নীল জোছনায় ভাসি পর্ব ১১

0
235

#নীল_জোছনায়_ভাসি (১১)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

সেদিনের পর দুটো দিন মন্দ কাটলো না। কিন্তু তৃতীয়তম দিনটা জীবনের অন্যতম কালো দিন। কারণ আপু তৃতীয়তম দিনে আমার বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। কথাটা জেনে খুব আঘাতপ্রাপ্ত হলাম। আপুই আমার ভরসা ছিল, কিন্তু আমার ভরসা চূর্ণ হয়ে গেল আজ। সেই সাথে চূর্ণ হলো হৃদয় নামক স্থানটিও। আপু কেন সম্মতি দিয়েছে তাও আমি বুঝতে পারছি। আনাম ভাইয়া সত্যিই ভালো। আপু একদিন বলেছিল, কাউকে পছন্দ করতে হলে হয় তার চেহারা সুন্দর হতে হয়, আর না হলে আর্থিক অবস্থা সুন্দর হতে হয়। আনাম ভাইয়ার চেহারা সুন্দর, আর্থিক অবস্থাও সুন্দর। তবে আপু যে কারণে বেশিই সম্মতি দিয়েছে তা হলো, আপু চিন্তিত। ও ভাবছে বাবা যদি সত্যিই বিয়ে করে ফেলে তাহলে ভালো ঘর থেকে আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসবে না। ও আরও চিন্তা করেছে, আমি হয়তো সৎ মায়ের সঙ্গে থাকতে পারবো না। এত সব ঝামেলার চেয়ে ভালো কারো সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেওয়াই তো ভালো হয়। তাহলে আমার নিজের একটা স্থানও হবে, নিজের একটা মানুষও হবে। আর বিয়ে তো দিতেই হবে, একটু আগেভাগে দিলে ক্ষতি কী? টের পেলাম বাম চোখ দিয়ে একটা উষ্ণ জলধারা গড়িয়ে নেমে গেছে গণ্ডদেশ পেরিয়ে। পরপরই আরও কয়েকটা উষ্ণ জলধারা সন্তর্পণে গড়িয়ে নামলো।

আপু বিয়েতে সম্মতি দেওয়ায় বাবা ভীষণ খুশি হয়েছে। আনন্দে সে সন্ধ্যায় তিন প্যাকেট মিষ্টি কিনে এনেছে। শিক্ষক সমিতি ও সেজান ভাইয়াদের বাসায় দুটো মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবে সেই সুসংবাদটা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানাবে বলে। বাবার এসব কাণ্ড আমার সহ্য হচ্ছিল না। যখনই দেখলাম সে মিষ্টি নিয়ে এসেছে আমি কিছু না বলেই ছাদে চলে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো দুটো ফ্লোরেই মিষ্টি পৌঁছে গেছে আমার বিয়ের আনুষ্ঠানিক বার্তার সঙ্গে। সেজান ভাইয়া আগে থেকেই জানতো বলে সে বিস্মিত হবে না। কিন্তু জাবির ভাই ভীষণ ঝটকা খাবে।

জানি না কী করবো! আমার কি আসলেই কিছু করার আছে? আপুর ঊর্ধ্বে কখনও কোনো কথা বলিনি। কারণ আমি সেই সাহস নিয়ে জন্মগ্রহণই করিনি। আর বাবাও ভীষণ খুশি আমাকে বিয়ে দেবে এটা নিয়ে। এই দুইজন মানুষের চাওয়ার সামনে আমার ইচ্ছাকে কি খুব হালকা লাগবে না? আসলে আমার ইচ্ছা যে বৃহৎ।
সিঁড়ি ভেঙে কারো উপরে ওঠার শব্দে আমার কর্ণ সজাগ হলো। মনে হলো বাবা এসেছে আমাকে ডাকতে। আলতো পিছন ফিরে দেখলাম বাবা নয়, অন্য কেউ। আমি দ্রুত চোখ মুছলাম। বাবা হলে অশ্রু মোছার প্রয়োজন ছিল না।

“সেতু!”

