পারিজাত পর্ব ৩

0
1378

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৩

পারিজা শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে নিচের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। দুটো ননদী আর তাদের বাচ্চারা কাল চলে গিয়েছে। বাড়িটা হালকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু, উঠোনে কয়েকটা বাচ্চার শোরগোল। ওয়াহেদের বড় দুই ভাইয়ের বাচ্চা ওরা। যদিও পারিজার এখনও ওদের কারো সঙ্গেই কথা হয়নি।তবুও বাচ্চাগুলো বেশ মিষ্টি দেখতে। এদিক ওদিক ছুটে ছুটে খেলছে একটু পরপর। পারিজা শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে হেঁসেলের দিকে এগোলো। তাঁর ভাগ্য ভালো। দুটো জা-ই খুব ভালো।

সুগন্ধা মির্জা হেঁসেলে গিয়ে দেখলেন পারিজা মাত্র হেঁসেলে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি মুখ কিছুটা কালো করে বললেন,
— বাড়িটা আজকাল অলসের দখলে চলে গেছে। কাজে আর কেউ হাত লাগায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তামাশা দেখে।”

পারিজা কথার মানে বুঝতে পেরে জলদি কাজে হাত লাগালো। সুগন্ধা মির্জা পারিজার সামনে মরিচের ঝুড়িটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
— মরিচগুলো পাটায় পিষে দাও তো। মরিচের ঝাল না হলে আবার তোমার শশুর বাবা খেতেই পারেন না।”

পারিজা মরিচের ঝুড়িটা নিয়ে পাটা আর শিল নোড়া নিয়ে কাজ শুরু করলো। হাতটা খুব জ্বালা পোঁড়া করছে। লাল হয়ে গেছে। পারিজা তবুও থামলো না। বেঁচে থাকার জন্য হাত পা নাড়িয়ে খেতে হয়। বসে বসেই বা আর কয়দিন!

মরিচগুলো বেঁটে বাটিতে তুলে রাখলো পারিজা। হাতটা ধুয়ে উঠে দাঁড়াতেই। ভিজিয়ে রাখা কাপড়গুলোর কথা মনে পরলো। ওগুলো যে ছাঁদে শুকাতে দিতে হবে। পারিজা কাপড়গুলো নিয়েই ওপরে ছুটলো। ছাঁদের দড়িগুলোতে কাপড় মেলে দিয়ে। কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো। বাড়িটা খুব উঁচু। বাড়ির সামনের বড় পুকুরটা। পাড়ার বেশ কিছু বাড়িসহ অনেকটা জায়গায়ই দৃশ্যমান। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন কাঁধে হাত রাখলো। পারিজা চমকে পেছন ফিরে তাকালো। একটা মহিলা দাঁড়ানো পারিজার সামনে। পারিজা অবশ্য তাঁকে চেনে। এই বাড়ির ঝি এটা। সবাই টপা দিদি বলে ডাকে। পারিজা হেসে টপা দিদির দিকে তাকাতেই তিনি বললেন,
— এই ভর দুপুরে একা একা কী করছো এখানে? ভূত প্রেত তো একা পেলেই ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়।”

পারিজা টপার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তাই না কি? আমি যে এতবার একা একা ছাঁদে উঠেছি। কাউকে তো দেখলাম না।”

টপা পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— সে কী তোমার সামনে এসে বলবে? এই আমি ভূত, আমি তোমার সামনে এসেছি দেখো।”

টপার কথা শুনেই পারিজা হেসে ফেললো। টপা হঠাৎ পারিজার হাত দুটো ধরে বললো,
–তোমার হাত দুটো এমন লাল হয়ে আছে কেন? কী হয়েছে হাতে?”

পারিজা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললো,
— বাবা না কি মরিচের ঝাল পছন্দ করেন৷ তাই মা মরিচ বেঁটে দিতে বলেছিল।”

টপা হঠাৎ কপালে হাত রেখে বললো,
— কী বলো গো ছোট ভাবী! এত বছর ধরে এই বাড়িতে কাজ করছি। কাউকে তো কখনো মরিচের ঝাল খেতে দেখিনি। এই বাড়ির কেউই তেমন একটা ঝাল খায় না বললেই চলে। তোমাকে আবার মরিচের বেঁটে দিতে কে বলেছে?”

