#প্রণয়_ডায়েরি
#Tafsia_Meghla
#পর্বঃ১৫
ধরনিতে তখন প্রভাত নেমেছে৷ সূর্যটা ঝলমল করছে সোনার ন্যায়৷ ঘড়ির ঘন্টার কাটা তখন ছয়টার কোঠায় আর মিনিটের কাটা টা বারোর ঘরে, সেকেন্ডের কাটা ঘুরছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে৷ আলসে শরীর টা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম৷ আজ কাল ঘুম যেন তাড়াতাড়ি ভেঙে যাচ্ছে আর মন হয়ে উঠেছে প্রকৃতির প্রেমে ব্যাকুল৷ তা যদি আমার প্রেমিক পুরুষ যানে মেনে নিবে তো? হাসলাম আমি নিজের ভাবনায়৷ আজ কাল মাথায় বাচ্চাসুলভ ভাবনা আসে৷
কাল ছাদের থেকে আসার পর কারো সাথেই তেমন কথা বলিনি তিশান ও আর ফোন করেনি৷
হয়তো রেগে আছে? কে যানে তাঁর মনের কথা? হুটহাট কি হয়৷
বারান্দা থেকে বেড়িয়ে রুমে এসে মুঠোফোন টা হাতে নিয়ে বসলাম৷ ফোন করবো কি করবো না ভাবছি এতো সকালে কি সে উঠেছে?
না ধৈর্য ধরতে পারলাম না সাত পাঁচ না ভেবে ডায়াল লিস্টে গিয়ে নাম্বার টা ডায়াল করেই দিলাম৷ কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেলাম নিমেষেই মন টা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো৷
ফোন বন্ধ কেন? লোকটা কি রেগে ফোন বন্ধ করে রেখেছে? রাগ হলো মাহতাব ভাইয়ার উপর৷ লোকটা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করে৷
বিষন্ন মন নিয়ে সমরেশ মজুমদার এর “সাতকাহন” বই টা নিয়ে বসলাম৷ এই সাতকাহন কি আমার মনের বিষন্নতায় দুর করতে পারবে?
লোকটা আমার সব কিছু এলো মেলো করে দিলো এখন তাকে ছাড়া আমার যেন কিছুই চলে না৷ এতো প্রগাঢ় ভালোবাসা হলো কি করে? নতুন নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি আজ কাল নিজেকে নিজের বুঝতেই বড্ড দায় হয়ে পরে তাকে বুঝবো কি করে?
হঠাৎ মাহতাব ভাইয়ার কথা মনে পরলো৷ তাকে কাল কেমন যেন লাগছিলো৷ উম্মাদের মত আচরণ করছিলো এ মাহতাব ভাই আমার অচেনা৷
তাঁর চোখের ভাষা কেমন অস্পষ্ট ছিলো কখনো আমার প্রতি তাচ্ছিল্যতা, কখনো ক্ষোভ, কখনো রুষ্টতা কেন? আমি কি কিছু করেছি?
সে আমায় ভালোবাসে? কবে থেকে আর কেন? পরক্ষণে ভাবলাম ভালোবাসার কোনো ‘কারণ’ হয় নাকি?
এতো এমনি এমনি হয়ে যায় যেমনটা তিশানের প্রতি হয়েছে?
মানুষটা যে আমায় প্রগাঢ় ভালোবাসে তা তাঁর কথায় স্পট ছিলো৷ তিশান কালকের ঘটনা ঘুনাক্ষরে যদি টের পায় আমার রক্ষে নেই৷ আচ্ছা হৃদয় ভাইয়া কে বললো না কেন? কি মতলব তাঁর? আচ্ছা কালকের জন্য কি ভাইয়া রেগে আছে?
অদ্ভুত হয়ে গেছে যেন সবাই৷ ভাইয়া যে আমাকে এসব বলবে তা কখনো কল্পনা ও করিনি৷ যে নিজের বোনদের নিয়ে এতোতা সম্বন্ধসূচক কোনো বন্ধুদের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয়নি সে মাহতাব ভাইয়ার হয়ে কথা বলছে? সে তাঁর প্রিয় বন্ধু বলে শুধু?
