প্রদীপের নিচে আমি পর্ব ৪

0
441

#প্রদীপের_নিচে_আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

বাবার ডাকে কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ছেলেটার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়েছি। একি আমার হাত কাঁপছে কেন! যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি, পাছে বাবা কিছু বলে বসলে। চা দেওয়া শেষে রান্নাঘরে চলে এলাম। মায়ের সাথে রান্না করতে হবে। তখন হঠাৎ অমন অনুভব করছিলাম কেন? প্রেমে পড়লে নাকি এমন অনুভূতি হয়, যখন কাউকে প্রচন্ড রকমের ভালো লাগে। লোকটার চেহারা মনে দাগ কাটার মতো। জোড়া ভ্রু, চাপ দাঁড়ি, শ্যামলা বর্ণ, সবকিছু মিলে অদ্ভুত সুন্দর। যার দিকে ভুল করে চোখ পড়ে গেলে দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে করবে।

” কিসব ভাবছি বসে বসে? তাড়াতাড়ি কর, সকালের নাস্তা কি দুপুরে খাবে সবাই?”

” এই তো, রুটি বানানো শেষ। আর কি করবো?”

” একটু পায়েস রান্না কর। ছেলেটা পায়েস থেকে খুব ভালোবাসে। ”

” কোন ছেলে মা? বাবা তো পায়েস খায় না তেমন, শশুর আব্বুও ডায়াবেটিস। ”

” তোরও যা বুদ্ধি! তোর বাবা, শশুর এরা কি ছেলে আছে এখনও? বড় আপার ছেলে এসেছে, আগে কখনো এ বাড়িতে আসেনি। আমাকে নিজের মা’য়ের মতো সম্মান করে। ”

” ওহ্ আচ্ছা। ”

” কথা না বলে কাজ কর। বেলা আটটা বাজে। ”

তাহলে বসার ঘরে যাকে দেখলাম সে বড় খালার ছেলে। খুব সুন্দর উনি। পায়েস রান্না শেষের পথে, তখন থেকে উনার কথা ভাবছি। কি নাম হতে পারে লোকটার। বিবাহিত নারীর পর পুরুষের ভাবনায় ডুবে থাকা একদম অনুচিত, অ”ন্যা”য় কাজ। নিরবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলেও কি আমি এভাবে ভাবতাম? কিছু মানুষ অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী হয়। তাদের দেখে অন্যরা নিজের সাথে দ”ন্দে জড়িয়ে পড়ে।

মা সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে, উনাদের নিজের হাতে খাওয়াতে চায়। আমি রান্নাঘর পরিষ্কার করে গোসলে যাব। গোসলের পর খুব ফ্রেশ লাগে, ফ্যানের নিচে চুল খুলে বসে থাকা যায়। বাতাসে চুল ওঠে, কিছু চুল কপালে লেপ্টে থাকে।

” আপনি বুঝি বিয়েতে ভয় পান?”

পুরুষালি গলায় সামনের দিকে তাকালাম। উনি দাঁড়িয়ে আছে, কেমন অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। লোকটা অনুমতি না নিয়েই খাটের পাশে বসে পড়লো। মুচকি হেসে বললো,” আপনিই তো সানজিদা তাই না?’

” জ্বি আমি। ”

” শুনেছি আপনি বিয়েতে রাজি ছিলেন না। ”

” আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না এ কথা আপনি কি করে জানেন?”

