পারিজাত পর্ব ১

0
2440

ছি ছি ছি! শেষ অবধি এমন ঘরের মেয়েকে ছেলের জন্য আনলাম! ছিহ! মানসম্মান যে ধুলোয় বালিতে মিশে একাকার হয়ে যাবে! এখনই বাড়ি থেকে বের করো এই অলুক্ষনে মেয়েলোককে!”

পারিজা বিহ্বলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ীর দিকে। কাল তো সব ঠিকঠাকই ছিল। আজ তাহলে এহেন আচরণের হেতু কী?

ওয়াহেদ দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। মুখভর্তি একরাশ বিরক্তি। নিচে এসে দেখলো বাড়ির সবাই নিচে গোল হয়ে জমা হয়ে গেছে। বিনিত গম্ভীর গলায় বললো,
— এই সকাল সকাল বাড়িতে হুলস্থূল না পাকালে চলতো না? শান্তি আর পেলাম না কোথাও!”

ছেলের কথার কোনো গুরুত্বই দিলেন না সুগন্ধা। গলায় উঁচিয়ে চিৎকার করে বললেন,
— কোন কালনাগিনীকে ঘরে তুলেছি জানিস? আমাদের জমিদারী মান-সম্মান কিছুই যে আর থাকলো না। ছিহ!”

ওয়াহেদ ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ঝেড়ে কাশো দেখি মা! তোমার আধো কথা শুনে আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সোজাসাপ্টা কাজের কথায় এসো।”

সুগন্ধা মির্জা অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁর সামনে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালেন। ওয়াহেদ বিষ্মিত হয়ে বললো,
— একি! তুমি তোমার এত আদরের ছেলের বউ পারিজাতের দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেন? কাল অবধি তোমাদের কত মিল মহব্বত। আজ আবার কী হলো?”

ওয়াহেদ কথা শুনে সুগন্ধা মির্জা ফুঁসে উঠলেন। দেখে মনে হচ্ছে যেন আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। পারিজাতের দিকে আঙুল তুলে বললেন,
— কোন নষ্টা মেয়ে মানুষের হয়ে কথা বলছিস তুই? লাজলজ্জা বিহীন নষ্টাটা তোকে এভাবে হাতিয়ে নিলো?”

পারিজা বিষ্ময় দৃষ্টিতে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। হচ্ছেটা কী তাঁর সঙ্গে? পারিজা একবার পাশ ঘুরে তাকালো। পুরো বাড়ির উঠোন জুড়ে বাড়ির মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। বড় দুই ভাসুর, ভাসুরদের ছেলে মেয়েরা। সঙ্গে দুই ননদ। তবুও এমন করে চিৎকার করে যাচ্ছে তাঁর শাশুড়ী। সুগন্ধা মির্জা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে উঠোনের দুপাটি সিঁড়িদুটোতে বসে পরলেন। ওয়াহেদ অবাক হয়ে তাঁর মাকে বললো,
— ও মাগো! কী হলো তোমার? ”

সুগন্ধা মির্জার মেজো ছেলে মাহমুদ বললো,
— হতে আর কী বাকি রেখেছে তোর বউ? আমাদের বংশের নাম তো এবার ডুবিয়ে ছাড়লো।”

ওয়াহেদ বিস্মিত হয়ে বড় দু-ভাইয়ের দিকে তাকালো। ওয়াহেদের বড় ভাই এহমাদ পরিস্থিতি সামাল দিতে বললো,
— হয়েছে কী সেটা সাফ সাফ বলবি তো! কী ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছিস!”

মাহমুদ ক্রোধের দৃষ্টিতে তাঁর ছোট ভাইয়ের বউ পারিজাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
— এই যে এত সাধ করে বড় ঘরে মেয়ে আনলে। তা কোন কালসাপিনীকে ঘরে এনেছো তা কী জানো?”

ওয়াহেদ মেজো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মানে কী বলতে চাইছো ভাই?”

মাহমুদ অগ্নিদৃষ্টিতে পারিজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
— এই মেয়ের জন্মপরিচয় জানো তোমরা? বিয়ের সময় আমাদের সকলকে এর মা বলেছিল তাঁর স্বামী নাকি মৃত। সত্য তো এটাই যে এই মেয়ের কোনো জন্মপরিচয়ই নেই! নষ্টা ঘরে মেয়ে এটা! এত বাড়ি ঘর যা দেখেছো সব তো এর মায়ের গতর বিক্রির টাকা দিয়ে কেনা!”

ওয়াহেদ হালকা স্বরে বললো,
— মানে?”

মাহমুদ রক্তরাঙা দৃষ্টিতে পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এই মেয়ের এত এত টাকা পয়সা, বাড়িঘর দেখেই তো তোকে আমরা বিয়ে দিয়েছিলাম! কিন্তু, সত্যি কী জানিস তুই? ওর মা মানে তোর শাশুড়ী তোকে বলেছিল ওর বাবা নেই। কিন্তু, সত্যিটা এই যে ওর বাবাকে তা ওর নিজের মা-ই জানে না।”

ওয়াহেদ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মানে?”

