বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে এক বিদেশী ছেলেকে প্রপোজ করার পরিণাম যে এতটা বেদনাদায়ক হবে সেটা ক্ষুণাক্ষরেও টের পায়নি মোহনা।
আর পাঁচটা দিনের মতোই আজকের দিনটাও শুরু হলো সুন্দর একটি রোদ ঝলমলে সকাল দিয়ে। সকালটা শুরুর প্রথম থেকে সুন্দর থাকলেও সেই সৌন্দর্য বেশিক্ষণ টিকল না যখন মোহনা তার বেলকনির ঠিক নিচে একজন অতিমাত্রায় ফর্সা লম্বা দেহাকৃতির পুরুষ মানুষকে দেখল। এই তপ্ত, উদ্ভ্রান্ত গরমেও মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে জমে গেল। এতটাই ভয়ানক ভাবে জমল যেন সে কোনো শীতের রাজ্যে বরফ খন্ডে আটকে রয়েছে।
মোহনা টের পেল তার বুকের ভেতরটা অত্যধিক মাত্রায় অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। সে আবিষ্কার করল সেই পুরুষ মানুষটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন নিয়ে কিছু একটা করছে। মনটা তার তখন খঁচ করে উঠতেই রুমের ভেতর থেকে ভো ভো শব্দ এল। তার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা কিসের শব্দ। নির্ঘাত ঐ আহাম্মক লোকটা তাকে কল করছে। মোহনা ফোন হাতে নিল। কল রিসিভ করার সাহস নেই। কেটে দিতেও ভয় করছে। কী একটা ঝামেলায় যে সে পড়েছে, উফ। রিং বাজতে বাজতে কলটা কেটে যাওয়ার পর পরই মোহনা চট করে তার বান্ধবী এশার নাম্বারে কল লাগাল।
ভার্সিটি অফ। আরামদায়ক একটা দিন। এই দিনটা ঘুমের জন্যই বানানো হয়েছে। কিন্তু সেই নিয়মে বা হাত ঢুকিয়ে আজ এই ঘুমের দিনেও কেউ ঠিক কল করে এশাকে বিরক্ত করছে। মাত্রাতিরিক্ত রাগে ফুঁসে উঠে এশা। রিংটোনের শব্দ কানে নিয়েও পাত্তা দেয় না সে। কিন্ত মোহনাও নাছরবান্দা, সে কলের পর কল দিয়েই যাচ্ছে। এশা শোয়া থেকে উঠে বসে। খুব বিশ্রী একটা গালি দিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। স্ক্রিনে দেখে “মোহনা টিভি” লেখা। চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে কলটা রিসিভ করে সে বলে উঠে,
‘এই মোহনা টিভি, সকাল সকাল সংবাদ টেলিকাস্ট না করে আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছিস কেন?’
মোহনা রাগে গর্জে উঠে বলল,
‘খালি তোর ঘুম না, তোদের প্রত্যেক কে ধরে ধরে আমি বারোটা, তেরোটা, একটা বাজাবো। শালি, আমার জীবনে এত্তবড়ো এক বাঁশ দিয়ে উনারা এখন আরামে পড়ে ঘুমাচ্ছে। বের করছি তোদের ঘুম।’
এশা বড়ো করে একটা হাই তুলে বলল,
‘এত প্যাঁচাল না পেড়ে আসল কাহিনী বল। আবার কী করেছিস?’
মোহনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আমি কিছু করেছি? যা করেছিস তোরা করেছিস? সব দোষ তোদের। তোদের জন্য এখন আমি ফেঁসেছি।’
‘আরে বাবা, হয়েছে কী বলবি তো।’
মোহনা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘আরে ঐ পোলা তো সত্যি সত্যি দেশে চলে এসেছে।’
‘তুই কেমনে জানলি?’
মোহনা রেগে গিয়ে বলল,
‘পোলা আমার বাসার নিচে হারামী।’
এশা এক লাফে দাঁড়িয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল “কী” বলে। মোহনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, ও সত্যি সত্যিই চলে এসেছে।’
‘কিন্তু, এক্সেক্ট তোদের বাসার নিচেই কী করে এল?’
