#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২.
মোহনা কলটা সাথে সাথেই কেটে দিল। এশা ভ্রু কুটি করে বলল,
‘কল কাটলি কেন?’
মোহনা ভয়ার্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
‘যদি এখন ও আমাকে নিচে নামতে বলে? যদি বলে আমি তোমার বাসার নিচে, তুমি নিচে আসো নয়তো আমি তোমার বাসায় চলে আসবো, তখন?’
চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে এশা বলে,
‘তুই তো আগে ওর সাথে কথা বলবি। ও কী বলে সেটা শোনার চেষ্টা করবি। একটা ছেলে তোর জন্য তার দেশ ছেড়ে এখানে চলে এসেছে, ব্যাপারটা কি আর চারটে খানি কথা। এভাবে ইগনোর করে কোনো লাভ নেই। তুই বরং ওর সাথে সরাসরি কথা বল।’
‘আরে ঐ হাঁদারাম এসেছে তো এসেছে আর কয়টা দিন পর আসতে পারল না। এখন আমার বাবাও বাসায়। বাবা আসলে এমনিতেই আমি ভয়ে থাকি, আবার কী নিয়ে উনি রেগে যান। তার উপর এখন আবার ঐ আপদ এসে আমার কপালে জুটেছে। আর এইসব হয়েছে তোদের জন্য। কী দরকার ছিল এই বিদেশি ছেলেকে খুঁজে খুঁজে প্রপোজ করতে বলার? এখন যে বাঁশ খাচ্ছি, মজা লাগছে?’
মোহনা ভয়ে চুপসে আছে। এশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আমরা কী আর জানতাম, বিদেশিরাও প্রেমের ব্যাপারে এত সিরিয়াস হয়। ওরা তো রাতদিন কত মেয়ের সাথেই ডেট করে, আমরা কী করে বুঝবো বল তোর ঐ মজনু একেবারে দেবদাস টাইপ লোক হয়ে যাবে? তুই প্রপোজ করেছিস বলে ছেলে হাত ধুয়ে তোর পিছনেই পড়ে থাকবে? দেশি ছেলে হলেও এক কথা। কিন্তু ঐ বেটা তো বিদেশি হয়েও আমাদের দেশি ছেলেদের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। এমন জানলে আমরা কখনোই তোকে ঐ ছেলেকে প্রপোজ করতে বলতাম না দোস্ত।’
‘এখন আর এসব বলে কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। এখন এসবের থেকে বের হবার উপায় বল। ঐ মজনু কে আমি কী বলে কনভিন্স করব?’
এশা জড়সড় হয়ে বসল। বলল,
‘শোন, বলি।’
কিন্তু কিছু বলার আগেই মোহনার ফোনে কল আসে। আবার সেই লোক। মোহনা চোখে মুখে হতাশার ছাপ ফেলে এশার দিকে তাকায়। এশা তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘কলটা রিসিভ কর। চিন্তা করিস না, আমি তোকে শিখিয়ে দিব সবকিছু।’
মোহনা কল রিসিভ করল। কিন্তু কিছু বলছে না। ওপাশ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এশা তাকে ইশারা করে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিতে বলল। মোহনা তাই করল। অনেকক্ষণ নিরবতা কাটিয়ে মোহনা আস্তে করে বলল,
‘হ্যালো।’
এবার ফোনের অপর পাড়ের ব্যক্তিটিও সজাগ হল। লোকটি গলা ঝেড়ে বলল,
‘হ্যালো, মোহানা?’
মোহনা এশাকে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বেটা আমাকে মোহানা বলছে কেন? আমার নাম তো মোহনা।’
এশা বলল,
‘আরে ওরা ওদের ভাষায় প্রোনাউন্স করছে তাই এমন শোনাচ্ছে। তুই কথা বল।’
মোহনা হালকা কেশে বলল,
‘হু আর ইউ?’
প্রশ্ন শুনে এশা মাথায় হাত দিয়ে বসল। মোহনা ইতস্তত কন্ঠে বলল,
‘কী হয়েছে?’
এশা ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আরে হাঁদিরাম, বেটা তো তার আইডি থেকে মেসেঞ্জারে কল করছে। তুই তো উনার আইডি দেখেই কল রিসিভ করছিস, এখন হু আর ইউ বলছিস কেন?’
মোহনা দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলল,
‘ওহ, তাই তো। সরি সরি’
তারপর সে ফোনের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘হ্যালো, হাউ আর ইউ?’
এশা আহাম্মক বনে গেল। সে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘শুরুতেই হাউ আর ইউ কেন? তুই কি ওর সাথে প্রেমালাপ করবি নাকি?’
মোহনা কাঁচুমাচু করছে। সে কী বলছে, কী করছে নিজেও বুঝতে পারছে না। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় মাথা তার আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গিয়েছে।
কিন্ত তার ফোনের বিপরীতে থাকা লোকটি বেশ স্বাভাবিক। লোকটি স্বচ্ছন্দে জবাবে বলল,
‘I’m fine Mohona. What’s about you? Why didn’t you answer my call? What’s wrong with you?’
মোহনা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
‘Nothing.’
