#নীল_জোছনায়_ভাসি (০৭)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
রাত এগারোটা। আমরা রাতের খাবার খাচ্ছি। আলু দিয়ে মুরগির ঝোল ও ডাল রান্না করেছিলাম। আজকের রান্না খারাপ হয়নি। কিন্তু মুরগির তরকারিতে ঝালটা একটু বেশি হয়েছে। বাবা খেতে খেতে আপুর উদ্দেশ্যে বললো,
“ফুল কাকে দিয়েছিস রে মা?”
আপু ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং করছিল। বাবার কথায় বাবার দিকে তাকালো। ও অবাক, সাথে আমিও। আপু কাকে ফুল দিয়েছে? আপু কি কাউকে ফুল দেওয়ার মানুষ?
আপু বিস্মিত হয়ে বললো,
“কাকে ফুল দিয়েছি?”
“সেজান বললো তুই ওর থেকে বাকিতে ফুল কিনেছিস। তো সেই ফুল দিয়েছিস কাকে? চাইনিজ বয়কে দিস নি তো আবার?”
আপুর মুখশ্রীতে চাপা রাগের ছাপ পড়লো।
“সেজান এই কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ, ফুলের টাকাও নিয়েছে।”
আপুর চোখ কপালে উঠলো,
“ফুলের টাকা নিয়েছে মানে? কত টাকা নিয়েছে?”
“তিনশ টাকা।”
“তুমি কি বোকা বাবা? ও বললো আর তুমি সে কথা বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছো? এমনই দুঃসময় এসেছে যে আমাকে ওর কাছ থেকে ফুল কিনতে হবে?”
বাবা চমকালো,
“তাহলে তুই বাকিতে ফুল কিনিসনি?”
“না। ফুল কিনে আমি করবোটা কী?”
বাবার মুখটা দুঃখ প্রাপ্ত দেখাচ্ছে। কণ্ঠও করুণ,
“ইশ! ছেলেটা কত খারাপ হয়ে গেছে! মিথ্যা বলে টাকা নিচ্ছে এখন। আশরাফের যে কী হবে এই ছেলেকে নিয়ে!”
আমি বাবাকে দেখে অবাক হলাম। তার টাকার জন্য চিন্তা নেই, চিন্তা হচ্ছে কি না আশরাফ চাচাকে নিয়ে? মানুষ একশ টাকা হারালেও পাগল হয়ে যায়। অন্য মানুষ কেন, আমি নিজেও পাগল হতাম। আর বাবা?
আপু হাত ধুয়ে নিলো। টিসু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“সেতু, আমার সাথে চল।”
“কোথায়?”
“ও কী ভেবেছে? ও আমার বাবার টাকা হজম করতে পারবে? ওঠ।”
আমার খাওয়া ফেলে একেবারেই যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু আপুর কথার অবাধ্য হওয়াও সম্ভব নয়। আমি হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বাবা বললো,
“এই রাতের বেলা তোরা ডা’কাতি করতে যাবি? আমার মেয়েরা ডাকাতি করবে?”
“আজব! ডাকাতি করবো কেন?” আপু বললো।
“তাহলে কি স’ন্ত্রাসবাদ করবি? ওটা তো আরও খারাপ জিনিস।”
আপু বাবার কথা শুনে সময় নষ্ট করলো না, নিচ তলায় চলে এলো আমাকে নিয়ে। সেজান ভাইয়াদের বন্ধ দরজায় করাঘাত করলো। আপু রেগে আছে বলে করাঘাত করছে, না হলে কলিং বেল চাপতো।
চাচি দরজা খুললো। এ সময়ে আমাদের দুজনকে দেখে অবাক হলো সে।
আপু বললো,
“সেজান ঘরে?”
সেজান ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করায় চাচি ভয় পেল। সে হয়তো ভাবছে তার ছেলে কিছু করেছে। সে নিচু গলায় বললো,
“ও কিছু করেছে?”
“ওকে বলো আমরা এসেছি।”
“আচ্ছা।”
চাচি আমাদের আগমনের খবর সেজান ভাইয়াকে জানাতে গেল। খবর শুনেই চলে এলো সে। ভ্রু কুঁচকে আমাদেরকে দেখে বললো,
“কী হয়েছে?”
