পানপাতার ঘর? পর্ব ৭+৮

0
839

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ০৭+৮
লেখা – Mahfuza_Monira

সকাল থেকেই সোহেলা বেগম বেদম রেগে আছেন। আজকে একটা না একটা ব্যবস্থা সে করেই ছাড়বে।

সোহেলা বেগম উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে মুখে বড় পান গুঁজে তার মেয়ে গোলাপীকে চওড়া গলায় ডাকেন। গোলাপী কারো সাথে কথা বলছিল। ফোন কেটে দ্রুত মায়ের কাছে এসে বসে। চিন্তিত গলায় বলে-
– কি মা!? এভাবে ডাকতেছো! সব ঠিক আছে?

সোহেলা বেগম মুখ ভার করে বলেন-
– কিচ্ছু ঠিক নেই রে মা। কিচ্ছু ঠিক নেই। ছেলেটার সরকারি চাকরি হয়েছে। দামড়া হয়েছে অথচ বিয়ের নাম গন্ধ নেই। পাড়া প্রতিবেশী নানান কটু কথা কয়। তাদের মুখ আমি কি করে বন্ধ করবো বল!??

গোলাপীর যেন চিন্তা বেড়ে যায়। আসলেই তো!

তার কত সাধ ছিল তার একমাত্র ননদের সাথে বিয়ে করাবে মেঘের। কিন্তু তার নিজের সংসারই তো টিকলো না! সেখানে ভাইয়ের বিয়ে কিভাবে হয়?

গোলাপী শান্ত গলায় বলে-
– দেখি,মা আমি মেঘের সাথে আবার এই ব্যাপারে কথা বলবো। তুমি চিন্তা করো না। পরে তোমার প্রেসার বেড়ে যাবে।

সোহেলা বেগম বিলাপ পাড়তে পাড়তে বলেন-
– আর প্রেসার! আমি মরে গেলেই বেঁচে যাবে ও। কোন কুক্ষণে এরকম ছেলে জন্ম দিয়েছিলাম কে জানে….!
.
.
সরকারি অফিস থেকে মেঘকে ডাকা হয়েছে। মেঘ ফর্মাল ড্রেস আপ করে বের হচ্ছিল তখনি গোলাপী পিছু ডাকে।

– কোথায় বের হচ্ছিস?
মেঘ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে-
– দেখছিস না অফিস যাচ্ছি!
– ওওও। আচ্ছা যা।
– ডাকলি কেন? জরুরি কথা?

গোলাপী আমতা আমতা করে।

– তেমন কিছুনা। যা তুই।

মেঘ না শুনে যাবেনা। কেন তাকে পিছু ডাকা হলো। কি সেই কারন!?

মেঘ আবারো জিজ্ঞেস করে
– বল,কেন ডেকেছিস?

গোলাপী এক রাজ্যের সাহস জুগিয়ে বলে-
– তোর বিয়ের ব্যা…

মেঘ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে-
– সেদিন তো বলেই দিয়েছি আমি বিয়ে করবো না। তাহলে? তাহলে এখন আবার কেন?

– মেঘ,তুই বুঝতে পারছিস না! আশেপাশের মানুষ নানান কথা বলে। কি জবাব দেবো তাদের?
– তাহলে আমাকে লিমার সাথেই বিয়ে দাওনা! তাকে ছাড়া অন্য কাউকে তো বিয়ে করবো না আমি আপু।
– মা যে মানবে না কিছুতেই। তুই একটু বোঝ না…

মেঘ গোলাপীর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে-
– তোর মনে আছে রাসেল ভাইয়ের কথা? তাকে যে খুব ভালোবাসতি! সেদিন যদি একটু সাহস করতি,আজ তোর সংসার থাকতো। পরিপূর্ণ সংসার।

