#পথের_কাঁটা(১)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
‘ও চরিত্রহীন মেয়ে আমি কিছুতেই বিয়ে করব না! সুযোগ পেয়ে আপনারা এই চরিত্রহীনা মেয়েটি গছিয়ে দেবেন আর আমি টের পাব না ভেবেছেন?’
উঠানের একপাশে মাথা নত অবস্থায় বধূ বেশে দাঁড়িয়ে রয়েছে জয়ী। ধরনীর সমস্ত কালো দাগ যেন আজ জোরপূর্বক তাঁর সর্বাঙ্গে মেখে দেওয়া হচ্ছে। এ অপবাদ নিদারুণ, অসহ্যকর, যন্ত্রণার। অসহনীয়ও বটে! জয়ীর বাবা জামশেদ রহমান চোয়াল শক্ত করে বরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর দুই মেয়েকে তিনি দেখেশুনে বড়ো করেছেন। আজ পর্যন্ত গ্রামের কোনো মানুষ তাঁর মেয়েদের দিকে আঙুল তুলে কিছু বলতে পারেনি। সেখানে বিয়ের দিন বর বলছে তাঁর বড়ো মেয়ে চরিত্রহীন! তিনি শিক্ষিত মানুষ। তাই অশিক্ষিতের মতো ব্যবহার তাকে সাজে না। নিজের রাগকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,’তুমি কীসের ভিত্তিতে আমার মেয়েকে চরিত্রহীন বলছ? কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’
‘আলবৎ প্রমাণ আছে। মেম্বারের ছেলে নিজেই এখানে উপস্থিত আছে। তাকেই জিজ্ঞেস করুন তাঁর সাথে আপনার মেয়ের প্রেম ছিল নাকি।’ বরের চটপটে স্বীকারোক্তি।
এবার আর জামশেদ রহমান রাগ দমিয়ে রাখলেন না। সজোরে থাপ্পড় বসালেন বরের গালে। হুংকার দিয়ে বললেন,’এক্ষুণী বরযাত্রী নিয়ে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। মেম্বারের ছেলের কথা শুনে তুমি আমার মেয়েকে চরিত্রহীন উপাধি দিচ্ছ? আমি যদি পারতাম এখনই তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম।’
ছোটোখাটো নয় বরং বেশ বড়োই ঝামেলা হয়ে যায় বিয়ে বাড়িতে। বরযাত্রীরা চলে গেছে। গ্রামের মানুষ কানাকানি শুরু করে দিয়েছে। তর্ক-বিতর্কের কোন পর্যায়ে জয়ী ঘরে চলে গেছে তা কেউ খেয়াল করেনি। মেম্বারের বোখে যাওয়া ছেলে অনেক আগে থেকেই জয়ীকে বিরক্ত করত। ভালোবাসার প্রস্তাব এমনকি বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। জয়ী কিংবা তাঁর পরিবার রাজি হয়নি। যার ফলস্বরূপ বরযাত্রীকে কানপড়া দিয়ে এই বিয়ে ভঙ্গ করেছে।
ঘরের চৌকাঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন জামশেদ রহমান। ভেতরের ঘর থেকে জয়ীর হাউমাউ করা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করছে গ্রামের কোনো এক ছেলের সাথে জয়ীর বিয়েটা দিয়ে দিতে। কিন্তু জয়ী শিক্ষিত মেয়ে। তাঁর উপযুক্ত কোনো ছেলে এই গ্রামে নেই। অন্য গ্রাম থেকেও বিয়ে ভাঙা কোনো মেয়েকে, বিয়ে করতে আসার জন্য কোনো ছেলে উদগ্রীব হয়ে নেই। জ্ঞাতশূন্য অবস্থায় তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
ছোটো বোন জেসমিন রহমান তখন ভাইয়ের পাশে এসে বসেন। বোনকে পাশে পেয়ে এতক্ষণে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। ক্রন্দনরতস্বরে বলেন,’এমন কেন হলো জেসমিন? আমার মেয়েটার সাথে এমন কেন হলো?’
‘আপনি কাঁদবেন না ভাইজান। জয়ীর কিছু হয়নি। বরং যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আজ যেটা হলো এটা যদি বিয়ের পর হতো? বিয়ের পর যদি ছেলে বলতো ডিভোর্স দিয়ে দেবে তখন কী হতো বলেন তো? বরং শুকরিয়া আদায় করেন। আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে। আল্লাহ্ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন,’জয়ীর বিয়ে আজই হবে। আমার অঙ্কনের সাথে।’
জামশেদ রহমান যেন আঁৎকে উঠলেন। সেই সাথে ভীষণ অবাকও হলেন। তিনি বললেন,’এসব কী বলিস? অঙ্কন জয়ীর চেয়ে দেড় বছরের ছোটো।’
‘তাতে কি আপনার বা জয়ীর কোনো সমস্যা হবে?’
