প্রণয় ডায়েরি পর্ব-১৯

0
362

#প্রণয়_ডায়েরি
#Tafsia_Meghla
#পর্বঃ১৯

দ্বিপ্রহর চলছে রৌদ্রজ্জ্বল চারোপাশ৷ ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে৷ ঠান্ডা মিষ্টি বাতাস বইছে৷ রৌদ্রত্তাপেও ঠান্ডায় হীম হয়ে আসছে শরীর, আম্মু একটা কালো ড্রেস ধরিয়ে দিয়ে গেলো বিকেলে পরার জন্য৷
আপুরা আমার রুমেই বসে আছে স্বর্না আপু আরাভ ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলো৷ ফোন টা রেখে মিষ্টি হেসে বলে,
“তারা আসছে৷ ”
এ কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র সেই অদ্ভুত অনুভূতিরা হানা দিলো আমায়৷ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো সন্তপর্ণে৷ শরীর যেন শিউরে উঠলো কিছু যেন টানছে আমায়৷ বুকটা কেমন টিপ টিপ করছে৷ হৃদস্ফন্দন বাড়ছে ক্রমশ৷ এমন লাগছে কেন?
এ অনুভুতি যেন সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে প্রগাঢ় হচ্ছে, নিবিড় গভীর৷ মধুর যন্ত্রনাচ্ছন্ন এ অনুভুতি নিয়ে কি করবো আমি? লজ্জার আভা যেন বিনা নিমন্ত্রণে নিমজ্জিত হচ্ছে৷
আপু নিঃশব্দে হাসলো৷ তাঁর হাসির কারণ বুঝলাম না কিন্তু তাঁর হাসি যেন আমার লজ্জাটাকে আরো নিঙরে দিচ্ছে৷
স্বর্না আপু আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো সন্তপর্ণে অতঃপর প্রসন্ন কন্ঠে বলেন,
“ছোট বোন হয়েও বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো ছিলি৷ তোকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে সেখানে ভাবছিলাম. আল্লাহ আমার মন খারাপ নিমেষে খুশিতে পরিনত করলো রে পুচকি৷ ভাগ্যক্রমে আমরা একই বাড়িতে যাবো৷ আমার পুচকি, আমাদের পুচকি বড় হয়ে গেছে৷ তাঁরো নাকি এখন বিয়ে হবে৷
বিশ্বাস কর পুচকি অন্য কোথাও হলে কান্না করে ভাসাতাম আমি কিন্তু তুই তো আমার কাছেই যাবি৷ এক সাথে থাকবো৷ নতুন সম্পর্কে জরাবো আমরা৷”
বলে আমার গালে হাত দিয়ে কপালে সন্তপর্ণে চুমু খেলো৷
হঠাৎ হাসি হাসি পরিবেশটা নিমেষে বিষন্ন করে তুললো আমার ছোট বোন সে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আব্বু কি রাজি হবে আপু? মানলাম সকালে একটু হেসে কথা বলছে৷ তা ছাড়া চাচারা চাচিরা রাজি হবে? তাসনিম আপুর বিয়ে হয়নি এখনো৷ ”
অনুভুতিতে পরিপূর্ণ মন টা নিমেষেই মন খারাপে পরিনত হলো৷ মুখশ্রী তে নেমে এলো মেঘের ছায়া৷
সত্যি তো মানবে সবাই? কি হবে বিকেলে? আম্মুর মুখ টা সকাল থেকেই থমথমে৷
এর মাঝেই তাসনিম আপু আশ্বাস দিয়ে প্রসন্ন কন্ঠে বলে,
“আরে কেউ রাজি হবে না কেন? এমনতো নয় আমার বিয়ের জন্য দেখছে কিন্তু হচ্ছে না৷ আমি বললেই রায়ান ফেমিলি নিয়ে আসবে কিন্তু আমি তো এখন বিয়েই করবো না এক বছর পর ডাক্তারি পড়তে দেশের বাইরে চলে যাবো৷ তাহলে কি পুচকি কে এতো দিন বিয়ে দিবে না? আমি কবে না কবে লন্ডন থেকে আসবো কবে আমার বিয়ে ঠিক হবে কবে বিয়ে করবো সেই ভেবে কি পুচকি কে বসিয়ে রাখবে নাকি? এসব চিন্তা করিস না অযথা৷”
আপুর কথায় সবাই আশ্বস্ত হলেও আমি হতে পারলাম না মনের মাঝে ভয় টা রয়েই গেলো৷
কি হবে তখন কে যানে?
বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ নিচে চোখ পরতেই মাহতাব ভাইয়াকে দেখলাম৷ তাঁর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো সে চোখ নামিয়ে নিলো আমার আগেই৷ আমিও চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালাম৷
লোকটাকে কেন যানি এখন আর সহ্য হয় না৷ এতো বাড়াবাড়ি না করলে এমনটা হতো না৷ সব বিষয়ে বাড়াবাড়ি তাঁর৷
আজ সারাদিন মাহতাব ভাইয়াকে দেখিনি এখনি দেখলাম সারাদিন আসেনি হয়তো৷ হঠাৎ ভাইয়ার গলা পেলাম মাহতাব ভাইয়া হৃদয় ভাইয়ার ঘরে এসেছে৷ আমার বারান্দা দিয়ে ভাইয়ার রুমের সব সরাসরি দেখা যায় পাশাপাশি বিল্ডিং তাই৷ আর আমার পাশের বারান্দা ওয়ালা রুমটাই হৃদয় ভাইয়ার৷
ভাইয়া মাহতাব ভাইকে বলছে,
“তুই এলি যে?”
“আসতে মানা করছিস?”
তাঁর কন্ঠে বিষন্নতা৷ মাহতাবের প্রশ্নে ভাইয়া বললো,
“এমন করে বলছিস কেন? তুই তো আমাদের বাড়িরি একজন৷ ”
“হুম তাই তো তোর বোন এমন করলো৷ এমন করে কষ্ট টা দিলো৷”
তাঁর কন্ঠে তাচ্ছিল্যতা৷ বুঝলাম না তাঁর কথা সে প্রতিবার আমার দোষ দিচ্ছে কেন? সেই ছোট বেলা কি না কি বলেছি তা নিয়ে সে কেন বসে আছে? অবুঝ নাকি সে?
ভাইয়া বললো,
“ভুল করছিস মাহতাব৷ রাগ করিস না এ ও বলিস না বোনের সাপোর্ট করছি৷ তোর হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো তোকে অনেকবার বলেছি বলেদে বলেদে৷ বলেছিলি? আমি চাইলেই এ বিয়ে টা আটকে দিতে পারি৷ ”
থামলো ভাইয়া রুহ কেঁপে উঠলো ভাইয়ার কথায়৷ অতঃপর সে দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলেন,
” চাইলেই আমি পারতাম তোর হাতে আমার বোন কে তুলে দিতে৷ ও টু-শব্দ করতো না৷ কিন্তু আমি আর চাই না৷ ভালোবাসে ও সে ছেলেকে৷ তোকে কম সুযোগ দিয়েছি বল? ভাই হয়ে তোকে বলেছি যা আমার বোনকে তোর মনের কথাটা বল৷ চাচাতো বোন হলেও ওদের আমি আপন বোনের মত আগলে রেখেছি তুই ভালো করেই জানিস আমার বোনেরা আমার জান তবুও তোর ব্যাপারে আপশ করিনি৷ কিন্তু তুই ব্যাপারটা প্রতিবার এড়িয়ে যেতিস এখন দেবদাশ হয়ে ঘুরছিস আমার বোনের দোষ দিচ্ছিস? আরে তুই তো বুঝতেও দিসনি ওকে তুই যে ওকে ভালোবাসিস৷ কিন্তু ওই ছেলে তিশান? তাঁর পাগলামো দেখেছি তুই নিজেও বলেছিস অনেক কথা মাঝরাতে আমার বোনকে দেখার বেকুলতা ওদের বাড়িতে ওর পাগলো নিজের চোখে দেখেছি৷ ভালোবাসি বললেও ভালোবাসা হয় না৷ কাজের মাঝেও বুঝিয়ে দিতে হয়৷ যা করেছে ওই তিশান৷”
বলে থামলো ভাইয়া৷ ভাইয়ার কথাটা মন ছুয়ে গেলো৷ সত্যি ভালো লাগলো অনেকটা৷ উনি শুধু বন্ধু কে নয় বোনকে ও সাপোর্ট করলো৷
হঠাৎ মাহতাব ভাইয়ার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো কেমন খারাপ লাগা কাজ করলো সে কান্না করছে? আমার জন্য? লোকটা আমাকে এতো ভালোবাসে? কই কখনো বলেনি তো?