গোলাপী চুপ হয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায় পুরোনো দিনের কথা।
তখন সবে এস এস সি দিয়েছে সে। হুট করেই ফুচকা খেতে গিয়ে পরিচয় হয় রাসেলের সাথে। বয়সে তার থেকে ৪ বছরের বড় ছিল সে। দেখতে সুন্দর,লম্বা,হাসলে গালে দুটো গর্ত হয়। শুধু সমস্যা ছিল একটাই। কোনো ভালো চাকরি ছিল না তার। বাবা মরে যাওয়া এবং আর্থিক সমস্যার কারনে পড়া হয়নি তার। তবুও নিজের একটা গ্যারেজ ছিল। কম বেশি ভালোই আয় হতো তার। গোলাপীর মনে ক্ষীণ আশা ছিল। যদি তার বাবা মেনে নেন! কিন্তু না,হলো না। গোলাপীর বাবা খালেদ মাহমুদ মেনে নেন নি। তিনি গোলাপীর জন্য বিয়ে ঠিক করেন বড় ঘরে…
রাসেল বলেছিল গোলাপী কে চলে আসতে। গোলাপী সাহস করে যেতে পারেনি। ২ বছরের প্রেম,আর তার গভীর ভালোবাসা কে বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করে নেয় সে।
গোলাপীর বিয়ের ২ মাস পরেই স্ট্রোক করে মারা যায় খালেদ মাহমুদ। এরপর কেটে যায় ৩ টি বছর…
এই ৩ টা বছর কিভাবে কাটিয়েছে গোলাপী সে নিজেও জানে না। জামাইর নেশা পানির অভ্যেস ছিল। রাত করে বাড়ি ফিরতো। উনিশ থেকে বিশ হলেই গোলাপী কে কি মার টাই না মারতো!
সেই মারের কথা ভাবলে এখনো গোলাপীর বুক কাঁপে…
এরপর আর না পেরে ডিবোর্স নিয়ে আসে সে। তবে এখন বড্ড আফসোস হয়। যদি সেদিন রাসেলের সাথে সত্যিই যেতো..
একটু সাহস করে…!
আজ হয়তো দিন টা অন্যরকম হতো…

গোলাপী চোখ মুছে নেয়। সে শান্ত গলায় মেঘ কে বলে-
– আমি মাকে বুঝিয়ে বলবো। দেখি যদি মেনে নেয় লিমা কে…..!
.
.
.
উদয়ের আজ ক্লাসে মন বসেনি। একদম বসে নি। কেননা মিশি আজ আসেনি ক্লাসে।
কি হলো মেয়েটার! জ্বর টর বাধালো না তো…!

উদয় ভাবে একবার তার বাড়ি গিয়ে দেখে আসবে। আবার ভাবে থাক,দরকার নেই।
.
.
মানুষের মন বড়ই অবাধ্য প্রাণী। একে শিকল বা কড়া কিছু দিয়ে বেধে সঠিক পথে রাখা যায়না।

উদয়েরও হয়েছে একই অবস্থা।
তার বারবার ইচ্ছে করছে দৌড়ে যেতে মিশির কাছে।

একবার দেখে আসতে মেয়েটার কি হয়েছে।
কেন আসেনি সে…
সে কি জানে,আজ সারা ক্লাসে উদয় তার পথ চেয়ে বসেছিল।
সে কি জানে,উদয় কোথাও না কোথাও তাকে বড্ড মিস করে এখন।
হয়তো জানে, হয়তো না।
.
.
.
বিকেল বেলা।
মিশিদের বাড়ির সামনে পায়চারি করছে উদয়। পা বারবার ভেতরে টানলেও উদয় যাচ্ছে না। কেন যাবে সে! কি ঠ্যাকা তার!
উদয় কিছুক্ষণ মিশিদের বাসার দিকে তাকিয়ে এক ছুটে চলে যায় সেখান থেকে।

আকাশে মেঘ জমেছে। হয়তো বৃষ্টি হবে…
মিশি ছাঁদে উঠেছিল জামা কাপড় তুলতে। তখনি তার চোখে পড়ে উদয় কে। তার মানে ছেলেটা তার খোজে এসেছিল! শুধু দ্বিধার কারনে ভেতরে আসেনি….!

মিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একটা চিঠি লেখা যাক…!
ছেলেটার সমস্ত অস্থিরতা দূর করা যাক।
.
.
প্রিয় উদু,
প্রিয় শব্দটা তোর জন্যেই বরাদ্দ। আমি তোর প্রিয় না হতে পারি,তুই তো আমার প্রিয়। জানিস,যখন মাঝরাতে হুট করে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সবার আগে আমার তোর কথা মনে পড়ে। কেন পড়ে? জানিনা….
আচ্ছা, তোর কখনো ঘুম ভাঙে মাঝরাতে? মনে পড়ে আমার কথা? আচ্ছা, আমার ভোর সকালের শিশির ফোটা যে তুই,তা কি জানিস? আমি কি তোর কাছে শুধুই গুড়ে বালি? আমি তোকে যেদিন তোকে প্রথম দেখেছিলাম,তোর ঐ গভীর চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। তোর উশকো খুশকো চুল গুচ্ছের মায়ায় পড়েছিলাম। তুই কেন সেগুলো দেখতে পেলি না..!?
অংক বোঝার ছলে তোকে ডেকে নিতাম। অংক কি করে বুঝবো বল, আমার চোখ যে তোর উপরেই নিবদ্ধ থাকতো। মনে পড়ে তোর একবার ধুম জ্বর এসেছিল? ৮ দিন স্কুল যেতে পারিস নি। আমি রোজ স্কুল যাওয়ার পথে তোকে দেখতে যেতাম। তবে আড়াল থেকে। সামনে গেলে যে আমার চোখ ভর্তি জল তুই দেখে ফেলতি…
যখন বুঝলাম আমার ভালোবাসা শুধু এক তরফা ভালোবাসা,তখন আমি কেঁদেছি,কেঁপে উঠেছি কিন্তু ভেঙে পড়িনি। যে আমার না,তার মায়া বাড়িয়ে লাভ কি! যে আমার না,তার ছায়া মাড়ানোও যে পাপ। সেই পাপ আমি অনেক করেছি। আর না..
তাই সরে যাচ্ছি…যেতে দে…
তবে তোর কোনো ভুল নেই…
ভুল আমার। কেননা আমি যে তোকে ভালোবেসেছিলাম…
ইতি,
তোর কেউ না।
.
.
শিপলু এসে সন্ধ্যের দিকে একটা চিঠি দিয়ে গেছে উদয় কে। উদয় যেন এক তৃষ্ণার্ত পথিক, ক্লান্ত, জরাজীর্ণ সে। মিশির এক টুকরো কাগজের এক টুকরো চিঠি যেন উদয় কে আবার চাঙা করে তুলেছিল।
কিন্তু চিঠি টা পড়ার পর,আগের থেকেও আরো বেশি ভেঙে পড়ে উদয়।
মিশি কি সত্যিই চলে যাচ্ছে তার থেকে?
সে কি হারিয়ে ফেলছে মিশিকে?

চলবে…..

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ০৮
লেখা – Mahfuza_Monira

উদয় গায়ে টি শার্ট চাপিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। বুকের ভেতর টা ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে। মনে হচ্ছে খুব আপন কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। খুব দূরে….খুব দূরে…

উদয় কখনো সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে একটা সিগারেট খেতে। শুনেছে সিগারেট খেলে নাকি বুকের ভেতরের কষ্ট বাষ্প হয়ে উড়ে যায়!? তার কষ্ট গুলোও উড়ে যাবে তবে? ভালোই হবে… সে যে আর নিতে পারছে এসব। মাথা টা এলোমেলো হয়ে আছে। নিজেকে নেশাগ্রস্তের চেয়ে কম লাগছে না কোনো অংশেই।

উদয় একটা চা’য়ের দোকানের সামনে দাঁড়ায়। এখানে একদম ভীড় নেই বললেই চলে। শুধু দোকানী এবং একজন লোক রয়েছে। উদয় আশেপাশে ঢোক গিলে একবার। ভীষণ ভয় করছে তার। যদি দোকানদার মাইর দেয় তাকে! কিন্তু কেন দিবে? কত লোকে এসে সিগারেট কিনে নিয়ে যায়। কই…কাউকে তো মাইর দেয় না কেউ।