‘সেটাই তো। আমিও তো তাই ভাবছি। নির্ঘাত এখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেছে। মানলাম বাংলাদেশে সে চলেই এল, তাই বলে আমার বাসাও এত সহজে খুঁজে বের করে ফেলেছে? আমি তো জীবনেও ওকে আমার বাসার এড্রেস বলেনি শুধু বলেছি আমি বাংলাদেশে থাকি, এইটুকুই। কিন্তু ও আমার বাসার এড্রেস পেল কই? আমাকে না জানিয়ে কে আমার বাসার এড্রেস ওকে দিয়ে দিল?’
‘রাফাত নয়তো?’
‘না, ও ভালো ছেলে। ও এমন করবে না।’
‘তাহলে?’
‘আরে সেটা পরে ভাবা যাবে। আগে বল, এই ছেলের কাছ থেকে আমি এখন বাঁচবো কী করে? সে তো আমাকে মেসেঞ্জারে কল দিয়ে জ্বালিয়ে ফেলছে। আমি এখন কী করব? কাল আব্বুও চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন। আজ যদি উনি এসব দেখেন, তাহলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে।’
‘শোন, এত ভয় পাস না। তুই রুমেই থাক। আর ওর কল ধরার দরকার নেই। আমি আসছি। আমি এসেই যা একটা ব্যবস্থা করব। ততক্ষণ পর্যন্ত তুই নরমাল থাক, ওকে?’
মোহনা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আচ্ছা আয়।’
.
.
ডাইনিং রুম থেকে বাবার গলা পেয়ে মোহনা এক দৌড়ে সেই রুমে গেল। বিচলিত হয়ে বলল,
‘বাবা ডাকছিলে?’
চিকন ফ্রেমের চশমাটা নাক বরাবর নামিয়ে মোহনার বাবা মাহবুব চৌধুরী বললেন,
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ডাকছিলাম যে শুনোনি?’
বাবা কে প্রচন্ড ভয় পায় এই মেয়ে। বাবার স্বাভাবিক প্রশ্নের জবাব দিতে গেলেও ভয়ে বুক কাঁপে তার। যেন কথা গুলিয়ে ফেলে। সহজ কথাটা সহজ ভাবে বলতে গিয়েও জড়িয়ে ফেলে। যেমন এখনটা হচ্ছে। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
‘বা-বাবা আ-আমি ওয়াশরুমে ছিলাম, তাই তোমার ডাক শুনতে পাইনি।’
‘ঠিক আছে, এখন খেতে বসো।’
বুকে ছোট্ট করে একটা ফুঁ দিয়ে চেয়ার টেনে বসল মোহনা। তার ঠিক বরাবর বসেছে তার ছোট বোন মাহিয়া। মেয়েটা চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বসে আছে। আজ স্কুল বন্ধ। সচরাচর এমন বন্ধের দিন অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে মাহিয়া, তবে আজ যেহেতু বাসায় বাবা আছেন তাই আর সাহস করে ঘুমাতে পারল না সে। সবার সাথে তাকেও আজ সকাল সকাল উঠে পড়তে হলো। এই নিয়েই এখন তার যত মন খারাপ।
এক পিস ব্রেড খেয়ে আরেকটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় কলিং বেলের শব্দ হয়। মোহনার মা লায়লা বেগম গেলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখলেন এশা এসেছে। এশা দাঁত বের করে হেসে লায়লা বেগম কে সালাম দিল। লায়লা বেগমও বেশ সাদরে তার সালাম গ্রহণ করে বললেন,
‘ভেতরে এসো মা।’
এশা ভেতরে প্রবেশ করল। লায়লা বেগম দরজা আটকে দিয়ে বললেন,
‘চলো, আমাদের সাথে নাস্তা করবে। আমরা মাত্রই নাস্তা করতে বসেছি।’
‘না না আন্টি, আমি এখন কিছু খাবো না। আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আসলে, মোহনার সাথে একটা নোট নিয়ে জুরুরি ডিসকাশান করার ছিল, তাই এসেছি।’
‘আচ্ছা মা, তুমি তাহলে মোহনার রুমে গিয়ে বসো। আমি ওকে পাঠাচ্ছি।’
এশা সম্মতি জানিয়ে মোহনার রুমে গেল। লায়লা বেগম গিয়ে মোহনাকে বললেন,
‘মোহনা, এশা এসেছে।’
মোহনা খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আচ্ছা, আমি ওর সাথে দেখা করে আসি।’
‘খাবার শেষ করে যাও।’
বাবার কর্কশ কন্ঠ শুনে সুন্দর করে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ল মোহনা। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে চুপচাপ খাবার গিলতে লাগল। মাহবুব সাহেব গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করেন,
‘এত সকাল সকাল এশা কেন এসেছে?’