আপু সেজান ভাইয়ার টি-শার্ট আঁকড়ে ধরলো গলার কাছ থেকে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাগ্যিস চাচি সাথে আসেনি।
আপু সেজান ভাইয়াকে টেনে আনলো টিউবওয়েলের কাছে। ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“তুই বাবার কাছ থেকে তিনশ টাকা নিয়েছিস? এখনই টাকা ফেরত দে। না হলে চাচাকে গিয়ে বলবো তুই মদ খেতে মিথ্যা বলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিস।”
“টাকা তো এমনি এমনি নিইনি। তুই ফুল চুরি করেছিস। ওটা আমার পাওনা টাকা।”
“আমি চাচাকে গিয়ে বলছি।”
আমি ভাবতে পারিনি আপু সত্যি সত্যি আশরাফ চাচাকে গিয়ে কথাটা বলে দেবে। সেজান ভাইয়াও হয়তো এটা আশা করেনি। আমি আর সেজান ভাইয়া যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে আপু চাচাকে সব জানিয়ে দিয়েছে। সেজান ভাইয়ার টাকা দিতেই হলো। আমি জানি আজ সেজান ভাইয়ার কপালে দুঃখ আছে। কষ্ট হচ্ছে তার জন্য। আপুকে বললাম,
“কাজটা বোধহয় ঠিক হয়নি আপু।”
আপু কটমট করে আমার দিকে তাকালো,
“তোর কাছ থেকে ঠিক-বেঠিক শিখতে হবে?”
“না।”
আমরা ঘরে চলে এলাম। যা ধারণা করেছিলাম তাই হলো। সেজান ভাইয়ার কপালে আসলেই দুঃখ জুটেছে। সে এখন হাঁটাহাঁটি করছে উঠোনে। চাচা তাকে বের করে দিয়েছে ঘর থেকে। আজ রাতে বোধহয় তাকে বাইরে হেঁটে হেঁটেই কাটাতে হবে। হঠাৎ দেখলাম সে সিগারেট ধরাচ্ছে। কী সাংঘাতিক! সিগারেট নিয়ে বের হলো কী করে? না কি সিগারেট সাথেই ছিল?হৃদয়ে আ’ঘাত অনুভব করলাম। বিড়বিড় করে বললাম,
“তুমি এমন কেন সেজান ভাইয়া? একটু ভালো হতে পারো না? একটু ভালো হও দয়া করে। আমার বুকে একরাশ তৃষ্ণা তোমাকে আবারও ভালো রূপে দেখার জন্য। প্লিজ ভালো হও, আমার জন্য হও।”
আমি বিড়বিড় করে বলছিলাম, এ কথা অবশ্যই সেজান ভাইয়ার শোনার কথা নয়। কিন্তু আমি চমকে উঠলাম সে আমার দিকে তাকানোতে। আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই সে তাকিয়েছে। তার হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেল। পড়ে গেল না কি ফেলে দিলো? আমি জানি না। আমি চাই সে একদিন চিরতরে তার জীবন থেকে এটা সরিয়ে ফেলুক।
__________________
রাতে দেরি করে ঘুমালাম, কিন্তু ঘুম ভাঙলো তাড়াতাড়ি। বাবা মসজিদ থেকে ফিরেছে সবে। করিম চাচাও বাবার সাথে রয়েছে। তারা রুমে ঢুকে নিচু স্বরে কী বিষয়ে যেন আলোচনা করলো অনেকক্ষণ ধরে। আলোচনাটা বিয়ে সংক্রান্ত এটুকু বুঝতে পারছি, কিন্তু তাদের আলোচনার ধরনটা গোপনীয় আলোচনার মতো। কিন্তু বাবা বিয়ে করবে এটা গোপনীয় কিছু তো নয়। তাহলে? আজকাল আজব আজব সব ঘটনা ঘটছে।
____________________
একদিন বিকেলে বাবা এক ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলো। দরজা খুলেই অপরিচিত একজন মানুষের সামনে পড়ে হকচকিয়ে গেলাম। বাবা ছেলেটাকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে আমাকে নিয়ে কিচেনে চলে এলো। চাপা গলায় জানতে চাইলো,
“ঘরে খাবার কী আছে?”
