#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫.
মোহনা কেন যেন আর কিছু আড়াল করতে পারে না। মা’র প্রশ্নের জবাবে সে তাকে সব বলে দেয়। মা’কে সব বলতে পেরে যেন আজ তার অন্তস্তল কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। এখন শান্তি পাচ্ছে খুব। কথা জমিয়ে একের পর এক মিথ্যে বলাটা খুব কঠিন। সত্য বলা সহজ, কিন্তু এই সহজ কাজ করতেই মানুষের ঘাম ছুটে যায়। মোহনারও সেই অবস্থাই হয়েছিল। মা’কে সব বলার আগে ভয়ে সে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল কিন্তু, এখন সব বলার পর মনে হচ্ছে যেন সবটা কত সহজ, সাবলীল।
মেয়ের কথার খুব বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দেখা মিলল না মায়ের মাঝে। তিনি আশা করছিলেন, মেয়ে তার কিছু একটা তো মিথ্যে বলছে। লরিনকেও তার প্রথম থেকে সন্দেহ হয়েছে যথেষ্ট। সঠিক যুক্তি মেলাতে পারেননি বলে তখন কিছু বলেননি।
সব শুনে অনেকক্ষণ নিরব থেকে তিনি মোহনার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ভালোবাসিস লরিনকে?’
মায়ের নিরবতা মোহনাকে এতক্ষণ যতটা না চিন্তিত করেছিল তার চেয়ে আরো বেশি মায়ের এই প্রশ্ন এখন তাকে চকিত করেছে। সে নির্বাক, হতভম্ব। অনেক খুঁজেও জবাব মেলাতে পারছে না। সহজ প্রশ্ন, উত্তর “হ্যাঁ” অথবা “না” হবে। অথচ এই “হ্যাঁ” অথবা “না” বলতে গিয়েই মোহনার দ্বিধা দ্বন্দ্বের পাহাড়ের তলায় পড়েছে। পরিষ্কার গলায় বলতে পারছে না, “হ্যাঁ, আমিও লরিনকে ভালোবাসি।” আবার বলতে পারছে না, “না, আমি লরিনকে ভালোবাসি না।” এর থেকে বিরক্তিকর ব্যাপার বোধ হয় আর কিছু হতে পারে না। সে অনেক ভেবেও যখন সঠিক জবাব মেলাতে পারল না, তখন সে কথা কাটাতে বলল,
‘আম্মু, আমার এখন পড়তে হবে। অনেক পড়া বাকি। এসব নিয়ে আমি পড়ে কথা বলব প্লিজ। আর তুমি আপাতত বাবাকে এসব কিছু বলো না। পরে সময় আর সুযোগ মতো আমিই বাবাকে সব বলব।’
লায়লা বেগম ব্যাপারটা আর ঘাটালেন না। তিনি ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
_______________________________
আজ মোহনার পরীক্ষা সমাপ্তি ঘটল। আরো এক সেমিস্টারের ইতি টেনে বেশ উৎফুল্ল মনেই বাড়ির দিকে পা বাড়াল সে। হেঁটেই যাচ্ছিল, পাশে এশাও ছিল। অর্ধেক রাস্তায় আসার পরই মোহনার ফোন হঠাৎ বেজে উঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল, লরিনের নাম্বার। রিসিভ করে সালাম দিল। লরিন তাকে সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘পরীক্ষা শেষ?’
‘হুম।’
‘বাসায় যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা যাও। বিকেলে আমিও তোমাদের বাসায় যাব।’
মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কেন? আপনি হঠাৎ আমাদের বাসায় কেন যাবেন?’