মাহমুদ ওয়াহেদের সামনে গিয়ে পারিজাতের দিকে আঙুল তুলে বললো,
— ওর মা কী করতো জানিস তুই? ওর মা হচ্ছে নষ্ট পাড়ার বাসিন্দা! ওর মা হচ্ছে নষ্টা! বাড়ি সম্পত্তি যা দেখেছিস সব হচ্ছে শরীর বিক্রির টাকায় কেনা। আমরা না জেনে না বুঝে তোর সঙ্গে ওই বে***র মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।”

পারিজা তাঁর মেজো ভাসুরের কথা শুনে বললো,
— এসব কী বলছেন আপনারা? আপনারা তো সব জেনে বুঝেই বিয়ে ঠিক করেছিলেন। তাহলে, এখন কেন এসব বলছেন?”

মাহমুদ রেগে গিয়ে পারিজার সামনে গিয়ে বললো,
— এই মেয়ে! তোমার মা যে একজন নষ্টা। সেটা কী আমরা জানতাম? তুমিও তো বলোনি? তোমার সঙ্গে বিয়ের সমন্ধ করার সময় তোমার মা বলেছিল তোমার বাবা মারা গেছেন। এইসব সম্পত্তি ওনার রেখে যাওয়া। কিন্তু, আমরা কী জানতাম তোমার কোনো পিতৃ পরিচয় নেই! সবচেয়ে বড় কথা তুমি একটা বে**র মেয়ে। তোমার মা একটা ভন্ড! জেনে-বুঝে তোমাকে গছিয়ে দিয়েছে। গছানোর হলে অন্য করোর সঙ্গে গছাতো! নষ্টা মেয়েলোক!”

পারিজার শাশুড়ী সুগন্ধা ছুটে এসে পারিজাতের চুলের মুঠি ধরে বললো,
— এই মেয়ে! তোর মায়ের এত সাহস হলো কী করে রে? আমাদের জমিদারী পরিবারে নষ্টা গছানোর! তোর মতো নষ্টাদের জায়গা এখানে না। কালই তুই বেরিয়ে যাবি বাড়ি থেকে।

কষ্টে,যন্ত্রণায় পারিজার চোখ থেকে নয়নজল গড়িয়ে পরলো। ওয়াহেদ একবার রক্ত চক্ষু মেলে পারিজাকে দেখলো। পারিজার হাত দুটো টেনে ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিয়ে চললো। পারিজাত প্রচন্ড বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওয়াহেদ তাঁকে?

ওয়াহেদ ওপরে উঠে ঘরের দরজাতে খিল দিয়ে পারিজাকে মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। পারিজাত যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো। ওয়াহেদ পারিজার চুলের খোঁপাতে শক্ত মুঠো করে ধরলো। পারিজা লজ্জায় চোখদুটো বন্ধ করলো। বিন্দু বিন্দু পানির কনা গুলো উপচে পরছে। ওয়াহেদ রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
–আমি তোমাকে একটা ভালো মেয়েমানুষ মনে করেছিলাম। কিন্তু, আজকের পর থেকে তুমি আমার কাছে শুধুমাত্র একজন প্রতারক নারী। তুমি আমার সঙ্গে প্রতারনা করেছো। তোমার মুখ আর দেখতে চাই না আমি! সাধ্য থাকলে এখনি বাড়ি থেকে বের করে দিতাম! ছিহ! তোমার মা এই কাজ করে? তুমিও একবার সত্যটা বলতে পারতে আমাকে। কিন্তু, বলোনি! স্বার্থপরের মতো সবকিছু জেনেও মুখ বুজে ছিলে। আর কখনোই তোমার মুখ দেখতে চাই না আমি। কাল ভোরের আগেই যেন তোমার মুখ দর্শন করতে না হয়।”

ওয়াহেদ ধপ করে দরজাটা খুলে বেড়িয়ে পরলো। শেষের কথাগুলো পারিজার গায়ে একটু বেশিই লাগলো। আত্মসম্মানবোধ তাঁরও আছে। কিন্তু, আম্মা? আম্মা তাঁর সাথে এটা করলো কীভাবে? আম্মা যে বলেছিল সব জেনে বুঝেই ওরা বিয়েতে রাজি হয়েছে। তাহলে, এখন এসব হচ্ছে কেন?

পারিজা মেঝে থেকে উঠে বসে নিজের গা পরিস্কার করলো।দোর খুলে নিচে গেল। আবার, মাথায় খোঁপাটা শক্ত করে বেঁধে নিচের বড় গেট বরাবর পৌঁছাতেই বড় ননদ লতা পথ আঁটকে দাঁড়ালো।
প্রশ্নের সূরে বললো,
–কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

পারিজা ছলছল নয়নে কেঁদে বললো,
–আমার স্থান যেখানে।”

লতা কড়া গলায় বললো,
–এখনও কোথাও যেও না। বাবা আসুক, তিনিই সবকিছুর হেস্তনেস্ত করবেন। এমনিতেই পাড়ায় আমাদের নাম ডুবিয়েছো। তোমার জন্য আবার অপমান সইতে পারবো না। ”

লতা আর কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। পারিজাত আর কোথাও গেল না। নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিলো। অপেক্ষা শুধু রাতের। পারিজা জানে না তাঁর কপালে কী আছে।আদৌও কী ঠাঁই মিলবে শশুর বাড়িতে? না কি ফিরে যেতে হবে? কিন্তু, ওয়াহেদ? ওয়াহেদ কেন তাঁকে ভুল বুঝলো?কাল রাতেও তো কত কথা দিয়েছিল। সবসময় সুখে রাখবে। কখনো কষ্ট দেবে না। তাহলে, আজ কেন না জেনে না বুঝে এত কষ্ট দিলো?

চলবে….

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here