প্রস্থান — ১৬তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
রশ্মি আর রুমানা বেগম চলে যাওয়ার পর, যখন দীপালি বেগমকে আশেপাশে দেখা গেল না, ঠিক তখন চিত্রা ডায়েরি আর বইটা নিয়ে সুব্রত ভাইয়ের ঘরে গেল। খুব সাবধানে বইটার সাথে সাথে ডায়েরিটাও আগের স্থানে রেখে দিলো। যদিও সে বড্ড কাতর ছিল জানতে, পরবর্তীতে কখন এবং কীভাবে সুব্রত ভাইয়ের সাথে রুশার দেখা হয়েছিল! কিন্তু ভয় আর অপরাধবোধ তাকে কুণ্ঠা করে রেখেছিল। যদি কোনোভাবে সুব্রত ভাই জানতে পারে, সে তাঁর অগোচরে এমন একটা কাজ করেছে, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এই কারণেই নিজেকে সংযত করল সে। সে যদি সুব্রত ভাইয়ের পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করতে পারে, তাহলে বাকিটা উনার কাছ থেকেই জানা যাবে। প্রতিটি মানুষই নিজের গোপন কথা বিশ্বস্ত কাউকে বলে হালকা হতে চায়; যেহেতু সে জানে না কখন তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়!
এরপর তিন-চারদিন কেটে গেল। সুব্রত ভাইয়ের ঘরে তেমন যাওয়া হলো না চিত্রার। ফিরোজও ইদানীং বিকেল পেরোতেই বাড়িতে চলে আসে। আর দিনের বাকি সময়টা সে নানান কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজগুলোও সব উদ্ভট! এখন দীপালি বেগম ঘনঘন চা খেতে চান। এবং তাঁর শর্ত, চা শুধুমাত্র চিত্রাই বানাবে। এর পিছনে তাঁর যুক্তি, ‘ ক’দিন বাঁচি ঠিক নেই। বয়স হয়েছে কী-না! মরার আগে ছেলের বউয়ের সেবা ভালো নিয়ে নেই। একমাত্র ছেলের বউ বলে কথা।’ শ্বাশুড়ির মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হয় চিত্রা! ভাবে, সামান্যই আবদার। শ্বাশুড়ি মা হলো নিজ মায়েরই বিকল্প! সকল আবদার পূরণ করা তাঁর কর্তব্য। চা বানানো চলে ভদ্রমহিলা আরও আবদার করেন। খুব বিনয়ী সুরে বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছ, মা? আসো, বসে বসে টিভি দেখি দুজনে।’ চিত্রা এসবে কখনো বিরক্ত প্রকাশ করেনি। হয়ও-নি সে। সে ভাবে, দিনেরবেলা তাঁরা দুজন ছাড়া বাকি কেউ তেমন বাড়িতে থাকে না। বয়স হচ্ছে বলে তিনিও বাইরে বেরোন না তেমন। বাড়িতে একা একা বসে থাকেন বলে একটু কারোর সঙ্গ চান। এতে বিরক্ত হওয়ার তো কিছু নেই।
সে সঙ্গ দেয় শাশুড়িকে। যখন যা বলেন, সেটাই শুনে। গল্প করেন নানান বিষয়ে। টিভি দেখেন। বাইরে থেকে কেউ দেখলে বলবে, সম্পর্কটা যেন শাশুড়ি বউমার না, স্কুল জীবনের দুই বান্ধবীর! এমনকি চিত্রাও মনে করে, তাঁর শাশুড়ি সাথে তাঁর যে সম্পর্কটা, সেটা বন্ধুত্বের। দিনেরবেলা সংসারের কাজ আর শাশুড়িকে সঙ্গ দেওয়া আর সন্ধ্যার পর ফিরোজকে সঙ্গ দেওয়া, এসবের মধ্যে বিরাজ থাকায় সুব্রত ভাইয়ের ঘরে আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। খোঁজখবর নিয়েছে সুলতানার কাছ থেকে। খাবার-দাবার, মেডিসিন সব এখন সুলতানাই দিয়ে আসে।
