পদ্ম ফুলের অভিমান পর্ব ১০

0
506

#পদ্ম_ফুলের_অভিমান(পর্ব 10)
#লেখনীতে_নাফিসা_আনজুম

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেলো, যদিও রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয় নি। উঠে দেখি, আম্মু ফুপি সহ আশেপাশের অনেকেই কাজ শুরু করে দিছে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। তবে ছোটদের মধ্যে মনে হয় আমি একাই উঠেছি। আম্মু কিচেনে সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে, আমি আম্মুর কাছে গেলাম।

-কি রে মা,এতো সকালে উঠেছিস যে কিছু বলবি

-না মানে আম্মু, আমি কি খুব বেশি হয়ে গেছিলাম তোমাদের কাছে

আম্মু চুলা বন্ধ করে ছলছলো নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
এসব কি বলছিস মা, আমার একটা মাত্র মেয়ে, বেশি কেনো হবে। আর একটাই কি পাঁচটাই কি, বাবা মায়ের কাছে কি সন্তান কখনো বেশি হয় নাকি পাগ*লি মেয়ে।

আমি হুট করেই আম্মুকে জরিয়ে ধরলাম, কেনো জানি মনে হচ্ছে আম্মুর থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমি। আগেও তো ফুপির বাড়ি গেছি তখন তো এমন হয় নি। আজ কেনো মনে হচ্ছে, তবে কি বিয়ে মানেই পর হয়ে যাওয়া।

ফুপি এসে বলতেছে,এই পাগলি কাদঁছিস কেনো,তুই কি শশুর বাড়িতে প্রথম যাচ্ছিস নাকি হুমম, আমাকে কি দজ্জা*ল শাশুড়ি মনে হয় তোর।

-কি যে বলো না ফুপি তুমি, তুমি আমার ফুপিই থাকবে শাশুড়ি কেনো হবে।

– না না তা তো চলবে না, আমার মেয়ে নেই,তাই আজকের পর থেকে তুই আমাকে আর ফুপি বলে ডাকবি না। মা বলবি ঠিকাছে।

-ফুপি কে মা বলবো, ধ্যাত আমি পাবো না লজ্জা লাগে। আমি আর থাকবোই না এখানে। চলে আসতেই ফুপি আম্মুকে বলতেছে ভাবি তোমার মেয়ে তো লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেছে এই বলে ফুপি আর আম্মু হেসেঁ উঠলেন।

একটু পর নানি এসে ডেকে নিয়ে গেলো নাস্তা খাওয়ার জন্য,
গিয়ে দেখি নিলয় ভাইয়াকে আম্মু তুলে খাওয়াচ্ছে। আমি যেতেই আমাকেও পাশে বসালেন। আম্মু আমাদেরকে খাওয়াচ্ছে আর অভ্র ভাইয়ার দাদি মানে আম্মুর চাচির সাথে গল্প করতেছে।

আম্মু-জানো চাচি তোমার নাতনি কি বলছে আজকে, বলছে আমদের কাছে নাকি ও বেশি হয়ে গেছে এজন্য বিয়ে দিচ্ছি

নানি-আমার নাতনির কি সেই বয়স হয়েছে যে বুঝবে, আগে দুই তিনটা সন্তানের জননী হোক তখন বুঝবে মা বাবার কাছে সন্তান বেশি হয় কি না

নিলয় ভাইয়া পাশ থেকে কেশে উঠলো, আম্মু পানি ঢেলে দিচ্ছে
-কি হলো নিলয় বাবা, ঠিক আছিস তো

-উনি পানি খেয়ে নিয়ে বললো হ্যাঁ মামি আমি ঠিক আছি। আর খাবো না এই বলে চলে গেলো। আর যাওয়ার আগে ফিসফিস করে বললো,তিনটা বাচ্চা নেওয়ার জন্য রেডি হও বউ

আমি চোখঁ বড় বড় করে তাকালাম ওনার দিকে কিন্তু উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে গেলো।

আমি যতোটা সম্ভব চেষ্টা করছি অভ্র ভাইয়ার সৃতি গুলো মনে না করার।কিন্তু আজকে যেনো কোনোভাবেই মাথা থেকে যাচ্ছেই না। একটু কিছুতেই শুধু ওনার কথাই মনে পরতেছে । কিন্তু আমি ঠিক করেছি আজকের পর থেকে আর কখনোই ঐ দিনগুলো মনে করবো না আমি। আমি যেহেতু একজনের বউ হয়ে যাচ্ছি, এখন সেটা না চাইলেও আমাকে মানতে হবে। তাই ঐ বে*ই*মানের কথা ভাবার থেকে নিজের স্বামির কথা ভাবা ভালো।
কি আশ্চর্য, আমি আজ নিজে থেকেই নিলয় ভাইয়াকে নিজের স্বামী বললাম। নিজের ভাবা কথায় নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।
একটু পর দুটো পার্লারের মেয়ে এসে আমার হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে, আমি চুপ করে বসে বসে ভাবছি, সত্যি সত্যি আমি নিলয় ভাইয়ার বউ হয়ে যাবো। এর মধ্যে পাশ থেকে নিলয় ভাইয়ার চাচাতো বোন জুই অন্যগুলাকে বলে উঠলো, এই আমাদের লম্বা নিলয় ভাইয়ার ভাগ্যে কি খাটো মেয়ে ছিলো। ওর কথাতে অন্য গুলা বললো এই আসতে বল,শুনলে আবার জেঠিমাকে বলে দেবে। তারপরো সবাই হাঁসতে লাগলো।

