পানপাতার ঘর? পর্ব ১৩+১৪

0
607

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ১৩-১৪
লেখা – Mahfuza_Monira

হুট করেই হাসিব চাচা রুমে প্রবেশ করেন। মিশি তখনো অজ্ঞান অবস্থায় উদয়ের বুকে পড়ে আছে। উদয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মিশির দিকে। তার মাথায় কিছুইতেই ঘুরছে না মিশির হঠাৎ অজ্ঞান হওয়ার ব্যাপারটা।

হাসিব চাচা খুকখুক করে কাশেন। উদয় সম্বিত ফিরে কাচুমাচু হয়ে বলে-
– চাচা,দেখো না,মিশি হুট করে অজ্ঞান হয়ে গেলো! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা চাচা।

হাসিব চাচার চিন্তা হয়। চিন্তিত গলায় বলেন-
– কিভাবে কি হলো! ওকে তুলো। খাটে শোয়াও বাবা।

উদয় পাজাকোলে তুলে নেয় মিশিকে। মিশির এলোচুল গুলো তখন উদয়ের গালে ঘঁষা খাচ্ছে বারবার। উদয়ের সুরসুরি লাগে।

উদয় উশখুশ করতে করতে মিশিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে। হাসিব চাচা মিশির হাত পা টেনে সোজা করে দেন। মিশির দিকে তাকিয়েই চিন্তিত গলায় আবার জিজ্ঞেস করেন-
– কি করে কি হলো উদয়?
উদয় কি বলবে! ভাবে একবার। তারপর অপ্রস্তুত হয়ে বলে-
– আসলে,মিশি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে ছিল। এরপর..এরপর গামছা শুকোতে দিলো দড়িতে। হঠাৎ করেই মিশি এরপর…অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে আমার বুকে। আমি একদম হকচকিয়ে গিয়েছিলাম চাচা,বিশ্বাস করো।

হাসিব চাচা মাথা দুলান।
– কি যে হলো মেয়েটার! উদয়ের বাবা মাকে ডেকে আনছি। তুমি একটু বসো তো।

উদয় বাধ্য ছেলের মতো মিশির পাশে বসে। হাসিব চাচা একবার মিশির দিকে তাকান,আরেকবার উদয়ের দিকে। এরপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যান।

উদয় বসে থাকে মিশির পাশে। দরজার দিকে তাকায় একবার। এরপর মিশির মাথায় হাত রাখে। মিশি হয়তো গভীর ঘুমে..নাকি অজ্ঞান! বোঝা যাচ্ছে না। উদয় বুঝতেও চায়না। সে শুধু জানে এখন যদি পারতো এই সময় টাকে আটকে দিতো। চিরজীবন এর জন্য আটকে দিতো। প্রিয় মানুষ টা ঘুমন্ত অবস্থায়,চোখের সামনে থাকা.. ব্যাপারটা কত রোমাঞ্চকর!

উদয় একদিক থেকে চিন্তিত আবার তার হাসিও পাচ্ছে। সামান্য চুমু সহ্য করতে পারলো না মেয়েটা! উদয় মনে মনে ভাবে,এই মেয়েটাকে আর আদর করা যাবে না। কিছুতেই না…
.
.
বকর মোল্লা হতদন্ত হয়ে রুমে ঢোকেন। নতুবা বেগম এবং হাসিব ও ঢোকে পিছুপিছু। উদয় মিশির মাথা থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বকর মোল্লা ব্যতিব্যস্ত হয়ে মিশি কে ডাকতে শুরু করে।

– মিশি মা…মিশি মা রে!