তখন বেলা তিনটে। দীপালি বেগম ঘুমিয়েছেন নিজের ঘরে। বাড়িতে কিছু কাঁচা আমা হয়েছিল। খালেদ সাহেব, ফিরোজ, কনা, এরা সবাই আমের আঁচার খুব পছন্দ করে। সেগুলোর ব্যবস্থাই করছিল চিত্রা আর সুলতানা। ড্রয়িংরুমে বসে আমের খোসা ছাড়াচ্ছিল, আর গল্প করছিল। সুলতানা হেসে হেসে বলছিল, এই বাড়ির লোকজন আমের আঁচারের কত বিশাল ভক্ত। “জানেন ভাবী, সেবার যখন আপনি ছিলেন না, তখন আমি আর কনা আপা মিলে বানাচ্ছিলাম। আমগুলো যখন চিনি দিয়ে জাল দিচ্ছিলাম, তখন কনা আপা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। আম জাল দিয়ে একটা বাটিতে রাখলাম আমি। আরও আম জাল দিয়ে যখন আগেরগুলো সাথে রাখতে যাবো, তখন বাটি দেখে আমার চোখ কপালে! দেখি, একটুও নেই। কনা আপার দিকে তাকিয়ে আমার মুখ ‘হা’ হয়ে গেল। দেখি, আপা খেতে খেতে গাল-মুখ মাখিয়ে ফেলেছে। একেবারে বাচ্চাদের মতো। আমাকে তাকাতে দেখেই হাসল। বলল, ‘আর একটু দে না।’ আমি কী আর দিই! দ্রুত খালাম্মাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘কনা আপারে রান্নাঘর থেকে না সরালে এই বাড়ির আর কেউ আঁচার পাবে না। সব উনি একাই শেষ করবে।’ শেষে খালাম্মা বকাঝকা দিয়ে কনা আপারে রান্নাঘর থেকে বের করলে আমি পুরো বাটিটা ভরতে পারলাম আঁচার দিয়ে। সেদিন রাতে কী হলো শুনবেন? ফিরোজ ভাই আর খালু বাড়িতে এসে যখন জানতে পারল আঁচার বানানো হয়েছে, তখন তাঁরা দুজনে হন্নে হয়ে খুঁজতে লাগল সেই আঁচার। ঠাণ্ডা হওয়ার জন্য রান্নাঘরেই রেখেছিলাম আমি। যেই না উনারা হাতের নাগালে পেলো, অমনি দুজনে বাঘের মতো থাবা মারতে শুরু করল। কোথায় হাত ধোঁয়া, কোথায় জামা-কাপড় ছাড়া, তৎক্ষনাৎ সেভাবেই শেষ করে ফেলল পুরোটা। ওসব দেখে আমাদের সে কী হাসি! এত বড় বড় মানুষ একেকজন, অথচ সামান্য আঁচারের জন্য কত কাড়াকাড়ি। কে বেশি খেলো, সেটা নিয়েও তর্ক চলে। আমারও লাভ হয় খুব। আমার বানানো আঁচারের খুব প্রশংসা করে সবাই। খালু তো কয়েকবার বখশিশ ও দিয়েছিল।”
সুলতানা কথা শুনে চিত্রা উচ্চস্বরে হাসছিল। অবাকও হচ্ছিল এমন ঘটনা সে। এইসব হৈ-হুল্লোড় তাঁরা ছোটবেলায় করেছে খুব, যখন সব ভাই-বোনেরা একসাথে হতো। সামান্য চকলেট নিয়েও কাড়াকাড়ি হতো। কিন্তু এই বাড়ির ঘটনা আরও চমকপ্রদ! হৈচৈ-তে বয়সের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
সুলতানা আরও বলল, “তবে গত বছর একটা ব্যাপারে খারাপ লেগেছিল আমার।”
“কোন ব্যাপারে?” হাসতে হাসতে জানতে চায় চিত্রা। তাঁর ধারণা, ওর ভাগ্যে আঁচার জোটেনি বলে খারাপ লেগেছিল।
