#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৫
— কোন কালে এসে পরেছি দেখেছো? ছোট ভাই তাঁর বড় ভাইয়ের কথা অমান্য করে। যে-ই মেয়ে নিজের ভাসুরকে এতগুলো বাজে কথা শোনাতে পারে। সে কোন জাতের মেয়ে সেটা আমার ঢোকে না। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষছি আমি!”
পারিজা নিজের শাশুড়ির মুখে এসব শুনে স্থির রইলো। সময়ের জবাব সময় দেবে। এখন কথা না বাড়ানোই ভালো।
ওয়াহেদ সকালে খেয়েদেয়ে বেড়িয়ে গেছে। পারিজা দোতলার সিঁড়ির সামনের ঘরটার সামনে পা রাখতেই জোরে জোরে অ আ পড়ার শব্দ আসছে। পারিজা চুপটি করে ঘরটার দরজা দিয়ে উঁকি দিলো। বড় ভাসুরের ছেলে নিনিত মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে পড়ছে। বয়স বারো কী তেরো। পারিজা ঘরে পা ফেলে বললো,
— তুমি লেখাপড়া পারো বুঝি?”
নিনিত পেছন ফিরে পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— দেখছো না আমি পড়াশোনা করছি? তুমি এখন যাও তো বাপু।আমাকে অনেক পড়া পড়তে হবে।”
পারিজা হেসে বললো,
— তা তো দেখছিই তুমি পড়াশোনা করো। এখন আমার সঙ্গে একটু গল্প করো ”
নিনিত পেছন ফিরে বললো,
— কী গল্প? তুমি গল্প জানো? আমায় একটু শোনাবো।”
পারিজা গাল ফুলিয়ে বললো,
— তুমিই তো বললে চলে যেতে। এখন আবার গল্প শুনতে চাইছো যে?”
নিনিত দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
— সে তো এমনিই বলেছি ছোটমা। চলো আমরা গল্প করি।”
পারিজা হেসে বললো,
— গল্প করবো তোমার সঙ্গে। কিন্তু, এখন না। এখন একটু পুকুর পাড়ে যাবো। ওখানে বসে বসে গল্প মনে করবো। তারপর এসে তোমায় বলবো৷ তুমি আবার হারিয়ে যেও না যেন ”
নিনিত হেসে মাথা ঘোরালো। পারিজা তাল তলার পুকুরের ধারে এসে বসলো। নিনিতকে লিখতে দেখেছে পারিজা। তাঁর মানে নিনিত পড়াশোনা জানে। আচ্ছা, নিনিতকে বললে কী নিনিত একটা চিঠি লিখে দেবে? ওটা পারিজা আম্মাকে পাঠাবে। নিনিতকে বললে নিনিত না করবে না। কিন্তু, চিঠিটা পাঠাবে কীভাবে পারিজা? আম্মার সঙ্গে কতদিন হয়েছে কথা হয় না। পারিজার খুব ইচ্ছে করে আম্মার সঙ্গে বসে বসে পুরনো দিনগুলোর মতো আম মাখা খেতে। কিন্তু, এখন যে এসব আর সম্ভব না। কখনো আম্মার সঙ্গে দেখা করতে দেবে কিনা তাও সন্দেহ। পারিজা এসব ভাবতে ভাবতে পুকুরের পাড় ঘেঁষে জল হাত ভেজাতে লাগলো। অকস্মাৎ কে যেন পারিজাকে ধাক্কা দিলো! পারিজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানিতে গিয়ে পরলো। আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পেল হালকা আকাশী রঙের শাড়ি পরা কোনো নারীর অবয়ব। পারিজার এরপরে আর কিছুই মনে রইলো না। খানিকটা সময় পানির মধ্যে হাত পা ছুড়াছুড়ি করলো বাঁচার জন্য। কিন্তু, এতে কাজ হলো না।পারিজার যন্ত্রণা,বেদনা পানি ছাড়া কেউ শুনলো না। কেউ বুঝলো না।
ওয়াহেদ কাজ শেষে দুপুরে বাড়ি ফিরলো। আজ আগে আগেই চলে এসেছে ওয়াহেদ। শরীরটা সকাল থেকে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বড় ভাই এহমাদকে ব্যবসার ভার বুঝিয়ে দিয়েই সে ফিরে এসেছে। দুপুরে খেতে বসে ওয়াহেদ স্বাভাবিক ভাবেই সবাইকে দেখলো। শুধু দেখলো না পারিজাকে। ওয়াহেদ সরল মনে ভেবে নিলো পারিজা আজ দুপুরে নিচে খেতে নামেনি। সবাইকে স্বাভাবিক দেখে ওয়াহেদের মনেও কোনো প্রশ্নের উদয় হলো না।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওয়াহেদ ওপরে গিয়ে দেখলো ঘরে দরজা আধখোলা। ওয়াহেদ ভেরানো দরজাটা খুলতেই দেখলো, পারিজা খাটের ওপরে শোয়া। টপা বসে বসে পারিজার মাথায় পানি দিচ্ছে। ওয়াহেদ পারিজার অবস্থা দেখে কিছুটা চমকে গেল। সকালেও যে মেয়েটাকে একদম সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে গেল। এখন কী আবার হলো? ওয়াহেদ চিন্তিত গলায় টপাকে বললো,
— কী হয়েছে তোর ভাবীর?”