উদয় ঝেড়ে কাশে একবার। তারপর দুরুদুরু বুক নিয়ে বলে-
– চাচা,একটা সিগারেট দেন তো।

দোকানী ভেতর থেকে মুখ বের করে ভালো করে দেখে নেয় একবার উদয় কে। তারপর প্রায় চিল্লিয়ে বলে-
– তুমি মইনুলের ছেলে না..!? হায় হায়! তোমারও সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে? দেশ টা রসাতলে…

বাকি কথা শোনার আগেই উদয় দৌড় লাগায়। এক দৌড়ে বাজার এর অপর প্রান্তে গিয়ে থামে সে। ইচ্ছে করছে নিজেকে নিজেই পুকুরে চুবাক কিছুক্ষন! এত দোকান থাকতে শেষমেশ ঐ দোকানেই যাওয়া লাগলো যেখানে তার বাবা পরিচিত…!?

উদয় আশেপাশে তাকায়। অনেকেই অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ছেলে এভাবে হুট করে দৌড়ে আসলে তাকাবে না?
উদয় সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সবার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি হাসার চেষ্টা করে একটু। এরপর দ্রুত পায়ে জায়গা বদল করে নেয়।
.
.
বাজারের থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ছোট্ট দোকান দেখতে পায় উদয়। দোকান টা একদম অজপাড়া গাঁয়ের দোকান টাইপ। একটা ছোট প্রদীপ জ্বলে নিভছে সেখানে।

উদয় গিয়ে সেই দোকানটার সামনে দাঁড়ায়। ভেতরে ভেতরে অনেক নার্ভাস সে। আচ্ছা যদি এই লোকেও তার বাবাকে চিনে থাকে তখন!?

উদয় আর কোনো রিস্ক নিতে চায়না। তাই এবার সরাসরি দোকানদার লোকটাকে জিজ্ঞেস করে –
– আপনি আমাকে চিনেন!?

দোকানী লোকটা পান সাজাচ্ছিল। হুট করে এমন প্রশ্ন শুনে আহাম্মক হয়ে যান তিনি। মাথা ঘাড় অব্দি কাত করে বলেন-
– না।

উদয় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তবুও আরেকটু সিউর হতে প্রশ্ন করে-
– আমার বাবাকে চিনেন? তার নাম মইনুল।

লোকটার কপালে ঈষৎ ভাজ পড়ে। সে কর্কশ কণ্ঠে বলে-
– তোমাকে চিনি না তো তোমার বাপ কে কেমনে চিনবো ছাওয়াল?

উদয় মৃদু হাসে। যাক,একটা ঠিক দোকানে এসেছে তাহলে।
উদয় আঙুল উঁচিয়ে সিগারেট দেখিয়ে বলে-
– তবে আমায় একটা সিগারেট দিন তো। এই নিন টাকা।

উদয় দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় লোকটির দিকে। লোকটি সিগারেট দিতেই উদয় দৌড়ে চলে যায়। লোকটি বেশ কিছুক্ষণ দোকানের ভেতর থেকে মাথা বের করে উদয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন অদ্ভুত ছেলেটা! সিগারেট কিনতে এসে আবোলতাবোল প্রশ্ন করছিল কিসব!? মাথায় সিট আছে বোধহয়।
লোকটা আবার পান সাজাতে সাজাতে মনে মনে ভাবে-
– আহারে,এই টুকুন ছেলেরও মাথায় সিট! আল্লাহ রহমত করুক।
.
.
.
ফাঁকা রাস্তা,নিকষ কালো অন্ধকার। ৮ টা সাড়ে ৮ টা বাজে হয়তো! উদয় আন্দাজ করে মনে মনে। উদয় আশেপাশে তাকিয়ে খুব সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পকেটে সিগারেট, অথচ সে এমন ভাবে হাটছে যেন তার পকেটে বাংলাদেশ উড়িয়ে দেওয়ার নীল নকশা।
.
বাজারের কাছাকাছি আসতেই উদয় খেয়াল করে এক জায়গায় সামান্য জটলা। কয়েকটা ছেলে মিলে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উদয় এগিয়ে যায় সেদিকে। সে অবাক হয় যখন সেই হট্টগোলের ভীড়ে লিমা কে দেখতে পায় সে।
.
লিমার চোখের নিচে দেওয়া কাজল লেপ্টে গেছে জলে। মুখে বিষন্নতার ভাব। সে কাধের ব্যাগ টা সামনে নিয়ে খুব শক্ত করে চেঁপে ধরে আছে সেটা। ৫-৬ টা ছেলে। কারো কারো মুখে ব্যঙ্গ,কারো কারো মুখে উত্যক্ত করার অশ্রবণীয় ভাষা। উদয় খেয়াল করে ছেলে গুলো তাদেরই স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। অর্থাৎ তার দু বছরের জুনিয়র। এই বয়সেই ছেলেগুলো এমন হয়ে গিয়েছে…! ছিঃ!
উদয়ের নিজেরই ঘিন ঘিন লাগে কথা টা ভাবতে গিয়ে।