মিশি যেন ঈষৎ নড়ে উঠে। উদয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বকর মোল্লা কে উদ্দেশ্য করে বলে-
– আংকেল, চিন্তা করবেন না। মিশি ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুমে আছে সে।

বকর মোল্লা যেন তাও শান্তি পান না। সে চিন্তিত দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকেন মিশির দিকে।
.
নতুবা বেগম মুখ বাকিয়ে বলেন-
– জানতাম এমন কিছুই হবে। পাশের গ্রামে শুনেছিলে না,একটা মেয়ে,বয়স হওয়ার পরেও বিয়ে না করায়,প্রায় হুটহাট অজ্ঞান হয়ে যেত। কত ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছে তার মা বাবা। কেউ ধরতে পারেনি কিছু। শেষে মেয়েটা মারাই গেলো! এই জন্যেই তো মেয়েদের বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। আমি তো মিশিকে এই জন্যেই বিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। শুনলো না মেয়েটা! এবার যদি ঐ মেয়ের মতো মিশিও….

নতুবা বেগম আচল মুখে চেঁপে ডুকরে উঠেন। বকর মোল্লা বিরক্তিকর গলায় বলে-
– আহ,থামবে তুমি? এমন আজব ঘটনা কোথা থেকে শুনছো!

উদয়ও সায় মিলায়।

– জ্বি আন্টি,আমরা তো কোনোদিন এধরনের কোনো কাহিনি শুনলাম না!

হাসিব চাচাও ভ্রু উঁচিয়ে এরকম কোনো কাহিনী তার ৪৫ বছরের জীবনে শুনেছে কিনা তা মনে করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নাহ! মাথার ব্রেইনে এমন কোনো কাহিনির কথা তো নাড়া দিয়ে উঠছে না।

নতুবা ঠোঁট কামড়ান। সে যে মিশিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য যতসব আবোলতাবোল কাহিনী বানিয়েছেন! সেসব তিনি কি করে বলে এদের কে!

বকর মোল্লা বিমূর্ষ গলায় বলে-
– মেয়েটা সারাদিন পড়াশোনা নিয়েই থাকে এখন! বোধহয় ক্লান্ত। তাই ঘুমিয়ে গেছে। ওকে জাগানো ঠিক হবে না। ঘুমাক। চলো চলো,এখানে এত জটলা পাকানোর কিছু নেই।

বকর মোল্লার পিছু পিছু সবাই চলে গেলেও উদয় রয়ে যায়। একটা কাগজে কিছু একটা লিখে মিশির বালিশের পাশে রাখে। এরপর নিজের বই খাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
.
.
খুব সকাল সকালই ঘুম ভেঙে যায় মিশির। চোখ খুলতেই সর্বপ্রথম মনে পড়ে উদয়ের কথা। উদয় কই! সে না উদয়ের সাথে বারান্দায় ছিল!

মিশি লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে বাহিরে আলো।
তার মানে এখন দিন! কিন্তু সে তো উদয়ের সাথে যখন ছিল,তখন সন্ধ্যা ছিল!

মিশি গভীর মনোযোগ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে কালকের কথা।

গামছা দিয়ে মুখ মোছা,গামছা দড়িতে দেওয়া, উদয়ের হা করে তাকিয়ে থাকা, এরপর এরপর…
সব মনে পড়তেই মিশি আবার লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। বিছানায় এসে বালিশে হেলান দিয়ে বসে। বালিশের তলায় একটা কাগজ। মিশি আগ্রহ নিয়ে কাগজ টা তুলে নেয়। ছোট আঁকাবাঁকা কাগজে গুটিগুটি অক্ষরে কিছু লেখা…

” আর কখনো চুমু খাবো না তোমায় অজ্ঞানবতী!”

উদয় এটা লিখেছে? সিরিয়াসলি!?

একরাশ লজ্জা কোথা থেকে হুট করে এসে ভর করে মিশির চোখে মুখে। তার নাক লাল হয়ে উঠে লজ্জায়। ঈশ! কেন যে কাল ওভাবে ঢলে পড়তে গেলো উদয়ের বুকে…! উদয়ের একটা চুমু! তাও সহ্য হলো না মেয়েটার!
.
.
.
সোহেলা বেগম খুব তোড়জোড় লাগিয়ে দিয়েছেন মেঘকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। মেঘ যেন একটা রোবট হয়ে গিয়েছে। সবসময় মুখ টা একরকম করে আছে। না হাসি,না কান্না। সোহেলা বেগম উঠতে বললে উঠে,বসতে বললে বসে।
গোলাপী ভেবে পায় না মেঘের এমন আচরণ এর কারন। ছেলেটার হলো কি!