‘সেটা কথা না জেসমিন। অঙ্কন রাজি হবে না।’ পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে বললেন তিনি।
‘অঙ্কনকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আপনি রাজি নাকি সেটা বলেন।’
‘এটা তো আমার ভাগ্য। কিন্তু অঙ্কন…’
‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। আমার ছেলেকে আমি চিনি। আপনি কাজীকে ডাকেন আবার। আমি আসছি।’
.
জয়ী মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। পাশে বসে বোনের পিঠে মাথা রেখে অনবরতভাবে কেঁদে চলেছে ত্রয়ীও।ওদেরকে ঘিরে ছোটোখাটো একটা জটলা চারপাশে। অঙ্কনের দৃষ্টি ক্রন্দনরত ত্রয়ীর দিকে নিবদ্ধ। ত্রয়ীকে কাঁদতে দেখে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। সমুদ্রের গর্জনের ন্যায় বুকের মাঝে বিষাদের ঢেউ তুলছে। ইচ্ছে করছে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলতে,’কাঁদবে না তুমি। তুমি কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয় জানো না?’
কিন্তু এতগুলো মানুষের সামনে সেটা কখনো সম্ভব নয়। এমনকি আড়ালেও না। কারণ ত্রয়ীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এক পাক্ষিক। এখনো মনের কথাটি ওকে জানানো হয়নি। মেয়েটা অনেক স্বপ্নবিলাসী। ডাক্তার হবে। গ্রামের মানুষের সেবা করবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে। তাই শত শত ভালোবাসার প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করে সেসব এড়িয়ে গেছে। তাই তো মনে মনে অঙ্কন পণ করেছে যেদিন ত্রয়ী সম্পূর্ণ ডাক্তার হয়ে যাবে সেদিন একটা রিং নিয়ে হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে বলবে,’ত্রয়ী, তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি। একদম প্রথম থেকে। যখন তুমি কিশোরী। সদ্য ফোঁটা গোলাপের ন্যায় কখন যে সম্পূর্ণ নারীতে পরিপূর্ণ হয়েছ তা বুঝে ওঠার আগে থেকেই ভালোবাসি। ভালোবাসি তোমাকে। ভালোবাসি তোমার স্বপ্নকে।’
‘অঙ্কন।’
জেসমিন রহমানের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে পিছু ফিরে তাকায় অঙ্কন। চিন্তিত মুখে তিনি চেয়ে আছেন। অঙ্কন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কিছু বলবে মা?’
‘তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।’
‘বলো।’
‘এদিকে আয়।’
অঙ্কন জেসমিন রহমানের সঙ্গে পাশের রুমে যায়। তিনি কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই বললেন,’তুই জয়ীকে বিয়ে করবি।’
অঙ্কনের মনে হলো ধরনীর সুদীর্ঘ অম্বর তার মাথার ওপর আছড়ে পড়েছে। মা এসব কী বলছে? সে কি মশকরা করছে? জেসমিন রহমানের সঙ্গে অঙ্কনের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই। তবে মশকরা করার মতো সম্পর্ক এবং সিচুয়েশন কোনোটাই এখন নেই। সে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতেও পারল না। ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’কীরে চুপ করে আছিস কেন? করবি না বিয়ে?’
‘মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? জয়ী আর আমি!’ উদভ্রান্তের মতো বলল অঙ্কন।
‘হ্যাঁ, জয়ী আর তুই। সমস্যা কী?’
‘সমস্যা আছে মা। জয়ী আমার বয়সে বড়ো। অনেকটা সমবয়সী বলে নাম ধরেই ডাকি তার মানে তো এই নয় যে বিয়ে করব।’
‘পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা কর বাবা। এই মুহুর্তে আর কোনো যোগ্য ছেলে নেই যে জয়ীকে বিয়ে করবে। ভাইজানের অবস্থা খুব খারাপ। তুই তো জয়ীকে চিনিস। শান্ত গোছের মেয়ে। এত বড়ো একটা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে? তুই আর অমত করিস না বাবা।’
‘সম্ভব না মা। সম্ভব না। কোনোভাবেই সম্ভব না। আমি জয়ীকে কখনোই ঐ চোখে দেখিনি। ওকে বিয়ে করা, সংসার করা… হবে না আমার দ্বারা।’
‘সব হবে। মানিয়ে নিলেই সম্ভব। তুই কি চাস তোর মামার এই বয়সে কিছু হোক? অথবা জয়ী উল্টাপাল্টা কিছু করুক?’