আমার ভাবনার মাঝেই আম্মুর ডাক পরলো৷ বইটা রেখে আম্মুর কাছে গেলাম কিছুক্ষণ আম্মুর সাথে কাজ করে নিজের ঘরে আসলাম৷
দ্বিপ্রহর শেষ হয়ে অপরাহ্ন চলছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই সবে আসরের আজান পরলো৷ আমাদের বাড়ি থেকে নয়-জন যাবো৷ মাহতাব ভাইয়া, হৃদয় ভাইয়া, তিন চাচা আব্বু যাবে না আব্বুর কাজ আছে৷ আমি তাসনিম আপু, লিনা আর রাইসা এ ক’জনি যাবো৷
তারা আপুকে নিয়ে যেতে বলেছিলো কিন্তু দাদু তা পছন্দে করে না তাই আপু যাচ্ছে না৷ সবাই এক গাড়িতে যাবে আর হৃদয় ভাইয়া মাহতাব ভাইয়া বাইকে যাবে৷
সবাই এক এক করে গাড়িতে উঠেছে কিন্তু বিপত্তি ঘটলো গাড়িতে সাত জন বসেছে আর জায়গা নেই আমি শেষে এসেছি তাই আমি বসার জায়গা পাচ্ছি না৷ আমাকে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হুট করে হৃদয় ভাইয়া এসে বড় চাচা কে বললো,
“তোমরা যাও আমি আর মাহতাব ওকে নিয়ে অন্য গাড়িতে আসছি৷ ”
আমি ভাইয়ার কথা শুনে ‘থ’ বনে গেলাম৷ এমা ভাইয়া কি বলছে? এমনি বাঘের খাচায় যাচ্ছি আজ আমার সত্যি রক্ষে নেই৷
ভাইয়ার কথায় সম্মতি জানিয়ে তারা আমার সামনে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো৷ এখন আমার এখানে বসেই কান্না করতে ইচ্ছে করছে৷ হৃদয় ভাইয়ার ঠোঁটে বাকা হাসির রেশ সে মাহতাব ভাইয়ার সামনে এসে বলে,
“তুই ওকে বাইকে করে নিয়ে যা আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি৷”
মাহতাব ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো৷ বুঝলাম না তাঁর হাসির মানে অতঃপর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুই একা? তাহলে তিন জন এক সাথেই যাই?”
হৃদয় ভাইয়া হেসে বলে,
“আরে অধম যা তুই৷ আর তাফসি যা গিয়ে মাহতাবের বাইকে বস৷”
আমি কিছু বলবো এর আগে ভাইয়া আবার শক্ত কন্ঠে বলে,
“বাইকে উঠতে বললাম তো?”
আমি অতি বিরক্ত নিয়ে বাইকে উঠে বসলাম৷ ভাইয়া হয়তো পৃথিবীর একমাত্র ভাই যে কিনা নিজের বোন কে বাঘের খাচায় পাঠাচ্ছে বন্ধুর সাথে যাকে দেখলে বাঘ আরো ক্ষেপে যাবে৷
ভাইয়া বাড়ির গ্যারেজে গাড়ি নিতে যেতেই মাহতাব ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিলো৷ ভাইয়ার গাড়ি বাড়ি থেকে বের হতেই মাহতাব ভাইয়া বাইক ছেড়ে দিলো অতঃপর মৃদু স্বরে বলে,
“ধরে বস মুন৷ ”
ধরলাম না সে কিছুটা গম্ভীরমুখে আবার বললো,
” আমি তোকে প্রেম করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিনা৷ তোর ভাই বলেছে তাই উঠিয়েছি তাই বেশি পাকামো না করে ধরে বস৷ ”
ভাইয়ার এহেন কথা শুনে কিছুটা ভরকে গেলাম অতঃপর ঠিক করে তাঁর কোমর জরিয়ে বসলাম৷
কিছুক্ষণ চুপই রইলো সে অতঃপর নিরবতা ভেঙে কিছুটা শব্দ করে হেসে রাম্যন্তিক কন্ঠে বলেন,
“আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এইটুকু শাস্তি তো পাওয়াই উচিত তোর তাই না মুন?”
