#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪.
দুই’টা কোর্সের পরীক্ষা শেষ। আর বাকি তিনটা। তবে আগামীকাল যেই কোর্সের পরীক্ষা, মোহনা সেই কোর্সে খুব কাঁচা। এই সেমিস্টারের সবথেকে বিরক্তিকর আর কঠিন কোর্স বোধ হয় এটাই। প্রথম দুই পরীক্ষা সে ভালোই দিয়েছে। তবে আগামীকালের পরীক্ষার জন্য এখন তার ভয় করছে। সিলেবাস খুব বড়ো, পড়া শেষ হয়নি কিছুই। এখন কীভাবে কী শেষ করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
বইয়ের প্রথম চ্যাপটারটা ভালোভাবে পড়ার পর মোহনার মনে হলো এইটুকুতেই যেন তার মাথায় জ্যাম লেগে গিয়েছে। আগে এই জ্যাম ছুটাতে হবে, নয়তো এই জ্যামের মাঝে আরো যত পড়াই পড়ুক না কেন সব এখন তার জ্যামেই আটকে থাকবে। তাই সে মন ভালো করার জন্য এশাকে কল দিল। এশারও একই অবস্থা। সারাবছর পড়াশোনা না করে পরীক্ষার আগের দিন পড়তে বসলে যা হয় আরকি। এশাও পড়ার টেনশনে অতিষ্ঠ হয়ে মোহনাকে বলল,
‘আমি তোর বাসায় আসব? আমার মাথা একেবারেই কাজ করছে না।’
মোহনা বলল,
‘আয়, তুই এলে দুজনে একসঙ্গে ডিসকাস করে পড়তে পারব।’
এশা আমতা আমতা করে ফের প্রশ্ন করল,
‘লরিনকে নিয়ে আসব?’
মোহনা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কেন? ও কেন?’
‘আসলে, লরিন Anthropology নিয়ে পড়াশোনা করেছে; তাই ওর এই ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে।’
মোহনা সংশয় না রেখে রাজি হয়ে গেল। এশাও এতে খুশি হলো খুব। চট করে লরিনকে কল করে মোহনাদের বাসায় আসতে বলল। লরিনও যেন খুশিতে আত্মহারা। সে সবকাজ ফেলে দ্রুত মোহনাদের বাসায় চলে এল। আসার আগে আগেই মোহনা দরজা খুলে রেখেছে। তাকে অনেকদিন পর দেখে লায়লা বেগমও খুশি হলেন খুব। মোহনা তার মা’কে লরিনের এখানে আসার কারণ বললে, তিনি খুব স্বচ্ছন্দ মনে মোহনাকে অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে মোহনা লরিনকে নিয়ে তার রুমে গেল। সেখানে যাওয়ার পর এশা লরিনকে দেখে হেসে হাই বলে। লরিন তাকে দেখে আলতো হাসে। তারপর সে একটা চেয়ারে গিয়ে বসে। অপর পাশ থেকে তখন এশা বলে,
‘তুমি না খুব ভালো Anthropology বোঝাতে পারো? নাও, এখন আমাদের পড়াও।’
লরিন বেশ ভাবসাব নিয়ে বসেছে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে এমন টান টান করে বসে আছে যেন সে একজন বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষক। মোহনা তার পাশে চেয়ারে গিয়ে বসল। সবাই ঠিকঠাক মতো বসার পর সে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘সবাই ঠিকঠাক মতো বসেছ? এবার তাড়াতাড়ি বই বের করো।’
লরিনের ভাবসাব দেখে মোহনা এশার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসে। এশাও তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে তাদের পড়ার বইটা বের করে। মোহনা তার বই আর খাতাটা লরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘নিন, দেখি কতটুকু ভালো বোঝাতে পারেন।’
লরিন হেসে খাতা আর বইটা নিজের কাছে নিল। বই খুলে একটা চ্যাপ্টার বের করে বলল,
‘যাক, সব ইংরেজি তে লেখা। আমার পড়াতে সুবিধা হবে।’
তারপর সে পড়ানো শুরু করে। মোহনা প্রথমে লরিনকে অতটা বিশ্বাস করতে পারেনি। সে ভেবেছিল ঐ একটু হয়তো কোনোরকমে পড়াবে। কিন্তু, লরিন যখন তাদের পড়ানো শুরু করল তখন মোহনা আশ্চর্য হয়ে লরিনের দিকে চেয়ে রইল। সে অবাক, ছেলেটা পুরো ভার্সিটির লেকচারারদের মতো করে পড়াচ্ছে। প্রত্যেকটা টপিক খুব সুন্দর করে বোঝাচ্ছে। আর কঠিন কঠিন টপিকগুলোও যেন মোহনা আর এশা এখন খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারছে। এত দারুণ ব্যাপার।
পড়ার মাঝে লায়লা বেগম সবাইকে নাস্তা দিয়ে যান। মাহিয়াও মাঝে মাঝে একটু করে উঁকি দিয়ে আবার চলে যায়। দুই ঘন্টার ভেতর লরিন পুরো বই পড়িয়ে ফেলে। সাথে তাদের সাজেশন ও দেয়। মোহনা আর এশা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। এই তো পুরো লরিনের আরেক রূপ। ও যে পড়াশোনায় এত শার্প সেটা তো কেউ জানতোই না।
সব পড়িয়ে লরিন এবার তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘Do you have any problem?’