মেঘ চুপ করে বসে আছে তার রুমে। হাতে একটা বই।
গোলাপী নিঃশব্দে ঘরে ঢোকে। নিঃশব্দেই মেঘের পাশে বসে। বলে-
– কি পড়ছিস ভাই?
– কিছু পড়ছিনা। দেখছি।
– কি?

মেঘ বইয়ের পাতা টা গোলাপীকে দেখিয়ে বলে-

– দেখ,কি সুন্দর কাপল। বইটা একটা ম্যাগাজিন। এখানে বিভিন্ন কাপলদের ভালোবাসার গল্প ছাপা হয়। আর তাদের ছবিও। দেখ না,অনেক সুন্দর না?

গোলাপী বইয়ের পাতায় তাকায় না। তার চোখ মেঘের দিকে। মেঘের চোখ ঝাপসা,চোখে নোনাজল।
গোলাপীর বুকের ভেতর টা নড়ে উঠে আবার। সে রাগী গলায় বলে –
– কেন লিমা কে নিজেই দূরে ঠেলে দিচ্ছিস?কেন এই বিয়ে করছিস?? পালিয়ে যা না!

মেঘ মৃদু হাসে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে-
– তাহলে আজীবন লিমা কে মার কাছে ডাইনি হয়ে থাকতে হবে,নষ্টা বাজে মেয়ে হিসেবে পরিচিত হয়ে যাবে গ্রামে। যা আমি চাইনা। তাই থাক না,আমার লিমা দূরে থেকেই ভালো থাকুক। আমি আমাকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। ভাগ্য যা চায়,তাই হবে।

গোলাপীর বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
আচ্ছা ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন??

চলবে….

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ১৪
লেখা – Mahfuza_Monira

শোনা যায়,প্রতিটা সকাল মানুষের জন্য একরাশি সুযোগ আর খুশি নিয়ে হাজির হয়। কোনো কোনো মানুষ সেই খুশি গুলোকে খুঁজে নিতে পারে,আবার কোনো কোনো মানুষ পারেনা। তবে আজকের সকাল টা লিমার জন্য একফোঁটাও খুশি নিয়ে হাজির হয়নি বোধহয়। যেদিন মেঘকে চিরজীবন এর জন্য ছেড়ে এসেছিল,সেদিনও এত কষ্ট হয়নি লিমার যতটা আজ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে কেউ একজন,বুকের উপর মস্ত বড় এক পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। যা বয়ে বেড়ানোর সাধ্য লিমার নেই।

স্কুল যেতেই লিমার বিষন্ন মুখ চোখে পড়ে মিশির। আজ অনেকদিন পর স্কুল এসেছে সে। আসার পথে মন বেশ উশখুশ করছিল। কখন সে বলবে লিমাকে কালকের ঘটে যাওয়া সবকিছুর কথা…! সেই ভাবনায় ভাবনায় বদহজম হয়ে গেছে মিশির। অথচ লিমার বিষন্ন মুখ দেখে যেন সমস্ত কিছু ভুলে গেছে মিশি। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
লিমার কি হলো!?

মিশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে লিমার পাশে বসে। লিমা বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে আছে তখন। মিশি প্রশ্ন করে –
– লিমারে,কিছু হয়েছে তোর? এত চুপচাপ যে!

লিমা মুখে কিছু বলে না। শুধু মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে বোঝায় যে তার কিচ্ছু হয়নি।
কথাটা মিশির বিশ্বাস হয়না। কিছু একটা তো নিশ্চয়ই হয়েছে। মিশি একপ্রকার চেপেই ধরে লিমা কে। কি হয়েছে তার। বলতেই হবে..