লরিনের গলার স্বরে তখন খুশির স্রোত নেমে এল। সে বলল,
‘আমি চাকরি পেয়েছি, মোহনা। একটা বেসরকারি কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে।’
মোহনার ঠোঁট জোড়া প্রস্ফুটিত হলো। সেও আনন্দে উল্লাসিত। লরিন বলল,
‘আজই আমি তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমাদের বিয়ের কথা বলব, আমি আর দেরি করতে পারব না।’
মোহনা আমতা আমতা করে বলল,
‘কিন্তু…’
‘উঁহু, আর দোহাই দিও না। আই কান্ড লিভ জাস্ট অ্যা সেকেন্ড উইথ আউট ইউ। এখন আমাকে যেকোনো মূল্যে বিয়ে করতে হবে। ঐ অরূপ এখনও ঝুলে আছে। যদি একবার তার মত বদলে যায়, তখন আমার কপাল পুড়বে। আমি আর কোনো রিস্ক নিব না। বি প্রিপিয়ার্ড, সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে।’
কল কেটে দেয় লরিন। আজব লোক, মোহনাকে কিছু বলার সুযোগও দেয়নি। মোহনা ফোন রেখে ভয়ে ভয়ে এশার দিকে চেয়ে বলল,
‘লরিন নাকি আজই বাবার কাছে বিয়ের কথা বলবে।’
‘তো, বলুক না। আর কত অপেক্ষা করবে ছেলেটা? এবার তো এর একটা গতির প্রয়োজন।’
‘কিন্তু, বাবা যদি ওর উপর খুব রেগে যান?’
‘সেটা তখন লরিন বুঝে নিবে। চিন্তা করিস না, ঐ বিদেশি বেটা চালু আছে। দেখিস, ঠিক তোর বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে।’
মোহনা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কী করে পারবে সে তো শুরুতেই লরিনের নামে বাবাকে মিথ্যে বলে রেখেছে। এখন সব সত্যি জানার পর কি তার বাবা এত সহজেই সবকিছু মেনে নিবেন? মোহনার তো মন বলছে, তা কখনোই সম্ভব না।
বাসায় গিয়ে মোহনা মা’কে সব বলে। মোহনার বাবাও কাল চট্টগ্রাম থেকে তাদের বাসায় এসেছেন। আবার কালই চলে যাবেন। আজ উনাকে এসব কথা বলা ঠিক হবে কিনা মোহনা তা নিয়ে খুব চিন্তিত। কারণ বাবা তার খুব করে চাইছেন যেন মোহনার বিয়ে অরূপের সাথেই হয়। কিন্তু অরূপের সাড়া পাচ্ছেন না তিনি। অপরদিকে চাইলেও জোর করতে পারছেন না। ভালো ভদ্র ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে আজকাল তিনি খুব চিন্তাই থাকেন। এর মধ্যে যদি আবার লরিন এসে উনাকে বিয়ের কথা বলে, তখন উনার কেমন রিয়েকশন হবে কে জানে।
আযান হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। বাবা মা’র নামাজ শেষ। সময় যত গড়াচ্ছে মোহনার দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে। বার কয়েকবার সেই দুশ্চিন্তায় সে বেলকনিতে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরেছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি লরিন চলে এল। কিন্তু লরিন তাড়াতাড়ি আসে না। তার আসতে আসতে বাজে সন্ধ্যা সাত’টা।
দরজার কলিং বেলের শব্দ পেয়েই কলিজা ধক করে উঠে মোহনার। উঠে যে গিয়ে দরজা খুলবে সেই সাহসটুকুও পায় না সে। সে মাহিয়াকে পাঠায় দরজা খোলার জন্য। মাহিয়া গিয়ে দরজা খুলে। দরজার বাইরে লরিনকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ ফুটে উঠে। লরিনকে ভেতরে আসতে বলে সে তার মা বাবাকে ডাকে। লায়লা বেগম যেহেতু আগে থেকেই সবকিছু জানেন তাই তিনি খুব সতর্ক রইলেন। মাহবুব সাহেবকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে লরিনকে দেখে খুব খুশি হয়ে তার সাথে কুশল বিনিময় করলেন।
লরিনকে প্রায় অনেকদিন পর দেখে মাহবুব সাহেবও বেশ খুশি হয়েছেন। তিনি সাদরে তাকে নিজের পাশে নিয়ে বসালেন। তারপর লায়লা বেগমকে বললেন, চা নাস্তার ব্যবস্থা করতে। ঐদিকে মোহনা পর্দার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছে আর ভয়ে ভীত হচ্ছে।
কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বার্তা শেষ করে লরিন গলা ঝেরে বলে,
‘আংকেল, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই?’
