#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১৪ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
তোমাকে খুঁজে খুঁজে এই শহরে আমি। বলল শুভ।
পিয়াসা ধ্যাবড়া করে হেসে ফেলল।
ভ্রু নাচিয়ে কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ঠিক বুঝলাম না শুভ ভাই। আমাকে আপনি খোঁজার কারণ?
আমার আরেকটা স্টুডেন্ট আছে। পড়াতে যেতে হবে। তোমার মোবাইল নাম্বার দাও। ডিটেইলস ফোন দিয়ে জানাবো।
পিয়াসা কিছু না বলতেই, আলিশা তার খাতার পৃষ্ঠার এক কোন ছিঁড়ে নিল। বড় বড় করে পিয়াসার নাম্বার লিখে শুভ হাতে দিয়ে দিল।
শুভ সারামুখে খুশির আবরণ ছড়িয়ে দিয়ে, আলিশাকে থ্যাংক ইউ জানাল। তার পর চলে গেল।
পিয়াসা আলিশার দিকে চেয়ে,
আমার নাম্বার দিতে বলছি তোমাকে আলিশা?
আলিশা পিয়াসার চিবুক নেড়ে,
বারে আমি তোমার কলেজ পড়ুয়া হবু ননদিনী। তাই অনুমতির দরকার মনে করিনা হবু ভাবি। আর শুভ স্যারের কথার ঢংয়ে বুঝতে পারলাম তোমার এলাকার ছেলে। নিশ্চয়ই তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তুমি কোথায় আছ,কিভাবে আছ তা জানার জন্যই মনে হয় খুঁজেছে।
আলিশার কথা শুনে পিয়াসা একটু ভাবল। ক্ষণ পরেই বলল, তোমার কথা লজিক্যাল। বাট আমাকে খোঁজার মতো কাছের কেউ নয় উনি। তবে আমাদের একই গ্রাম। দুই বাড়ি পরেই উনাদের বাড়ি। উনি ঢাকায় পড়াশোনা করে এটা জানতাম। বাবা মাঝে মাঝেই বাসায় উনার প্রসঙ্গ তুলতো আমার সাথে।
আর বিয়ের আগে একটিবার ও আমাকে ভাবি বলবেনা। প্লিইইজ।আমার কেমন জানি লাগে বলেই পিয়াসা দৌড় দিলো। বারান্দার দিকে। না দেখা সত্ত্বেই আয়মানের গায়ের সাথে ধাক্কা খেল। আয়মান একপাশ থেকে হাত চেপে ধরলো পিয়াসার। পিয়াসা জোর করে হাত ছাড়িয়ে লাজুক হাসি হেসে ফেলল। আবার ছুট দিল বারান্দার দিকে৷
আয়মান মুখে কিছুই বললনা, শুধু পাশ ফিরে চাইলো পিয়াসার দিকে।
বাংলা সিনেমার একটা গানের কলি তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে খেলে যাচ্ছে।
” ওই চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ /জোছনায় ভরে থাক সারাটি জীবন।
হাজার বছর বেঁচে থাক তুমি,
বুকে নিয়ে স্বর্গের সুখ।
দুঃখ ব্যথা সব ভুলে যাই যে,
দেখলে তোমার ঐ চাঁদ মুখ।
ফুলও তুমি। ফাগুনও তুমি,
গন্ধ বিলাও সারাক্ষণ।
ঐ চাঁদ মুখে যেন…”
আয়মান এগিয়ে বোনের কাছে জানতে চাইলো,
পিয়াসার কি হলোরে?
কি আর হবে। হবু ভাবি বলতেই উনি লাজুক লাজুক বদনে কাঁচুমাচু হয়ে পালালো।
ভেরি গুড়। লজ্জা নারীর ভূষণ। তোর পড়াশুনার কি খবর? শুভ স্যার কেমন অংক করায়? ব্রেনে কিছু যাচ্ছে?
খুউব যাচ্ছে ভাইয়া।
শুভ স্যার পিয়াসাপুর পরিচিত।
আয়মান কিঞ্চিৎ অবাক হলো। কি বলছিস? কিভাবে?
