নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব-৮
এত বড় পোস্টে ভাবনাকে দেখে তার কলিগরা কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা। ভাবনাকে দেখলেই নানান ভাবে চোখ ইশারা করে একে অপরের সাথে টিপ্পনী কাটে। ভাবনা যে কিছু বোঝেনা তা নয়। সে সবই বোঝে । তাকে নিয়ে যে আড়ালে আবডালে নানান ধরণের মুখরোচক গল্প হয় সেটা সে ঠিকই টের পায়। খুব চেষ্টা করছে এসবে নিজেকে মানিয়ে নিতে। জীবনে কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায়না। এই পর্যন্ত আসতে তাকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সে কথা অন্যরা কী করে বুঝবে? বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত তাকে পদে পদে নানানভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে। কোনোকিছুই খুব সহজে তার জীবনে আসেনি। তবে এইবার কেন যেন সবকিছু তার কাছে সবকিছু খুব সহজে হাতের নাগালে চলে এসেছে বলে মনে হয়। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি এত বড় পদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। বিয়ের আগে এমন বড় বড় স্বপ্ন দেখত! কিন্তু বিয়ের পরে শুধুমাত্র তিনবেলা খেয়ে পরে সম্মানের সাথে টিকে থাকাটাই তার কাছে স্বপ্ন ছিলো। এর অধিক কোনোকিছুই সে চায়নি। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত তার জীবনে ঘটে গেল এমন ঘটনা।
মাস প্রায় শেষ হয়ে এলো। নতুন দায়িত্ব বেশ নিষ্ঠা আর দায়িত্বের সাথে ভালোভাবেই পালন করেছে ভাবনা। রায়হান সাহেবের বাবা এই অফিসের এমডি সামাদ সাহেব সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে ছেলের এমন সিদ্ধান্তে খুব রাগ করেছিলেন। মাসুদ সাহেব তার বাল্যকালের বন্ধু। একসাথে বেড়ে ওঠা দুজনের। মাসুদ সাহেব যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা কিছুটা লোভী একথা জানা স্বত্তেও সে তার বন্ধুকে কখনো চাকরীচ্যুত করার কথা ভাবেনি। এই মাস কয়েক হলো ছেলের হাতে এই কোম্পানীর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এখানে তার দায়িত্ব শেষ। কিন্তু মাসুদ সাহেবকে এভাবে অবসরে পাঠানোতে সে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। নিজেই কিছুদিন আবার তদারকি করছেন সবকিছু। মাসুদ সাহেবের সব ধরণের দুর্নীতির প্রমাণপত্র হাতে পেয়ে ছেলের সিদ্ধান্তে আস্থা আসে তার। ভাবনাকে সহকারী হিসাবরক্ষক থেকে মাসুদ সাহেবের জায়গায় পদন্নোতি দেয়াতে প্রথমে খুব ক্ষেপে গেলেও এই একমাসে ভাবনার কর্মদক্ষতা, দূরদর্শিতা আর বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নমনীয়তায় সত্যিই তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। কোম্পানী পরিচালনায় এমন নবীন আর দক্ষ ব্যবস্থাপনারই প্রয়োজন। সেকেলে মনোভাব এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে দ্বারে দ্বারে ধাক্কা খাচ্ছে যেন। তাই সত্যি পরিবর্তনের খুব প্রয়োজন। এটা তিনি নিজেই অনুভব করছেন এখন। তার ছেলে এই লাইনে নতুন হলেও সে যে বিচক্ষণতায় তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এ কথা সে মুখে না বললেও ঠিকই বুঝে গেছে। ভাবনা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী আর ট্যালেন্ট একটা মেয়ে । সামাদ সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস ভাবনাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে সঠিকভাবে পালন করতে পারবে।
কোম্পানীর মাসিক সভায় ভাবনাকে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে পার্মানেন্ট করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামাদ সাহেব ভাবনাকে এই পোস্টের জন্য এপ্রুভ করে দিলেন। ভাবনার দু’চোখ বেয়ে যেন খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সভায় রায়হান সাহেব ফুলের তোড়া দিয়ে ভাবনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদে অভিষিক্ত হওয়ার জন্য সবার সামনে অভিনন্দন জানালেন।