“কিছু নেই।”
বাবা ভ্রু কুঁচকালো
“কিছুই নেই?”
“না।”
“চা, বিস্কুটও নেই?”
“চিনি নেই।”
“আগে বলিসনি কেন?”
“সকালে বলেছিলাম তো।”
“দুপুরে যে রসমালাই নিয়ে এসেছিলাম, তা তো আছে।”
“নেই, যা ছিল আমি আর আপু খেয়ে ফেলেছি। নুড্লস আছে। রান্না করে দেবো?”
“দে, জলদি কর।”
বাবা চলে যেতে নিয়েছিল, আমি বললাম,
“ছেলেটা কে বাবা?”
বাবা হেসে উত্তর দিলো,
“তোর দুলাভাই।”
আমার চোখ কপালে উঠলো,
“দুলাভাই মানে?”
“এত বড়ো হয়েছিস অথচ দুলাভাই কাকে বলে জানিস না? বড়ো বোনের স্বামীকে দুলাভাই বলা হয়, আর বড়ো ভাইয়ের বউকে ভাবি বলা হয়।”
“আমি ভালোই জানি কাকে কী বলা হয়। আপু জানে তুমি ওর বিয়ের জন্য পাত্র দেখেছো?”
“আগে থেকে জানিয়ে দিলে কি সারপ্রাইজ হবে? ছেলেটা কেমন বল তো? সুন্দর না? ইঞ্জিনিয়ার। বাবার নাম সিকান্দার আলী, মায়ের নাম মমতাজ বেগম। গুলশানে পাঁচ তলা বাড়ি আছে। ছেলে মাশাআল্লাহ। ঠোঁট কিন্তু কালো না। কালো হবে কেন? ছেলে তো সিগারেট খায় না।”
বাবা বিগলিত গলায় কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল কিচেন থেকে।
আমার মাথায় চিন্তার মেঘ উড়ছে। আজ শুক্রবার। আপু স্টুডেন্ট পড়াতে যায়নি, গেছে মার্কেটে। একটু পরই এসে যাবে। এসে যখন দেখবে বাবা পাত্র নিয়ে এসেছে বাড়িতে তখন তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। আমি বাবার জন্য দুঃখবোধ করছি। না জানি বাবাকে আজ কত কিছুর সম্মুখীন হতে হয়।
নুডলস পরিবেশন করে আমি সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম আপুর জন্য। আমি চাচ্ছি না আপু হঠাৎ করে পাত্র দেখে রেগে যাক, তাই ওকে আগেই বাবার করা মস্ত বড়ো কাজটি সম্পর্কে জানানোর জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না, ছয় মিনিট পরেই আপুকে দেখতে পেলাম। আমাকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপু দুই ভ্রুর মধ্যস্থলে ভাঁজ ফেলে কাছে এগিয়ে এলো। অবাক গলায় জানতে চাইলো,
“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“চিন্তা করো না, জাবির ভাইয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি না।”
“ভালোই জানি কেন দাঁড়িয়ে আছিস। ফাজিল মেয়ে, ঘরে যা।” আপুর গলা চড়া হলো। আপুর ধারণা আমি জাবির ভাইয়ের জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। বললাম,
“আস্তে কথা বলো। ঘরে অতিথি এসেছে।”
“কে এসেছে?”
“দুলাভাই।”
“কোন দুলাভাই? জেসমিন আপুর হাসব্যান্ড?”
“না, মিস রূপকথার হাসব্যান্ড।”
“রূপকথার হাসব্যান্ড? সেটা আবার কে?”
আপুর খেয়াল নেই যে রূপকথা ও নিজেই। আমাকে উত্তর দিতে হলো না, তার আগে ওর নিজেরই খেয়াল হলো। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠলো ওর। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“রূপকথার হাসব্যান্ড মানে?”
“বাবা তোমার জন্য পাত্র দেখেছে। নাম ইমাইদ। ইঞ্জিনিয়ার। বাবার নাম জনাব…”
“ইয়ার্কি পেয়েছে? যাকে তাকে নিয়ে আসলেই আমি বিয়ে করবো?”