সুলতানা সহসা মুখ মলিন করে বলল, “কী আর বলব ভাবী। সুব্রত ভাই গতবছর আমের সিজনে জেল থেকে ছাড়া পেলো। একদিন রাত করে বাড়িতে ফিরল সুব্রত ভাই। নতুন চাকরি খুঁজছিল তো, সেজন্য খুব খাটুনি যাচ্ছিল। তাঁর ঘটনাটা খবর হয়েছিল খুব, তাই কেউ চাকরি দিচ্ছিল না। সেদিন খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরল। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাইজান, কিছু খাবেন?’ উনি ‘না’ বলে ঘরের দিকে যেতে লাগলেন। হঠাৎ সিড়ির কাছে গিয়ে থেমে গেলেন, আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আজ কি আঁচার বানিয়েছ, সুলতানা?’ আমি বললাম, ‘জি, ভাইজান। খালু আম এনেছিল সেদিন। তা দিয়েই বানিয়েছি আজ।’ এরপর আর কিছু বললেন না উনি। ঘরের দিকে চলে গেলেন চুপচাপ। আসল ঘটনা সেই রাতেই ঘটল।” আসল ঘটনা বলার আগে চিত্রার দিকে তাকাল সুলতানা। সে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে তাঁর মুখের দিকে। থেমে যাওয়ায় যেন ঈষৎ বিরক্ত হলো। সুলতানা আবার বলতে শুরু করল, “তখন রাত ১১টা কী ১২টা বাজে। হঠাৎ শব্দ পেয়ে আমি ওঠে বসলাম। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখলাম, রান্নাঘরের আলো জ্বালান। অবাক হয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। কাছে গিয়ে দেখলাম, সুব্রত ভাই কিছু খুঁজছেন। আমি বললাম, ‘কী খুঁজছেন, ভাইজান?’ আমাকে দেখে সুব্রত ভাই থতমত খেয়ে গেল! ভূত দেখার পর চমক! মুখটা একেবারে চুপসে গেছিল তাঁর। রান্নাঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আঁচার কী সবটুকু শেষ, সুলতানা?’ আমি বললাম, ‘জি ভাইজান। সবটুকু শেষ।’ আমার কথা শুনে যেন সুব্রত ভাইয়ের মুখ আরও কালো হয়ে গেল। কেমন যেন মনমরা হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার বড় মায়া হলো তাঁর উপর। চোখে পানি চলে এসেছিল। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাইজান বললেন, “না না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। এখনো ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে তো, সেজন্য। আমি তো ফ্রিজের পানি খেতে এসেছি।’ পরে আমি তাকে ফ্রিজ থেকে একটা পানির বোতল বের করে দিলে উনি সেটা চলে গেলেন নিজের ঘরে। এর ক’দিন পর বাড়িতে আবার আম এলো। আমি আগেই উনার জন্য কয়টা আম সরিয়ে রাখলাম। রাতে সবাই ঘুমানোর পর চুপিচুপি রান্নাঘরে গিয়ে আঁচার বানিয়েছিলাম। পরদিন সকালে সবাই জেগে উঠার আগে উনাকে আম দিয়ে আসি। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে পুরোটা শেষ করে ফেললেন।”
চিত্রা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সুলতানার কথা। শেষ হতেই সে অত্যন্ত আফসোসের সাথে বলে উঠল, “বেচারা!” এরপর সুলতানার মাথায় হাত রেখে বলল, “কিন্তু তুমি দারুণ কাজ করেছ, সুলতানা। তোমার জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম।”
সুলতানা খুশি হলো কৃতকর্মের জন্য প্রশংসিত হয়ে।
চিত্রাও মনেমনে ঠিক করল, এবার যখন আঁচার বানানো হবে, তখন সে সুব্রত ভাইয়ের জন্য কিছুটা রেখে দিবে।
২০.
