পারিজাত পর্ব ৯

0
1028

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৯

পারিজা যখন চোখ দু’টি খুললো। তখন দেখলো তাঁর সামনে বাড়ির ঝি ব্যাতীত আর কেউ নেই। পারিজাকে চোখ খুলতে দেখে ঝি দৌড়ে এসে বললো,
— ছোট আম্মা,একটু দেখেশুনে চলবেন না? বড় আম্মা এসে যদি এসব শুনেন তাহলে খুব কষ্ট পাবেন।”

পারিজা পুরোপুরি চোখ মেলে বললো,
— আম্মাকে বলো না এসব। আমার শরীরটা ভালো নেই। এখন তুমি যাও।”

ঝি দ্রুতই ঘর থেকে প্রস্থান করলো। পারিজা উঠে বসলো। গায়ে তাঁর তীব্র জ্বর। কাঁপা কাঁপা হাতটা ঘাড়ে রেখে দেখলো রক্ত শুকিয়ে গেছে। পারিজা পুনরায় পালঙ্কে শুয়ে পরলো। গায়ের শাড়িটা শুকিয়ে গেছে। এখন আর বিছানা ছেড়ে ওঠবার শক্তি নেই। পরে উঠে শাড়িটা পাল্টে নেওয়া যাবে।

আনুমানিক সন্ধ্যার দিকে ঝি পারিজার কাছে আসলো। পারিজা তখন বিছানায় আরাম করছে। ঝি পারিজাকে বললো,
— বড় আম্মা, আপনার স্বামী আসছে।”

পারিজা ক্ষনিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ঝি-কে ততক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করলো,
— কে এসেছে? ”

ঝি হেসে বললো,
— আপনার স্বামী এসেছে ছোট আম্মা। ”

পারিজা প্রতুত্তরে কিছু বললো না। ঝি হেসে বললো,
— আম্মা আমার কাজ শেষ। আমি গেলাম ওনাকে বলেছি বাড়ির গেটটা লাগিয়ে দিতে। রান্নাবান্না সব করা আছে। আপনি একটু কষ্ট করে উঠে খেয়ে নিয়েন। আমি গেলাম আম্মা।”

পারিজা তখনও চুপ। ঝি কী তাঁর সঙ্গে মজা করলো? ওয়াহেদ সত্যিই তাঁকে নিতে এসেছে? কিন্তু ওয়াহেদ এখানে কেন আসবে? তাঁকে যে ওয়াহেদ প্রচন্ড ঘৃণা করে। ঘৃণার কারণেই তো সেদিন এতগুলো কথা বললো। ওয়াহেদ তো তাঁকে ভালোবাসে না। তাহলে ফিরে আসলো কেন? পারিজা বিছানা থেকে নেমেই দোর খুলে ছুটে গেল। তাঁর অসুস্থতা, জ্বরের কাঁপুনি সব যেন নিমিষেই সেরে গেল।

নিচতলার ঘরের সামনে একটা মানুষের ছায়া মুর্তি। পারিজা নিচে যেতেই কে যেন তাঁকে একছুটে জড়িয়ে ধরলো। পারিজা থমকে গেল। শরীরের ঘ্রানটাই বলে দিলো মানুষটা কে। সব অভিমান গলে গিয়ে যেন পানি হয়ে গেল।পারিজা জ্বরের ঘোরে ঝাপসা চোখে অনুভব করলো একটা পুরুষ মানুষ তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। পারিজার শরীরটা অকস্মাৎ কেঁপে উঠলো। চোখ মেলে দেখলো এতক্ষন সে যা দেখেছে তা সত্যিই ভ্রম। এখনও সন্ধ্যাও হয়নি। ঝিও বাড়ি ফিরে যায়নি। এবং,অতি আকাঙ্খিত পুরুষটি এখনও উপস্থিত হয়নি। তাঁর জন্য সত্যিই কেউ আসেনি। পারিজার চক্ষু হতে নোনাজল গড়িয়ে পরলো। জ্বরের ঘোরে আজগুবি জিনিস চোখের সামনে ভাসতে থাকলো। পারিজা বিছানায় ছটফট করতে লাগলো। জীবনে কখনোই এতটা একা লাগেনি তাঁর। পারিজা তৃষ্ণার্থ পিপাসিত হৃদয়ে আম্মা আম্মা বলে ডাকতে লাগলো। কেউ কোনো সারা দিলো না। পারিজার ডাকে কেউ সারা দিলো না।

