–‘সে আরও এক বছর আগে বিয়ে করে নিয়েছে সূচি।এমনকি দেশেও নেই। পুরো পরিবার সমেত আমেরিকা তে থাকে।
কথাটুকু কর্ণধার হতেই সূচনা চট করে তাকালো স্নেহার পানে।মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না তার।যেন সব দ’লা পাকিয়ে আ’টকে গেছে গ’লায়।গ’লা ঝে’ড়ে পরিষ্কার করে নিল সুচনা।চোখ থেকে উপচে আসা কান্না আটকালো কোনোমতে।কা’পা কাঁপা গলায় বললো –
–‘আ,,আজ তাহলে আস,,আসি স্নেহু, পরে দেখা হবে একদিন।
–‘মাত্রই তো আসলি আর একটু থাক।
–‘না রে যেতে হবে।
স্নেহার উত্তরের অপেক্ষা না করে পেছনে ঘুরে হাটা ধরলো সূচনা।ফিরে তাকালো না পেছনে। চোখ ভিজে উঠেছে তার।দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে মিনিট পাচেক হাঁটলেই একটা পার্ক। সেই পার্কের সামনে এসেই থেমে গেল।মনের অস্থিরতার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছেনা।পা দুটোও যেন চলছে না আর।পার্কের এক কোণে একটা খালি বেঞ্চে বসে পড়লো ধপ করে।চোখ থেকে অনবরত ঝড়ছে অশ্রু। আনমনে আওরাতে লাগলো –
–‘ভালোবাসায় এত বিষাদ কেন?কেন এত বিরহ?সব ভালোবাসা পূর্নতা পায়না কেন?
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নিজেই আবার নিজেকে শোধালো-
–‘আমার ভালোবাসা তো এক তরফা ছিল।সে আদৌ ভালোবাসতো? পছন্দ করতো নাকি কিছুই ছিল না।সে তো আজও ধোঁয়াশা। আর তুই বো’কার মতো সেই ধোঁয়াশার বে’ড়া জ্বালে আটকে আছিস সূচি।এভাবে আর ক’দিন তিন বছর কম কথা না।
চোখ মুছে হাত ঘড়িতে সময় পরখ করে নিল।পাঁচটা বেজে গেছে প্রায়।তাড়তাড়ি ফিরতে বলেছিল তার মা আর সে এত বেলা করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাড়ালো সূচনা। পার্ক থেকে বেড়িয়ে একটা রিকশা ডে’কে উঠে পড়লো,রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
“এতক্ষণ যার কথা হচ্ছিল সে সূচনা কবির তানজুম।এইচএসসি পরীক্ষার্থী।পরীক্ষার্থী বলতে আজকেই শেষ হয়েছে তার পরীক্ষা।মা -বাবা সহ ঢাকাতে থাকে।বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।বাবা আরহাম কবির পেশায় একজন ব্যবসায়ী আর মা মিসেস দিশা গৃহীনি।স্নেহা স্কুল সময়ের এক ফ্রেন্ড সূচনার মূলত তার সাথে ই দেখা করতে ক্যাফেতে এসেছিল।
.
.
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি। বাসায় আসতেই সূচনার মা মিসেস দিশা তাড়া দিতে থাকলেন তাড়াতাড়ি রেডি হওয়ার জন্য। সূচনা বিরক্ত হলো খানিক।বিরক্তি মাখা কণ্ঠে ই জিজ্ঞেস করলো-
–‘কি হয়েছে আম্মু?এত তাড়া কীসের?রেডি হতে বলছো কেন?কে আসবে?
মিসেস দিশা এত প্রশ্ন একসাথে শুনে বললেন –
–‘তোর সব প্রশ্নের একটাই উত্তর।
–‘কি সেটা?
মিসেস দিশা নির্বাক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন-
–‘তোকে দেখতে আসবে আজকে।
মিসেস দিশার কথা শুনে বিস্ময়ের চূড়ায় সূচনা।অবাক চিত্তে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে।মুখে কোনো রা নেই তার।বিস্ময়ের ভাব যেন কাটছেই না।
সূচনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিসেস দিশা বললেন-
–‘দাড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে সূচি।পাত্র পক্ষ এসে পড়বে।
নীরবতার অবসান ঘটিয়ে সূচনা কর্কশ গলায় বলে উঠলো-
–‘আম্মু তুমি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?আজকে মাত্র পরীক্ষা টা শেষ হলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে দিলেনা। নতুন করে টেনশনে ফেলে দিলে।আমি কি বেশি হয়ে গেছি তোমাদের জন্য যে এখনই বিয়ে দিতে চাইছো।অন্তত অনার্স টা তো কমপ্লিট করতে দিবে।
–‘বেশি কথা কেন বলছিস? যা বলেছি তাই করবে।যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
–‘আমি বিয়ে করবোনা আম্মু।
–‘বিয়ে করতে বলিনি।আজকে দেখতে আসবেন শুধু যদি পছন্দ হয় তাহলেই কথা এগোবো নয়তো না।তুই শুধু সুন্দর করে তৈরী হয়ে তাদের সামনে যাবি।
–‘আমি যাবনা আম্মু।
–‘রাগ উঠাস না সূচি।
–‘তাহলে আমার কথা মেনে নাও। না করে দাও তাদের। আব্বুকে বলবো আমি যে তুমি জোর করছো আমাকে।
সূচনার কথা শুনে মুচকি হাসলেন মিসেস দিশা। তারপর বললেন-
–‘ছেলে কিন্তু তোর আব্বুর পছন্দের ই।তোর আব্বু নাকি অনেক আগে থেকেই চিনে।ওনার তো বেশ পছন্দ হয়েছে।আর তোর আব্বুর কাছ থেকে ছেলের বর্ননা শুনে আমারো পছন্দ হয়ে গেছে। এখন শুধু দেখার পা’লা,সামনাসামনি কথা বলার পা’লা তারপর সব।এখন তুই যা।
–‘যাবনা আমি।আসবো না তাদের সামনে।
কথাটুকু বলেই ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সূচনা।
.