লিমা বিরক্তি গলায় বলে-
– বললাম তো কিছুনা। যা তো! পড়তে দে। সামনে টেস্ট আসছে।

মিশি নাছোড়বান্দা। সে না শুনে যাবে না।

– উঁহু। যাবো না। বল আগে,কি হয়েছে। আমি জানি কিছু একটা হয়েছে।

লিমা চটে যায়। বাজখাঁই গলায় বলে-
– বললাম না যা এখান থেকে!! কিচ্ছু হয়নি আমার! নিজে তো কখনো পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করে না,পড়াশোনা করে না। এখন আমাকেও জ্বালাতে আসছে!

পুরো ক্লাস অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে একবার মিশির দিকে। আরেকবার লিমার দিকে। কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

লিমা বই নিয়ে উঠে যায়। বসে রয় শুধু মিশি। উদয় এগিয়ে আসে। মিশির কাধে হাত রাখতেই মিশি কেঁদে ফেলে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। কেন লিমা এমন করলো তার সাথে!?
.
পুরোটা ক্লাস মিশি আর কারো সাথে কথা বলে না। উদয় কিছু বললেও হু হা তে জবাব দেয়। উদয় বোঝে মিশির মন খারাপ।তাই সেও জ্বালাতন করে না মিশিকে।
.
লিমার অপরাধবোধ জাগে। সে বুঝতে পারে মেঘের উপর দাবানো রাগ টা সে মিশির উপর ঝেড়ে ফেলেছে। এখন কি করা যায়! মিশি তাকে মাফ করবে তো…!?
.
.
স্কুল ছুটি হতেই উদয় কে সাথে করে বাড়ির পথে পা বাড়ায় মিশি।

কিছুদূর যেতেই কে যেন ডাকে মিশিকে।
মিশি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে লিমা দাঁড়িয়ে। মিশির রাগ হয়। খুব রাগ হয়। সে একহাতে শক্ত করে উদয়ের হাত চেঁপে ধরে জোরে জোরে হাটা দেয় এবার। উদয় হতভম্ব হয়ে যায়। নিচু গলায় বলে-
– আহঃ! মিশি লাগছে হাতে।
মিশি কটমট করতে করতে বলে-
– লাগুক।
উদয় আবারো নিচু গলায় বলে-
– লিমা…লিমা ডাকছে তোমায়।
মিশি হাটতে হাটতেই উদয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
– ডাকুক। মরুক ও। আমাকে বলবা না।

উদয় চুপচাপ হয়ে যায়। এই মেয়েদের মাঝে সে পড়তে চায়না।
.
লিমা দৌড়ে আসে। মিশির সামনে দাঁড়ায়। কাঁদো কাঁদো স্বরে নিচু গলায় বলে-
– সরি রে। একটা বার আমার কথা শুনবি?

লিমা আর মিশি বান্ধুবী কম,বোন বেশি। ৬ বছর ধরে একে অপরের সাথে আছে তারা। লিমার ঝাপসা চোখ আর কাঁদো কাঁদো গলা শুনে মিশির রাগ উবে যায় যেন। থেমে যায় সে। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না।

লিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে-
– মেঘের বিয়ে ঠিক হয়েছে মিশি। ওর মা ওকে অনেক বড় ঘরে বিয়ে দিচ্ছে নাকি..!

লিমা চোখ নামিয়ে ফেলে। সে চায়না তার চোখ বেয়ে পড়া পানি মিশি দেখুক।
মিশির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।
কিন্তু উদয় একটুও দুঃখী হয়না। সে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে-
– মেঘ ভাইয়ের বিয়ে! ওহ মাই গড! আমাকে দাওয়াত ও না ভাইয়া!! মেঘ ভাইয়াকে পেয়ে নি। খবর আছে তার।

মিশি চোখ ঘুরিয়ে তাকায় উদয়ের দিকে। উদয় ভয় পেয়ে বলে-
– কী!

মিশি দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে-
– খুব বিয়ে খাওয়ার শখ না? তো নিজেই একটা বিয়ে করে খা না!!

উদয় ঘাবড়ে যায়। আমতাআমতা করে বলে-
– এ–এভাবে বলছো কেন তুমি? মেঘ ভাইয়ার বিয়েতে তুমি খুশি নও?