ওয়াহেদ পাড়ার প্রত্যেকটা বাড়িতে খুঁজে ছিল পারিজাকে। কোথাও পারিজার সন্ধান মেলেনি। ওয়াহেদ ভেবেছিল পারিজা কখনোই তাঁর আম্মার কাছে এসে পৌঁছাতে পারবে না। মেয়ে মানুষ এত পথঘাট চিনবে নাকি? প্রকৃতি বড় অদ্ভুত আচরণ করলো ওয়াহেদের সঙ্গে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেই দেখলো তাঁর মা তাঁর জন্য মেয়ে দেখছে। সুগন্ধার মতে,অলক্ষী বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে। শুভ কাজে বেশি দেরি করতে নেই। কবে আবার ওই অলক্ষী ফিরে আসে। সবকিছু আগে আগে সেরে রাখাই ভালো। তাই তো, আগে ভাগেই সব কাজ শেষ করে ফেলতে চাইছেন। ওয়াহেদকে একটা বিয়ে দিতে পারলেই এবার শান্তি।

ওয়াহেদ যখন ঘরে ঢুকলো। তখন সে ঘরে ঢুকেই পারিজার খোঁজ করলো। হঠাৎই তাঁর মনে পরলো পারিজা আজ সারাদিন হতে নিখোঁজ। এবং,তাঁকে এখনও পাওয়া যায়নি। ওয়াহেদ ঘরের একপাশে বসে একটা কথা ভাবলো। আজ যদি সে পারিজাকে না খোঁজে। তবে,আর কখনোই তাঁর সন্ধান পাবে না। সুগন্ধা তাঁর জন্য মেয়ে দেখছে। পারিজাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করা ওয়াহেদের জন্য অসম্ভব। অভিমানে কয়েকটা কথা হয়তো সে বলেছে। তবে,এটাও সত্য যে সে সত্যিই পারিজাকে ভালোবাসে।পারিজার জায়গা কখনোই কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। পারিজার রাগী মুখখানা,অগ্নির ন্যায় উত্তপ্ত মেজাজখানা ছেড়ে অন্যের দিকে মুখ ফেরানো অসম্ভব! ওয়াহেদের ক্লান্তি মুহূর্তেই শেষ!পারিজাকে খুঁজতে খুঁজতে সেদিন আর কাজে যাওয়া হয়নি ওয়াহেদের। ওয়াহেদ চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। দ্রুত হেঁটে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে শাশুড়ির বাড়ি চললো। পারিজা হয়তোবা ওখানেই আছে।

ওয়াহেদ যখন সেখানে পৌঁছালো তখন বিকেলে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে। পুরোটা পথ ওয়াহেদ চিন্তায় চিন্তায় কাটিয়েছে।পারিজার রাগ কীভাবে ভাঙাবে সে?পারিজা কী তাঁর সঙ্গে ফিরবে?

ঝি এসে জানালো সে চলে যাচ্ছে। পারিজা যেন দরজাটা লাগিয়ে দেয়। পারিজা একটু একটু করে উঠে বসলো। নিচে গিয়ে দরজাটা লাগানোর সময়ই কে যেন দরজাটা জোরে ধাক্কা দিলো। পারিজা পিছু ফিরে আবার দরজা খুলে দিতে গেল। মুখভর্তি বিরক্তি! ঝি-টা এই মাত্রই গেল। এখন আবার কে এলো? দরজা খুলতেই সামনে ওয়াহেদের বিষন্ন চেহারা। পারিজা বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওয়াহেদ এখানে তাঁর জন্য এসেছে কী? পারিজা নিজের হাতে আস্তে একটা চিমটি কাটলো। এটা কী ভ্রম নাকি সত্যি? নাহ!সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ওয়াহেদ। এটা কোনো স্বপ্ন নয়।

ওয়াহেদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। পারিজা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
— তোমার মা এখনও তোমার বিয়ে ঠিক করেনি?নাকি বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তোমার?তুমি এখানে আসলে কেন?তোমার তো মায়ের কাছে থাকার কথা!”

