প্রণয় ডায়েরি পর্ব-২০

0
342

#প্রণয়_ডায়েরি
#Tafsia_Meghla
#পর্বঃ২০

অপরাহ্নের তখন অন্তিম কাল চলছে৷ রক্তিম অন্তরিক্ষ তখন আঁধার ছেয়ে গেছে৷ আজান পরেছে সেই কখন গধুলি পার হলো৷ মন ক্ষুণ্ণ হয়ে আছে সে কখন থেকেই বড়রা কথা বলছে৷ তিশানো এসেছে, তিশানের আসাটা মেঝো চাচি ভালো চোখে দেখছে না এখানে এসে কয়েকবার কটুক্তি করে গেছে৷
সবার কথা বলছে আমার রুম থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে৷ সবার কথার মাঝে মেঝো চাচি বিঘ্ন ঘটিয়ে উগ্র কন্ঠে বলেন,
“এক বাড়িতে দুই মেয়ের বিয়ে কিভাবে হয়? তাফসি কে তো অন্য রকম ভাবতাম সে তলে তলে বোনের দেবরের সাথে প্রেম করছে জানতাম ও না বাহ৷ ”
মেঝো চাচির কথায় অতি বিরক্তি কন্ঠে মেঝো চাচা বলে,
“এখানে এসব উঠছে কেন? ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে কখনো করেনি মানে এই না করবে না৷ ওদের বুঝার ক্ষমতা হয়েছে তা ছাড়া তাফসি কিন্তু একবারো বলেনি আমাদের মতের বাইরে যাবে তবুও ওকে টানছো কেন তুমি?”
চাচির কথায় ভয় ঝেকে বসলো মনে, আমি এ ভয়টাই পাচ্ছিলাম৷ কি হবে? হাত পা যেন আসাড় হয়ে এলো৷ লজ্জাও বাড়লো পরিবারের সামনে নিজের প্রেমের আলাপ শুনে লজ্জা লাগছে৷ কি হবে তা ভেবে বুকটা কেমন টন করে উঠলো৷
হঠাৎ আমার এতো লজ্জা আর ভয়ের অবসান ঘটিয়ে মোবাইলটায় মৃদু আওয়াজ হলো৷ ম্যাসেজ এসেছে৷
ম্যাসেজ টা দেখেই ক্ষুণ্ণ মন কিঞ্চিৎ ভালো লাগা কাজ করলো৷
সে ম্যাসেজ দিয়েছে সারাদিন পর৷
“ভয় পাবেন না চাঁদ৷ আমাদের প্রেম প্রহর সমাপ্তি ঘটিয়ে পরিণয় প্রহরের গণনা শুরু করে দিন৷”
তাঁর বার্তায় থমকালাম,অবাক হলাম৷ ওষ্ঠজোরায় এক চিলতে হাসি ফুটলো অজান্তেই৷ ‘পরিণয়’ তাঁর আমার ‘পরিণয়’ ঘটবে? হবো আমি তাঁর সে আমার? মানুষ টা কে এখনো ‘ভালোবাসি’ বলে উঠতে পারলাম না৷ না পেরেছে সে কিন্তু দু-জন এক হওয়ার কথা চলছে৷ শুভ পরিণয় এর কথা চলছে কি অদ্ভুত না?
সবার ভালোবাসার ধরণ এক হয় নাকি? আমাদের টা না হয় একটু ভিন্ন হলো? খুব তো ক্ষতি হবে না৷
চাচার কথায় চাচি চুপ রইলো৷ চাচার কথার মাঝেই আরাভ ভাইয়ার বাবার কন্ঠ পেলাম সে বলছে,
“এক বাড়িতে কোথায়? স্বর্না মা আমার বাড়িতে যাবে আর তাফসি আমার ভাইয়ের বাড়িতে এখানে সমস্যা তো দেখছি না? এমন তো নয় তাফসি মা কে আমরা আমার কোনো ছেলের জন্য নিয়ে যেতে চাইছি৷ আর যদি এমনটা হতো ও সমস্যা আমি দেখছিনা আমাদের বাড়িতে এসব নিয়ে কখনোই কোনো ঝামেলা হতো ও না৷”
আরাভ ভাইয়ার বাবা-র কথা শুনে ভালো লাগলো৷ এ কথায় হয়তো আমার চাচি বুঝবে না সে তাঁর কথাই বলে যাবে তাকে ভালো করে চেনা আছে আমার৷ কখনোই বুঝে না সহজ ভাবে কোন কিছু৷
আরাভ ভাইয়ার বাবা-র কথা শুনে আমার বাবা গলা খাকারি দিয়ে বলেন,
“সব মেনে নিলাম পরিবার নিয়ে ঝামেলা নেই আমার৷ তাফসি আর স্বর্না বন্ধু সুলভ ওদের সমস্যা হবে না৷ কিন্তু কথা হলো তিশান তো বেকার৷ বাবা মায়ের যতই থাকুক বেকার ছেলের কাছে কোন ভরসায় আমার মেয়ে কে বিয়ে দিবো?