-কথাটা শুনে কিছুটা খারাপ লাগলো। অজান্তেই চোখঁ থেকে জ্বল গরিয়ে পরলো। আমি কি এতোই খাটো।

– আমি বিয়ে করতেছি আমার কোনো সমস্যা নেই,তোদের এতো কথার কি আছে

নিলয় ভাইয়ার কন্ঠ শুনে আবার ওদের দিকে তাকালাম। সবাই কেমন চুপসে গেছে,,

-তাছাড়া পদ্ম এতোটাও খা*টো না যে আমার সাথে মানাবে না, আর তোদের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই অন্যের সমালোচনা করা ছাড়া।

জুই-ভাইয়া ঐ মেয়েটার জন্য আমাদের সাথে এভাবে কথা বলতেছো

-ঐ মেয়েটা কাকে বলছিস তুই, তোর বড় ভাবি হয় পদ্ম, সেভাবেই সম্মান দিবি ওকে। আর তোদের মতো মেকাপ সুন্দরী পদ্ম না। ও এমনিতেই তোদের থেকে সুন্দর।

একপাশ থেকে নিলয় ভাইয়ার আরেকটা চাচাতো ভাই মুখ চেপে হেসেঁ বললো, ভাই অনেক হয়েছে এই বুইড়া বেডিগুলাকে আর ধুয়ে দেস না, না হলে কান্নাকরে সব মেকাপ ভাসিয়ে ফেলবে। এই বলে সবাই হো হো করে হেসেঁ উঠলো। পাশ থেকে পার্লারের মেয়ে দুটাও হাঁসছে তা দেখে আমিও আর হাসিঁ থামাতে পারলাম না। জুই সহ সব মেয়েগুলা হন হন করে চলে গেলো।

নিলয় ভাইয়া আমার সামনে এসে বসতেই আমি চুপ হয়ে গেলাম,,

-পদ্ম ফুল কি মন খারাপ করেছে

-কই না তো

-তাহলে চোখেঁ পানি

পাশ থেকে পার্লারের মেয়েটা বললো, আরে ভাইয়া যখন মেয়েগুলো আপুকে খাটো বলছিলো তখন কান্না করছিলো তাই পানি লেগে আছে। এখন আপনার কথা শুনে মনে হয় না আর মন খারাপ থাকবে।

উনি একটু হেসেঁ বললো, আমার পদ্ম ফুলকে কেউ কিছু বলবে আর আমি সেটার প্রতিবাদ করবো না তা কি করে হয়। আমি সর্বদাই আমার পদ্ম ফুলের পাশে আছি।

,,

দুপুরের আগে আগে গোছল শেষ করে চুল শুকাচ্ছি, চুল শুকানো হলে সাজিয়ে দেবে,,

-পদ্ম

খুব চেনা গলার স্বর শুনে পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, তানিয়া,সিমা, রিপা তিনজনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

কান্না পেয়ে গেলো আমার, স্কুলে থাকতে আমরা চারজন সবসময় একসাথে ছিলাম। কতোশতো খুনসুটি, কতো মজা করেছি। আজ তিনজনকে একসাথে দেখে কান্না আটকাতে পারলাম না। কতোদিন পর দেখা। চারজন জরিয়ে ধরে কান্না করছি। আমাদের কান্না শুনে বাড়ির অনেকেই চলে এসেছে।

সিমা-কি রে জেরিনের মতো তুই ও একা একা বিয়ে করে নিচ্ছিস

-আমি নিজেই জানতাম না এখনি বিয়ে করতে হবে,আর তোদের সাথে তো যোগাযোগ ও ছিলো না। আর জেরিনের বিয়ে হয়ে গেছে

তানিয়া-হ্যা সে একবছর হতে চললো প্রায়, কার সাথে হয়েছে জানিস

-কার সাথে

তানিয়া-আমরা যে ভাইয়াটার থেকে ছাঁদে একদিন গান শুনেছিলাম না,সিমা বলেছিলো আমাদের যে আমি বললেই গাইবে দেখিস,তার সাথে