উদয় ভীড় ঠেলে মধ্যিখানে প্রবেশ করে। উদয় কে দেখে যেন লিমার প্রাণ ফিরে আসে। ছেলেগুলো উদয় কে ভালো করেই চিনতো। তারা সবাই চুপ হয়ে যে যার মতো চলে যায়। উদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিমার দিকে তাকিয়ে বলে-
– তুই এখানে কেন?

লিমার চোখে তখনো ভয়ের রেশ। লিমা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
– কোচিং-এ পরীক্ষা ছিল। দেড়ি হয়ে গিয়েছে তাই। প্রতিদিন বাবা নিতে আসে। কিন্তু আজ আসেনি। বাবা অসুস্থ যে…!

উদয় আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
লিমা কে সহানুভূতির গলায় বলে-
– আমি বাড়ি অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসবো তোকে। চল।
.
.
মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে উদয় লিমা। দুজনের মুখে বুলি নেই।

উদয় মিশির দেওয়া চিঠি নিয়ে তখনো ভাবনায় বিরাজমান। তার বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছে,সে কি হারিয়ে ফেলবে মিশিকে?
আর লিমা যেন হঠাৎ করে এমন একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যাওয়ায় একদম কুঁকড়ে পড়েছে। নেতিয়ে গেছে।
উদয়ই নিরবতা ভাঙে।

– আর কখনো একা একা এ পথে আসবি না। এলাকাটা ভীষণ খারাপ।

লিমা নিচু গলায় বলে-
– আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। বাবা না আসলে আমি আর কখনো আসবো না। সম্মানের আগে পড়ালেখা না।

উদয় ছোট্ট করে জবাব দেয়।
– হু।

আবারো চুপচাপ। দুজনেই চাঁদের আলোয় নিজেদের পথ অনুসরণ করে হাটছে অনবরত।

প্রায় লিমার বাড়ির কাছাকাছি আসতেই উদয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। উদয়ের সাথে সাথে লিমাও দাঁড়িয়ে পড়ে। লিমা অবাক হয়ে উদয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলে-
– কি হলো! দাঁড়িয়ে পড়লি যে..! আর যাবি না?

উদয়ের চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। আশেপাশের সমস্ত কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। উদয় হঠাৎই হাটু গেড়ে বসে পড়ে রাস্তায়। দু হাতে মুখ লুকিয়ে বলে-
– আমি ভালোবাসি রে মিশি কে। ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। আমি ওকে মিস করতেছি। ভীষণ করতেছি। আমি ওকে হারাতে পারবো না রে লিমু। হারাতে পারবো না। কিছুতেই না…

লিমার মুখে প্রসন্ন হাসি।
যাক,অবশেষে হাদারাম টা বুঝতে পেরেছে তার ভালোবাসার কথা… ভালোবাসার অনুভূতি…

লিমা এগিয়ে গিয়ে উদয়ের হাত ধরে তাকে টেনে তোলে।
উদয়ের চোখ ফোলা ফোলা। নিশ্চয়ই ছেলেটা বেশিক্ষণ কাঁদতে পারে না।
লিমা হাসি মুখেই উদয় কে বলে-
– এখন যখন বুঝতে পেরেছিস,আর দেড়ি কিসের? প্রকাশ করে ফেল। মেয়েটা তোকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে রে। বড্ড ভালোবাসে। তার যে ভীষণ কষ্ট হয়েছে তোকে ছাড়া থাকতে।

উদয় চোখ মুখ মুছে পকেট থেকে সিগারেট টা বের করে ফেলে দেয়। শান্ত গলায় বলে-
– আমি হারাতে দিবো না মিশিকে। কিছুতেই না….