আলিশা যতটুকু দেখেছে ও শুনেছে আয়মানকে জানাল। আয়মান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চলে গেল নিজের রুমে।
আয়মানের মা ছেলেকে নিজের রুমে ডাকলেন। ছেলের সাথে যুক্তি পরামর্শ করে বিয়ের বিষয়ে একটা খসড়া তৈরি করলেন। এবং ছেলেকে আদেশ দিলেন, যেহেতু পিয়াসা আমাদের কাছেই আছে।
তাই ওকে সঙ্গে নিয়েই ওর কেনাকাটাগুলো করিস। আর বিয়েটা হবে সামনের সপ্তাহের শুক্রবারে । ‘ বধু বরন ‘ সেন্টারটি ভাড়া করে ফেলিস। গায়ে হলুদ ছাদে বা বাসায় হবে। প্রায় দুই সপ্তাহ সময় আছে। তোর কোন আপত্তি আছে এতে বাবা ?
আপত্তি নেই মা। তুমি যা ভালো মনে করো।
তবে বিয়ের প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় শাড়ি আমরা সবাই মিলে কিনবো। আর বাইশ ক্যারট সোনার ভরির দাম অনেক পড়বে। তাই আপাতত আমার গহনাগুলো দিয়েই ওকে বৌ সাজানো হবে। শুধু একবার ঘষেমেজে নিলেই চকচক করবে নতুনের মতো।
মা তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে।
আয়মানের মা সন্তুষ্টির চোখে ছেলের মুখপানে চাইলেন। মনে মনে প্রার্থনা করলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
পাশ থেকে আলিশা বলল,আরে কোন গয়না না দিলেও সমস্যা নেই। আপু কুল মাইন্ডের মেয়ে।
তার মা বলল, তা ঠিক বলছিস। কিন্তু আমি চাইনা মেয়েটার এটা মনে হোক, যে আজ এতিম অসহায় বলে এমন সাদামাটা বিয়ে হয়েছে আমার। যদি বাবা মা থাকতো সাধ্যমতো অনুষ্ঠানাদি করতো।
আমরা কি অনুষ্ঠান করব না? সব কিছুই আমাদের এবিলিটির মধ্যে হবে। দশটা নয় পাঁচটা নয় একটা মোটে ভাই। আমার ভাইয়ের মতো ভাই বলেই আলিশা ভাইয়ের বুকে মুখ রাখল।
আয়মান বোনের মাথায় চুল এলোমেলো করে দিয়ে শাসনের সুরে বলল,
বিয়ের নামে পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া চলবেনা। মনে থাকে যেন। শিক্ষা জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো এই সময়। ফিউচার ডিফেন্ড করবে কলেজের রেজাল্টের উপরে। মনে থাকে যেন।
ধুর ভাইয়া। কিসের ভিতর কি পান্তা ভাতে ঘি। বোরিং কথা শুনতে এক ঘেয়েমি লাগে। বিরক্তি নিয়ে বলল আলিশা।
শুনলে মা তোমার ফাঁকিবাজ মেয়ের কথা। গেলাম। ও হ্যাঁ। মা পিয়াসাকে আমার রুমে একটু ডেকে নিই? ওর পছন্দের বিষয়গুলো জেনে নিই। কি বল?
অনুমতি নিতে হবেনা মায়ের। যা ডেকে নে।
আয়মান বের হয়ে গেল। পুলক পুলক মনে বলল,
আরেহ মা আজ একটু বেশী সময় পিয়াসাকে রুমে রাখব। আর পারছিনা থাকতে। আজ বলেই ফেলব ভালোবাসি। এই বাক্য বলতেই তো আমি ঘন্টা লাগিয়ে ফেলব। তোমরা আবার যদি মাইন্ড করো অনেক সময় পিয়াসাকে না দেখে। তাই আগেই বলে নিলাম।
আয়মান রুমে গিয়ে পিয়াসাকে মেসেজ দিল। একটু জরুরী দরকার ছিল। যদি আসতে।
পিয়াসা মেসেজ পেয়েই চঞ্চল হরিণীর মতো ছুটে এলো। দরজা ফাঁক করে ধীর ভঙ্গিতে রুমে ঢুকল।
দরজাটা লক করে দাও।
পিয়াসা চোখ কটমট করে পিয়াসার দিকে চাইলো।
আজব। এভাবে তাকাচ্ছ কেন? খারাপ কিছু বলেছি আমি? জাস্ট দরজা বন্ধ করতে বললাম। এই বাক্যটি কি অশালীন?
