প্রণয় রেখা পর্ব ২৮

0
584

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮.

একটা লাল বেনারসির সখ মোহনার অনেক আগ থেকেই ছিল। তবে সেই সখ গায়ে জড়িয়েই যে তার বিয়ে হবে সেটা আগে কখনো ভাবেনি সে। একটা লাল টকটকে শাড়ি, ঠোঁটে রক্তিম রঞ্জক পদার্থ, চোখের নিচে হালকা কাজলের ছোঁয়া আর ললাটের ক্ষুদ্র বিন্দু; ব্যস এইটুকুই। এইটুকুই কি একটা মেয়ের বিয়ের সাজ?

শাড়ি গায়ে মোহনা আয়নায় চেয়ে বলে,

‘আমাকে সুন্দর লাগছে।’

তার কথা শুনে মাহিয়া আর এশা হাসে। এশা বলে,

‘নিজের প্রশংসা নিজেকে করতে হয় না, আমরা আছি না তার জন্য।’

মোহনা আলতো হেসে বলল,

‘কে বলেছে, নিজের প্রশংসা নিজে করতে হয় না? আমার নিজের কাছে আমি নিজে সবসময়ই প্রশংসনীয়। আর এটাকে অহংকার বলে না, এটাকে বলে আত্মানুরাগ, নিজেকে নিজে ভালোবাসা।’

‘আচ্ছা বাবা, বুঝেছি। এখন একটু তোর মেকআপ টা দেখ, আরেকটু করলে কী হয়? বেশি নরমাল হয়ে গিয়েছে না?’

‘উঁহু, এইটুকুতেই ঠিক আছে।’

‘আচ্ছা, তাহলে তুই বস। এবার আমরা একটু সাজি।’

মোহনা বিছানায় গিয়ে বসে বলল,

‘এশা শোন, তুই কিন্তু আবার বেশি সাজিস না। পরে তোকে দেখে রাফাত এত পাগল হবে যে, আমার বিয়ের কাজীকে বলে নিজের বিয়েটাও পড়িয়ে ফেলবে। আবার তোর পরিবারও আজ থাকবে, রাফাতের জন্য কিন্তু আজ খুব সুযোগ। সো, বি কেয়ারফুল।’

এশা নাক ফুলিয়ে বলে,

‘বেশি বুঝিস তুই।’

মোহনা ঠোঁট চেপে হাসে। এশা আর মাহিয়া তৈরি হয়। তাদের তৈরি হওয়ার মাঝেই নিচ থেকে গাড়ির শব্দ পাওয়া যায়। সেই শব্দে মোহনার মনে মোচড় দিয়ে উঠে। হঠাৎ তার মাথায় আসে, তার আজ বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সে আজ থেকে অন্য এক বাড়ির বউ হতে যাচ্ছে। কেমন যেন অন্যরকম এক অনুভূতি। না ভয়, না অস্বস্তি। এই অনুভূতির ঠিক ধরা বাঁধা কোনো নাম নেই। তবে মোহনার বুক ভার হচ্ছে, ভালো লাগছে যেমন খারাপও লাগছে খুব। সে বুকে হাত দিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে এশাকে বলে,

‘দোস্ত, আমার কেমন যেন লাগছে।’

এশা তার সাজায় ব্যস্ত ছিল। মোহনার কথা শুনে সে পেছন ফিরে তার দিকে চেয়ে বলল,

‘ভয় পাচ্ছিস?’

‘না, ঠিক ভয় না। একটু অন্য কিছু, বুঝতে পারছি না।’

এশা গিয়ে তার পাশে বসল। মোহনার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

‘বিয়ের সময় হয়তো সব মেয়েরই এমন হয়। আমার আম্মুও বলেছিল, আম্মুর বিয়ের দিনের অনুভূতির কথা। সেদিন নাকি বুকের ভেতরে কেমন করে, স্পন্দন বেড়ে যায়। ভয় হয়, অস্বস্তি লাগে। তোরও এখন এমন হচ্ছে তাই না?’

মোহনা অসহায় ভাবে মাথা নাড়াল। এশা দ্বিতীয় কোনো কথা বলার আগেই সেখানে লায়লা বেগম এসে বললেন,

‘কিরে, তোদের এখনো শেষ হয়নি। দরজার সামনে বর দাঁড়িয়ে আছে, বরণ করবি চল।’

এশা বলল,

‘জি আন্টি, আসছি।’

পরে আর মোহনার সাথে কথা না বলেই এশা মাহিয়াকে নিয়ে দরজার কাছে গেল গেইট ধরতে। এশা আর মোহনা পাত্রী পক্ষ। আর রাফাত ছিল পাত্র পক্ষ। গেইটে কত টাকা দিবে সেই নিয়ে দুই পক্ষের তুমুল তর্ক শুরু হয়েছে। এশা আর মাহিয়ার দাবি, তারা দশ হাজারের কমে ছাড়বে না। ঐদিকে রাফাত পাঁচও দিবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

বেশ অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্কের পর অবশেষে ছয় হাজারে গিয়ে তাদের মনস্থির হলো।

লরিনকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে দিয়ে মাহিয়া তার বোনের কাছে ছুটে গেল। গিয়ে বলল,

‘আপু জানো, লরিন ভাইয়াকে যা লাগছে না।’

‘তুই আমার জামাইয়ের দিকে নজর দিচ্ছিস?’

মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল। মাহিয়া ভেংচি কেটে বলল,

‘এএ, আমার বয়েই গেছে তোমার বিদেশির দিকে নজর দিতে। আমি তো শুধু বলছিলাম, দেখতে কেমন লাগছে। আসলে ভাইয়াকে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না। আমি তো মিথ্যে বলছিলাম, তোমাকে খুশি করার জন্য।’

‘আচ্ছা হয়েছে, আমি জানি কোনটা তোমার সত্য আর কোনটা তোমার মিথ্যা।’

মাহিয়া মুখ কালো করে বলল,

‘যাও, তোমাকে আর কিছু বলবোই না।’

সে আবার ড্রয়িং রুমে গেল। লরিনের কাছে গিয়ে বসে বলল,

‘জানেন ভাইয়া, আপুকে যা লাগছে না। আপনি তো আজ পাগলই হয়ে যাবেন।’

লরিন সরু চোখে মাহিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ভীষণ দুষ্টু হয়েছ তুমি।’

‘এখন হয়নি তো, আগে থেকেই ছিলাম।’

মাহিয়ার কথা শুনে লরিন খুব কষ্টে হাসি আটকায়। তারপর সে তার ফোনটা মোহনার কাছে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘তোমার আপুর ছবি তুলে নিয়ে আসো, তোমার কথা শুনে এখন দেখতে মন চাচ্ছে।’

মাহিয়া লরিনের ফোন নিয়ে মোহনার কাছে গেল। গিয়ে তাকে বলল সব। মোহনা ছবি তুলতে না দিয়ে ফোনের নোট প্যাডে গিয়ে কিছু একটা লিখল। তারপর সে মাহিয়াকে বলল এটা লরিনকে পড়তে দেওয়ার জন্য। মাহিয়া আস্তে আস্তে আবার লরিনের কাছে গিয়ে বসল। সেখানে বড়োরা সবাই আছে বলে, মাহিয়া কোনো হৈ চৈ করতে পারছে না। সে লরিনকে ফোন দিয়ে বলল,

‘আপু এটা পড়তে বলেছে।’

লরিন দেখল তার ফোনের নোট প্যাডে লেখা,

‘একটুও ধৈর্য নেই আপনার? এত তাড়া কিসের, হু?’

লেখাটা পড়ে লরিন মোহনাকে টেক্সট করল। যেখানে সে লিখল,

‘না নেই। এতদিন ধৈর্য ধরতে ধরতে এখন ধৈর্যের বক্স খালি হয়ে গিয়েছে। এখন যা হবে ছটফট হবে, কোনো ধৈর্য ধরাধরি হবে না। আই মিন, সবকিছু ফাস্ট ফাস্ট। লাইক এখন বিয়ে, আর রাতে বাসর।’

মেসেজ দেখে মোহনার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। মানে ছেলেটা এতকিছু ভেবে ফেলেছে? মোহনা তাকে রাগের ইমুজি পাঠিয়ে লিখল,

‘এখনই এত লাফালে বিয়ে কিন্তু ক্যান্সেল করে দিব।’

লরিন তাকে হাসির ইমুজি পাঠিয়ে লিখল,

‘সাহসী ছেলেরা কারোর হুমকিতে ভয় পায়না।’

মোহনা মেসেজ দেখে ফোনটা রেখে দিল। ছেলেটা পাজি হয়েছে খুব। এই ছেলে যে তাকে সারাজীবন জ্বালিয়ে মারবে সেটা আর বোঝার বাকি রইল না তার।
.

.

কাজী সাহেব বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বড়োরা সবাই ড্রয়িং রুমে। মাহিয়া মোহনার পাশে বসে আছে। এশা আর রাফাত এই মুহুর্তে উধাও। হয়তো ছাদে আছে। কেন আছে, সেটা মোহনারও অজানা।

লরিনের বাড়ির লোকেরা সবাই কথা বলে বললেন, কাবিনের সাথে কবুলও বলিয়ে নিবেন। তাতে একবারে সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। মোহনার মা বাবাও এই সিদ্ধান্তে কোনো আপত্তি রাখলেন না।

মাহবুব সাহেব লায়লা বেগমকে বললেন, মোহনার রুমে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে তিনি কাজী সাহেবকে নিয়ে আসছেন। লায়লা বেগম মোহনার রুমে যান। অপরদিকে মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়াতেই উনার ফোনে কল আসে। ফোন হাতে নিয়ে দেখেন যে উনার বন্ধু আব্দুল্লাহ সাহেব কল করছেন। তিনি এই মুহুর্তে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন, কলটা রিসিভ করবেন কিনা। কারণ, মোহনার বিয়ের ব্যাপারে ঐ পরিবারের কাউকেই তিনি কিছু জানাননি। যদি এখন তিনি কল রিসিভ করার পর উনার বন্ধু বলে উঠেন, তার ছেলেও এখন বিয়েতে রাজী, তখন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here