আপু হনহনিয়ে ঘরের দিকে ছুটলো। আমিও ছুটলাম পিছন পিছন। খুব শঙ্কিত ছিলাম, কিন্তু আমি যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম কিছুই হলো না। ভেবেছিলাম আপু ঘরে ঢুকেই চ্যাঁচামেচি শুরু করবে, ওর ছুটে আসার ধরনও তেমনই ছিল। কিন্তু ছেলেটাকে দেখে থেমে গেল আপু। আপুকে অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে। অথচ আপু মোটেই কোনো পরিস্থিতিতে অপ্রস্তুত হওয়ার মতো মেয়ে নয়। আপু চ্যাঁচামেচি করলো না কেন? আপুর কি পাত্র পছন্দ হয়েছে? আমার মনে হলো আপু লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু আপুর এখন মোটেই লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল না। ইমাইদ ছেলেটা আপুকে মিষ্টি কণ্ঠে সালাম জানালো।
ছেলেটা সালাম দেওয়ায় আপু আরও লজ্জা পেয়ে গেল। সালামের জবাব দিয়েই রুমে চলে গেল ও।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আপুর কি পাত্র পছন্দ হয়েছে? আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটা সুদর্শন, স্মার্ট। পছন্দ হওয়ারই মতো। হয়তো আপুর পছন্দ হয়েছে। আমিও আপুর রুমে গেলাম। আপু বসে আছে।
“পাত্র পছন্দ হয়েছে আপু?”
আপু কটমট করে তাকালো।
“বাজে কথা বলিস না।”
আপুর ধমকে তেজ নেই। তারমানে পাত্র সত্যিই পছন্দ হয়েছে আপুর। আমি মুখ টিপে হাসলাম।
“হাসছিস কেন?”
“ভাবছি তোমার আর বাবার বিয়ে একদিনে হলে মন্দ হবে না।”
আপু রাগলো। ধমকে উঠলো তেজি কণ্ঠে,
“বেয়াদব! যা এখান থেকে।”
আমি মুখ কালো করে বেরিয়ে এলাম। তারপরই আবার হেসে ফেললাম। পাত্র সম্ভবত এখন চলে যাবে। হ্যাঁ সে চলে গেল। আমি বাবাকে বললাম,
“পাত্র আপুর পছন্দ হয়েছে।”
বাবা গদগদ কণ্ঠে বললো,
“বলিস কী?”
“হুম। কিন্তু বাবা, তুমি হঠাৎ নিজের বিয়ে রেখে আপুর বিয়ে দিতে উদ্যত হলে কেন?”
“তাশরীফ ভালো ছেলে না। বলা তো যায় না, রূপকথা যদি তাশরীফের জন্য পাগল হয়ে ওঠে? তাছাড়া ধর, আমি যাকে বিয়ে করবো সে যদি ভালো মহিলা না হয় তখন কী হবে? সে তোদের সহ্য করতে পারবে না, তোরাও তাকে সহ্য করতে পারবি না। তাই যাতে এরকম কোনো সমস্যা না হয় তাই এই উদ্যোগ গ্রহণ। ভালো করেছি না? তাছাড়া ওর তো বিয়ের বয়স হয়েছে।”
“ভালো করেছো।”
“আমি কি ভাবছি জানিস?”
“কী ভাবছো?”
“তোর বিয়েটাও আমি শীঘ্রই দিয়ে দেবো।”
বুকের ভিতর ধড়াস করে উঠলো। বিয়ে? বললাম,
“আমার তো এখনও আঠারো বছর হয়নি বাবা।”
“হয়েছে।”
“হয়নি।”
“কাগজপত্রে না হলেও আসলে হয়েছে। তোর জন্মনিবন্ধনে এক বছর বয়স কমানো। তোকে আমি এক বছর দেরি করে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।”
“কিন্তু জন্মনিবন্ধনে তো হয়নি। আমি বাল্যবিবাহ করবো না।”
“তোর চেয়ে কত ছোটো ছোটো মেয়েরা কত সুন্দরভাবে স্বামীর সংসার করে জানিস?”