মিশি হাত মুঠি করে বলে-
– না মোটেও খুশি না। কেন খুশি হবো হ্যাঁ? আমার বান্ধুবীর কষ্টে আমি খুশি হবো উদয়??

উদয় মাথা চুলকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে-
– আমি কিছু বুঝতেছি না। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবা..!

মিশি কিছু বলতে নেওয়ার আগে লিমা বলে-
– আমি মেঘ কে ভালোবাসি উদয়।

উদয় চোখ বড়বড় করে ফেলে।সে যেন নিজের কান কে বিশ্বাসই করতে পারছে না। লিমার কাছে এগিয়ে এসে অবিশ্বাসের গলায় বলে-
– কি!?? কি বললি তুই! বুঝলাম না তো..!

লিমা চোখের জল মুছে নিয়ে ধরা গলায় বলে-
– আমি মেঘ কে ভালোবাসি। মেঘও আমাকে ভালোবাসে। আমাদের সম্পর্ক ছিল। শুধু আমি ছোট ঘরের,আর সে বড়,তাই আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো আমার মন থেকে আলাদা হয়ে যায়নি। সেই ভালোবাসার মানুষ টার বিয়ে অন্য কারো সাথে! অন্য কেউ তার সাথে ঘর করবে।সংসার পাতবে।

লিমা কেঁদে ফেলে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।
লিমার কান্না দেখে মিশি কেঁদে ফেলে। তার বুকের ভেতর টা যেন কেউ দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে।
মিশি লিমাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে-
– তোর ভালোবাসা যদি সত্যি হয়,আর আল্লাহ যদি মেঘ ভাইয়া কে তোর কপালেই লিখে রাখে,তবে সে তোরই হবে। কাঁদিস না তুই,কাঁদিস না।
.
.
.
মেঘের বাড়ির সামনে উদয় আর মিশি। মূলত মিশিই এসেছে। আর উদয় কে টেনে ধরে নিয়ে এসেছে। মিশি মেঘের সাথে কথা বলতে চায়। সামান্য বংশ উঁচু নিচু বলে কী দুজন মানুষের এত গভীর ভালোবাসা এভাবে হেরে যাবে…..!

মিশি বাজখাঁই গলায় ডাকে।

– মেঘ ভাইয়া….মেঘ ভাইয়া…!

মিশির ডাকে মেঘ না বের হলেও মেঘের বড় বোন গোলাপী বের হয় ঘর থেকে। মিশিকে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে আসে।

– আরে! মিশি যে! আসো আসো ভেতরে আসো। উদয় কেমন আছো?

উদয় মাথা কাত করে নিচু গলায় বলে-
– ভালো আছি।

মিশি উদয়ের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় একবার। এরপর কঠিন গলায় বলে-
– নাহ,আমরা ভেতরে যাবো না। আমরা মেঘ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি। সে কই? তাকে ডাকো আপু।
– মেঘ তো নাই। শহরে গেছে। বিয়ের জন্য শেরওয়ানি অর্ডার করতে।

মিশি মৃদু হেসে বলে-
– বাহ! আমার বান্ধবী লিমা,যে কিনা কেঁদে কেটে অস্থির আর তার ভালোবাসা বিয়ের জন্য খুশি খুশি মনে শেরওয়ানি কিনতে গেছে…! দেখেছো উদয়? ছেলেরা কত স্বার্থপর!

গোলাপী ও মৃদু হেসে বলে-
– ছেলেরা স্বার্থপর কিন্তু সব ছেলেরা না। আর ভাই যেতে চায়নি,তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে। এদিক আসো মিশি উদয়। তোমাদের কিছু কথা বলবো।

মিশি একটু নরম হয়। সে আর উদয় উঠোনের এক পাশে পিড়ি পেতে বসে। গোলাপীও বসে তাদের সাথে। গোলাপী একটা কাগজ বের করে তাদের দেখায়। জিজ্ঞেস করে-
– এখানে কি দেখতে পাচ্ছো?

মিশি বিরক্তির গলায় বলে-
– একটা কাপল! এটা দেখানোর জন্য ডেকেছো আমাদের?