.
.

আকাশে চাঁদ উঠেছিল কিন্তু এখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোনো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে। আকাশে মেঘও করেছে বড্ড। মিশি বারান্দা দিয়ে মেঘের ধীর গতিতে উড়ে যাওয়া দেখছে।
হঠাৎ মিশির ইচ্ছে হয় একটা কবিতা আবৃত্তি করতে। এত রাতে কেউ হয়তো জেগে নেই। তাই একদম খোলা মনেই মিশি শুরু করে…

উড়বে হাওয়ায় বিষন্ন চিরকুট
শিউরে দিবে অজস্র বিদ্যুৎ
একটু দাড়া, এখন তো বৈশাখ
শব্দগুলো যত্ন করে রাখ।
দহনগুলো একটু করে লেখ,
হয়তো এখন বড্ড দূরে মেঘ
শুনছে কারোর নানান অনুযোগ
সবাই তো চায় মেঘ শুধু তার হোক।
অবুঝ করে দেয় অধিকার বোধ
তোর দুচোখে ছিপিয়ে উঠে রোদ
সত্যি তাকে সত্যি যদি চাস
ভুল না বুঝে একটু ভালোবাস।
তোর অভিমান অস্বাভাবিক নয়
ভালোবাসাও অনেক রকম হয়
সেও ভোলেনি তোর দেওয়া ডাকনাম
আসবে দেখিস,ঝড়বে অবিশ্রাম।
শব্দগুলোর চমকাবে বিদ্যুৎ
ভিজিয়ে দেবে তোর লেখা চিরকুট
তোকেও ছোঁবে,ক দিন শুয়ে থাক
বৃষ্টি হবেই, সবে তো বৈশাখ।।

কবিতা শেষ হতেই টুপ করে একফোটা জল মিশির চিবুক গড়িয়ে পড়ে। ঠিক তখনি রুমঝুম শব্দ তুলে নামে এক পশলা বৃষ্টি।
মিশি মৃদু হাসে। ঠোঁট বাকিয়ে বলে-
– এই বৃষ্টি না হয় এসে গেলো,কিন্তু আমার সে… সে কি আসবে?
.
.
সেই রাতে আর ঘুম হয়না মিশির। সারারাত গোলাপী ডায়রির ভাজে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে সে। ভোরের দিকে ঘুম আসে তার। রাজ্যের ঘুম ভর করে তার ছোট্ট সরু চোখের দু’পাতায়।
.
.
সকাল ১০ টার ঘুম ভাঙে মিশির। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। মনে মনে একগাল গালি দেয় নিজেকে। আজকেও হলো না স্কুল যাওয়া। এভাবে করলে তো আবার অংকে ডাব্বা মারবে সে….

মিশি রাগে কটমট করতে কর‍তে উঠোনে বের হয়। বকর মোল্লা আর নতুবা বেগম বসে বসে চা খাচ্ছিলেন। নতুবা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বাজখাঁই গলায় বলে-
– মা,উঠালে না কেন আমায়! আজকেও ক্লাস টা মিস গেলো।

নতুবা বেগম চোখে কপালে তুলে বলেন-
– আমি উঠাইনি? মিশির আব্বু,শুনেছো মেয়ের কথা? কত করে ডেকেছি তাকে। তুই তো মুখ কামড়ে পড়েছিলি বিছানায়। টেনেও তুলতে পারিনি।

মিশি হাই তুলতে তুলতে একটা চেয়ার টেনে বসে। বকর মোল্লা কপালে ভাজ এনে বলে-
– কাল রাতে ঘুমাস নি?

মিশি উত্তর দেয় না। চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাকে সে। নতুবা বেগম চায়ে আরেকবার চুমুক দিয়ে বলেন-
– তোর দ্বারা তো পড়ালেখা হবে না। অংক ও হবে না। বিয়ে দিয়ে দেই তোর? কি বলিস?