সে ভাঙা গলায় বলছে,
” পারছিনা আমি হৃদয়৷ ভিতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেল ভাই আমায় মেরে ফেল৷ তখন হয়তো তোর কথা শুনলে আজ এমন হতো না৷
আমি বাইরেটা আর সবার সামনে শক্ত রাখতে পারছি না৷ এই মাহতাব প্রথম এমন বাজে ভাবে হেরে গেলো৷ আমি চাইলেও আর কিছু করতে পারবো না৷ আমি পারতাম তোর বোন কে তুলে এনে আমার কাছে রাখতে কিন্তু সে ক্ষমতা থাকলেও তেমন হৃদয় আমার নেই রে আমার চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট পেতে দেখা আমার সাধ্যি নেই৷ তোর বোন যে ভালোবাসে ওই ছেলেটাকে৷ ভালোবাসে তাই হেরে গেলাম৷ ”
থমকালাম আমি তাঁর কথায়৷ হুম সত্যি যে ভালোবাসি আমি তিশান কে ওকে ছাড়া আমি নিষ্প্রাণ হয়ে যাবো৷ বাচা দায় হয়ে পরবে৷
শান্ত হলো পরিবেশ স্বর্নাপু সবটা শুনেছে আমার সাথে দাঁড়িয়ে৷ বেশক্ষানিক্ষণ পর ঠান্ডা কন্ঠ ভেসে এলো মাহতাবের সে বলছে,
“আল্লাহ হয়তো আমার জন্য বেস্ট কাউকে বেছে রেখেছে৷ সে দিনের জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিলাম আগলে নিলাম৷ ”
সে থামলো অতঃপর দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলেন,
“আল্লাহ সবার জন্য কাউকে না কাউকে বেছে রাখেন৷ যে নিবিড় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে তাকে৷ কিন্তু প্রথম ভালোবাসা তো প্রথমই? যার প্রতি নিবিড় ভালোবাসাটা থেকেই যায় মনের অন্দরে৷ প্রকাশ্যে নয় আড়ালে আবডালে রয়ে যায় সর্বকাল সর্ব সময়৷ মাঝে মাঝে তা একাকিত্বটা ঘুচিয়ে স্মৃতির পাতায় নিমজ্জিত হয় নিজ দায়িত্বে৷ আবার কখনো বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস হয়ে৷ ”
তাঁর কথাটা ভালো লাগলো৷ যাক সে বুঝতে পেরেছে এই অনেক৷ নিজেকে যে বুঝিয়ে নিয়েছে নয়তো এ কারণে নিজেকে অপরাধী মনে হতো৷
দ্বিপ্রহর গড়িয়ে অপরাহ্নের সূচনা হলো৷ তারা এসেছে কালো জামাটা অঙ্গে ধারণ করলাম৷ অতঃপর বারান্দায় এসে ফের দাঁড়ালাম রোদ্র তখন আর ঝলমলে নয়৷ তার উত্তাপ হ্রাস করেছে৷ অন্তরিক্ষ তখন আবছা রক্তিম৷ আমার লজ্জায় সূর্যটা বুঝি লজ্জা পেলো তাইতো সে ও লুকিয়ে পড়লো একটুকরো ধুসর মেঘের আড়ালে৷ আর সেই সূর্যের এমন লজ্জায় চারোপাশ নিমজ্জিত হলো সুশ্রী রূপে৷ যেন কোনো শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলেছে কৃত্রিম রঙে৷ কিন্তু না এ যে সৃষ্টিকর্তার অকৃত্রিম মাধুর্যতা৷

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here