‘বাবা, আমার কাজ থেকে একটা এসাইনমেন্ট নিতে।’
লায়লা বেগম তখন বললেন,
‘ও তো বলল কী নোট নিয়ে নাকি ডিসকাশান করতে এসেছে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই দুই কারণেই এসেছে। নাহলে ও কী আর এত সকালে উঠার মেয়ে। আচ্ছা, আমার খাবার শেষ; এখন আমি আমার রুমে যাই বাবা?’
‘ঠিক আছে যাও।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মোহনা তার রুমের দিকে পা বাড়াল।
.
অনেক ভেবে চিন্তে এশা বলল,
‘তুই ওর কলটা রিসিভ কর। দেখ ও কী বলে। এভাবে চোরের মতো বসে থেকে তো কিছু হবে না। আমি তো আসার সময় দেখলাম ও নেই। হয়তো আশে পাশের কোনো হোটেলে উঠেছে। এই সুযোগ, ওর সাথে কথা বলে নে। নয়তো পরে দেখা যাবে, ডিরেক্ট তোর বাসার ভেতর এসে হামলা করবে।’
‘কে হামলা করবে?’
মোহনা পেছনে ফিরে মা’কে দেখে আঁতকে উঠল। মা সব শুনে ফেলল না তো? এশাও ঘাবড়ে গেল। লায়লা বেগম কফির স্ট্রে টা বেড সাইড টেবিলে রেখে আবারও সেই একই প্রশ্ন করলেন। এশা আর মোহনা একজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসল। মোহনা হে হে করে হেসে বলল,
‘আরে আম্মু, আমার না সামনে জন্মদিন তাই এশা বলছিল ওরা সবাই এসে নাকি আমার বাসায় হামলা করবে ট্রিটের জন্য। শোন, আমি কিন্তু বলে দিয়েছি আমি কোনো ট্রিট ফিট দিতে পারব না। বাসায় এসে হামলা করেও কোনো লাভ হবে না।’
লায়লা বেগম হেসে বললেন,
‘আচ্ছা, জন্মদিন আসলে না হয় আমিই তোমাদের সবাইকে বিরিয়ানি ট্রিট দিব।’
এশা খুশি হয়ে বলল,
‘ঠিক আছে আন্টি।’
‘আচ্ছা মা, তোমরা তাহলে কফি খাও; আমি আসি।’
লায়লা বেগম চলে যেতেই মোহনা আর এশা নিশ্বাস নিতে পারল। আরেকটু হলেই মারা পড়ছিল তারা। এশা কফির গ্লাস’টা হাতে নিয়ে বলল,
‘নে নে, এবার জলদি কল দে তোর ঐ বিলাতি প্রেমিককে।’
মোহনা চটে গিয়ে বলল,
‘এক লাথি দিয়ে তোকে ঐ বিলাতি ইন্দুরের কোলে নিয়ে ফেলব।’
‘আচ্ছা কে কার কোলে পড়ে সেটা পরে দেখা যাবে। আগে এখন কলটা তো কর।’
মোহনা ভয়ে ভয়ে কল করল। সাথে সাথেই রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে পুরুষালী এক তীক্ষ্ণ সুরে বুকের ভেতরে তার মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ মুখ শুকিয়ে গেল তার। লোকটি বলল,
‘আই কেম টু বাংলাদেশ ডিয়ার, জাস্ট ফর সি ইউ।’
চলবে…?
#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১.