#পারমিতা
পর্ব—০৫
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
গুপ্ত কর্নার শহর থেকে খানিকটা বাইরে,যেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশকিছু সময় লেগে গেলো।
তারপর রোড নং ৩৭ এর খোঁজ।
খুঁজতে খুঁজতে রোড নং ৩৭ এর সন্ধান মিললো।কিন্তু এখন পারমিতার ঠিকানা কিভাবে খুঁজে বের করবে আকাঙ্খা।
যাকে জিজ্ঞেস করছে কেউ সঠিকভাবে কিছু বলতে পারছে না।এভাবে অনেকক্ষন খুঁজতে লাগলো।যখন একবার এই জায়গাতে এসে পড়েছে পারমিতার খোঁজ সে নিয়েই ছাড়বে,কোনোমতেই এখানে আসাটা বিফলে যেতে দেওয়া চলবে না।
আরো ভালো করে খুঁজতে থাকে পারমিতা,এক পর্যায়ে একটা ক্লু পেয়েও গেলো।তবে সেইরকম পাকাপোক্ত কোনো ক্লু নয়,একটা লোক খানিকটা আন্দাজ করে পারমিতার ঠিকানা জোগাড় করে দেয়,পারমিতা মারা গেছে আজ থেকে নয় বছর আগে,এখানে অনেকে হয়তো চেনেও না তাকে,শহুরে এলাকা বলে কথা।নিত্য নতুন কতো লোক শিফট হয় এইজায়গায়, কতলোক চলে যায়।কে কার খোঁজ রাখে।
সেই ক্লু অনুসারে একটা বাসায় এসে উপস্থিত হয় আকাঙ্খা।একটা ছোট ফ্যামিলি।বাড়িটা ভীষণ সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে।
ভেতর থেকে দুজন বৃদ্ধ লোক বেরিয়ে আসে, একজন ভদ্রলোক,সাথে তার স্ত্রী।
বাড়িতে বছর আঠারো উনিশের একটা ছেলেও আছে,আর একজন মধ্যবয়স্কা বিধবা মহিলা।
এ ছাড়া কারো সাথে দেখা হলো না আকাঙ্খার।
সবাই ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে আছে,আকাঙ্খাকে দেখে নানান প্রশ্ন তাদের মনে।
—-হ্যাঁ,বলুন।আপনি এতো দূর থেকে আমাদের বাড়ি বয়ে এসেছেন। কি উপকার করতে পারি আপনার?(বৃদ্ধ ভদ্রলোক)
আকাঙ্খা কিভাবে কী প্রশ্ন করবে বুঝতে পারছে না কিছুতেই,পারমিতা যদি সত্যি তাদের বাড়ির সদস্যা হয়ে থাকে তবে,আর সে মারা গিয়ে থাকে,তার ব্যপারে কথা বলতে একটু সংকোচ বোধ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
—কি হলো,আপনি চুপ আছেন যে,বলুন।কি জানতে চান।আচ্ছা এক গ্লাস জল দেবো আপনাকে?(বিধবা মহিলা)
—হুমম,দিতে পারেন।
ছেলেটাকে ইশারা করতেই একগ্লাস ঠান্ডা লেবুজল নিয়ে আসলো।
আকাঙ্খার হাতে এগিয়ে দিতেই সে গ্লাসটা নিয়ে পুরোটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো(পান করে নিলো)।
এমনিতে সত্যি ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছিলো তার, জিনিসটা এই সময়ে বেশ কাজে লাগলো।
—এবার আপনি বলুন,কি বলতে চান?
—হ্যাঁ,অবশ্যই।দেখুন আমি আসলে আপনাদের বাড়িতে একজন মানুষের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।
—একজন মানুষের ব্যাপারে,কোন মানুষের ব্যাপারে?
—দেখুন সে ছিলো,কিন্তু এখন আর নেই আমি তার ব্যাপারেই কথা বলতে চাই।
—মানে ঠিক বুঝলাম না,আর আপনি আমতা আমতা কেন করছেন ম্যাডাম,যা বলার খুলে বলুন।সংকোচ করার কোনো কারণ নেই।
—এই বাড়িতে নয় বছর আগে পারমিতা নামে কেউ থাকতো,আমি মূলত পারমিতার বিষয়ে কথা বলতে এসেছি আপনাদের সাথে।
—হ্যাঁ,পারমিতা আমাদের বাড়িরই মেয়ে।কিন্তু সে গত হয়েছে আজ থেকে প্রায় নয় দশ বছর আগে,এখন তার সম্বন্ধে কি জানার প্রয়োজন হলো আপনার?
