প্রদীপের নিচে আমি পর্ব ৬

0
349

#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৬

পৃথিবী তখনও আলোকিত হয়নি, উজ্জ্বল আকাশে শুকতারা জ্বলজ্বল করছে। আকাশে সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। দাদির সাথে বাগানের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। মা’কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে? এ বাড়ির ত্রিসীমানায় কোন ক”ব”র নেই, ছোট বেলা থেকে এ বাড়িতে বেড়ে উঠেছি। আনাচে-কানাচে সব জায়গা আমার পরিচিত। আশায় বুক বেঁধে আছি, মা হয়তো জীবিত। আজ মা’য়ের সাথে দেখা হবে, কি অদ্ভুত অনুভূতি! এক কদম এগিয়ে গেলে উত্তেজনা কয়েকগুন বেড়ে যায়। হৃৎস্পন্দনের হার ক্রমাগত বেড়ে চলছে, ধুকধুক শব্দ কানে বাজে। দাদি সামনে হাঁটছে আমি তাঁকে অনুসরণ করছি, দাদি কখন থেমে যাবে সেই অপেক্ষা। দাদি একটা মেহগনি গাছের কাছে এসে দাঁড়ালেন। চমকে উঠলাম! এখানে মা কি করে আসবে? হয়তো দাদি আগে থেকে মা’কে জানিয়ে রেখেছিল। দাদি আবার রসিকতা করছে না তো? হয়তো এখনই হেসে উঠবে, হাসতে হাসতে বলবে, ‘ দিদিভাই কেমন বোকা বানিয়েছি বল। তুই তো অভিনয় ধরতেই পারলি না। কত্ত সরল সোজা একটা মেয়ে!’

তবে দাদি খিলখিল করে হেসে উঠলো না, শান্ত গলায় বললো, ” এই গাছের নিচে তোমার মা’য়ের ক”ব”র। ”

দাদির হীম শীতল কন্ঠ আমায় বরফে পরিনত করলো, প্রথমে পায়ের আঙ্গুল থেকে জমাট রাঁধতে শুরু করেছে, এরপর সারা শরীর, চুলগুলোও শক্ত হয়ে গেছে। আশায় ছিলাম মা’কে দেখতে পাবো। এতো বছরেও জানতে পারিনি এখানে মা ঘুমিয়ে আছে। কোমল হাতে গাছের গায়ে স্পর্শ করলাম। চোখ অশ্রুশূন্য, হৃদয় এতো পু”ড়”ছে কেন! আজীবন অন্য নারীকে মা হিসাবে জেনে এসেছি। এ মন কখনো তাঁর মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেনি। নিজের ভাগ্যকে দোষ দিয়েছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভুল খুঁজেছে। তবে আজ কেন এ ব্যাথা! কেন হৃদয় জুড়ে হাহাকার! কন্ঠ জড়িয়ে গেছে, কথা বলার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে, তবুও অস্পষ্ট গলায় বললাম,

” মা কবে মা”রা গেছে? আমি তো জন্মের পর দিয়েই অন্য কাউকে মা হিসাবে চিনে এসেছি। ”

” তোমার মা তোমায় জন্ম দিতে গিয়ে মা”রা গেছে। রেণু তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। ”

” তুমি কি আর কিছু বলতে চাও? নাকি এতটুকুই অজানা ছিল?”

“ঘরে ফিরে চলো। এখানে তুমি স্বাভাবিক নেই। তোমার শরীর কাঁপছে। দিদি ভাই সত্য দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, তবে এর বিশেষত্ব রয়েছে, রাতের আঁধার একে গ্রাস করতে পারে না। সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ করতে শিখতে হয়। যা ঘটেছে তুমি তা পরিবর্তন করতে পারবে না। ”

দাদিকে অনুসরণ করে ঘরে ফিরে এলাম। ছোট থেকে অতিরিক্ত শাসন, মা”র”ধ”র আমাকে মানসিক রোগীতে পরিনত করেছে। অজানা দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে, বদ্ধ জীবন আমার। এ দেয়াল ভেঙে বেরতে হবে, আমায় শক্ত হতে হবে। সবকিছুর জবাব চাইতে হবে। কি হয়েছিল মা’য়ের সাথে? যদিও মা’য়ের মৃ”ত্যু স্বাভাবিক হলে হয়তো কিছুই করার থাকবে না!

খাটের কোণায় চুল খামছে ধরে বসে আছি। নিজের প্রতি বড্ড বিরক্ত। এতবছর পরে এসব কথা না জানলে তেমন কোন ক্ষ”তি হতো না, বরং জানার পর কষ্ট লাগছে, মনের মাঝে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, নিজের মা হলে জীবন অনেক পাল্টে যেতে পারত। কিন্তু তিনি মৃ’ত। পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব নেই।

” হ্যাঁ রে দিদি ভাই। রেণু এতো ডাকাডাকি করছে কেন?”