সেজান ভাইয়ার ডাক হৃদয় বিক্ষিপ্ত করলো। হঠাৎ তার ডাক শুনে এত কষ্ট পাচ্ছি কেন? চোখ ছলছল করে উঠলো আবারও। উপরের দিকে তাকিয়ে অশ্রুর ঝরে পড়া রোধ করতে চাইলাম। সেজান ভাইয়া ততক্ষণে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখলাম সে মিষ্টি খাচ্ছে। সম্ভবত বাবা যে মিষ্টি দিয়ে এসেছে তাই খাচ্ছে। তার হাতে একটা বাটি, সেখানে আরও দুটি মিষ্টির অবস্থান। আমাকে বাটির মিষ্টির দিকে তাকাতে দেখে বললো,
“খাবি?”

“না।”

আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। সে রেলিংয়ে বাটিটা রেখে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“খাওয়ায় নজর যখন দিয়ে ফেলেছিস, তখন খা।”

“আমি নজর দিইনি।”

ভেবেছিলাম সেজান ভাইয়া বিষয়টা নিয়ে কথা প্যাঁচাবে, কিন্তু সে এ প্রসঙ্গে আর কথা বললো না। কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
“তাহলে বিয়ে করছিস?”

প্রশ্নটার উত্তর দিলাম না। সে বললো,
“তোর বাবা শখ করে বিয়ে করতে চেয়েছিল, আর তোরা দুই বোন তার আগে বিয়ে করে নিবি তোদের লজ্জা করবে না?”

তার বকবক এই মুহূর্তে আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি এই মানুষটার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছি, অথচ তার কি আমার জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে না? একটুও না?

“তুমি চলে যাও সেজান ভাইয়া।”

“কেন?”

“না হলে আমি চলে যাব।”

“সেটা তোর ইচ্ছা।”

তার এ কথার পর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম না। দরজার দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে আসার পর হঠাৎ বললো,
“শোন।”

আমি দাঁড়ালাম। পিছন ফিরে তাকাতেই সে বললো,
“বিয়ে করে তো শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি, গাছ দুটোর কী হবে তাহলে?”

“কোন গাছ?”

সেজান ভাইয়া ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। খুব শান্ত স্বরে বললো,
“একটা সত্যি কথা বলবি সেতু? আমার গোলাপ গাছ দুটো এখন কোথায়?”

সেজান ভাইয়ার প্রশ্নে চমকালাম। সে জানে তার গাছ আমার কাছে? কীভাবে জানলো? জাবির ভাই বলেছে? আমার মনে হলো না সে জাবির ভাইয়ের থেকে শুনেছে। তাহলে কি সে আমাকে চুরি করতে দেখেছিল?
সেজান ভাইয়া বললো,
“আর কখনও কিছু চুরি করিস না। গোপনে কারো জিনিস চুরি করা ভালো না। আর যখন সেটা মালিক দেখে ফেলে তখন তো ব্যাপারটা আরও ভালো হয় না!”

আমি ম্লান হেসে বললাম,
“যে চালগুলো খাইয়েছিলে সেগুলো স্বাভাবিক চাল ছিল, তাই না?”

সে উত্তর দিলো না। কয়েক সেকেন্ড নীরবে তাকিয়ে রইল। তারপর দরজার দিকে পা বাড়ালেই বললাম,
“আনাম ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে সেটা আগে থেকেই জানতে, তাই না?”

“হুম।”

“কত আগে থেকে?”