সুস্থ হয়ে অফিসে গিয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন রুমানা। সেদিনই করছিলেন তিনি, সহসা ডাক পড়ল বসের রুমে। আশেপাশে অনেকেই শুনলো পিওনের কথা, সে-ই খবরটা দিয়ে গেল। রুমানা বেগম তাকালেন আশেপাশের টেবিলগুলো, সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে ফুসুরফাসুর করছে। কারোর মুখের হাসিতে যেন ইঙ্গিতপূর্ণ ভাব। সে পাশের ডেস্কের মানুষটির দিকে তাকাল বিমর্ষ চাহনিতে!
মিসেস আজিম আড়চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বললেন, “এটা ঘটনা তো আজ প্রথম না। আপনি যান।”
নিরুপায় হয়ে ওঠে দাঁড়ালেন রুমানা বেগম। ইচ্ছে না থাকলেও তাকে এখন যেতে হবে। চাকরি হারানোর ভয়ে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের চাকরি গেছে। আরও ছাটাই হবে, নিশ্চিত জানেন তিনি। বসের অমান্য করলে সেই দলে যে তাঁর নাম যুক্ত থাকবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? পরের চাকরির কোনো গ্যারান্টি নেই৷ তাছাড়া গরীরের জীবনে এইসব ছোটখাটো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে থাকে। যদিও এর প্রভাব বিশালভাবে ক্ষতগ্রস্ত করে তাঁদের।
বসের রুমের দরজা ঠেলে রুমানা বেগম বললেন, “স্যার, আসবো?”
মিস্টার মুজিবর তাকালেন দরজার দিকে। চেয়ারে বসে তাঁরই অপেক্ষা ছিল এতক্ষণ। তিনি অভ্যাসগত সেই হাসিটা প্রকাশ করে বললেন, “আরে মিসেস রুমানা, আমার ঘরে আসার জন্য আপনার আবার অনুমতির প্রয়োজন আছে? আপনি যখন খুশি আসতে পারেন আমার ঘরে। আমার ঘরের দরজা আপনার জন্য ২৪ঘণ্টা খোলা আছে।” কথাগুলো বলে আবারও হাসলেম মিস্টার মুজিবর। তাকে অত্যন্ত উৎফুল্ল দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে।
বিরক্ত মুখে ভিতরে ঢুকলেন রুমানা বেগম। টেবিলটার কাছে গিয়ে নতকণ্ঠে বললেন, “কেন ডেকেছেন, স্যার?”
“আহা! আগে বসুন না। দাঁড়ান, আমি চেয়ারটা টেনে দিচ্ছি।”
মিস্টার মুজিবর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন, রুমানা বেগম সাথে সাথে বললেন, “আপনাকে উঠতে হবে না, স্যার। আমি বসছি।”
রুমানা বেগম চেয়ারে বসে আবার বললেন, “স্যার, কেন ডেকেছেন বলুন এবার।”
রুমানা বেগম হাত টেবিলের উপর রেখেছিলেন। মিস্টার মুজিবর নিজের হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিতেই তিনি চট করে নিজের হাত জোড়া গুটিয়ে নিয়ে, জড়োসড়ো হয়ে বসলেন। মিস্টার মুজিবর খিলখিল করে হেসে বললেন, “আপনিও না, মিসেস রুমানা। এত ভয় পান!”