—দেখুন,আমার আসলে ওর ব্যপারে জানাটা খুব প্রয়োজন।প্লিজ আমি কিছু প্রশ্ন করি, আপনাদের হার্ড করার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।
—ঠিক আছে,করতে পারেন।এই যে পাশেই ওর মা দাঁড়িয়ে আছে।
(বিধবা ভদ্রমহিলার দিকে ইঙ্গিত সবার)
তার মানে এই বিধবা মহিলা পারমিতার মা হন।
—আচ্ছা,পারমিতা মারা যাবার কারন টা কি, নরমাল মৃত্যু নাকি কোনো এক্সিডেন্ট কেস?কি হয়েছিলো ওর সাথে?
—দেখো মা,কিছু মনে করো না।তোমায় মা বলেই ডাকলাম।পারমিতা বেঁচে থাকলে আজ তোমার মতোই দেখতে হতো।
—আমি কিছু মনে করি নি আঙ্কেল,আপনি বলুন।(সহাস্য বদনে)
—ওর মৃত্যুটা এখনো একটা রহস্য আমাদের কাছে,আজ পর্যন্ত কেউ ওর মৃত্যুর কোনো কারন খুঁজে বের করতে পারে নি।আর আমরাও জানতে পারলাম না।
—বুঝলাম,কিন্তু ও যেদিন মারা যায় সেদিন বা তার আগে কোনো বিশেষ কিছু ছিলো কি?ওর মৃত্যুর সাথে কোনো না কোনো কারণ নিশ্চয়ই জরিয়ে আছে,তাই না?
—বিশেষ কিছু ছিলো মানে?ওর বিয়ে ছিলো সেদিন।।২০১১ এর ৬ই জানুয়ারি।বিয়ের দিন একপ্রকার অদ্ভুত ভাবে মৃত্যু হয় ওর।কি বলবো আমরা কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি নি মা,যে মেয়েটার বিয়ে করে শ্বশুড়বাড়ি যাবার কথা ছিলো তাকে কফিনের কাপড় পরে কবরে যেতে হবে (চোখ মুছতে মুছতে বৃদ্ধ ভদ্রলোক)
—প্লিজ আপনি কাঁদবেন না আঙ্কেল।প্লিজ, দেখুন এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আমি কিন্তু প্রশ্ন করতে পারবো না।
—না,মা আমি ঠিক আছি। বলো।
—আপনি যে বললেন ওর বিয়ে হচ্ছিল? তো কার সাথে বিয়েটা হচ্ছিলো।আমি বলতে চাইছি কে সে,তার পরিচয় কী??
—তার কথা বলে আর কি হবে,তুমি কি আর চিনতে পারবে।সে তখন সবে মেডিকেল পাশ করে বেরিয়েছে।মস্ত বড়ো ডাক্তার হতে চলছিলো সে।সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিলো তার।
(মেডিকেল ,ডাক্তার এই কথাগুলো শুনে বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো আকাঙখার!)
আমরা ভাবলাম যেহেতু দুজনের পড়াশুনা শেষ, দুজনেই চাকরি পেশায় নিয়োজিত হবে।তার আগেই বিয়েটা হয়ে যাক।দীর্ঘ পাঁচ বছরের রিলেশন ছিলো ওদের।একে অপরকে পাগলের মতো ভালোবাসতো,কেউ কাউকে চোখে হারাতো না।আমাদের মেয়েটা একটু বদরাগী, মেজাজী ছিলো ঠিক,কিন্তু ছেলেটা একেবারে বিপরীত মেরুর মানুষ।এইটুকু টা টু শব্দ করতো না পারমিতার ওপর।
মজার ব্যপার হলো পারমিতাকে প্রচুর ভয়োও পেতো সে।
যতোই ঝগড়া মনোমালিন্য হোক না কেন দিনশেষে দুজন দুজনকে ছাড়া চলতো না, একদিন দেখা না হলে বা কথা না বলতে পারলে যেন পাগলপ্রায় হয়ে যেতো।
(আকাঙ্খা ভদ্রলোকের কথাগুলো হা করে শুনে যাচ্ছে,মনে মনে ভীষণ ভয়ও পাচ্ছে সে।কোন ছেলের কথা বলছেন ভদ্রলোক,সেই জানে)
দু’পক্ষের পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে ঠিক হয়।
দুজন দুজনের বিয়েতে কি খুশি,আমাদের বুঝতে না দিলেও তাদের ভেতরে আনন্দ টা আমাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে নি।
—তারপর কি হলো?