.
.
পাত্রপক্ষের সামনে নত মস্তকে বসে আছে সূচনা।তখন রা’গ দেখিয়ে চলে গেলেও তার মায়ের ইমোশনাল ব্ল্যাইকমেলের কাছে হে’রে গেছে। না করতে পারেনি আর।অগত্যা তৈরী হয়ে এসেছে পাত্রপক্ষের সামনে।তাদের সামনে বসার পরে মাথা তুলে তাকায়নি আর। সালাম দিয়ে শুধু তাদের করা দু’টো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল সেটাও নত মস্তকে। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো।একটা মেয়ে।তার বয়সী কিংবা তার চেয়ে একটু ছোট। মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলো-
–‘কেমন আছো ভাবি?
আগন্তুক মেয়েটার মুখে ভাবি ডাক শুনে থতমত খেয়ে গেল সূচনা। এক মূহুর্তের জন্য যেন তব্দা মে’রে গেল।অন্য দিকে আরেক জনের কা’শি উঠে গিয়েছে। মিসেস দিশা তাড়াতাড়ি করে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে।এরই মাঝে পাত্র পক্ষের একজন মহিলা বললেন –
–‘ওদের আলাদা করে কথা বলতে দিলে ভালো হয়।বিয়ে তো ওরাই করবে, সারাজীবন একসাথে ওদেরই থাকতে হবে।তাই বলছিলাম।
মিসেস দিশা ও সম্মতি জানিয়ে বললেন –
–‘হ্যা আপা ঠিক বলেছেন।
তারপর সূচনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন –
–‘সূচি মা ওকে নিজের রুমে নিয়ে যা।
সূচনা মায়ের কথা শুনে অবাক হলো।এভাবে একটা ছেলেকে একা নিজের রুমে নিয়ে যেতে বলছে।আজ মায়ের ব্যবহারে একের পর এক শক খাচ্ছে সে।কিন্তু কি করবে এখন?বি’পাকে পড়লো সে।উপায় না পেয়ে উঠে দাড়ালো। ছেলেটাও উঠে দাড়ালো তার দেখাদেখি। সূচনা তাকে উদ্দেশ্য করে নিচু স্বরে বললো-
–‘আসুন।
বিনা বাক্যে তার পেছনে চলতে লাগলো সে।দুরুদুরু বু’কে তাকে নিয়ে প্রবেশ করলো রুমে।
.
.
বারান্দার এক পাশে সূচনা আর তার থেকে যথা সম্ভব দূরত্ব নিয়ে দাড়িয়ে আছে ছেলেটা।নিরব,নিস্তব্ধ পরিবেশে অচেনা দুই জন মানবী।দু’জনই নিশ্চুপ। মৌনতা ভাঙলো আগন্তুক সেই ছেলেটাই।জিজ্ঞেস করলো –
–‘আপনার নাম কী?
জলপাই রঙা শাড়ীর আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে ভাবনায় মত্ত ছিল সূচনা। হঠাৎ করা প্রশ্নে কেঁপে উঠলো সে।তা দেখে ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে বললো-
–‘আপনি নার্ভাস ফিল করছেন?রিল্যাক্স আমি তেমন কিছু করবোনা।আর আপনার মতামত ছাড়া বিয়ের ব্যাপারে ও কিছু হবে না।এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন।
শীতল কণ্ঠে বলা কথাটুকু শুনে কেন যেন সাহস এলো সূচনার। ইচ্ছে হলো তার কথা বিশ্বাস করতে। আপাদত কম্পনরত হাত আর হৃদপিণ্ড দু’টোকেই সামলাতে হবে।বেসামাল তারা, একটু টেনশনে ই তাদের কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়।নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দিলো-
–‘আমার নাম সূচনা কবির তানজুম।এবার এইচএসসি দিয়েছি।
–‘আচ্ছা। আমি প্রণয়,প্রণয় আহমেদ।পড়ালেখার পাঠ আপাদত চুকিয়ে ফেলেছি।এখন জব করছি মিরপুরের একটা কোম্পানি তে।
–‘ আচ্ছা।
–‘তখন আপনার পাশে যে বসেছিল,ওর নাম ইরা।আমার বোন।
মিনিট দুয়েক মৌনতা পালন করার পর বললো প্রণয়।
তার দিকে না তাকিয়ে ই সূচনা বললো-
–‘ওহ,,
–‘হ্যা,,বাচ্চা মানুষ। এজন্য তখন আপনাকে,,
সূচনা বুঝতে পারলো যে সে কি বলতে চাইছে তাই হালকা হেসে বললো-
–‘সমস্যা নেই আমি বুঝতে পেরেছি।
–‘আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।
–‘জ্বি বলুন।
প্রণয় কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ডাক পড়লো বাইরে থেকে। বারান্দা থেকে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো দু’জন।
#চলবে
#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#সূচনা_পর্ব