রুমানা বেগম দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন, “কাজের কথা বলুন, স্যার।”
“আমি কী সবসময় আপনাকে কাজের জন্য ডাকি? নিজের যে সুখ-দুঃখের কথা আছে, সেগুলো শেয়ার করার জন্য আপনাকে ডেকেছি। আপনি শুধু কাজ নিয়ে পড়ে আছেন। কাজ তো হবেই। পাশাপাশি বন্ধুত্বও রক্ষা করতে হবে। আমি যেমন আপনার কষ্ট বুঝি, তেমনি আপনারও উচিত আমার কষ্ট বুঝা। কত বছর হয়ে গেল আপনি স্বামীহারা! আমার ঘরেও শান্তি নেই একেবারে।”
রুমানা বেগম অনুজ্জ্বল হয়ে বললেন, “স্যার, প্লিজ। যখন-তখন আমাকে ডাকবেন না। সবাই হাসাহাসি করে। উল্টো পাল্টা কথা বলে আমাকে অপমান করে। কেউ কেউ নোংরা ইঙ্গিতে তাকায়।”
হঠাৎ পিছিয়ে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন মিস্টার মুজিবর। মুখে প্রশস্ত হাসি টেনে বলল, “সেজন্যই তো আপনাকে বলি, অফিস শেষে আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে বসতে পারি। সেখানে কেউ দেখবে না আমাদের। আমরা আরামে কথা বলতে পারব। সময় কাঁটাতে পারব।”
নীরব থাকলেন রুমানা বেগম। মিস্টার মুজিবর আবার বললেন, “মিসেস রুমানা, আপনার বয়স হলেও তা বুঝা যায় না খুব একটা। এখনো আপনার শরীরে সেই যৌবন খুঁজে যায়। আপনার মতো সুন্দরী মহিলার সাথে রেস্টুরেন্টে বসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। বুঝলেন?”
অপমানে আর ঘৃণার রুমানা বেগমের দুই চোখ ভিজে এলো। ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। মাথা নত করে বসে রইলেন।
মিস্টার মুজিবর আবার বললেন, “তাছাড়া এতে আপনারই লাভ। আপনার প্রমোশনের নিশ্চয়তা পেয়ে যাবেন। যেদিন আপনি আমার সাথে যাবেন, নিশ্চিত থাকুন, সেদিনই প্রমোশন লেটার আপনার হাতে থাকবে।”
মাথাটা সামান্য তুলে রুমানা বেগম বললেন, “স্যার, আমি তো আপনাকে অনেকবার বলেছি, এটা সম্ভব না। অফিস শেষে আমাকে দ্রুত বাড়ি যেতে হয়। বাড়িতে আমার একটা মেয়ে আছে। ও একা থাকে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে সমস্যা হবে। আপনি আমার বাসার পাশ দিয়ে যাতায়াত করেন বলে বাকিদের বিদ্রুপ না দেখার ভান করে আপনার গাড়িতে উঠেছি এই ক’দিন। কিন্তু আর না, স্যার। আমার মেয়ে বোধহয় আমাদের দেখেছে। ও এইসব ভালো চোখে দেখছে না।”
“আমার কাছে এর একটা ভালো সমাধান আছে।”
“ঠিক বুঝলাম না। সমস্যা কোথায়, যে আপনি সমাধান দিতে চাচ্ছেন?”