পিয়াসা দরজা বন্ধ করলনা। আয়মান উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
তোমার বিয়ের তারিখ শুনেছ?
আপনার কি জরুরী কাজ সেটা বলেন। নিরস স্বরে বলল পিয়াসা।
এত রাগ দেখিয়ে বললে, ভুলে যাব যে জরুরি কথাটাও।
ওকে বলুন। আয়মান পিয়াসার কপালের কালো টিপ খুলে আবার পরিয়ে দিল। কপালের উপরে উড়ে আসা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে দুপাশে সরিয়ে দিল।
এসব ফাজলামো করা আপনার জরুরী কাজ?
নাহ। মা বলছে তোমার বিয়ের কেনাকাটা আমার সাথে গিয়ে করে নিতে। আর তোমার বিয়ে পরের সপ্তাহের শুক্রবারে। এটা বলার জন্যই ডেকেছি।
পিয়াসা মাথা নিচু করে ফেলল। উঠে দাঁড়ালো চলে আসার জন্য। অমনি হাতে থাকা তার মোবাইল বেজে উঠলো। দেখলো আননোন নাম্বার। আয়মান ইশারা দিল তার সামনেই বসে কথা বলার জন্য। লাউড স্পিকার অন করে দিলো আয়মান। প্রথমবার রিসিভ করতে পারেনি পিয়াসা। দ্বিতীয়বার ফের ফোন বেজে উঠলো।
পিয়াসা রিসিভ করেই হ্যালো বলে সালাম দিল। জিজ্ঞেস করলো কে?
অপর পাশের কথাও আয়মান স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। পিয়াসা শুভ বলছি। আলিশার স্যার আর তোমার পাশের বাড়ির সেই ছেলেটি। কেমন আছ তুমি?
আলহামদুলিল্লাহ শুভ ভাই। দিব্যি আছি। আপনি?
আমি এখন বেশী ভালো আছি তোমাকে দেখার পর হতেই।
পিয়াসা অস্বস্তি অনুভব করল শুভর কথায়।
বলেন কেন ফোন দিয়েছেন শুভ ভাই?
শুন চাচা মারা যাওয়ার পর যখন মা বাড়ি থেকে জানালো। তখন আমি খুব ঝামেলায় ছিলাম। তাই সাথে সাথে তোমাদের বাসায় যেতে পারিনি। আর যখন গিয়েছি তখন তোমাকে পেলাম না। পাশের এক মহিলা বলল,
তোমাকে তোমার পরিচিত কে তাদের বাসায় নিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যক্রমে তোমাকে এ বাসায় পাব কল্পনাই করতে পারিনি। এ যেন কোন অচেনা রাজপুরীর গল্প।
আচ্ছা ধন্যবাদ শুভ ভাই। আর কিছু বলবেন?
বলব মানে? আসল কথাটি বাকিই রয়ে গেল যে।
বলেন শুনি।
আচ্ছা একটা সত্যিই কথা বলবে পিয়াসা?
অবশ্যই শুভ ভাই।
চাচা কি তোমাকে আমার বিষয়ে কিছু বলেনি?