ওয়াহেদ কিছু বলার আগেই পারিজা ওপরে চলে গেল। ওয়াহেদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

পারিজা দ্রুত বিছানায় শুয়ে পরলো। সারা শরীর মিইয়ে আসছে। মনে হচ্ছে মাথার ওপাশটা ফেটে যাচ্ছে। পারিজা পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। ওয়াহেদ হাতরে হাতরে ওপরে উঠে পারিজাকে খুঁজলো। পুরো বাড়ি মানবশুন্য। হঠাৎ ওয়াহেদ দেখতে পেল। ওপাশের ঘরের পালঙ্কে কে যেন পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ওয়াহেদ একটু একটু করে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে হাতটা ধরতেই শুয়ে থাকা ব্যাক্তিটি উঠে বসলো। রাগী স্বরে বললো,
— কেমন দেখতে তোমার নতুন বউ?তাঁকে ফেলে আমার কাছে এলে কেন? বিয়েতে পাওয়া সব জিনিস তোমাদের বাড়িতো রাখা। এই বাড়িতে কিছু নেই। তুমি চলে যাও।”

ওয়াহেদ হেসে বললো,
— আমার বাড়ি থেকে এত দামী কিছু দেয়নি। তাই,আমার ফেরত নেওয়ার মতো কিছু নেই। আমার শাশুড়ী আম্মা যে-ই জিনিসটা আমাকে দিয়েছেন। সেটাই সবচেয়ে দামী। আমি তো ওটাই ফেরত নিতে এসেছি।”

পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— তুমি আমাকে এত কথা শোনাবে। তারপরও আমি ফিরে যাবো ভেবেছো? আমি এতটাও সস্তা না।”

ওয়াহেদ আবার হাসলো। হেসে বললো,
— সস্তা জিনিস আবার কেউ ফেরত নিতে আসে নাকি? তুমি অনেক দামী জিনিস বলেই তো আমি এসেছি। আমি খুব লোভী। দামী জিনিসের লোভ ছাড়তে পারি না।”

পারিজার রাগ ক্রোধ খানিকটা বেড়ে গেল। ওয়াহেদের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
— তুমি যে লোভী। সেটা কী আমি আগে বুঝিনি ভেবেছো? তুমি আমাকে বিয়ে করেছো আমার সম্পত্তি দেখে। তোমার ভালোবাসাও সম্পদের প্রতি। আমার প্রতি কখনোই তোমার দয়া,মায়া ভালোবাসা কিছু ছিল না। আজ আমি চলে গেলে। তোমার সম্পত্তিও চলে যাবে। নিজের লাভেই তুমি ফিরে এসেছো। আমার জন্য আসোনি।”

ওয়াহেদের মুখটা তখন বেরঙের বর্ণ ধারন করলো।পারিজার সম্পদের প্রতি বিন্দুমাত্র লোভ তাঁর ছিল না। তাঁর নিজেরও যে কম আছে এমন না। পাড়ার সবচেয়ে দামী,এবং সুন্দর বাড়িটা তাঁদের। টাকাপয়সা, সম্পত্তি কোনোকিছুরই কমতি নেই। তবে, পারিজার সম্পদের প্রতি লোভটা কাজ করবে কী করে? ওয়াহেদ চুপ করে বসে রইলো। পারিজা মনে মনে ভাবলো সে ওয়াহেদের সঙ্গে ফিরবে না। আবার সেখানে ফিরে গেলে তাঁর নিজের কোনো আত্মসম্মান থাকবে না। সম্মান ব্যাতীত কোথাও থাকা অসম্ভব। কেউ ভালোবাসে না তাঁকে। মায়ের পেশাগত কারণে সকলে তাঁকে ঘৃণা করে। কেন করে? তাঁর কী দোষ?