মিস্টার মুজিবর হাসতে হাসতে বললেন, “সমস্যা না? খুব বড় সমস্যা এটা। আপনার মেয়ের জন্য আপনি আমার সাথে সময় কাঁটাতে পারছেন না। আমি এর একটা যোগ্য সমাধান দিই। বাড্ডায় আমার একটা নতুন শো-রুম ওপেন হয়েছে। আপনার মেয়েকে না-হয় ওখানকার ম্যানেজার বানিয়ে দিই। ইয়াং লেডি। ভালো স্যালারিও থাকবে। সাথে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা। মাসে ছুটি নিয়ে একদিনের জন্য না-হয় বাড়িতে আসবে। এতে সুবিধা হবে কী, বাড়তি কিছু টাকা আসবে সংসারে, পাশাপাশি আপনার আর বাড়ি যাওয়ার তাড়া থাকবে না।”
রুমানা বেগম মুখ শক্ত করে বললেন, “কোনো প্রয়োজন নেই, স্যার। আমার মেয়ের বয়স কম। এখন পড়াশোনা করছে। তাছাড়া যতদিন আমি বেঁচে আছি, ওর চাকরির দরকার নেই।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না মিসেস রুমানা। এটাই তো সময়। আজকাল কার অল্পবয়সী মেয়েরা কত উল্লাস করছে। কতকিছু করে বেড়াচ্ছে এরা। টাকার অভাব নেই। মেয়েকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখলে হবে? আপনি এক কাজ করুন। সন্ধেবেলা সিভি নিয়ে মেয়েকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন। গ্রাজুয়েশন নিয়ে ভাববেন না, আমার খুশিটাই বড় কথা। অবশ্যই আমার মিরপুরের ফ্ল্যাটে পাঠাবেন। আজকাল আমি ওখানেই রাত্রিযাপন করছি।”
“ছি!” ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দাঁড়ালেন রুমানা বেগম। যে চেয়ারটাতে বসে ছিলেন, সেটা পড়ে গিয়ে একটা বিকট আওয়াজ হলো। নিজের ব্যাপারে তিনি যতটা দুর্বল, মেয়ের ব্যাপারে তিনি ততটাই শক্ত। লোকটার চোখে চোখ রেখে, রক্তবর্ণ চেহারা করে, গলায় কাঠিন্য এনে তিনি বললেন, “আর একবার যদি আপনি আমার মেয়ের ব্যাপারে এমন নোংরা চিন্তা করেন, তাহলে আমি ভুলে যাব আপনি আমার বস।” এ-কথা বলে ঘুরে দাঁড়ালেন রুমানা বেগম।
মিস্টার মুজিবর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, “কোথায় যাচ্ছেন, শুনি?”
হঠাৎ রেগে উঠায় রুমানা বেগমের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করেছে। তিনি চোখে মুছে দৃঢ় গলায় বলল, “চেয়ারম্যান স্যারের কাছে যাচ্ছি। আপনার অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে। এত নোংরা আপনি! একজন ধর্ষক আপনি। নারীর মনুষ্যত্ব, সম্মানকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে যাচ্ছেন। আপনার প্ররোচনায় বিকৃত হচ্ছে নারীর মস্তিষ্ক। আপনাকে এখনি থামানো দরকার।”
মিস্টার মুজিবর পা নাচাতে নাচাতে বললেন, “এতকিছু করে আপনার লাভ কী? আপনার সম্মান এখানে কতটুকু অবশিষ্ট আছে? তাছাড়া এই চাকরি গেলে আমার কিছুই হবে না। নিজের ব্যবসা করে। এই চাকরি তো শুধুমাত্র বড় বড় অর্ডারগুলো পাওয়ার মাধ্যম। একবার ভেবে দেখুন, এতকিছুর পর আপনার চাকরি থাকবে তো? তখন কী করবেন আপনি? প্রতিবাদ পেটের ভাত জোগাবে তো? যদি জোগায়, তাহলে যেতে পারেন।”
কথাগুলো শুনে, জবাব না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন রুমানা বেগম। চুপচাপ নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলেন।
মিসেস আজিম কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও আশেপাশের লোকদের উৎসুক চাহনি দেখে থমকে গেল। নীরবে নিজের কাজ করতে লাগল সে। এভাবেই ১০জনের কাছে সম্মানহানীর ভয়ে ১জনের কাছে নিজের সবগুলো সম্মান বিসর্জন দিয়ে সবশেষে বিলুপ্ত হয় নারীরা। অথচ তাঁরা বুঝে না, মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করা আর গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা, দুটো একই! সাজা-ও এক।
১৬তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=833410874270281&id=100028041274793
বি:দ্র: ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। কোনোমতে লিখে চট করে পোস্ট দিয়ে দিলাম। লেখা শেষ একবারও চেক দেওয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।