” খালাম্মা বলেছিল। শেষ পর্যন্ত তো আমাকে কল দিয়ে বোঝাতে বললো। ছেলে নাকি খুব ব্যস্ত কথা বলার সময় নেই। ”

” আপনার কথার মানেটা ঠিক বুঝলাম না। ”

” বিয়ের আগে আপনি হবু বর ভেবে যার সাথে কথা বলেছিলেন সেই লোকটা আমি। খালাম্মা আমাকে আপনার হবু বর হিসাবে কথা বলতে বলেছিল। কি কি বলতে হবে তাও বুঝিয়ে দিয়েছিল, তবে আমি বেশকিছু কথা বাড়িয়ে বলেছিলাম। আপনার কন্ঠ খুব চমৎকার! ”

চমকে উঠলাম। বিয়ের আগে নিরব ভেবে যে লোকটার সাথে কথা বলেছি সে নিরব না, এই লোকটা । বিয়ের পরে অবশ্য বুঝেছিলাম সেদিন নিরবের সাথে কথা বলিনি। নিরবের গলার স্বর অমন গম্ভীর নয়। কিছুটা বাচ্চাদের মতো। কিন্তু মা কেন এই লোকটাকে দিয়ে কথা বলাবে? হয়তো বিয়েতে রাজি করানোর জন্য, নিরবের কন্ঠ শুনলে ওদের চালাকি ধরে ফেলতাম। বয়সে ছোট বলে সমস্যা শুরু করতাম, তখন আবার ঝামেলা হতো। তবে কি কি বাবা-মায়ের কাছে বোঝা হয়ে গেছিলাম? নাকি অন্য কোন কারণ আছে।

” কি হলো? চুপ করে আছেন যে। ”

” না এমনই। ”

” আজ আপনাকে দেখে আফসোস হচ্ছে। সত্যিই যদি সেদিন হবু বর হতাম!”

” মাস খানেক হলো আমার বিয়ে হয়ে গেছে। শশুর বাড়িতে ছিলাম, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

” হ্যাঁ, খালার কাছে শুনেছি। আপনি স্বামী সংসার নিয়ে খুব সুখে আছেন। তবে আজ থেকে আমার সুখের দিন শেষে, হয়তো আর ভালো থাকা হবে না। ”

” ঠিক বুঝতে পারলাম না। ‘

” যতোটা অবুঝ সাজেন ততো অবুঝ আপনি নন। ”

লোকটা উঠে চলে গেল। হঠাৎ এমন কেন লাগছে, গলা শুকিয়ে গেছে, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। যাই একটু পানি খেয়ে আসি। ঘরের কোথাও পানি নেই, কি য’ন্ত্র’ণা! এখন টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে হবে। কলস নিয়ে কলপাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। টিউবওয়েল বেশ দূরে, বাগানের ওদিকটায়, প্রয়োজন ছাড়া কেউ সেদিকে যায় না। হেঁটে যেতে মিমিট চারেক সময় লাগে।

” সত্যি করে বলেন তো কি মতলব আপনার? সানজিদাকে নিয়ে এ বাড়িতে আসার কারণ কি?”

মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছি। কেমন শ্যাওলা পড়েছে সবদিকে, পিচ্ছিল হয়ে আছে। হঠাৎ বাবার গলায় সামনের দিকে তাকালাম। টিউবওয়েলের ওপাশে বাবা আর শশুর আব্বু দাঁড়িয়ে, হাসনাহেনা ফুলগাছটার জন্য দূর থেকে চোখে পড়ছিল না। বাবা কি বলতে চাইলো, আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে মতলব লাগবে কেন? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যাই, কথাগুলো শোনা গুরুত্বপূর্ণ। শশুর আব্বু বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, শান্ত চেহারা। বাবার কপাল কুঁচকানো, চিন্তার ভাজ পড়ছে।

” আপনার মেয়ে আপনাদের দেখতে চেয়েছিল তাই নিয়ে এসেছি। এর বাইরে কোন মতলব নেই। ”

” বলেছিলাম ওঁকে এ বাড়িতে আসতে দিবেন না, কিন্তু আপনি তো মশাই নিজেই সাথে করে নিয়ে এসেছেন। ”

শশুর আব্বু শান্ত ভাবে পকেটে হাত ঢুকালো। একহাজার টাকার একটা বান্ডিল আব্বু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এমন আসা-যাওয়া থাকবে। এর জন্য আলাদা পারিশ্রমিক পাবেন। সবকিছু এতো সহজে সম্ভব হয় না। ”