‘এখানে তুমি আমায় কেন টানছো? এই বিয়ে ভাঙার পেছনে আমার তো কোনো হাত নেই।’
‘আমি জানি সেটা। সবাই তো ভাঙতেই জানে। তুই না হয় গড়ে দিলি।’
দন্ত দ্বারা নিচের ঠোঁট চেপে ধরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায় অঙ্কন। সে চেয়েছিল ত্রয়ীকে ভালোবাসার কথাটা চেপে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বলে দেওয়াই উত্তম হবে। তাই আর কোনোকিছু না ভেবেই বলে ফেলল,’আমি ত্রয়ীকে ভালোবাসি মা।’
জেসমিন রহমান চমকে ওঠেন। একই বাড়িতে থাকে ওরা। ডাক্তারি পড়াশোনার জন্য ত্রয়ীও ওদের সঙ্গে থাকে। অথচ এমন কোনো কিছুই তিনি দেখেননি।
‘ত্রয়ীও তোকে ভালোবাসে?’ জিজ্ঞেস করেন তিনি। তাঁকে একই সঙ্গে উপায়ন্তরহীন এবং দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে।
অঙ্কন নির্মল কণ্ঠে জানাল,’জানিনা। আমি যে ওকে ভালোবাসি এটাও ত্রয়ী জানে না।’
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। এতক্ষণে যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ছিল এবং এখন সে নিশ্চিন্ত। তিনি বললেন,
‘বেশ! যেটা জানে না সেটা অজানাই থাক। ত্রয়ীর জন্য ছেলের অভাব হবে না। এমনও না যে তোদের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এই মুহুর্তে জয়ীর পাশে তোকে প্রয়োজন।’
নিজের মাকেই যেন অচেনা লাগছে অঙ্কনের। ছেলের ভালোবাসার মূল্যও নেই তাঁর কাছে। অঙ্কন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,’সব জেনেও তুমি এ কথা বলছ মা?’
তিনি কঠোরসুরে বললেন,’আজ পর্যন্ত আমি তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনি। আজ চাচ্ছি এবং আদেশ করছি, তুমি জয়ীকে বিয়ে করবে। আমি মা হয়ে তোমাকে আদেশ করছি শুনেছ তুমি?’
মায়ের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছে না অঙ্কন। চারদিকের সবকিছু মরুভূমি মনে হচ্ছে। আর সে তৃষ্ণার্ত এক পথিক। তখন দরজার পাশ থেকে ত্রয়ীর গলা শোনা যায়,’ফুপি আব্বু ডাকছে তোমায়। কাজী চলে এসেছে।’
ত্রয়ীর কণ্ঠস্বর অঙ্কনের বুকে তীরের ফলার মতো বিঁধে। কী ভারী সেই যন্ত্রণা। কী বিষময় সেই যন্ত্রণার জ্বালা! কীভাবে সে ত্রয়ীকে রেখে জয়ীকে বিয়ে করবে? কীভাবে সে মায়ের অবাধ্য হবে? সে মায়ের আদেশ পূরণ করবে নাকি ভালোবাসা বিসর্জন দেবে?
জেসমিন রহমান চলে যাওয়ার পর ত্রয়ী শান্তভঙ্গিতে তাকায় অঙ্কনের দিকে। যেই দৃষ্টিতে এতক্ষণ বর্ষার জলে টইটুম্বুর ছিল সেই দৃষ্টিতে এখন পরিতৃপ্তির ছাপ। ত্রয়ী বলল,
‘আপনাকে আল্লাহ্ নিশ্চয়ই দেবদূত হিসেবে পাঠিয়েছিল। নয়তো অফিসের এত কাজের ব্যস্ততা থাকার পরও কেন আপনি বিয়েতে আসতে যাবেন? আল্লাহ্’র অশেষ রহমত! আপনার ঋণ কখনও হয়তো আমরা শোধ করতে পারব না। চিরদিন ঋণী হয়েই থাকব। আমাদের পরিবারের সম্মান, আপুর জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি আপনি আমাদের বিপদে এগিয়ে এসেছেন।’
ব্যর্থ যোদ্ধার ন্যায় স্তম্ভিত অঙ্কন। সে এসেছিল ত্রয়ীর জন্য। সকল ব্যস্ততাকে একপাশে ফেলে শুধু কিছুটা সময় হাসিখুশি ত্রয়ীকে দেখবে বলে এসেছিল। আর এই আসাটাই এখন তাঁর কাল হয়ে দাঁড়াল। ত্রয়ীও ধরে নিয়েছে অঙ্কন বিয়েটা করবে। সে আসলে কী করবে এখন? কী করা উচিত?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। প্রথম পর্ব তাই কিছু না কিছু কমেন্টে বলে যাবেন।]