“আমি পারবো না।”
“তোর কেমন ছেলে পছন্দ? লম্বা না খাটো? শ্যামলা না ফরসা? শুকনো না মোটা?”
“মজা বন্ধ করো বাবা, আমার ভালো লাগছে না।”
আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। ঘেমে যাচ্ছি। বাবার কথা শুনে সত্যিই ভয় করছে।
বাবা বললো,
“লোকের মেয়েরা কত সুন্দর করে বাবার কাছে এসে বিয়ের কথা বলে, অথচ আমার মেয়েকে দেখো, আমি নিজ থেকে বিয়ের কথা বলছি তাতে আমার মেয়ে ঘেমে একাকার। আমার মেয়েদের মাঝে যে কত গুণ মিসিং!” বাবার কণ্ঠে স্পষ্ট আফসোস প্রকাশ পেল।
বাবা মজা করছে না সিরিয়াস বোঝা যাচ্ছে না। আমি বাবাকে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম। বাবা বললো,
“এক কাপ চা খাওয়াতো মা।”
“চিনি নেই তো।”
“চিনি ছাড়াই খাওয়া। শুনেছি চিনি ছাড়া চা না কি অনেক মজা হয়।”
“কার থেকে শুনেছো?”
“তোর মা বলতো। জানিস ও চায়ে চিনি খেতো না।”
মায়ের সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি না। কারণ মা যখন মারা যায় তখন আমি অনেক ছোটোই বলা যায়। বাবা সেই তখন থেকে একা একা আমাদের দেখভাল করেছে। ঘর সামলেছে, ব্যাবসা সামলেছে। এতগুলো বছর বাবা এত কষ্ট করে কাটানোর পর হঠাৎ এখন কেন বিয়ে করতে চাইছে? আমি শুনেছি যখন মানুষের বয়স হয়ে যায় তখন মানুষ একাকীত্ব বোধ করে। এ সময়ে নিজের পাশে সর্বক্ষণ একজন মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সন্তানরা তো সব সময় পাশে থাকতে পারে না। বাবা কি সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে? বাবা যাই করুক, আমি জানি সে ভুল কিছু করবে না।
বাবাকে চিনি ছাড়াই চা বানিয়ে দিলাম। চা দিয়ে নিচে গেলাম পানি আনতে। বন্ধ গেটের ওপাশে সেজান ভাইয়ার গলা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। একটা মেয়ের গলাও শুনতে পাচ্ছি। আমি কল পাড়ে না গিয়ে গেটের কাছে এলাম। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম সেজান ভাইয়া কার সাথে কথা বলছে। নীলিমাকে দেখা মাত্র থমকে গেলাম। চোখ সরিয়ে এনে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। সেজান ভাইয়ার বিয়েটা কি এবার সত্যিই হয়ে যাবে? আমি আবারও উঁকি দিলাম। সেজান ভাইয়া গেট থেকে কিছুটা দূরে। দেখলাম হঠাৎই সে আমার দিকে তাকালো। আমি গেটের একটুখানি ফাঁক দিয়ে তাদের দেখছিলাম। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলাম। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।
আমি টিউবওয়েলের কাছে এলাম। পানি নেওয়ার বৃহৎ পাত্রটা টিউবওয়েল চেপে পানি পূর্ণ করলাম। ঘরে যাব ভেবেও আবার গেটের দিকে তাকালাম। সেজান ভাইয়া কি এখনও নীলিমার সাথে কথা বলছে? আমি গেটের কাছে গেলাম আবারও। তখন গেটের ফাঁকটুকু বন্ধ করে গিয়েছিলাম। গেটটা আলতো হাতে টানলাম একটুখানি ফাঁক করার জন্য। আর ফাঁক করতেই আঁতকে উঠলাম। সেজান ভাইয়া একদম গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে কি জানতো আমি আবার এসে গেট ফাঁকা করবো? আমার জন্যই কি সে বন্ধ গেটের ওপাশে এরকমভাবে দাঁড়িয়ে ছিল?