বাবা কিছু না বলে টাকাগুলো পকেটে রেখে দিল। দাঁড়াতে পারছি না, মনে হয় পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। এসবের মানে কি? বাবা কি আমায় বিক্রি করে দিয়েছে? কি কাজের জন্য আমাকে উনারা ছেলের বউ করেছে? ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করি, এসব কি? কিসব বলছেন আপনি? কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। এলোমেলো পায়ে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলাম। ঘর পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবো তো, নাকি এখানে পড়ে যাব। শরীরটা অবশ হয়ে আসছে কেন? কিসের এতো জড়তা আমার? কিসের এতো ভয়?

” আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? ”

চোখের সামনে উনি দাঁড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট গলায় বললাম, ” আমাকে রুম পর্যন্ত দিয়ে আসবেন? শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে। ”

লোকটা আমার হাত ধরে ঘর পর্যন্ত দিয়ে এলো। আমি উনার কাছে সাহায্য চেয়েছি ঠিক তবে এতোটা ভাবতে পারিনি। ছোট বেলা থেকে একটা অসুখ আছে, প্রচন্ড ভিতু আমি। যে কোন ব্যাপারে অতিরিক্ত রিয়াক্ট করে ফেলি। বাবা ডাক্তারও দেখিয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি। সামান্য কিছু হলেও মস্তিষ্কে খুব বেশি প্রভাব পড়ে। অনেক কাছে এটা নেকামো কিন্তু ইচ্ছে করে এমন করি না।

বিছানার এক কোণায় কপাল চেপে ধরে বসে আছি। আমাকে স্বাভাবিক হতে হবে, অনেক প্রশ্নে উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। উনি এক গ্লাস পানি আমাকে দিকে এগিয়ে দিলেন, কোমল গলায় বললেন, ” পানি খেয়ে নিলে কিছুটা ভালো লাগবে। ”

” ধন্যবাদ। কিন্তু ঘরে তো পানি ছিল না, কোথায় পেলেন?”

” টিউবওয়েল থেকে নিয়ে এসেছি, এজন্য এতো দেরি হলো। পানি খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম করুন। ”

এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করে, গ্লাসটা বিছানার কোণায় রেখে দিলাম। কিছু সময় ঘুমানো দরকার, ঘুমালে মস্তিষ্ক স্বচ্ছ হয়।

বেলা বারোটা। সূর্যের তাপে পৃথিবীর উত্তাপ বাড়ছে, গরমে সারা শরীর ভিজে একাকার। সকালে গোসল করেছিলাম, এখন আবার গোসল করতে পারলে খুব ভালো লাগতো। ঘুমানোর কারণে বেশ ভালো লাগছে। জীবন নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, কিনারা খুঁজতে হবে নয়তো ডুবে ম”র”তে হবে। বিয়ের পিছনে খুব বড় রহস্য লুকিয়ে আছে। বাবা আমাকে বি”ক্রি করে দেয়নি তো?

” দিদিভাই, বিয়ে হয়ে তো বুড়িটাকে ভুলেই গেছিস!”

” আরে দাদি, তুমি কখন এলে? দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো। ”

” এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে, তুই ঘুমচ্ছিলি তাই বিরক্ত করিনি। ”

” ভালো হয়েছে, খেয়েছ কিছু? চা করে দিবো?”

” ব্যস্ত হতে হবে না, এখানে আমার পাশে বস তো, কয়েকটা কথা বলি। ”

” তোমাকে খুব খুশি লাগছে, কি হয়েছে? ”

” তোর বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। শুনেছি স্বামীর সাথে খুব ভালো আছিস, তোর শশুর আবার তোকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। এসব দেখলে মন ভরে যায়। ”

” আজ কিন্তু আমার কাছে ঘুমাবে। ”

” হ্যাঁ বাপু হ্যাঁ। ঘুমাবো। ওকি! বউমা আবার তোকে ডাকাডাকি করছে কেন?”