মাহবুব সাহেব স্বাভাবিক গলায়’ই বললেন,
‘বলো না কী বলবে।’
লরিনের নিজেরও এখন কিছুটা চিন্তা হচ্ছে। যদি উনি মুখের উপর না করে দেন, যদি মেনে না নেন, যদি লরিনকে খালি হাতে ফিরতে হয়, তখন? ভয়কে আশকারা দিলে তা আরো পেয়ে বসবে। তাই লরিন ভয়কে সুযোগ না দিয়ে নিজেকে শক্ত করল। চোখ বুজে নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘আমি মোহনাকে বিয়ে করতে চাই, আংকেল।’
মাহবুব সাহেব অবাক হলেন। মাথাটা একটু ঘুরিয়ে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে চাইলেন লরিনের দিকে। শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলেটার এত সাহস? সে এত সহজে তার মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলে ফেলল? আশ্চর্য, সে একটুও ভয় পেল না?
মাহবুব সাহেবের বিস্ময় যেন কাটছেই না। ঐদিকে মোহনা, মাহিয়া আর তাদের মায়ের বুকের ভেতরটা ধরাৎ ধরাৎ করে লাফাচ্ছে। বড়ো কোনো ঝড় আসার আগে পরিবেশ এমন ঠান্ডাই থাকে। তবে কি মাহবুব সাহেবের এহেন শান্ত রূপ বড়ো কোনো ঝড়ের ইঙ্গিত করছে? মোহনার ভয়ে এবার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। সে পর্দার আড়ালে থেকেই মাহিয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
অন্যদিকে লরিনও নড়ছে না। গম্ভীর হয়ে বসে উত্তরের অপেক্ষা করছে। অনেকটা সময় গেল সবাই নিরব। এবার মাহবুব সাহেব নিশ্বাস ফেললেন। তার ভারী নিশ্বাসের শব্দও যেন এই গুমোট পরিবেশে টের পাওয়া গেল। তিনি গম্ভীর সুরে বললেন,
‘বলতে হবে, তোমার সাহস আছে। আর সাহসী ছেলেদের আমার বরাবরই পছন্দ। তোমার সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারতাম যদি না তুমি বিদেশি হতে। কিন্তু, এখন সেটা সম্ভব না। আমি আমার মেয়েকে কোনো বিদেশি ছেলের সাথে বিয়ে দিব না। আমি দুঃখিত।’
লরিন ঢোক গিলল। বলল,
‘আংকেল, আমার বাবা বাংলাদেশি। সেক্ষেত্রে, আমিও বাংলাদেশি। আর আমি এখন এই দেশেই স্যাটেল হয়েছি। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জবও পেয়েছি। এখানেই থাকব, দাদা দাদুর সাথে। তাই অন্তত বিদেশি বলে আমায় ফিরিয়ে দিবেন না, প্লিজ।’
মোহনার বাবা ভ্রু কুঁচকালেন। বললেন,
‘মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জটিল। কে কয়টা মিথ্যে বলেছ? সবটা ক্লিয়ার করো।’
লরিন বলল,
‘মোহনাকেও ডাকুন তাহলে। ও নিজেই না হয় সবটা বলবে।’
লরিনের কথা শুনে মোহনার আত্মা যেন আর জায়গায় রইল না। তার মনে হচ্ছে, এবার বুঝি জীবনের অন্তিম সময় তার ঘনিয়ে এসেছে।
চলবে…
(আগামীকালই গল্পের শেষ পর্ব আসবে।)