পর্ব—-১৩
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ
পরের দিন রাতে আকাঙখা জামান নিজের প্লান অনুসারে পারমিতার দাদাভাই আর মায়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।যদিও তাদের দুজনকে সে নিজেই একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।
আরফানকে কিছুই জানায়নি আকাঙখা,
যা করার সে একা একাই করছে।
এ ছাড়া কোনো উপায় নেই তার কাছে, আরফানো তার সন্দেহর বাইরে নয়।
আকাঙখা শুধু একা যাচ্ছে না,সাথে পারমিতাও আছে।পারমিতাকে আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না,শুধুমাত্র আকাঙখা ছাড়া।
আকাঙখা আগেই পারমিতাকে শিখিয়ে দিয়েছে কি কি করতে হবে?
সেই অনুসারে কাজ করবে সে।
কিন্ত কাজটা এতো সহজ সরল পথে হবে বলে মনে হয় না।
পারমিতার মা আর দাদার বাসাটা একটা ফাঁকা জায়গায়,বাসার আশেপাশে আর তেমন কোনো বাসা নেই,যা আছে একটু দূরে।
কাছাকাছি যেতেই ভেতর থেকে একটা আওয়াজ টের পায় আকাঙখা।
মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ জোরে জোরে কথা বলছে,আরো কাছে যেতেই বুঝতে পারলো,শুধু কথা নয়,কেউ ঝগড়া করছে হয়তো।
আকাঙখা বুঝতে পারছে না কিছুই,যে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে ভেতরে।
সে যতটা সম্ভব ভেতরের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছে।
—-সর্বনাশ,এতো ধস্তাধস্তি হচ্ছে মনে হয়,কিন্তু এই ঘরের ভিতর পারমিতার মা আর দাদাভাই ছাড়া কে আছে?
আশ্চর্য তো।
হঠাৎ পারমিতার মায়ের জোর গলার আওয়াজ দরজা ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসলো।
—ছিহ!বাবা।তার মানে আপনি এতোটুকু পাল্টান নি।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম সব।।ভেবেছিলাম আপনি হয়তো শুধরে নিয়েছেন নিজেকে,কিন্ত আমি ভুল জানতাম,আমার বোঝা উচিত ছিলো আপনি শুধরানোর মানুষই নন।
—চুপ,একদম চুপ।আস্তে কথা বলো,আর তুমি কিসের এতো জ্ঞান দিচ্ছো আমায়।বেশ করেছি,আমি যা করেছি বেশ করেছি।
—এতোকিছু করার পরেও আপনার ভেতরে এতটুকু অনুতাপ হচ্ছে না,বলছেন যা করেছেন ঠিক করেছেন?
—হ্যাঁ,ঠিক করেছি।গতকাল পারিনি তাতে কি হয়েছে,আজকে তো পারবো,আজ না পারলে পরেরদিন ঠিক পারবো।
বুড়ো লোকটা কিসের গতকালকের কথা বলছে,কি পারেনি সে,কি করতে চাইছে লোকটা!
—না,আপনি কোথাও যাবেন না,আমি সব বলে দেবো সবাইকে বলে দেবো।
—কি বলে দেবে,কি বলে দেবে তুমি বৌমা.?
—আমি বলবো আপনি ডাক্তার ম্যাডাম এর ক্ষতি করতে চান,,এমনকি তাকে মারার জন্য মুখোশ পড়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে যান।এসব আপনার কাজ।ভাগ্যিস আমি কাল ধরে ফেলেছিলাম আপনাকে।নয়তো আমি নিজেও আপনার কুকর্মের কথা জানতে পারতাম না।
ভদ্রমহিলার কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো আকাঙখা জামানের।
তার মানে সত্যি গতকাল রাতে পারমিতার দাদুই মারতে এসেছিলো তাকে,আকাঙখার সন্দেহই সঠিক।
আজ এদের কথা শুনে নিজের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হলো তার।
—আপনি ডাক্তার ম্যাডাম এর সাথে কেন এমনটা করছেন বাবা,দেখুন উনি আমাদের কত কষ্ট করে খুঁজে বের করেছেন,উনি আমাদের পরীর হারিয়ে যাওয়া লাশ দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন,আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ওনার কাজের জন্য।তাছাড়া উনি এটাও আশ্বাস দিয়েছেন আমাদের যে পারমিতার খুনিকে খুঁজে বের করবেন।
আর সেই আপনি কিনা ওনাকেই মারতে চাইছেন।আমার তো এবার অন্য কিছু সন্দেহ হচ্ছে।
—কি বললে তুমি?কি সন্দেহ হচ্ছে তোমার,, বলো,বলো।
এই বৃদ্ধ লোকের গলায় এতো জোর বাহির থেকে ওনাকে দেখে বা শুনে বোঝা সম্ভব নয়,যা আকাঙখাও বুঝতে পারে নি।
—–আমার তো মনে হচ্ছে আমার মেয়ের মৃত্যুর পেছনে আপনার কোনো না কোনো ইন্ধন ছিলো,যদিও এই কথা আগে স্বপ্নেও কল্পনা করি নি আমি,কিন্তু আজ আপনার এই অদ্ভুত ব্যবহার আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে।
—তোমার এতো বড়ো সাহস হয় কিকরে,তুমি আমাকে সন্দেহ করো।
আমি বুঝে গেছি,সব বুঝে গেছি আমি।
—কি বুঝে গেছেন।
—আমি বুঝে গেছি,আগে ঠিক কোন কাজটা করতে হবে আমায়,তোমার খুব মুখ হয়েছে,এই মুখ বন্ধ করার দ্বায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।
—-ছি ছি ছি!বাবা।কি বলছেন কি আপনি এগুলো।আপনাকে মানুষ বলতে ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে আমার,আপনি আমার সাথে এ কেমন ব্যবহার করছেন,আমি সম্পর্কে আপনার মৃত ছেলের স্ত্রী হই।
—একদম,ঠিক ধরেছো আমি মানুষ নই,আমি কোনোদিন মানুষ ছিলামও না,আমি কতো বড়ো অমানুষ বুঝতে পারবে আজ তুমি?