” কি করে বলি বলো তো, গিয়ে দেখছি। হয়তো দুপুরের রান্না করতে হবে। ”

” আচ্ছা যা, দেখ গিয়ে। আর ভালো লাগে না। ”

” এই দেখ, বাচ্চাদের মতো করছ কেন? আজ সারারাত তোমার সাথে গল্প করবো, এখন যাই। ”

দাদিকে রেখে মা’য়ের কাছে গেলাম। খুব খুশি লাগছে, একমাত্র দাদির কাছে থাকলে নিজেকে নিরাপদ মনে হয়, মা বাবা তো কথায় কথায় রাগারাগি করে আর মা”রে। বিয়েতে রাজি হচ্ছিলাম না বলে মা খুব মে”রে”ছি”ল। দুপুরের জন্য পোলাও-গোশত রান্না করতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে রান্না শুরু করলাম। কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছি, কিন্তু কি ভাবছি বুঝতে পারছি না। কোন রহস্য লুকিয়ে আছে জীবনে? রহস্য উন্মোচন হলে নিজেকে সামলাতে পারবো তো? নাকি কোনদিন জানতেই পারবো না, কি লুকিয়ে আছে ২৪ বছরের জীবনে!

সবেমাত্র সন্ধ্যে নেমেছে। ধরনীর বুকে আঁধার নেমে আসছে, আঁধার রাতকে বরণ করে নিতে হাজির হয়েছে সন্ধ্যাতারা। আবছা আলোর মাঝে জ্বলজ্বল করেছে, নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কারো পায়ের শব্দ কানে লাগছে, কে আসছে ছাঁদে?

” তারা দেখতে ভালো লাগে ? ”

” জ্বি, খুব ভালো লাগে। আপনার নামটা এখনও জানা হয়নি। ”

” মৃদুল হাসান। দুইটা নাম, যা ইচ্ছে তাই বলে ডাকতে পারেন। চাইলে নিজের পছন্দসই কোন নাম দিতে পারেন। ”

” আমি সানজিদা। ”

” সুন্দর নাম, এ নামের অর্থ কি?”

” জানি না। ”

” কখনো উপন্যাস পড়ছেন? বা গল্পের বই?”

” তেমন পড়া হয়নি, পথের পাঁচালী নামে একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। অনেক কেঁদেছি, তারপর আর সাহস করিনি। ”

” কোমল হৃদয়ের অধিকারী। বেশ ভালো! মেয়েদের হৃদয় হবে কোমল, ফুলের মতো। কোন কাঁটাযুক্ত ফুল, এই যেমন গোলাপ অথবা পদ্ম।”

” হয়তো বা। ”

” আপনি কথা বলতে পছন্দ করেন না বুঝি? আমার কিন্তু আপনার কথা শুনতে বেশ ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় আজীবন এই কন্ঠের আওয়াজ শুনে যাই, অবাক দৃষ্টিতে ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ”

” এসব কি বলছেন? আমি বিবাহিত। ”

” আমি জানি আপনি বিবাহিত। আফসোস সেদিন যদি কল না দিতাম। তবে আমি আপনাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছি না, শুধু হৃদয় মাঝে জেগে ওঠা কথাগুলো জানাচ্ছি। আপনি শুনতে না চাইলেও বলবো। ”

লোকটা কেমন অদ্ভুত। নিরবের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ওই নামেই, তবুও উনাকে এড়িয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। পাবো না জেনে কারো মায়ায় জড়াতে চাই না, সহ্য করতে খুব কষ্ট হবে। মৃদুলের কাছাকাছি থাকতে বেশ ভালো লাগছে, জীবনে প্রথম কেউ এভাবে কথা বলছে। আবার খুব ভয় হচ্ছে, যদি মায়ায় পড়ে যাই!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here