মোহনা আর এশা একই সঙ্গে মাথা নাড়ায়। লরিনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তখন। সে এতক্ষণে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চা দিয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু পড়াচ্ছিল বলে সেটা আর সে হাতে নেয়নি।
মোহনা বই খাতা গুছিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ল। মনের ভয় এখন অনেকটা কমেছে। মনে হচ্ছে সে কালও ভালো পরীক্ষা দিতে পারবে। সে লরিনের দিকে চেয়ে দেখল লরিন চা পান করছে আর এক দৃষ্টিতে কী যেন দেখছে। মোহনা তার সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল লরিন তার টেবিলের উপর রাখা তার শাড়ি পরা ছোট্ট ফ্রেমের ছবিটাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মোহনা লরিনের দিকে আবার ফিরে চাইল। লরিনের চোখ জুড়ে প্রশান্তির ছোঁয়া স্পষ্ট। যেন মোহনার সেই প্রতিচ্ছবি তার মনে শান্তি দিচ্ছে। মোহনাও কী ভেবে যেন শান্তি পায়। হালকা গলা ঝেরে লরিনকে বলে,
‘আপনি তো খুব ভালো পড়ান। আপনার কি অনার্স মাস্টার্স সব কমপ্লিট?’
লরিন চায়ের কাপ রেখে সোজা হয়ে বসে। বলে,
‘হ্যাঁ। আমি আমার দেশে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কয়েক মাস হয়েছিল একজন লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছিলাম। আপাতত এখানে আছি বলে চাকরিটা আর করতে পারছি না আরকি।’
মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আপনি বাধ্য হয়ে এই দেশে থাকছেন তাই না?’
লরিন জবাবে বলল,
‘না। ভাবছি এবার এই দেশেই স্যাটেল হবো। আর ঐ দেশ থেকে জরুরি সব কাগজ পত্র আনার ব্যবস্থা করেছি। কাগজগুলো হাতে পেয়ে গেলেই এখানে যেকোনো একটা চাকরীর জন্য এপ্লাই করব।’
‘আপনি চাইলে আমাদের ভার্সিটিতেও ট্রাই করতে পারেন।’
কথাটা বলে ফেলে মোহনা একটু থামল। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, “একটু বেশি বলে ফেলেনি তো?”
মোহনার কথা শুনে এশাও তাল মিলিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ লরিন, তুমি যা ব্রিলিয়েন্ট। আমাদের ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে এপ্লাই করে দেখো নিশ্চয়ই তুমি চাকরিটা পেয়ে যাবে।’
লরিন ভেবে বলল,
‘তাহলে তো আমি মোহনার টিচার হয়ে যাব।’
‘হ্যাঁ, কী হয়েছে তাতে?’
মোহনার প্রশ্নে লরিন বলে,
‘না, তেমন কিছু না। ভাবছি, তোমার বাবা যদি আবার বলেন, ভাইয়া থেকে ডিরেক্ট স্যার কী করে হয়ে গেলাম; তখন?’
লরিনের কথা শুনে এশা হেসে ফেলে। মোহনা চোখ গরম করে বলে,
‘সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। প্রয়োজন পড়লে মানুষ সবকিছুই হয়, সেটা বাবা বুঝবে।’
মোহনার রাগ লরিনকে প্রতিবারই আনন্দ দেয়। এবারও দিয়েছে। তার কঠিন চোখযুগল তাকে বরাবরই কাতর করে। সে তো প্রথম থেকে এই চোখ দেখেই অভ্যস্ত। আর এখন তো তার সেই অভ্যাস যেন ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।
লরিন আর এশা একসঙ্গে বেরিয়ে যায়। তারা চলে যাওয়ার পর মোহনার রুমে তার মা আসেন। তিনি এসে মোহনার বিছানায় বসলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। মোহনা মায়ের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু বলবে, মা?’
লায়লা বেগম নিরবতা কাটিয়ে গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আচ্ছা, লরিন কি সত্যিই কেবল তোর বন্ধু হয়?’
চলবে…