—-কি,কি করবেন আপনি আমায় (পারমিতার মা ভয়ার্ত স্বরে)
—কি করবো? যেটা দেখতেই পাবে শুধু শুধু শুনে সময় নষ্ট কেন করবে।
—আমি এক্ষুনি গিয়ে ডাক্তার ম্যাডামকে সব বলে দেবো,আপনি ওনার ক্ষতি করতে চাইছেন,পারীর মৃত্যুতে আপনার যে হাত থাকতে পারে সেটাও জানিয়ে দেবো।
—তুমি এখান থেকে বের তবেই না সবাইকে সবটা জানাতে পারবে,কিন্তু আমি তো তোমাকে সেই সুযোগই দেবো না।
পারমিতার মা এগিয়ে আসতে চাইলেই বৃদ্ধ লোকটা তাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেন।
এতোক্ষণ পারমিতা আর আকাঙখা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের সমস্ত কথা শুনছিলো,কিন্তু এবার আর কিছু একটা না করলেই নয়,নয়তো এই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি করে দেবে পারমিতার মায়ের।
আকাঙখা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো,ভেতর থেকে লক থাকার কারনে কিছুতেই ওপেন হচ্ছে না।
এদিকে ভেতর থেকে পারমিতার মা অনেক লড়াই করে ছুটে এসে দরজাটা খুলে দিলেন,
তার পেছনে পেছনে পারমিতার দাদাভাই।
দরাজাটা খুলেই হতবাক দুজনে।
নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তারা।
আর কিকরেই বা বিশ্বাস করবে,নয় বছর আগের মরে যাওয়া কোনো মানুষ যদি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সেটা কারোর পক্ষেই বিশ্বাসযোগ্য ব্যপার হতে পারে না।
পারমিতার মা আর দাদাভাইয়ের ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাক।নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তারা।
পারমিতাকে দেখে ওর দাদাভাই বেশি ঘাবড়ে যায়!
—কে,কে এটা?কে তুমি?
–আমায় চিনতে পারছো না দাদা,আমি পারি, তোমাদের পারি।
পারমিতার কথা শুনে তার মা কেঁদে দিলেন…।
—-না,না তুই পরি হতে পারিস না,কিছুতেই হতে পারিস না,নয় বছর আগে মারা গেছিস তুই।
—না,আমি মারা যাই নি,আমি বেঁচে আছি,এই যে তোমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি দেখো।(আকাঙখার প্লান অনুসারে কথা বলে পারমিতা)
—এটা হতে পারে না,কিছুতেই হতে পারে এটা।
—মা পারি,এ কি বলছিস তুই।আমরা সেদিন ও হাসপাতালে তোর লাশ দেখে আসলাম নিজেদের চোখে,আর এখন কিনা বলছিস তুই মারা যাস নি।এটা কিকরে হয়া(পারমিতার মা )
—না,আমি মারা যাইনি,দেখো,এই যে দেখো আমি বেঁচে আছি।
—না,মিথ্যে,মিথ্যে বলছো তুমি
।তুমি কিছুতেই পরি হতে পারো না।কিছুতেই হতে পারো না।(পারমিতার দাদা)
—কেন হতে পারে না?পারমিতা তো সত্যি বেঁচে আছে,এই দেখুন সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও।আপনার কেন বার বার এটা মানতে অসুবিধা হচ্ছে?(আকাঙখা)
—হ্যাঁ,অসুবিধা হচ্ছে।হচ্ছে অসুবিধা।কারণ আমি.আমি নিজে.
কথাটা বলেই বৃদ্ধ লোকটা আটকে গেলেন।। আর কিছু বললেন না।
—কি,আপনি,এইমাত্র কিছু একটা বললেন না,,, বলুন আপনি নিজে কি করেছেন পারমিতার সাথে.? (আকাঙখা)
—-কিছু না,আমি কিছু বলতে চাই নি..