গেটের ক্ষুদ্র ফাঁকা অংশ দিয়ে কেবল সেজান ভাইয়ার একটা চোখ দেখা যাচ্ছে। সেজান ভাইয়া গেটে ঠ্যালা দিয়ে আরও কিছুটা উন্মুক্ত করলো। এখন তাকে সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে। সে বললো,
“উঁকি মারছিলি কেন?”
“অন্যায় করেছি? উঁকি মারা দোষের?”
“এটা তো কোনো ন্যায়েরও কাজ না।”
খুব রাগ লাগছে। না চাইতেও বলে ফেললাম,
“মেয়েটার সাথে এত কী কথা বলছিলে?”
“ব্যক্তিগত কত কথা থাকতে পারে, তোকে বলতে হবে?”
ব্যক্তিগত কথা? আমার কপালে ভাঁজ পড়লো। এরই মধ্যে দুজনের মাঝে ব্যক্তিগত ব্যাপারও শুরু হয়ে গেছে? খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু সেই খারাপ লাগা গোপন করে বললাম,
“তুমি ওকে বিয়ে করবে?”
“চেয়েছিলাম করতে, কিন্তু ওকে বিয়ে করলে যদি কেউ কেঁদেকেটে ঘর ভাসায় সেই ভয় পাচ্ছি।”
আমি যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম,
“তুমি বিয়ে করলে কে কেঁদেকেটে ঘর ভাসাবে?”
“ভাসাবে না কেউ?”
“না।”
“তোর আপু…”
“আপু জীবনেও কাঁদবে না।”
“তুই কাঁদবি?”
সেজান ভাইয়া এমন একটা প্রশ্ন করবে আমি কখনও ভাবীনি। তাই আচমকা প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম। কেন যেন এখনই কান্না পেল এই প্রশ্নে। কিন্তু বললাম,
“আমি কাঁদবো কেন?”
সেজান ভাইয়া হাসলো। তার দুর্বোধ্য হাসির মানে আমি বুঝতে পারলাম না। সে হঠাৎ আমার হাতের বৃহৎ পানির পাত্রটা লক্ষ করে বললো,
“দেখিস, এটার ভারে তোর হাত না আবার ছিড়ে পড়ে যায়।”
বলেই সে হাসতে লাগলো। যেন খুব মজার কোনো কথা বলে ফেলেছে। অথচ আমার একদম হাসি পাচ্ছে না। আমি যেতে উদ্যত হলাম। এক পা এগোনো মাত্রই সেজান ভাইয়া হাত থেকে পানির পাত্রটা নিয়ে নিলো। আমাকে কষ্ট করতে হলো না। সে একদম আমাদের দরজার সামনে পাত্রটা পৌঁছে দিলো।
“থ্যাঙ্ক ইউ বল।” হুকুমের সুরে বললো সেজান ভাইয়া।
“কেন?”
“কেন মানে? এত ভারী পাত্রটা তোকে কে টেনে এনে দিতো এত উপরে?”
“আমি কি বলেছি টেনে আনতে?”
“বড়োদের মুখে মুখে তর্ক করিস? থ্যাঙ্ক ইউ বল।”
“তোমাকে থ্যাঙ্ক ইউ সেদিনই বলবো, যেদিন থেকে তুমি সিগারেট, মদ, গাঁজা এসব খাওয়া বন্ধ করবে।”
“তোর থ্যাঙ্ক ইউর দরকার নেই আমার।” কথাটা বলে সেজান ভাইয়া যাওয়া দিলো।
আমি অভিমানের গলায় বললাম,
“তুমি কি জানো মেয়েদের বাবারা সিগারেট খাওয়া ছেলেদের অপছন্দ করে?”
সেজান ভাইয়া থামলো। বললো,
“বাবারা অপছন্দ করলে মেয়েদেরও উচিত অপছন্দ করা।”
“তোমারও উচিত মেয়েদের কথা চিন্তা করে এসব ছেড়ে দেওয়া।”
“জ্ঞান বড়োরা ছোটোদের দেবে, ছোটোরা বড়োদের দেবে না।”
প্রচণ্ড রাগ হলো আমার। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় কি সেজান ভাইয়া অপমান বোধ করবে? ব্যাপারটা ভালো হবে তাহলে।
(চলবে)