ওয়াহেদ পারিজার শরীরে হাত দিলো। শরীরটা প্রচন্ড গরম। পারিজা নকশীকাঁথা গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে আছে। ওয়াহেদ পারিজার সঙ্গে একই বিছানায় শুয়ে পরলো। পারিজা তখন ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। ওয়াহেদ পেছন থেকে ফিসফিস করে পারিজাকে বললো,
–সত্যিই যাবে না?”

পারিজা কঠিন গলায় বললো,
— না।”

ওয়াহেদ নরম গলায় বললো,
— স্বামী, স্ত্রীর মধ্যে তো কতকিছুই হয়। রাগটা দেখলে শুধু। ভালোবাসাটা তোমার চোখে পরলো না? কিছুতে কিছু হলেই আমার ওপরে চটে থাকো। আমি না-হয় এটাসেটা বলেই ফেলি। তুমি এত কথা ধরো কেন? আমি কিছু বললেই তোমার রাগ হয়। আমারও তো রাগ হয়। আমি কী রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?”

পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো, — সেদিন রাতে তুমি ঘর ছেড়ে বের হওনি? বানিয়ে ছানিয়ে একটা মিথ্যা কথা বলে। আমাকে ভোলাবে ভেবেছো? আমি এতটাও বোকা নই।”

ওয়াহেদ পারিজার হাতটা ধরে বললো,
— কানুর দোকানে বসে চা খেয়ে গল্প করেছি। বাইরে গিয়ে কোনো মেয়ের সঙ্গে রাত কাটাইনি।”

পারিজা ওয়াহেদের দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো। সবকিছু যন্ত্রণার লাগলেও ওয়াহেদের কথাগুলোয় সত্যি একটা শান্তি ছিল। যে-ই শান্তিটুকুর জন্য পারিজা সারাদিন ছটফট করেছে। সেটা সত্যিই ওয়াহেদের কথাগুলোতে উপস্থিত ছিল।

পারিজা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলো। ওয়াহেদ তাঁর পাশে শুয়ে আছে। গভীর ঘুমে মগ্ন ওয়াহেদ। পারিজা উঠে গিয়ে খাতা নিয়ে বসলো। দোয়াত কলমে কালি ভিজিয়ে লিখলো,
— আম্মা,
আমি তোমার পারিজাত বলছি। আমি এখানে এসেছিলাম। কিন্তু, তোমাকে দেখতে পাইনি। আমার তোমাকে না দেখার শোক এখনও কাটছে না। বিয়ের পর থেকে তোমার সঙ্গে একটাবার দেখা তো দূর কথাও হয়নি। আমাকে এত পর করে দিলে আম্মা? আমি কী তোমার কেউ না?”

পারিজা পৃষ্ঠাটা ভাঁজ করে রেখে দিলো। আম্মার ওপর তাঁর প্রচন্ড অভিমান জমে আছে।

পারিজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে কখনোই ওই বাড়ি ফিরবে না। তবে, ওই বাড়িতে না ফিরলে সে নিজের কাছেই হেরে যাবে। হারার মতো মেয়ে সে না। সে প্রমান করেই ছাড়বে তাঁর আম্মা খারাপ না। সত্যি বলতে মানুষ আসলে খারাপ হয় না। পরিস্থিতি, তাঁদের খারাপ হতে বাধ্য করে। পেশা কখনোই একটা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারন করতে পারে না। মানুষ তো বেঁচে থাকার জন্য অনেককিছু করতেই বাধ্য হয়। তাই বলে তাঁরা কী খারাপ? তাঁদের মন তাঁদের চরিত্র খারাপ?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here