“অনেক আগে থেকেই।”

“ওহ, ভালো।”
তাহলে আমার ভাবনাই ঠিক ছিল! সে আগে থেকেই জানতো! আমার আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করলো না। দরজার দিকে এগিয়ে এলাম। তাকে অতিক্রম করে যাওয়া দিলে সে বললো,
“অনেক আগে থেকে জানতাম না।”

“মিথ্যা বলছো।”

“না। যেদিন তোর আর ওর রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা ছিল, সেদিন বিকেল থেকে জানি।”

সেজান ভাইয়া সত্যি বলছে, তাই এটা নিয়ে আর কিছু বলার পেলাম না। জানতে চাইলাম,
“তোমার বন্ধুর বিয়েতে তুমি খুশি?”

“হ্যাঁ।”

“আমার বিয়েতে?”

সেজান ভাইয়া অপ্রস্তুত বোধ করলো। বললো,
“তোর বিয়েতে আলাদা করে খুশি হওয়ার কী আছে?”

কয়েক সেকেন্ড কিছু বললাম না। বুঝতে চেষ্টা করলাম আমার বিয়ের খবরে সেজান ভাইয়া কতটা খুশি। বললাম,
“আমরা এত অভিনয় কেন করি সেজান ভাইয়া? আমরা কি জানি না আমরা অভিনয়ে ভীষণ কাঁচা?”

সেজান ভাইয়া কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। আমি তার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করলাম না। বাসায় এলাম। বাবা মিষ্টি নিয়ে এগিয়ে এলো। জোর করে মুখে পুরে দিলো একটা মিষ্টি। আমি হেসে বললাম,
“একটা দৃশ্য কল্পনা করো বাবা। একটা কমিউনিটি সেন্টার। সেখানে নানান সাজে নানান মানুষের ভিড়। আর কিছুক্ষণ পরই বিয়ে হবে। কাজি বসেছে বিয়ে পড়াবে বলে। কিন্তু হঠাৎ খবর এলো পাত্রী মিসিং। ব্যাপারটা কেমন? ইন্টারেস্টিং না?”

বাবা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
“মোটেই ইন্টারেস্টিং না। শুধু পাত্রী পালাবে? পাত্র পালাবে না? এটা একটা ঘটনা হলো?”

আমি বাবার কথায় সায় দিয়ে বললাম,
“আসলেই বাবা, এটা একটা ঘটনা হলো না।”

আমি রুমে এলাম। ব্যালকনিতে এসে গোলাপ গাছ দুটোকে দেখলাম অনেক সময় নিয়ে। হঠাৎ গোলাপ গাছের কাঁটাযুক্ত কাণ্ড আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা হলো। আমি তাই করলাম, আচমকা একটা কাণ্ড আঁকড়ে ধরলাম। নরম তালুতে কাঁটা ফুটে যন্ত্রণার সৃষ্টি করলো। তবে আমার ভালো লাগলো এই যন্ত্রণাটুকু। আরও একটু ভালো করে আঁকড়ে ধরলাম কাণ্ডটা। তারপর হাত সরিয়ে নিলাম। একটা ছোটো গোলাপ ফুটে আছে। আমি গোলাপটা ছিঁড়লাম। তারপর সেটাকে কানে গুঁজে ফিরে এলাম লিভিংরুমে। বাবা ইংলিশ পত্রিকা পড়ছে। বাবা ইংলিশে খুব একটা ভালো না। তবুও কী পড়ে বুঝি না।

“বাবা।”

বাবা তাকালো না, পত্রিকায় অতি মনোযোগী দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে বললো,
“বল।”

“হাত থেকে র’ক্ত বের হচ্ছে।”

বাবা এবার পত্রিকা ছেড়ে উঠে এলো আমার কাছে। শিউরে উঠে বললো,
“কীসে কেটেছে?”

“কাঁটায়।”

“কাঁটা এলো কোত্থেকে?”

“গাছের কাঁটা। গোলাপ গাছে কাঁটা থাকে বাবা।”

“গোলাপ গাছ পেলি কোথায়?”

