প্রদীপের নিচে আমি পর্ব ৮

0
431

#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৮

সম্পূর্ণ সিড়ি জুড়ে পিচ্ছিল পদার্থ লেগে আছে, অথচ থালাবাসন ধোয়ায় সময় কোন কিছু ছিলো না। কেউ ইচ্ছে করে কিছু লাগিয়ে রেখেছে? শরীর অবশ হয়ে আসছে, চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। সম্পূর্ণভাবে অচেতন হবার আগে রিতুর কন্ঠ কানে ভেসে এলো। নিরবের নাম ধরে চিৎকার করছে।


সন্ধ্যা সাতটা, চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেছি। স্যালাইন চলছে, বেডের পাশে নিরব বসে আছে। আশেপাশে আর কাউকে দেখতে পেলাম না।

” আপনি উঠার চেষ্টা করছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না স্যালাইন চলছে? ”

শুকনো মুখে নিরবের দিকে তাকালাম। রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষন্ন স্বরে বললাম, ” কি হয়েছে আমার?”

” পুকুরে পড়ে গিয়ে ছিলেন, অজ্ঞান ছিলেন তাই দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। খুব ব্যাথা করছে তাই না?”

” হুম, পায়ে খুব ব্যাথা। আর কেউ আসেনি?”

” সবাই এসেছিল, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাড়িতে গেছে। রাতে থাকার জন্য আমাকে বলেছে, যদি আপনি ভূতে ভয় পান! কেবিন নেওয়া হয়েছে তাই সমস্যা হবে না। ”

” আমি ভূতের ভয় পাই এ কথা তোমায় কে বললো শুনি?”

” তার মানে ভয় পান না। সাহসী মেয়ে!”

” হুহ!”

” ক্ষুধা লাগলে বলেন, খাবার খাইয়ে দিচ্ছি। ”

” তুমি খাইয়ে দেবে?”

” হু।”

” এখন খিদে পাচ্ছে না, স্যালাইন শেষ হতে বেশি বাকি নেই। আমি নিজে নিজে খেয়ে নিবো। ”

” বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে, তাড়াহুড়ায় মোবাইলটা আনতে ভুলে গেছি। ”

” বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারো। সমস্যা নেই, আমি ভয় পাবো না। ”

” গেলে হাসপাতালের বাইরে যেতে হবে, হাসপাতাল খুবই বিরক্তিকর জায়গা। একদমই ভালো লাগে না আমার। ”

” কেন ভালো লাগে না?”

” জানি না। আপনি থাকেন, আমি বাইরে দিয়ে ঘুরে আসছি। ”

নিরব বাইরে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। সকালের ব্যাপার নিয়ে বড্ড চিন্তিত, সিঁড়ির উপর কিছুই ছিলো না, থালাবাসন ধোয়ার সময় নিজ হাতে সিঁড়ি ঘাট কুড়িয়েছি। হোটচ খেয়ে পড়ে গেলে আলাদা কথা ছিল, কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে পা পিছলে গেছিলাম। কে করতে পারে এই কাজ? রিতু? হলেও হতে পারে। মেয়েটা আমায় একদম সহ্য করতে পারে না। সারাক্ষণ বাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে। হয়তো আমাকে নিজের সতীন মনে করে। স্যালাইন শেষ হয়েছে মিনিট পাঁচেক আগে। একজন নার্স এসেছিল, কয়েক মিনিট দেরি করলে র” ক্ত উঠে যেত।

রাত নয়টা, নিরবের আসার নাম নেই। হাসপাতাল থেকে রাতের খাবার দিয়ে গেছে। পেঁপে দিয়ে পাবদা মাছ রান্না, কয়েক পদের সবজি মিশিয়ে ভাজি, ডাল, শশা, লেবু। মনেই হচ্ছে না হাসপাতালে ভর্তি আছি। খাবারের সাথে একটা চামচও দিয়েছে। কেবিনের সাথে বাথরুম, ফ্যান, এসি দুটোই আছে, একটা ফ্রিজও আছে। বেশ ভালো ব্যবস্থা এখানে, প্রাইভেট হাসপাতালে সুবিধা বেশি থাকে। খরচও তেমন!
খেতে ইচ্ছে করছে, আবার মনে হচ্ছে নিরবের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। না আর সহ্য করতে পারছি না, সকাল থেকে না খেয়ে আছি। যদিও স্যালাইন দিয়েছে, তবুও এতো খিদে লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। খাওয়া শুরু করবো এমন সময় নিরব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো।

” দেরি করে ফেললাম তাই না? আসলে বাইরে ঘুরতে বেশ ভালো লাগছিলো। ”

” রিতু এসেছিল নাকি?”