মাহতাব ভাইয়ার কথা প্রথম না বুঝলেও পরক্ষণেই বোধগম্য হলো৷ আমি যা ভাবছি সে ও তাই ভাবছে সে জানে তিশান দেখলে রাগ করবে৷ ইচ্ছে করছে এখান থেকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই৷
আবার কিছুক্ষনের নিরবতা ছেয়ে গেলো ব্যাস্ত শহরের কোলাহল পূর্ন ব্যস্ত গাড়ি আওয়াজ কানে আসছে শুধু৷ বেশ ক্ষানেক্ষণ পর সে আবার নিরবতা ভেঙে শান্ত কন্ঠে বলে,
“বিয়ে করছিস কবে?”
“যানি না৷ ”
শান্ত কন্ঠেই জবাব দিলাম৷ সে আবার বলেন,
“যদি না দেই বিয়ে করতে?”
বিস্ময় চোখে বাইকের মিররে তাকালাম৷ সে আবার বলে,
“যদি জোর করে নিজের করে রেখে দেই?”
রাগ হলো আমার ইচ্ছে করছে এখনি নেমে যাই৷ সত্যি গিরগিটির মতো রঙ পালটায় নাকি লোকটা? আমি কিছুটা রাগী কন্ঠে বলি,
“মাহতাব ভাইয়া আপনি না কাল বলেছিলেন,,,৷ ”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে থামিয়ে দিয়ে বলে,
” কখন কি বলেছি অতশত ভাবি না আমি৷ আমার যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করি৷ ”
কিছু বললাম না রাগে দাতে দাত চেপে বসে রইলাম৷ এখন যদি সম্ভব হতো এখানেই নেমে যেতাম কিন্তু না তা তো আর হওয়ার না৷
সে শব্দ করে হেসে দিলো অতঃপর নিবিড় মায়ামাখা কন্ঠে বলেন,
“তোর ভিতু চাওনি৷ আর রাগী রাগী মুখ খানা যে আমার মনে ধরলো রে মুন এখন যে তোকে খুব করে পেতে ইচ্ছে করছে৷”
চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো আমার শরীর আরো কেঁপে উঠছে ইচ্ছে করছে খুন করে দেই৷
সারা রাস্তা আর সে কিছু বললো না আমিও চুপ করেই ছিলাম৷ রাগ বাড়ছে মাহতাব ভাইয়ের উপর৷ সে তো এমন ছিলো না৷ তাকে তো আমি ভাইয়ের মতই দেখতাম ছোট বেলায় কি বলেছি তা নিয়ে কি সে বসে আছে? আর আমি কি ভুল করলাম যে শাস্তি দিবে? আমি কি বলেছি তাকে ভালোবাসতে?
একটা কালো গেট দিয়ে হৃদয় ভাইয়ার গাড়ি ঢুকলো তার পিছনে পিছনে বাইক নিয়ে গেলো মাহতাব ভাইয়া৷ আমাদের আগের গাড়ি বাড়ির সামনেই থেমে আছে একটা মেইন গেইট কিন্তু এখানে দুইটা বাড়ি হয়তো একটা তিশান দের একটা আরাভ ভাইয়াদের৷ বাইক থামাতেই তাড়াহুড়ো করে নামলাম আমি৷ কিন্তু নামতে গিয়েই বিপত্তি ঘটলো বাইকের কোনে ওরনা বেজে গেলো৷ আমি খুলতে যাওয়ার আগেই মাহতাব ভাইয়া এগিয়ে এলো৷ সবাই আমাদের আগে এসেছে তাই বাড়ির ভিতর চলে গেছে সবাই৷ আমি নেমেই এপাশ ওপাশ তাকালাম যাক তিশান নেই ইশান ভাইয়া এগিয়ে এসেছে৷
ওরনা ছাড়াতেই মাহতাব ভাইয়া আমার ওরনা ধরে বলে,
“আমি চাইলেই তোকে জোর করে নিজের করে নিতে পারি কিন্তু,,,৷ ”
মাহতাব ভাইয়া বাকি কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ সে চিরচেনা কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলাম আমি৷ বুক ধক ধক করছে৷ আল্লাহ আজ বুঝি আমার শেষ দিন৷
চলবে,