—বিয়ের দিন রাতে,একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আমরা সবাই বর বৌএর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।কখন তারা আসবে,তারপর বিয়ের কাজ শুরু হবে।পারমিতাকে একটা পার্লারে যেতে হলো বিয়ের সাজগোজের জন্য।পার্লারটা কমিউনিটি সেন্টার থেকে খানিকটা দূরে ছিলো।
পারমিতার যথাসময়ে পৌঁছানোর কথা,এদিকে বিয়ের সময় বয়ে যাচ্ছে।
বৌএর কোনো খোঁজখবর নেই।
ফোনের পর ফোন দিয়ে যাচ্ছে সবাই,ওপাশ থেকে কেউ ফোন তুলছে না।
এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা অতিক্রম হয়ে যায়।কিছু লোকজন খুঁজতেও বেরিয়ে পড়লো,ওর বর পর্যন্ত সাথে গেলো।কিন্তু তারা সবাই হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
অপেক্ষা করতে করতে সকাল হয়ে গেলো, আমাদের সমস্ত গেস্টরা চলে যায়,কিন্তু তখনো পারমিতা এলো না।
চিন্তায় সবার শোচনীয় অবস্থা।ঐদিন আমাদের থেকেও বেশী কষ্ট পেয়েছিলো পারমিতার বর। বেচারার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমরা কেউ।
এরপর দুপুরের দিকে একটা কল আসে।পারমিতার দূর্ঘটনার খবর পেলাম আমরা, সবাই হাসপাতালে ছুটে যাই।গাড়ির ড্রাইভার বেঁচে গেলেও আমারা মেয়েটাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেললাম।ওর সেই মৃত্যুর যন্ত্রণা আজো বয়ে বেড়াচ্ছে সবাই।
হঠাৎ করে কিভাবে কি হয়ে গেলো,কিভাবে দুর্ঘটনা ঘটলো,কেন হলো।আজ পর্যন্ত সবার অজানা।শুধু জানি একটা দুর্ঘটনা হয়েছে।আর তাতে আমাদের মেয়ে মারা যায়।
এখানে একটা বিষয় ধরতে পেরেছে আকাঙ্খা, পারমিতার পেটের ভেতরে সে নিজে বিষের শিশি পেয়েছে,এরা সেই ব্যাপারে কিছু জানে না এখন পর্যন্ত,পারমিতার মৃত্যু নিছক দূর্ঘটনা ছিলো না,এটা সে নিশ্চিত।
—-আচ্ছা,আমার শেষ প্রশ্ন।আপনি যে এতোক্ষণ পারমিতার বরের কথা বললেন?কে সে?
সে এখন কোথায় থাকে? নাম কি তার।আমাকে তার ব্যপারে কিছু বলা যাবে কি?
একটা ভয়ানক প্রশ্ন করে বসলো আকাঙ্ক্ষা, সে নিজেও জানে না এর উত্তর কি আসবে?
এই একটা উত্তর আকাঙ্খার জীবনের সবকিছু উলটপালট করে দেবার জন্য যথেষ্ট!
——সে এখন মস্ত বড়ো ডাক্তার,তার নাম আরফান জামান!
সেই নয় বছর পরে আজ তোমার সামনে নামটা উচ্চারিত হলো আবার।
বৃদ্ধলোকের কথা শুনে ধপাস করে সোফার ওপরে বসে পড়ে আকাঙ্খা,তার হাতের মোবাইলসেট টা মাটিতে পড়ে যায়।
বিদেশ থেকে ডাক্তারি পাশ করে ফিরে আসার পরেই বিয়ে হয় আকাঙ্খার,আরফান তার জীবনের অতীত কেন লুকলো আকাঙখার থেকে.?
ওনাদের কথাঅনুসারে পারমিতার মৃত্যুতে আরফান একজন নিষ্ক্রিয় চরিত্র মাত্র।যদি তাই হবে,পারমিতাকে এতোটাই ভালোবাসতো সে, পারমিতার সমস্ত অতীত কেন মুছে ফেলেছে সে নিজের জীবন থেকে,প্রকৃত ভালোবাসা কি এভাবে চিরতরে হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায়?
এমনকি পারমিতার লাশ দেখেও নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত বলার সাহস পেলো না সে!
কিন্তু কেন?
কিসের এতো ভয় আরফানের কিসের এতো সংকোচ তার?
চলবে,,,,