বলছ আমরা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি।”
চিত্রা ভাবগম্ভীর হয়ে বলল, “হানিমুনে যাওয়া কী পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া নয়? ওখানে তো আমরা পরিবারের কাউকে পাশে পাবো না। না থাকবে বাবা-মা, না থাকবে কনা-সুব্রত ভাই। শুধু আমরা দুজন। অর্থাৎ আমরা এখনই পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাব; এটা কী আলাদা হওয়া নয়? সমাজ যাকে ভিন্ন হওয়া বলে। যদি ঘুরতে যাওয়ারই হয়, তাহলে সবাই মিলে যাবো। সারাজীবন যেহেতু একসাথেই থাকবো, তাহলে এখন একে অপরকে জানার জন্য আলাদা হানিমুনে যেতে হবে কেন? সবার মাঝে থেকেই সময় কাটাবো আমরা।”
চিত্রার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো ফিরোজ। কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “একটু আগে তুমি বললে, আমি তোমাকে সময় দিই না। এখন যখন তোমাকে খুব বেশি সময় দেওয়ার জন্য দূরে কোথাও যেতে চাইছি, তখন তুমি বলছ তোমাকে সময় দেওয়ার জন্য পরিবারের থেকে দূরে যেতে হবে কেন। আমি আসলে তোমাকে বুঝতেই পারছি না।”
ফিক করে হেসে, ফিরোজের নাক ডলে দিয়ে চিত্রা সশব্দে বলল, “সারাক্ষণ মোবাইল আর ল্যাপটপে ডুবে থাকলে বউকে বুঝবে কীভাবে শুনি? বউকে বুঝতে হলে একটু-আধটু বউয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হয়।”
“আচ্ছা।” খাট থেকে নেমে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো ফিরোজ। ফিরে আসার সময় দেখল চিত্রার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। সে মুচকি হেসে আগের মতো বসল খাটে। মুখোমুখি বসে, একটা হাত রাখল চিত্রার কাঁধের উপর, আর একটা হাত দিয়ে ওর বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে দিলো। সমুদ্রের বড় ঢেউ খেলে চিত্রার চুলগুলো নিচে নেমে বিছানা স্পর্শ করল, এতবড় চুল মেয়েটার! এরপর চিত্রাকে শুইয়ে দিয়ে ওর মুখের উপর মুখ রেখে বলল, “তাহলে বরং এখন বউয়ের দিকেই মনোযোগ দিই।”
ফিরোজ মুখটা নিচে নামিয়ে আনতেই চিত্রা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “যা দুষ্টু!” মুখটা দুই হাতে ঢেকে ফেলল সে।
ফিরোজ হেসে উঠল মৃদু আওয়াজ করে। চিত্রার হাত সরিয়ে দিলো। বুক থেকে ওড়নাটা সরাতে গেলে চিত্রা খপ করে ওড়নাটা ধরে ফেলল। ফিরোজ জিজ্ঞাসা ভঙ্গিতে ভুরু নাচাতেই সে নিজেই ওড়নাটা সরিয়ে দিলো। এরপর সেই ওড়না দিয়ে ফিরোজের চোখ বাঁধল।
ফিরোজ বলে উঠল, “চোখ বাঁধলে বউকে পড়ব কীভাবে? বোঝার জন্য তো পড়তে হবে।”
“বন্ধ চোখে পড়ো দেখি, কেমন পারো!”
হাসল ফিরোজ। সেভাবেই চিত্রার পাশে শুয়ে পড়ল। চিত্রা হেসে উঠল খিলখিল করে। এরপর স্বামীর বুকে মাথা রেখে শুলো। রাতে আর কেউই কিছু খেলো না।
সকালে কাঁচ ভাঙার মতো একটা শব্দ শুনে ফিরোজ চোখ খুলল। আধো আধো চোখে তাকিয়ে দেখল, চিত্রা একটা বড় প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্লেটে তিনটে চায়ের কাপ। একটা চামচ দিয়ে প্লেটে মেরে শব্দটা করছে ও। সে ঘুমন্ত গলায় বলল, “চিত্রা, তুমিও না!”
“আজ্ঞে জনাব। এবার উঠুন।” এগিয়ে এসে টেবিলে প্লেটটা রাখল চিত্রা।
ফিরোজ বলল, “ছুটির সময়। এত সকালে ঘুম ভাঙাতে আছে?”
“খুব আছে। এবার ওঠে বসো। চা এনেছি। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কতৃপক্ষকে দোষারোপ করতে পারবে না।”
“উঠছি।” ওঠে বসল ফিরোজ। খাট থেকে নেমে, তোয়ালে হাতে নিয়ে, ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের দিকে এগোতেই একটা খটকা লাগল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আমরা তো দুজন। চায়ের কাপ তিনটে কেন?”
“এটা আসলে..।” থমকে গেল চিত্রা। সত্যিটা বলা যাবে না কিছুতেই।
ফিরোজ বলল, “কার এটা?”
“এটা কনার।”
“ওহ্।” আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল ফিরোজ।
ফিরোজ চলে যেতেই বড় একটা শ্বাস ফেলল চিত্রা। এক্ষুণি মুখ দিয়ে নামটা বেরিয়ে যেতো। সে একটা কাপ ওখানে রেখে, বাকি দুটো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে, সুব্রত ভাইয়ের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো।
৬ষ্ঠ পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=825035528441149&id=100028041274793