গোলাপী মৃদু গলায় বলে-
– নাহ। কালকে রাতে মেঘ এই কাগজ টাই দেখছিল জানো? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তুই লিমা কে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিস না? উত্তরে মেঘ কি বলেছিল জানো? বলেছে,সে চায়না লিমা কে কেউ বাইরান্না মাইয়া,নষ্টা,পোলা ফাসানো সহ আরো অনেক খারাপ খারাপ কথা বলুক। বলেছে সে চায় না লিমার সম্মান নিয়ে কোনো টানাটানি হোক। জানো বোন,আমাদের সমাজ টা বড্ড কাপুরুষ আর স্বার্থপর। এরা অন্যের করা ভুল,অপরাধ এসবই দেখবে,তার পেছনের আসল কাহিনী না জানবে,আর না জানতে চাইবে।

এই সমাজে রাত কাটানো মেয়েটা পতিতা হয়,আর সেই মেয়ের সাথেই রাত কাটানো ছেলেটা হয় ফেরেশতা। কি অদ্ভুত না? কিন্তু এটাই সত্য। মেঘ পালাবে লিমা কে নিয়ে,কিন্তু সবাই আঙুল তুলবে লিমারই উপর। লিমার পরিবারের উপর। এই কারনেই মেঘ নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে লিমার থেকে। একপ্রকার বলি দিচ্ছে সে নিজেই নিজেকে। এবার বলো,এখনো মেঘ কে বলার মতো কিছু আছে তোমাদের??

মিশি মাথা নিচু করে আছে। মেঘ ভাইয়াও তাহলে ভালো নেই। সেও লিমার মতো কষ্ট পাচ্ছে…!

গোলাপী আবার বলে-
– এই বিয়েতে দুজোড়া হাত এক হবে না,হবে দুটো পরিবার এক। এই বিয়েতে হাজারো বাজনার ভিড়ে কোথাও একটা শোক বাজনাও বাজবে। এখানে একটা মেয়ের সাথে একটা ছেলের না,একটা জীবন্ত লাশের বিয়ে হবে। আসিও তোমরা। দেখে যেও আমার ভাই টাকে। আর সাথে তার এই অপদার্থ বোনটাকেও দেখে যাইয়ো। যে কিনা তার ভাইয়ের এত কষ্টের দিনেও কিছুই করতে পারলো না।

গোলাপী মুখে ওড়না চেঁপে ডুকরে কেঁদে উঠে। মিশির আর ভালো লাগে না। চারিদিকে এত কান্না কেন..! এত কষ্ট কেন!

মিশি উদয় কে নিয়ে চলে আসে সেখান থেকে।
একটা বড় মাঠ পেরিয়ে তবে মিশির বাড়ি।
মাঠের মাঝখানে দুজনে চুপচাপ হেটে যাচ্ছে। উদয়ের মনটাও খারাপ বেশ। মেঘ ভাইয়া এত ভালো মানুষ আর তার সাথেই এমনটা হচ্ছে..!

হঠাৎ মিশি দাঁড়িয়ে পড়ে। উদয় বলে-
– কি হলো? পা ব্যথা করছে?

মিশি আশেপাশের সমস্ত কিছু ভুলে ঝাপিয়ে পড়ে উদয়ের বুকের উপর। উদয় কোনোমতে নিজেকে সামলায় পড়ে যাওয়া থেকে। মিশি উদয়ের বুকে মাথা রেখে নিরবে কেঁদে চলে। উদয় মিশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
– কাঁদছো কেন? মেঘ ভাইয়া আর লিমার জন্য? আল্লাহ যা করবেন ভালোর জন্যেই করবেন মিশি।

মিশি মাথা উঠায়। চোখ আর নাকের পানি এক হয়ে গিয়েছে তার। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে-
– উদু,ওয়াদা করো। আমাদের ভালোবাসার পরিনতি এমন হবেনা। আমাকে ছেড়ে তুমি কখনো যাবে না।
উদয় মিশির নাক মুছিয়ে দিয়ে বলে-
– যাবো না পাগলি। কোথাও যাবো না। আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকবো। প্রমিস…

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here