শশুরের আর ভাসুরের টাকা খাবে নাকি আমার মেয়ে?”
বাবার কথায় ভয় টা বাড়লো৷ তাহলে কি বাবা মানবে না?
হঠাৎ তিশানের গলা পেলাম সে বলছে,
“আংকেল ওকে আমি ভালো রাখবো৷ কাজ করবো আমি বিয়ের পর”
তিশানের কথার প্রেক্ষিতে বাবা গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
” আমি আমার মেয়েকে বেকার ছেলের হাতে দিবো না৷ দুঃখিত৷ ভাইয়ের শশুর বাড়ি এসেছো থাকো খাও আড্ডা দাও আমার মেয়ের কথা ভেবো না৷ এ নিয়ে আমি আর কথা চাই না৷ তা ছাড়া ভাবি ঠিকই বলেছে এক বাড়িতে দুই মেয়ে সম্ভব না৷ আমার সমস্যা না হলেও মানুষ এটা নিয়ে কটুক্তি করতে ছাড়বে না৷ ”
বাবার কথায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো আমার৷ শরীরে কম্পন শুরু করে দিয়েছে এই বুঝি পরে যাবো৷ কোনো মতো বসলাম আমি বিছানায়৷ সকালে তো ঠিক ছিলো তাহলে এখন আবার এসব কেন বলছে বাবা? তাহলে কি সত্যি এখানে সব শেষ?
তিশান কে ছাড়াতো আমি অন্য কথা ভাবতেও পারি না৷ বাবার কথাও ফেলতে পারবো না৷ চোখ গুলো ঝাপসা হয়ে এলো আপু আমার হাত ধরলো৷ অতঃপর আস্বস্ত কন্ঠে বলেন,
“তাফসি কান্না করিস না বোন৷ ঠিক হয়ে যাবে সব তিশান কে তো চিনিস ও ঠিকি কিছু না কিছু করে চাচা কে মানাবে৷ ”
আপুর কথায় শান্ত হতে পারলাম না৷ জানি বাবার কথাই শেষ কথা বাবা কথার নড়চড় করবে না৷
অভিমান জমলো৷ তীব্র অভিমান৷ সকালে আমার অনুভূতি পূর্ন মন টা কে আশা না দিলেই পারতো বাবা৷
আবার তিশানের থমথমে কন্ঠস্বর পাওয়া গেলো সে বলছে,
“আকদ টা হয়ে যাক না হয়? আমি চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ও আপনাদের বাড়িতেই থাকুক৷ ”
“না৷ ”
বিনা সংকোচে বাবার নির্লিপ্ত উত্তর৷ এখন তো পুরো পুরি অসহায় লাগছে আমার৷ কি হবে এরপর? তিশানের কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ও রেগে যাচ্ছে৷ রাগের বসে বাবা কে কিছু বলে না দেয় আবার এই ভয়ই করছে আমার৷
বেশক্ষানিক্ষণ পর ডাকলো আমায় স্বর্নাপু আমার মুখ মুছে দিয়ে মুচকি হেসে বলেন,
“তাফু চাচা হয়তো তোর মতামত জানতে চাইবে৷ তুই হ্যাঁ বলিস বোন তাহলে দেখবি চাচা আর দ্বিমত করবে না৷ ”
আপু কথার প্রতি উত্তরে আমি শুধু হাসলাম৷ না চাইতেও৷ নিজেও জানি না বাবা আমায় কেন ডাকছে আর কি জিগ্যেস করবে আর তার উত্তরই বা দিবো কি আমি?
আপু আমায় বসার ঘরে নিয়ে এলো চোখাচোখি হলো তিশানের সাথে৷ সে আমায় চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বললো আদৌকি নিজের মন কে শান্ত করতে পারবো আমি?
বাবা আমায় তার পাশে ডেকে বলে,
“আম্মাজান এখানে এসে বসো৷ ”
বসলাম আমি তাঁর পাশে৷ বাবা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
“শুনেছো নিশ্চয়ই সব? তোমার কি মতামত আম্মাজান?”