বকর মোল্লা হাত দিয়ে ইশারায় থামতে বলে নতুবা কে। কেননা মিশি কখনো বিয়ের কথা শুনতে পারে না। রেগে উঠে।

নতুবা থামেন না। আবারো বলেন-
– বিদেশ ফেরত এক ছেলে ছিল। কিন্তু তোর বাবার পছন্দ হলো না তাকে। তাই বলে কি আর ছেলে নাই? কত ছেলে তোকে বিয়ে করার জন্য বসে আছে। তুই চাইলে লাইন লেগে যাবে। আমি দেখবো পাত্র মা তোর জন্য?

মিশি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। শান্ত গলায় বলে-
– দেখো।

এরপর ভেতরের দিকে চলে যায়।
.
.
.
স্কুলে টিফিন টাইমেই ছুটি নিয়ে নেয় উদয়। দৌড়ে আসে মিশিদের বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই দেখে মিশির বাবা মা বসে আছেন উঠোনে।

উদয় সেখানে গিয়ে সালাম জানায় তাদের। মুখ প্রসন্ন হাসি এনে বলে-
– আংকেল,মিশি?

বকর মোল্লা পত্রিকায় মুখ রেখেই বলে-
– ভেতরে আছে। যাও।
– জ্বি আচ্ছা।

উদয় আরেক দফা সালাম জানায় তাদের। এরপর মিশির রুমের দিকে এগোয়।
.
.
মিশি ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সবে। ঠিক তখনি সে শুনতে পায় ক্ষীণ গলায় কেউ গান গাইছে।

তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি হয়ে ছাদ বানিয়ে শুই
ছাদ ভেঙে যেই বাষ্প হবে জল
বাষ্প দিয়ে তুই কি করবি বল
তারচেয়ে চল, এইবেলা মেঘ খুঁজে
দুজন মিলে ঝাপ দেই মুখ বুজে……

মিশি কম্পিত চোখে উদয়ের দিকে চেয়ে আছে। উদয় ২ টাকা দামের কোকোলা লাঠি চকলেট মিশির সামনে ধরে হাটু গেড়ে বসে। অনাবীল খুশির আবেশে বলে-
– মিশি, প্রথমেই সরি। আমি এতই নির্বোধ যে এত কাছে ভালোবাসা পেয়েও বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম,ভালোবাসা কী,আর আমার ভালোবাসা কে,আমি আর একমুহূর্ত দেড়ি করিনি রে। চলে এসেছি। তোর কাছে চলে এসেছি। দৌড়ে দৌড়ে এসেছি। রাস্তায় কতগুলো হোচট খেয়েছি জানিস? তবুও থামিনি। শ্বাস উঠা নামা করছে। তবুও জিড়োনোর যে সময় নেই একলেশ। আজকেই তোকে বলবোই, বলবোই…..
আ-আমি..তোকে ভালোবাসি মিশি।

মিশির চোখ বন্ধ করে ফেলে। হাজারো জলকণা ভীর করেছে তার চোখে। এগুলো যে সুখের। যে সুখের জন্য সে ৩ টি বছর অপেক্ষা করেছে।

উদয় উঠে দাঁড়ায়। মিশির এলোমেলো চুল গুলো কানের কিনারায় গুঁজে দেয়। ফিসফিস করে বলে-
– টাকা ছিল না রে। তাই ফুল আনতে পারিনি। কিন্তু দেখ,লাঠি চকলেট এনেছি। খাবিনা?

মিশি চোখ খুলে হেসে ফেলে। দু তিন ফোটা পানি তখন গড়িয়ে পড়ে চোখের কিনারা ঘেঁষে। উদয় পরম আবেশে মুছে দেয় সেগুলো। মিশির গালে হাত ছুঁইয়ে বলে-
– এটাই তোর লাস্ট কান্না। আর কাঁদবি না। একদম কাঁদবি না। মনে থাকে যেন…

[কবিতা টি নীলাঞ্জন ব্যানার্জীর লেখা]

চলবে…..
(আগের পর্বগুলো আমার টাইমলাইনে পাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here