পিয়াসা বিস্মিত হয়ে গেল শুভ কথার সুর অন্যরকম দেখে।
হ্যাঁ প্রায়ই বলতো আপনার পড়াশোনার কথা।
আরেহ নাহ। চাচা আমাকে কথা দিয়েছে তোমার পড়াশোনা শেষ হলে আমার সাথে তোমার বিয়ে দিবে।
পিয়াসা চকিতেই বিষম খেল। কণ্ঠে জোর এনে বলল,আমিতো এমন কিছুই জানিনা। আর বাবা যদি বলেও থাকে তা বাবার বিষয়। আমি আপনাকে ছোটবেলা থেকেই বড় ভাইয়ের মতো জানি। সুতরাং এ বিষয়টা আপনি ভুলে যান। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবোনা। লেখিকা রেহানা পুতুল।
কেন পিয়াসা ? কারো সাথে তোমার এফেয়ার চলছে? ফোনের ওপাশে আহত গলায় জিজ্ঞেস করলো শুভ।
হ্যাঁ চলছে । তার সাথেই আমার বিয়ে হবে।
বিয়ে হবে। এখনো হয়নি কিন্তু পিয়াসা। তাকে বুঝিয়ে বল। নয়তো আমিই বলব।
শুভ ভাই আপনি এমন কিছু করে আমার চোখের বিষ হতে চাইবেন না আশাকরি।
বাহ পিয়াসা বাহ! নিজের মৃত বাবার ওয়াদার চেয়ে নিজের প্রেমকে বড় করে দেখলে। ছিহঃ বলে শুভ লাইন কেটে দিলো।
আয়মান এতক্ষন নিরব থেকে লাউড স্পিকারে সব শুনেছে। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। একহাত দিয়ে মাথার পিছনের চুলগুলো খামচে খামচে ধরছে। অজস্র কষ্টের চুলা বুকের ভিতর জ্বলছে দাউদাউ করে।
পিয়াসা একটু থেমে আয়মানকে ডাক দিলো। আয়মান চুপ হয়ে আছে। কিছুই বলছেনা।
আবারো ডাকলো পিয়াসা,
স্যার আপনার শরীর খারাপ? চুপ হয়ে আছেন যে।
আয়মান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আরক্ত চোখে পিয়াসার মুখপানে চাইল। বলল তুমি শুভকেই বিয়ে করো। মিথ্যা বলার কারণ কি ছিল? তুমিতো আর আমাকে ভালোবাসনা। মায়ের জন্যই রাজী হয়েছ। আমি মাকে এক্ষুনি বলি গিয়ে বিয়ে ক্যান্সেল।
ছলছল চোখে পিয়াসা বলল, আমার দিকে চাপাচ্ছেন কেন? আপনি ও তো আমাকে ভালোবাসেন না। মায়ের জন্য রাজী হয়েছেন।
আয়মান চটে গেল। হ্যাঁ আমি কিভাবে ভালোবাসি। আমার কি মন বলতে কিছু আছে নাকি। আমি ভালো বাসতে পারিনি বলেই তো একবার রায়হান তোমার প্রেমিক হয়। আবার প্রেমিক হয় শুভ। বাহবা! চারদিকে পিয়াসার প্রেমিকের ছড়াছড়ি।
চলে যাও বলে আয়মান পা বাড়ালো দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। তখনি পিয়াসা আয়মানের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। আয়মানের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে লুটিয়ে কাঁদতে লাগলো।
আয়মান তাজ্জব বনে গেল। পিয়াসাকে ধরে দাঁড় করালো। কি হয়েছে তোমারতো আনন্দ হওয়ার কথা।
পিয়াসা নরম গলায় বলল,
স্যার আমি শুভকে বিয়ে করবনা। কারণ স্কুলে থাকতে ধরেই আমি একজনকে এক পৃথিবী সমান ভালোবাসি। প্রগাঢ়ভাবে তাকে মিস করি প্রতিটিমুহুর্তে। আপনি পারলে আমাকে তার বুকে নিয়ে দিন।
শুনে আয়মানের মাথার মগজ টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো। পিয়াসাকে ছেড়ে দিয়ে খানিক দূরে দাঁড়াল।
চোয়াল শক্ত করে বলল,
এ দেখি প্রেমিকের সিরিয়াল পিয়াসাকে দিয়ে পিয়াসা মিটানোর জন্য। তাহলে আমার সাথে বিয়েতে রাজী হলে কেন ছলনাময়ী কোথাকার ?
চলবেঃ ১৪