লোকটি ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলল,
‘Just for nothing? You know, I was very worried about you. Mohona, I came to your country. And I stayed in a hotel near your house, now I want to see you. Can we meet Mohona?’
মোহনা নির্বাক। জবাবহীন চাহনীতে সে এশার দিকে চেয়ে আছে। এশা ভেবে বলল,
‘বল দেখা করবি। কাল সকাল এগারোটাই বলে দে।’
মোহনা অস্থির গলায় বলল,
‘কী বলছিস? কীভাবে সম্ভব?’
‘আরে আমি ব্যবস্থা করব। তুই আপাতত ওকে এই কথাটা বলে দেখ।’
মোহনা ঢোক গিলল। লোকটিকে বলল,
‘Ok, then we will meet at eleven tomorrow morning. I will tell you the name of the place in the message. Well now I have to cut the call because my mom is calling me. Bye.’
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মোহনা কল কেটে দিল। এশার দিকে চেয়ে বলল,
‘ঝামেলা তো আরো বাড়ছে এশা।’
এশা বলল,
‘বাড়ছে না। শোন, ওর সাথে কথা বলে ওকে বোঝাতে হবে। সবকিছু খুলে বলবি ওকে। আর আমরাও সবাই সেখানে থাকব। তুই কোনো টেনশন নিস না, ঐ বেটা কে আমরা সবাই মিলে সোজা করে ফেলব।’
মোহনা গাঢ় নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘কী জানি এত সহজে সবটা সমাধান হবে কিনা।’
‘হবে হবে। তুই জাস্ট আমাদের উপর একটু ভরসা রাখ। যেহেতু আমাদের জন্য তুই এই ঝামেলায় পড়েছিস, সেহেতু আমরাই তোকে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করব। এখন শুধু একটু নরমাল হো। মোহনা টিভির চেহারা এত কুঁচকে থাকলে এই টিভিতে কেউ আর নিউজ দেখতে আসবে না। তাই দাঁত কেলিয়ে হাসি হাসি মুখে বসে থাক, ওকে?’
.
.
বিকেলের দিকে মোহনা তার ছোট বোনকে নিয়ে তাদের বাসার ছাদে গেল। তখন এক ঘোলাটে বিকেল। চারদিক তার লাল আভায় ছেয়ে আছে। সূর্যের তেজ নেই, মৃদুমন্দ হয়ে জ্বলছে পশ্চিমাকাশে। ঐদিকে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে। বাড়ির সামনে দুটো নারকেল গাছ। তার পাশ ঘেষেই একটা চার ফুট চওড়া রাস্তা গিয়েছে। এই রাস্তা সবসময়ই ব্যস্ত। মানুষ, যানবাহনে সবসময়ই কোলাহল থাকে এখানে। বিকেলের এই অশান্ত, ব্যস্ত রাস্তাটাই চোখ বুলাতে বেশ ভালো লাগে মোহনার। সে তাই বোনকে নিয়ে প্রায়ই ছাদে আসে। তার বোনের রাজ্যের গল্প। এত সব গল্প শুনতে শুনতে সেই রাস্তায় নিষ্পলক চেয়ে থেকে মোহনার বিকেল কাটে।
আজ আর তার ব্যতিক্রম হলো না। মাহিয়া তার স্কুলের গণিত স্যারের নামে খুব বদনাম করছে। এই স্যার ভীষণ রকম খারাপ। ফাউ ফাউ ছাত্র ছাত্রীদের বকাবকি করেন। মাহিয়ার একদম সহ্য হয় না এই স্যারকে। মোহনা বেশ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছিল। সঙ্গে রাস্তার পথচারীদের ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলাচল দেখছে। হঠাৎই তার দৃষ্টি আটকে গেল কিছু একটা দেখে। সে চোখ ছোট ছোট করে তার দৃষ্টিকোণ সরু করল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বুকের ভেতরে ধক করে উঠল তার। রাস্তার ঐপাশে একটা কাপড়ের দোকান আছে। সেই দোকানের সামনেই সে ঐ ভদ্রলোক কে আবার দেখতে পেল। লোকটি কার সাথে যেন কথা বলছে। ফাঁকে ফাঁকে আবার মোহনাদের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মোহনা ভয় পেয়ে গেল, মাহিয়ার হাত ধরে টেনে তাকে ছাদের অপর পাশে নিয়ে গেল। মাহিয়া অবাক হয়ে বলল,
‘কী হলো আপু?’
‘কিছু না। ঐদিকে রোদ লাগছে।’
মাহিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘রোদ? তুমি রোদ কোথায় পেলে?’
‘উফফ, তুই বুঝবি না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাক চুপচাপ।’
মাহিয়ার কাছে ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগল। সে এক দৌড়ে আবার ঐপাশে গেল। রাস্তার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল কেউ আছে কিনা। কিছুক্ষণ দেখে সে আবার মোহনার কাছে ফিরে এল। তাকে এসে বলল,
‘জানো আপু, রাস্তার ঐপাশ থেকে একটা ছেলে আমাকে হাত নাড়িয়ে হাই দিয়েছে। ছেলেটা বোধ হয় বিদেশি, কী ফর্সা সুন্দর দেখতে!’
চলবে…