” ওই আর কি! ওর এক বান্ধবীর সাথে ঘুরতে এসেছে, হঠাৎ করে দেখা হলো। ”

” এতো রাতে বাড়ি দিয়ে এতো দূরে ঘুরতে এসেছে? কি জানি বাপু!”

” ধূর! আপনি শুধু বাজে কথা বলেন। এই দেখেন আপনার জন্য কামিনী ফুল নিয়ে এসেছি। ”

নিরবের হাতে একগুচ্ছ কামিনী ফুল, মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগছে। এতো সময় ভেবেছি পারফিউম লাগিছে। হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিলাম। নরম ফুলের মিষ্টি গন্ধ।

” আপনি রাতে খেয়েছেন?”

” না তোমার জন্য বসে ছিলাম। তুমি খাবে না?”

” আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। আপনি খেয়ে নিন, একটু পরে আবার ঔষধ দিবে হয়তো। ”

” তুমি কি এখন আবার কোথাও যাবে নাকি?”

” ওই যাব আর আসবো। ”

” তুমি যে পিচ্চি একটা ছেলে তা কি তোমার মনে আছে?”

” আপনি পিচ্চি! ”

নিরব বেরিয়ে গেল। সাত-পাঁচ না ভেবে খাওয়ায় মন দিলাম। দশটা বাজতে চললো, নিরব আসছে না। এই ছেলে থাকার থেকে না থাকাই ভালো ছিল। এতো টেনশন নিতে হত না। শহরের রাস্তায় রাতে এভাবে ঘুরঘুর করছে, সাহস মন্দ না! রিতু মেয়েটার তো আরও বেশি সাহস, এইটুকু পিচ্চি মেয়ে এতো রাতে ঘুরতে এসেছে। আকাশ- পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালের মিষ্টি রোদ চোখে লাগছে, জানালার পর্দা ভেদ করে মুখের উপর পড়েছে। চোখ মেলে দেখলাম নিরব ঘুমচ্ছে, পাশাপাশি দু’টো বিছানা, একটা রোগীর অন্যটা রোগীর স্বজনদের জন্য। ঘুমন্ত অবস্থায় নিরবকে বড্ড অদ্ভুত দেখতে লাগছে, সম্পূর্ণ মুখে তেলতেল ভাব,নিষ্পাপ চেহারা। উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, পায়ে ব্যাথা নেই তেমন। নিজেকে সুস্থই লাগছে, সামান্য পড়ে যাওয়া নিয়ে এতো দৌড়াদৌড়ি লেগে যাবে কে জানতো! একটা গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম, গোসল করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পায়ে ব্যান্ডেজ করা, চাইলেও গোসল করা সম্ভব নয়।

” কখন উঠলেন? ”

” বেশ অনেক্ক্ষণ আগে। ”

” ওহ আচ্ছা, বিশ্রাম করুন। আমি ফ্রেশ হয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি। আজ হয়তো আপনাকে ছেড়ে দিবে। আমি বাইরে পরোটা খেয়ে নিব। ”

” আচ্ছা। ”

বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। হাসপাতালে যতই সাজানো গোছানো হোক না কেন সেখানে ভালো লাগার কিছু নেই। সকালের নাস্তায় রুটি, ডিম সেদ্ধ আর ভাজি। খাওয়া শেষ করতেই নিরব ফিরে এলো।

” বাবা হাসপাতালে বিল পরিশোধ করে দিয়েছে, আপনার শরীর ভালো বোধ করলে আমি ড্রাইভার কাকুকে কল দেবো। ”

” হুম, আমার শরীর সুস্থ লাগছে। ”

গাড়ির পিছনের সিটে একা বসে আছি, নিরব ড্রাইভার কাকুর সাথে সামনে বসেছে। একটা জানালা খুলে রাখা, বাতাসে চুল উড়ছে। কাল অসুস্থ অবস্থায় আসার সময় বোরকা পরার সময় কই! শশুর আব্বু কাল রাতে এসেছিল নাকি অন্য সময়ে বিল পরিশোধ করেছে। কেন জানি মনে হচ্ছে শশুর আব্বু কাল রাতে এসেছিল, আর উনার সাথেই রিতু ছিল।