-কি রে সিমা তাই নাকি, তলে তলে এতোকিছু

সিমা মাথা নিচু করে বললো, তখন তো কিছু ছিলো না আমাদের মাঝে

রিপা-একদম মিথ্যে বলবি না,আমি একদিন তোদেরকে একসাথে দেখেছিলাম রাস্তায়

আমি বললাম আচ্ছা থাম, তোদেরকে এখানে কে নিয়ে এসেছে,,

রিপা-হ্যাঁ ভালো কথা বলছিস,কাল দুপুরের পর হটাৎ নিলয় ভাইয়া আমাদের বাড়িতে যায়, আমি তো চিনতে পারি নি। পরে পরিচয় দিয়ে বললো আজ নাকি তোদের বিয়ে, আমি প্রথমে শুনে অবাক হয়ে যাই, কারন আমি অভ্র ভা….

আমি ওকে আর কিছু বলতে না দিয়ে আটকিয়ে দিয়ে বললাম আচ্ছা বুঝেছি। চোখঁ টিপ দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম এখানে অনেকেই আছে। যা বোঝার ওরা তিনজনে বুঝে গেলো। কারন অনেক আগের অভ্যাস এটা।

ওরা বসে বসে এটা ওটা গল্প করছে আর পার্লারের আপু দুইটা আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। অনেকদিন পর পুরানো বান্ধবীদের কাছে পেয়ে সত্যি অনেক ভালো লাগছে। নিলয় ভাইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ আমি আজকের দিনে আমার প্রিয় বান্ধবীদের নিয়ে আসার জন্য। আসলে স্কুলে থাকতে ওটাও যেনো একটা পরিবার হয়ে গেছিলো। পড়া না হলেও ওদের সাথে দেখা করার জন্য হলেও স্কুলে যেতাম। শুক্রবারটাও যেনো কাটতে চাইতো না ওদেরকে ছাড়া।

সাজগোজের মধ্যেই বিয়ের জন্য এসেছে, আব্বু আম্মু সহ সবাই এসে বসে আছে আমার মুখে ‘কবুল’ শোনার জন্য, কবুল বলার সময় গলাটা আটকে এসেছিলো,কি কি আজগুবি সবকিছু মনে এসেছিলো, চোখঁ বন্ধ করে বাবা মায়ের কথা মেনে নিয়ে কবুল বলে দিয়েছি।যতোটা সম্ভব তারাতারি বিয়েটা শেষ করেছে কারন আজকেই ফুপির বাড়িতে যাবো। এখান থেকে কার এ যেতে কমপক্ষে পাঁচ ঘন্টার মতো লাগবে।

বিয়ে মানেই কনের যা কিছু হোক অন্য সবার আনন্দ, বান্ধবীরা মিলে ঠিক করেছে নিলয় ভাইয়াকে বউ চিনতে হবে, আমি সহ ওরা তিনজন কম্বলের নিচে বসে আছি, নিলয় ভাইয়া আমাদের সামনে বসে আছে, সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে নিলয় কি পারবে তার পদ্ম কে চিনতে,,
সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিলয় ভাইয়া আমাকে চিনে নিলো, আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে কালো শেরওয়ানিতে ওনাকে এতোটা সুন্দর না লাগলেও পারতো। তার ওপর মুখে মুচকি হাসিঁ।
আমি ফিসফিস করে বললাম কিভাবে বুঝলেন এটাই আমি,উনি আমার থেকেও গভীর ফিসফিসিয়ে বললেন,এটা সিক্রেট বাসর রাতে বলবো কেমন। ওনার এমন কথা শুনে আমি আর কিছু বললাম না, সবসময় বাসর রাত, বাচ্চা এসব বলে আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়।

সবাইকে বিদায় দিয়ে, ছয়টার দিকে রওনা দিলাম, সামনে ড্রাইভার আর পেছনে আমি আর নিলয় ভাইয়া, আর বাকীরা অন্য গাড়িতে আজে। আজ কেনো জানি তুর্যটা ছাড়তেই চাইছিলো না। বার বার বলছিলো আমার আপুকে কোথায় নিয়ে যাবে,খুব মায়া লাগছিলো আমার তখন।

আমি জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি, আর মনে মনে ভাবছি নিলয় ভাইয়া আসলেই খুব আলাদা একজন মানুষ। আমার কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সবকিছু খেয়াল উনি রাখেন। আমি খুব তারাতারি ওনাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবো। কেনোনা বাঙালি মেয়েদের বিয়ে একবারি হয়, আমারো হয়েছে, যতো তারাতারি মেনে নেবো ততোই ভালো।

চলবে,,

ভূল ত্রুটি থাকলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।❌কপি করা নিষেধ ❌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here