আমার মতামত কি তা আমি নিজেও জানি না৷ একবার মনে হচ্ছে রাজি হবো আরেকবার ভাবছি বাবা যা বলবে তাই হবে৷ কি করবো আম? কি করে এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠবো?
তিশান আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে ও আমার উত্তরের আসায় বসে আছে সবার দৃষ্টি এখন আমার পানেই আমি জ্বরতায় ভুগছি কি করা উচিত আমার? ভালোবাসার জন্য বাবা মা কে কষ্ট দিবো? যারা আমাকে দুনিয়া দেখিয়েছে যারা আমাকে চলতে শিখিয়েছে বলতে শিখিয়েছে৷ যাদের ছায়াতলে আমার বসবাস যাদের দ্বারা আমি৷ তাদের কষ্ট দিবো?
কিন্তু তিশান? তাকে ছাড়াও অন্য কিছু আমি ভাবতে পারি না তাকে ছাড়া আমি শূন্য৷
মন মস্তিষ্কর সাথে কেমন যুদ্ধ চালাচ্ছি একবার৷ মস্তিষ্ক বলছে হ্যাঁ বলতে মন বলছে না৷
কি করবো? কারো প্রতি আমি অন্যায় করতে চাচ্ছি না আমি যে নিষ্ঠুর নই আমারো কোমল একটা হৃদয় আছে৷ এতো বড় সাদ্ধান্ত তারা আমার উপর চাপিয়ে দিলো আমি কি করবো?
মন মস্তিষ্ক দুটোই শান্ত করলাম অতঃপর দুটো থেকে একটা বেছে কাঠকাঠ কন্ঠে উত্তর দিলাম,
“আব্বু তুমি যা চাও তাই হবে৷ ”
কষ্ট হচ্ছিলো আমার এইটুকু সহজ শব্দ বলতে৷ গলা কাঁপছিলো বুকটা যন্ত্রনায় মিইয়ে গেলো৷
কথা গুলো শুনতে সহজ হলেও এ কথাটার ওজন যে কয়েক টন বেশি তা কথাটা বলার সময় বুঝেছি৷ গলাটা যেন কেউ চেপে ধরেছিলো এই বুঝি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এখানে আমার প্রান টা হারাবো৷
বুকটা কেমন অদ্ভুত ব্যাথায় ছেয়ে আছে হাত পা আমার আসার হয়ে গেছে৷
তার সাথে বিনা আমন্ত্রণেই এক ফোটা অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যহীন মুক্তার ন্যায় নেত্র থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো কৃত্রিম ওই মাটিতে৷
স্নায়ু যেন ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দিলো তিশানের দিকে না চাইতেই অবাধ্য নেত্র দৃষ্টি চলে গেলো সে ও মাথা নিচু করে আছে৷
রাগ হয়েছে আমার উপর? হলেই বা কি? সে রাগ তো আমি ভাঙাতেও পারবো না৷ আমাদের প্রেম প্রহরের সমাপ্ত ঘটলো এখানেই৷ তবে প্রণয় শেষ হবে না হয়তো কখনোই পাল্লা দিয়ে প্রগাঢ় হবে, নিবিড় হবে৷ থমকে গেলো সব বেহায়ার মত তাকিয়েই রইলাম তাঁর পানে আজ না হয় একটু বেহায়াই হলাম ক্ষতি কি? কে যানে আর তাঁর সাথে দেখা হবে কি না? প্রণয় ডায়েরি অপূর্ণই রয়ে গেলো……….


নিজের অপূর্ণ প্রণয় ডায়েরিটা শেষ পাতা লিখে শেষ করলো তাফসি৷ সে দিনের পর আজ দশ দিন কেটে গেছে এ দশ দিন কোনো ভাবেই দেখা হয়নি কথা হয়নি তাঁর তিশানের সাথে৷
আজ কতদিন হলো তাঁর পাগলটার কন্ঠ শুনতে পায় না৷ তাহলে কি এই ডায়েরিটার মতই ওদের প্রণয় অপূর্ণ রয়ে যাবে? সদ্য অনুভূতিতে পরপূর্ন মন টা না ভাঙলেও পারতো ওর বাবা৷ অভিমান হয় বাবার ওপর ওর কিন্তু তা প্রকাশ করে না কখনোই৷ বাবা তো? হয়তো যা করেছে ভালোর জন্যই?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here