টপা উত্তেজিত গলায় বললো,
— ছোট ভাবীকে আমি ভালোই দেখেছিলাম। এই সকালের দিকে না কি পুকুর পাড়ে বসে ছিল। তখনই পরে গেছে পুকুরে। পানিতে পেট ফুলে গিয়েছিল। পেটে চাপ দেওয়া মাত্রই ওয়াক করে এতগুলো পানি বের হয়েছে। এখন গায়ে জ্বর করেছে।বড় ভাবী বলেছে ছোট ভাবীকে পুকুর পাড়ের আলগা জিনিসে ধাক্কা মেরেছে। নয়তো এমন ভালো একটা মানুষের এই অবস্থা হয়? এজন্যই লোকে বলে একা একা পুকুর পাড়ে বসে থাকতে হয় না। আলগা জিনিসের নজরে পরলে এরা খবর করে ছাড়ে!”
ওয়াহেদ টপার কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,
— এই চুপ করতো! জিজ্ঞেস করেছি একটা কথা। বিরবির করতে করতে সাতসমুদ্র তেরো নদী পার করে দিচ্ছে! যা এখন এখান থেকে। পারিজাকে আমি দেখে রাখতে পারবো।রান্না ঘর থেকে গেলাস ভর্তি করে দুধ রুটি নিয়ে আসবি। এখন যা!”
ওয়াহেদের কথা শুনে টপা চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ওয়াহেদ পারিজার শরীরে হাত রাখলো৷ শরীরটা প্রচন্ড গরম। ওই তাল তলার পুকুরের পানি খুব ঘোলাটে।পারিজাকে যদি পুকুর পার থেকে তুলে এনে ভালো পানি গিয়ে গোসল করাতো। তবে, এভাবে শরীরে জ্বর আসতো না। কিন্তু, এই বাড়ির মানুষের সেই জ্ঞান আছে কী? পারিজা এভাবে তাল তলার পুকুরে ডুবে গেল। তবুও,কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। যেন কিছুই হয়নি। বাড়ি ফেরার পর কেউ একটু জানালো না পর্যন্ত!মেজো ভাই সত্যি একটা কথাই বলেছে। বাড়িটাকে আজকাল মানুষের বাড়ি মনে হয় না। মনে হয় পাগল জন্তু জানো/য়ারের বাড়ি! একটা জীবিত মানুষ পঁচে মরলেও তো কেউ দেখবে না! টপা সেই মুহূর্তে দুধ রুটি রেখে গেল ওয়াহেদের সামনে। টপা চলে যেতেই ওয়াহেদ আস্তে আস্তে পারিজাকে ডাকলো,
— পারিজা! এই পারিজা! একবার ওঠো দেখি!”
পারিজা ওয়াহেদের গলার স্বর শুনে পাশ ফিরে শুতেই ওয়াহেদকে দেখলো। ওয়াহেদ একেবারে পারিজার মাথার সামনেই বসা। হাতে খাবারের থালা। পারিজা আবার চোখ বন্ধ করলো। ওয়াহেদ কানের সামনে অবিরাম চেচিয়েই চলেছে। পারিজা বিরক্ত হয়ে ওয়াহেদের দিকে তাকালো। ওয়াহেদ নরম গলায় বললো,
— ওঠো দেখি একটু খেয়ে নাও। নাহলে আরো শরীর খারাপ করবে যে ”
পারিজা খাবারের থালাটা দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— আমি খাবো না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
ওয়াহেদ হেসে বললো,
— কেন? তাল তলার পুকুরের ঘোলাটে পানি খেয়ে পেট ভরে গেছে বুঝি? তোমার যদি এখন এই খাবার মুখে না রোচে৷ তবে, টপাকে বলে আরো এক গামলা ওই পুকুরের পানি আনাই? তিনবেলা খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবে তোমার।”
পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকালো। ছি ছি! ওয়াহেদ মাথামুন্ডু গেছে না কি! ওই বিচ্ছিরি পানি পেটে গেছে বলেই পারিজার মুখে আর কিছু রুচছে না। টপা দিদিও খাবার নিয়ে এসেছিল। কিন্তু, ওই খাবার মুখের সামনে নিতেই গা গুলিয়ে উঠেছে। ঘোলাটে পানির ওই বিচ্ছিরি গন্ধ এখনও নাকের সামনে ভাসছে বুঝি!
সন্ধ্যার দিকে পারিজার শরীরটা বেশ সুস্থ হলো। পারিজা আলতো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামার চেষ্টা করলো। হঠাৎ সুগন্ধার সঙ্গে পারিজার দেখা হলো। সুগন্ধা পারিজাকে দেখে মুখ কালো করে ঘরে চললেন। পারিজা প্রথমে মুখ ফিরিয়ে নিলো। পরেরবার হঠাৎই চোখ ফিরিয়ে আবারও শাশুড়ীর দিকে তাকালো। আতংকে পারিজার গায়ে কাঁটা দিলো। পানিতে ডুবে যাওয়ার আগে পারিজা আকাশী রঙের শাড়ির যেই অবয়বটা দেখেছিল। হুবহু একই রঙের শাড়ি তাঁর শাশুড়ির গায়ে! পারিজা এবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বুঝতে আর বাকি রইলো না তাঁর আসলে;ঘটনা কী ঘটেছে!
চলবে……