পারিজা চুপ করে রইলো। মুখে টু শব্দও করলো না। শাশুড়ী মা যে তাঁকে কষ্ট দেবার জন্যই এসব করতে বলেছেন। তা পারিজা ঢের টের পেল।

ওয়াহেদ ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো। পারিজা তখন তেলের বাটি হাতে নিয়ে নিজের মাথায় তেল দিচ্ছে। সুগন্ধি তেল, এই তেল চুলে দিলে একটা সুন্দর ঘ্রান বের হয়। ওয়াহেদ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
— কেউ যে বাড়ি ফিরেছে তা তো কারো মনেই নেই। সবাই নিজেদের রূপচর্চায় ব্যস্ত।”

পারিজা তেলের বাটিটা সাবধানে রেখে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলে বের হতে চাইলেই ওয়াহেদ পেছন থেকে হাত টেনে পারিজাকে নিজের কাছে টানলো। শান্ত গলায় বললো,
— আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো কোথায়?”

পারিজা চুলে হাত রেখে বললো,
— তুমিই তো কাল বললে, আমি তোমার আশেপাশে থাকলে তোমার ভালো লাগে না। ”

ওয়াহেদ পারিজাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
— সে তো আমি অনেক কিছুই বলি। সব কথা ধরতে আছে না কি?”

পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— বেশ তবে। আজ থেকে আমি আর তোমার কোনো কথাই শুনবো না।”

ওয়াহেদ পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— শুনো না। সব বারন শুনতে হবে সেটা তো বলিনি।”

পারিজা নিজের তেল মাখা হাতটা ওয়াহেদের গালে ছুঁইয়ে দিতেই। ওয়াহেদ চিৎকার করে বললো,
— একি করলে! আমি এই সুগন্ধি তেল দেই না কি? ছি ছি! মেয়েদের মতো গন্ধ বেরোবে গা থেকে।”

পারিজা হেসে আবারও ওয়াহেদের মাথায় দু’হাত দিয়ে তেল মেখে দিলো। ওয়াহেদ বিরক্ত হয়ে বললো,
— তোমাকে বারন করলাম তো পারিজা। এসব কিন্তু আমার ভালো লাগে না। ”

পারিজা হেসে ওয়াহেদের কথার জবাবে বললো,
— সে তো তুমি কতকিছুই বলো। সব কথা ধরতে আছে না কি?”

ওয়াহেদ রেগে গিয়ে পারিজার দিকে তাকালো। মেয়েটা তাঁকে বড্ড জ্বালায়। বারবার কথার ফাঁদে ফেলে!

পরদিন সুগন্ধা আবারও পারিজাকে মরিচের ঝুড়ি ধরে দিয়ে বললেন,
— কালকের ঝালটা যা হয়েছিল না! তোমার বাবা তো খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ!আজকেও একটু মরিচ পিষে দাও দেখি।”

পারিজা হাসি মুখে সম্মতি জানালো। পাটায় কয়েকটা মরিচ পিষেই মেঝেতে শিল নোড়া দিয়ে জোরে জোরে বেশ কয়েকটা আঘাত করলো। মেঝে ফেটে দিয়ে ফাটলের সৃষ্টি হলো। সুগন্ধা দৌড়ে হেঁসেলে ঢুকে বললেন,
— কী হয়েছে? এত জোরে জোরে কীসের শব্দ হলো।”

পারিজা মুখটা কিছুটা দুঃখের ভঙ্গি করে বললো,
— মা, মরিচ পিষতে গিয়ে শিল নোড়া হাত থেকে পরে গিয়ে মেঝেতে পরে গেছে। এত সুন্দর মেঝেটা তো আমার জন্য ফেটেই গেল!”

সুগন্ধার চোখ তখন কপালে উঠলো। মুখটা কালো করে পারিজাকে বললেন,
— থাক তোমার আর মরিচ পিষতে হবে না। টপাকে বলবো ওই পিষে দেবে। তুমি এখন ওঠো দেখি।”

পারিজা দুঃখিনীর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। মনে মনে মিটমিট করে হাসলো। বেশ শিক্ষা হয়েছে আজ। শুধু শুধু মরিচ পেষাবে। আর সে কিছুই বলবে না। সেটা কী হতে পারে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here