—আপনি না বললেও আমি বুঝে গেছি যে পারমিতাকে আর কেউ নয়,আপনিই খুন করিয়েছেন।আর কেন করিয়েছেন সেই কারনটাও আমার জানা।(আকাঙখা)
আকাঙখার কথা শুনে পারমিতার মা কান্না নিজের সংবরন করে তাকে জিজ্ঞেস করে,
—তুমি পারমিতার খুনের ব্যপারে এতো কিছু কিকরে জানলে মা,আর সত্যি করে বলো এই মেয়েটা কে?
ভদ্রমহিলার কথা শুনে আকাঙখা পারমিতার দাদাভাইকে পেছনে ফেলে তার দিকে এগিয়ে যায়!
—-আমি আপনাকে সব খুলে বলবো মা।তার আগে আমাদের।
পারমিতার দাদাভাই একটা শুকনো কাঠ কুড়িয়ে এনে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই পারমিতার মাথায় সজোরে আঘাত করার জন্য উদ্যত হলেন।
পারমিতার মা এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে সামনে থেকে আকাঙখাকে সরিয়ে দেয়।
বৃদ্ধ কাঠটা উপরে তুলতে যাবে ঠিক তক্ষুণি পেছন থেকে কেউ একটা এসে তার পিঠে একটা সজোরে আঘাত করে।
সবার চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে।
আকাঙখা আর পারমিতার মা ছুটে যায় সে দিকে।
এতো ডক্টর সৌজন্য!
—আরে এটা কি করলে তুমি….???
কি করলে?(আকাঙখা)
—এই বুড়োটা আপনায় মারতে যাচ্ছিলো ম্যাডাম,আমি না থাকলে ও আজ একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতো এখানে (সৌজন্য )
—দূর্ঘটনা ঘটার কি বাকি আছে আর,তোমার ওনাকে এইভাবে আঘাত করা ঠিক হয়নি,আমি ঠিক সেভ করে নিতাম নিজেকে।
সৌজন্য চুপ হয়ে গেলো।
সে এসে সেভ করেছে আকাঙখাকে,নয়তো বৃদ্ধ লোকটা আজ একটা অঘটন ঘটিয়ে দিতো।
—বাই দ্যা ওয়ে,আর ইউ ওকে ম্যাডাম। আপনি ঠিক আছেন তো?
—হ্যাঁ,আমরা ঠিক আছি।কিন্তু তুমি এতো রাতে এখানে কিকরে এলে?
—সে কথা পরে হবে ম্যাডাম,আগে এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।ওর মুখ থেকে সত্যিটা বের করে ছাড়বো আমি,এতোক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকল কথা শুনেছি আমি।
পারমিতার দাদাভাই এখনো পুরোপুরি জ্ঞান হারায় নি।
অস্ফুট স্বরে সে বলতে লাগলো….
—হ্যাঁ,আমিই খুন করিয়েছি।পারমিতাকে আমি নিজে খুন করিয়েছি।ও আমার পরিবারের জন্য একটা কলঙ্ক,ও অন্য কারোর পাপের ফসল, কিকরে নিজের নাতনি হিসেবে মেনে নিতাম ওকে।ও আর ওর মা আমার ঘরে আসার পরে একের পর এক সব হারিয়েছি আমি,নিজের সম্পত্তি হারিয়েছি, ব্যবসা হারিয়েছি,নিজের ছেলেকে পর্যন্ত হারাতে হয়েছে আমাকে।কি করতাম আমি ছেড়ে দিতাম ওকে।যা করেছি বেশ করেছি আমি,ওর মতো অপয়ার কোনো অধিকার ছিলো না এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার।
বৃদ্ধর কথায় সবাই হতবাক!
—আমি জানতাম,এমন একটা জঘন্য কাজ কেবল মাত্র আপনার দ্বারাই সম্ভব।নিচ। অমানুষ কোথাকার।(আকাঙখা)
আকাঙখার কথা শুনে বৃদ্ধ
ভদ্রলোক হাসতে থাকে…
সবাই আরো বেশী অবাক হয়ে যায় তার এই আচরণ দেখে।
—আমি অমানুষ,আমি নিচ।তাই তো।।। তাহলে সে কি ম্যাডাম?আপনার আমার ওপর আজ খুব ঘৃনা বোধ হচ্ছে তাই না।আসল সত্যটা এখন পর্যন্ত আপনি জানেন ই না।
—কিসের সত্য,আর কিসের আসল ঘটনা। বলুন আমায়,আর কি জানার বাকি আছে?
—পারমিতার খুনের সাথে শুধু আমি না,আরো একজন মানুষ জড়িয়ে আছে।তার নামটা শুনলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন তো।তখন আমার মতোই তাকে অমানুষ,নিচ মনে করতে দ্বিধা বোধ হবে না তো?
চলবে…..