“গোলাপ যেখানে পেয়েছি, গাছও সেখানে।”

বাবা আমার কানে গুঁজে রাখা গোলাপটা লক্ষ করলো এবার। আমি জানতাম বাবা গোলাপ অথবা গোলাপ গাছ নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সত্যিই মাথা ঘামালো না। আমার হাত ধুইয়ে দিয়ে ঔষধ লাগিয়ে দিলো। আমি গভীর চোখে বাবাকে দেখছিলাম। অকারণে বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছিল। বললাম,
“আমাকে বিয়ে দিয়ো না, তুমি একা থাকতে পারবে না।”

বাবা ঔষধ লাগাতে লাগাতেই বললো,
“মানুষ অনেক কিছু পারে না, তবে পারবে না এমন নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষকে অনেক কিছু পারা শিখতে হয়, আর মানুষ তা পারেও।”

আমি বাবার দিকে চেয়ে রইলাম। অতীতের উপলব্ধ ব্যাপারটা আজ আরও একবার উপলব্ধি করলাম, এমন একজন বাবা আছে বলেই আমার জীবন এত সুন্দর। যদিও আমি এখন একটা অসুন্দর অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
___________________

আপু আজ সকালে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে এসেছে। আপুর আগমনের সংবাদ পেয়ে সুমনা চাচি এলো আপুকে দেখতে। কিছুক্ষণ আপুর সাথে কথা বলে সে কান্না জুড়ে বসলো আমাদের সামনে। চাচির মনে বিশাল দুঃখ। আপুর বিয়ে হয়ে গেছে, আমারও বিয়ে হয়ে যাবে, অথচ তার ছেলেকে সে অনেক আগে থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু ছেলের কি না বিয়ে হচ্ছে না। গত পরশু সে সেজান ভাইয়াকে গ্রামের একটা মেয়ের কথা বলেছিল। মেয়ে না কি দেখতে সুন্দর, কাজকর্মও সব পারে। কিন্তু সেজান ভাইয়া মেয়েটার কথা শুনেই রেগে গিয়েছিল। সে না কি বলেছে সে বিয়ে করবে না। চাচিকে আর মেয়ে দেখতেও নিষেধ করেছে।
আপু বলার সুযোগ পেয়ে বললো,
“সেটাই ভালো চাচি, ওর জন্য আর মেয়ে-টেয়ে দেখো না। মেয়ে দেখে লাভ কী? ওকে কি কেউ বিয়ে করবে? কুলাঙ্গার ছেলেদের কোন মেয়েরা বিয়ে করতে চায় বলো?”

চাচি আবার কেঁদে উঠলো। বললো,
“কী করবো বল তো? মানুষ তো বিয়েতে ভাঙানি দেয় না। ও নিজেই নিজের বিয়ে ভাঙে। আমরা চাই পাত্রী পক্ষের কাছে সব গোপন রেখে বিয়ে দিতে, আর ও কি করে জানিস? ও নিজের সম্পর্কে সব বলে দেয়। নীলিমা মেয়েটা কত ভালো ছিল। ওকে কী বলেছে জানিস? থাক, তোদের আর নাই বা বললাম।” চাচি হঠাৎ দেওয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো,
“ওমা পাঁচটা তো বেজেও গেছে। আমি উঠি। জেসমিনদের বাড়ি থেকে ব্লেন্ডার আনতে যেতে হবে। ওদের ব্লেন্ডার নষ্ট হয়ে গেছে দেখে আমারটা নিয়েছিল।”
চাচি ব্লেন্ডার আনতে চলে গেল।

আপু আমার হাতের দিকে আরও একবার চেয়ে বললো,
“আহাম্মক!”

বলে উঠে গেল। ও জানে আমি ভুল করে একটা কাঁটাযুক্ত গাছ আঁকড়ে ধরে হাতের এই দশা করেছি। কিন্তু না, আমি ইচ্ছা করে হাতের এই দশা করেছি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here