” কি করে জানবো? তুমি যেখানে আমিও সেখানে বসে আছি। ”

” হ্যাঁ রে সানজিদা, কখন দেখে তোকে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছিস না কেন? কত বেলা হল সে খেয়াল আছে? বলি রান্না করবে কে?”

” আমি যখন এ বাড়িতে না থাকি, তখন বুঝি তোমরা না খেয়ে থাকো?”

মা চমকে উঠলো। তবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। হয়ত নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এতো বছরে যে মেয়ে কোন ব্যাপারে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করেনি সে কি করে মুখের উপর জবাব দিচ্ছে। সত্যিই ভাবনার বিষয়! ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম। শশুর আব্বু ফিরে যাবে, উনার জন্য নাশতা বানিয়ে দেওয়া জরুরী। যদিও উনি সকালে খাবেন না বলে জানিয়েছিল তবুও কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। এ বাড়িতে থাকা সম্ভব না, দাদির সাথে গ্রামে চলে যেতে পারলে মন্দ হত না তবে নানান প্রশ্ন উঠবে। তার থেকে শশুর বাড়িতে থাকাই বেশ ভালো। কাজ করতে হলেও কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। নিজের বাবা টাকার বিনিময়ে মেয়েকে অযোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিয়েছে, এর থেকে খারাপ আর কি হতে পারে।

চুলায় গরম পানি বসিয়েছি, চায়ের সঙ্গে কি দেওয়া যায়? নুডলস রান্না করলে মন্দ হয় না, তবে শশুর আব্বুর পরোটা খুব পছন্দের। মিটসেফ থেকে আটা বের করে, তিনটে পরোটা হবে এমন আন্দাজে আটা মাখতে শুরু করলাম। এসব কাজের অভ্যাস আছে বহুবছর ধরে, তেমন সময় লাগবে না। মিনিট বিশেকের মধ্যে নাস্তা রেডি, পরোটা, ডিম ভাজা আর চা। মিষ্টি জাতীয় কিছু তৈরি করে ভালো হতো। শশুর আব্বু আবার চায়ে চিনি খান না। ট্রে সাজিয়ে গেস্ট রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম।

” কষ্ট করে এসব করতে গেলে কেন? বাইরে খেয়ে নিলে তেমন সমস্যা হতো না। ”

” সকালে না খেয়ে বের হওয়াটা ভালো দেখায় না। তেমন কষ্ট হয়নি। ”

” তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কাজ পড়ে গেল। অবশ্য এ সুযোগে বেশ কয়েকদিন বেড়ানো হলো। ”

” আপনি বললে আপনার সাথে ফিরে যেতে পারি। ”

” না না, এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বাপের বাড়ি থাকতে সব মেয়েরই কমবেশি ইচ্ছে করে। তোমার শাশুড়ি নতুন বউ থাকতে প্রতি সপ্তাহে একবার বাপের বাড়ি যেতে বায়না ধরতো। ”

” আর কিছু লাগবে?”

” যা দিয়েছ যথেষ্ট। পরোটাগুলো দারুণ হয়েছে। ”

” আচ্ছা তাহলে যাই। কিছু লাগলে বলবেন। ”

” নিশ্চয়ই। ”

শশুর লোকটা খারাপ নয়, কত সুন্দর করে কথা বলে। নিরবও বেশ ভালো, তবে ইঁচড়েপাকা। এই বয়সে প্রেমিকা যোগাড় করে ফেলেছে। সকালের নাস্তায় পরোটা আর ডিম ভাজা করলে মন্দ হয় না। মা-ও আমার হাতের পরোটা খেতে খুব পছন্দ করে। সকাল থেকে মৃদুলকে দেখছি না, চলে গেল নাকি? যাওয়ার আগে তো বিদায় নেওয়া উচিত ছিল। হয়তো প্রয়োজন মনে করেনি।

” আপনার সাথে কথা ছিল। ”

দরজার সামনে মৃদুল দাঁড়িয়ে, মনে হয় মাত্রই গোসল শেষ করছে। ভেজা চুল কপালে লেপ্টে আছে, স্নিগ্ধ, মায়াময় চেহারা। চোখ ফেরানো দায়!

” উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”

” হ্যাঁ, বলেন। ”

” আসলে আমি পরোটা খাই না। অন্যকিছু তৈরি করে দিলে খুশি হতাম। ”

” রুটি খান? তাহলে রুটি বানিয়ে দিচ্ছি। ”

” হ্যাঁ, রুটিতে চলে যাবে। আচ্ছা আসি তাহলে। ”

” ঠিক আছে। ”

লোকটা দারুণ চালাক। কথা বলার জন্য ভালোই বাহানা বানাতে পারে। এখনও পরোটা ভাজা শুরু করিনি, সবে আটা মাখছি। উনি কি করে বুঝলেন পরোটা বানাবো? প্রেমে পড়লে বোকা লোক চালাক হয়ে যায়, চালাক লোকেরা বোকামি করে বসে। মৃদুলের বাহানা ধরতে পেরেছি বিধায় কয়েকটা কথায় উনাকে বিদায় করে দিলাম। কারো সঙ্গে বেশি কথা বললে মায়ায় পড়ে যেতে হয়। প্রচন্ড রকমের খারাপ মায়ায়, যে মায়া কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন। না চাইতেও তাদের কথা মনে পড়ে। যে কোন বিষয়ে তাদের টেনে আনতে ইচ্ছে করে। আফসোসের ব্যাপার হলো এসব মিথ্যে মায়া বহুবছর পর্যন্ত অক্ষত থাকে। এ মায়ায় জড়াতে চাই না।

মৃদুল মা-বাবার সাথে টেবিলে খেতে বসেছে, দাদির খাবার রুমে নিয়ে এসেছি। সে মৃদুলের সামনে যাবে না। আমারও তার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না, যুবতীর সামনে সুদর্শন পুরুষ থাকলে চোখ তাকে দেখতে চাইবে। নিতান্ত সৎ প্রকৃতির লোক তাদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমার পক্ষে দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তাই উনার সামনে পড়তে চাই না। মা’য়ের শোকে হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হলেও চোখের কোণে অশ্রু জমছে না। দাদি তৃপ্তি সহকারে খাবার খাচ্ছে, মাঝেমধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। খেতে ইচ্ছে করছে না, ক্ষুধা পেলেও গলা দিয়ে কিছু নামবে বলে মনে হয় না।

” দিদি ভাই, তুমি খাবে না?”

” তুমি হঠাৎ তুই বলে সম্মোধন করছ আবার তুমি করে বলছো কেন?”

” তোর সবদিক খেয়াল থাকে, যুবতী কন্যা। আমি বুড়ি মানুষ যা মনে আসে তাই বলি। ”

” ভালো। ”

” কিছু একটা খেয়ে নিলে ভালো হতো না? বেশি সময় না খেয়ে থাকলে পিত্তি পড়বে। ”

” তুমি খাওয়া শেষ করো। আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। পরে খেয়ে নিব। ”

” আচ্ছা, যা ভালো মনে হয়। ”

এখানে বসে থাকলে দাদি খাওয়ানোর জন্য পাগল করে দিবে। তার চেয়ে ছাঁদে বসে কিছু সময় কাটিয়ে এলে মন্দ হয় না। শশুর আব্বু চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ হলো, যাওয়ার আগে পাঁচশ টাকার দুইটা নোট হাতে গুঁজে দিয়ে গেছে। দু’দিন পর নিতে আসবে, সাবধানে থাকতে বলেছে। আচ্ছা নিরবের কি আমার কথা মনে পড়ছে না? রোজ সন্ধ্যায় পড়তে বসলে অন্তত আমার কথা মনে করে উচিত। নিবর আমার সমবয়সী হলে সম্পর্কটা অন্য রকম হতে পারতো, কিন্তু রিতু? নিরব তো রিতুকে ভালোবাসে, কোন একদিন ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। আমার জীবনে কি ভালোবাসা আসবে না?

ছাদের এক কোণে মৃদুল দাঁড়িয়ে। লোকটার থেকে পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে হয়, সে সবসময় সামনে চলে আসে। মোবাইল কানের কাছে ধরে ওদিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখতে পায়নি, কারো সাথে কথা বলছে হয়তো।

” আর বলিস না, এখানে এসে দারুণ একটা মেয়ে পেয়েছি। হেব্বি দেখতে, তুই দেখলে পাগল হয়ে যাবি!”

” আরে না, মেয়েটা বিবাহিত। তবে আমার কোন সমস্যা নেই, নিজের কাজ হলেই হলো। ”

” কি যে বলিস! রাজি হবে না কেন? পটাতে পারলে বিবাহিত মেয়েরা খুব সহজে বিছানা পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু সবাইকে প্রেমের ফাঁদে ফেলানো সহজ নয়। বেশিরভাগ মেয়ে স্বামীর কাছে সৎ থাকতে চায়। ”

” জানি না, রাজি হবে কিনা! তবে ওকে আমার চাই, একদিনের জন্য হলেও চাই। বিছানা পর্যন্ত নিতে পারলেই ছেড়ে দিব।”

” চেষ্টা করতে থাকি। আমার এ ব্যাপারে যোগ্যতা কেমন তুই খুব ভালো করে জানিস। যদিও এখনও ওর আশেপাশে ভিড়তে পারিনি। ”

” হা হা হা, ভালো বলেছিস, খাওয়া জিনিস একটু খেয়ে দিলে কি আর হবে!”

মৃদুলের কথায় গা গুলিয়ে উঠলো। ওপাশ থেকে কি বলেছে শুনতে পাইনি। তবে মৃদুলের উদ্দেশ্য স্পষ্ট।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here