” নিরব আব্বু কখন এসেছিল? আমাকে তো দেখতে যায়নি। ”

” আমিও কিছু জানি না, হাসপাতাল থেকে বললো কাল রাতে নাকি সব বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সঠিক বলতে পারবো না। ”

” ওহ আচ্ছা। ”

তাহলে আমার সন্দেহই ঠিক, রিতু আব্বুর সাথে এসেছিল। কিন্তু নিরবকে মিথ্যা বলবে কেন? নাকি নিরব আমাকে মিথ্যা বলেছে? কোথাও খুব বড় একটা ঝামেলা আছে, ঠিক ধরতে পারছি না।

হাসপাতাল থেকে ফিরেছি সাতদিন হতে চললো। শশুর বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক। শাশুড়ি মা’য়ের মতে আমাকে একটু খেয়াল করে চলা-ফেরা করতে হবে। বেখেয়ালি চলাফেরা করলে এমন বি”প’দে পড়তে হয়। পায়ের ব্যাথা নেই বললে চলে, কাজ করতে তেমন অসুবিধা হয় না। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারি।

বিকেলের নাস্তার জন্য চা বসিয়েছি, নিরব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো।

” মা কোথায়?”

” মা কাকিদের ঘরে গেছে। তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?”

” বাবা কোথায় জানেন? ”

” বাবা এখনও বাড়ি ফেরেনি, কোন বন্ধু বাসার গেছে। রাতে উনার বন্ধুরাও আসবে। ”

” আপনাকে কে বলেছে এসব কথা?”

” মা বলেছে, কি হয়েছে তোমার এতো উত্তেজিত হয়ে আছো কেন?”

নিরব আমার কথার উত্তর না দিয়ে শশুর আব্বুর রুমে চলে গেল। সারাঘর তন্নতন্ন করে কিছু একটা খুঁজছে। মিনিট বিশেক পর হাতে একটা ফাইল নিয়ে ফিরে এলো।

” আমার সঙ্গে আসুন। ”

” কোথায় যাব?”

” আপনার ঘরে।”

নিরবের কান্ড কারখানা বুঝতে পারলাম না। আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল, দরজার বাইরে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

” আপনি পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলেন তাই না?”

” হ্যাঁ, কেন?”

” এই দেখেন হাসপাতালের বিল, একদিন এক রাতের জন্য পয়তাল্লিশ হাজার টাকা খরচ হবে কেন?”

” প্রাইভেট হাসপাতালে খরচ তো হবেই। ”

” না খরচ হবে না, এখানে আপনার যেসব টেস্ট করা হয়েছে তার রিপোর্ট নেই। কিন্তু এখানে বেশ কয়েকটা টেস্টর কথা উল্লেখ আছে। আমি এসব লেখা খুব ভালো বুঝতে পারি না তাই বলতে পারছি না। ”

” তোমার কথা ও কাজের কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। ”

” ছোট মানুষের মতো ভাব ধরেন কেন? আপনার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু আপনি তো পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিলেন। ”

” এখন কি বলতে চাইছো?”

হুট করে নিরব আমার হাত চেপে ধরলো। করুণ গলায় বললো, ” আপনি পা’লি’য়ে যান। ”

” এসব কি বলছো? কোথায় পা’লি’য়ে যাব?”

” আপনার বাবার কাছে, বা অন্য কোথাও। আপনি অনেক বড় বি’প’দে পড়তে চলেছেন। ”

” কি ধরনের বি’প’দ?”

“হয়তো আপনাকে বি” ক্রি করে দিবে, বা শরীরের কিছু অংশ নিয়ে নিবে। মে”রেও ফেলতে পারে।”

” তোমাকে এসব কে বলেছে?”

” রিতু। টিফিনের সময় কথায় কথায় বললো আগেরদিন বাবার সাথে হাসপাতালে গেছিল। ফিরে আসার সময় নাকি বাবা কাকে বলছিল আপনি একদম সুস্থ, শরীরে কোন সমস্যা নেই। কাজটা সহজ হয়ে গেল। ”

” কি কাজ?”

” জানি না। রাতে কে আসবে?”

” আব্বুর পু’লি’শ বন্ধু আর সাথে দুই-চারজন কে সঠিক জানি না। ‘

নিরবের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here