ভাবনার কাছে সবকিছুই স্বপ্নের মত লাগছে। কী থেকে কী হয়ে গেলো ?এভাবে তার জীবনের বাঁক ঘুরে যাবে সে ভাবতেই অবাক হচ্ছে। আজ আবিরকে সব কথা খুলে বলবে। সময় হয়েছে। এতদিন বড় কষ্টে সে এত বড় সাকসেসের কথা সবার কাছে লুকিয়েছে। আবিরের খুশি খুশি মুখটা সে কল্পনাতে এখনই যেন দেখছে।
বাসায় ফেরার পথে বাসের দুলুনিতে কখন যে চোখটা বুজে আসলো সে টেরই পায়নি। চোখ বন্ধ করতেই ভাবনা দেখতে পাচ্ছে আবির তার সাক্সেসের খবর শুনে খুশিতে বাম হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে ডান হাতে কপালের চুলগুলি সরিয়ে আলতো করে চুমু দিচ্ছে ভাবনার কপালে। ভাবতেই ভাবনা শিহরিত হয়ে উঠল। আজ যেন পথ কমছেই না। এই কদিন ধরে অফিস থেকে যেতে দেরী হচ্ছে দেখে প্রায়ই আবিরের কাছে নানান বাহানায় মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়েছে। নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছিলো এভাবে প্রতিনিয়ত আবিরকে মিথ্যে বলার জন্য। অবশেষে আজ সে সবকথা খুলে বলবে। আবির কতদিন মন খুলে কথা বলেনা , হাসেনা। আবিরের একটা চাকরী বড্ড প্রয়োজন। পুরুষ মানুষ এভাবে বসে থাকলে ধীরে ধীরে মানসিক রোগী হয়ে যাবে। এই ক’মাস ধরে আবির একটা জবের জন্য কোথায় কোথায় না ধর্না দিয়েছে। ভাবনা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ডিরেক্টর রায়হান সাহেবের সাথে আবিরের ব্যাপারে কথা বলবে। তাদের কত ব্যবসা ! কোথাও না কোথাও ঠিকই আবিরের জন্য একটা ব্যবস্থা সে করে দিতে পারবে। আজকাল রায়হান সাহেবের সাথে তার সম্পর্কটাও বেশ ভালো যাচ্ছে। সে তার সমস্যার কথা বললে সে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সমাধান দিবেন। আগামীকাল রায়হান সাহেব আসবেন অফিসে। তাই কালকেই কথা বলবে সে!
বাসায় আসার পথে হাতে করে তার শাশুড়ি আর জারার পছন্দের নানান ধরণের খাবারদাবার কিনে ফেললো। অনেকদিন ধরে হিসেবের বাইরে কোনোকিছু কেনাকাটা করতে গেলেই পুরো মাস কীভাবে চলবে এই কথাটিই মনে এসেছে। কিন্তু আজ আর কোনো বাধা নেই। এখন তার বেতন ডবল হয়ে গেছে। তাই সে চাইলেই সবার জন্য তার পছন্দমত কেনাকাটা করতে পারবে। ভাবতেই চোখ ভিজে উঠল তার। কতদিন মেয়েটাকে তার পছন্দের কিছু কিনে দেয়া হয়না। মেয়েটাও বুঝতো। এতটুকুন মেয়ে যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে বাবার চাকরী নেই , মাকেই পুরো সংসার টানতে হবে সেদিনের পর থেকে কখনো অফিস থেকে ফেরার পরে ভাবনার কাছে একটা চকলেটও আবদার করেনি সে। আজ মেয়ের জন্য নানান রকমের চকলেট কিনেছে ভাবনা।
এদিকে আবির খুব চিন্তিত হয়ে বারবার ফোন দিয়েই যাচ্ছে। ভাবনা মিটিংয়ের সময় ফোন সাইলেন্ট করেছিল । সেভাবেই আছে ব্যাগের ভেতর। তাই আবিরের ফোনের শব্দও সে টের পাচ্ছেনা। অন্যদিন ন’টার ভেতরে পৌঁছে যায় । কিন্তু আজ বাসায় পৌঁছাতে সাড়ে দশটা বেজে গেলো।
ভাবনাকে দেখেই আবির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
– এত দেরী করলে যে? রাস্তাঘাটের যে অবস্থা! খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ।
– এত ভয় পাবার কি আছে? আমি কি বাচ্চা, ডার্লিং?
– ছেলেদের জন্যই চলাফেরা রিস্ক সেখানে তুমি একটা মেয়ে।
– ভাবনা খানিকিটা হেসে বলল, ভয় নেই গো! আমার কিচ্ছু হবেনা। তোমার বউ এমন আহামরি কেউনা যে তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে!
– উহু, এটা ভুল বললে । আমার বউ পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। তাকে নিয়ে আমার মত গোবাচারা স্বামীর ভয় হবে এটাই স্বাভাবিক।
– হাহাহা!
আবির ভাবনার হাতের ব্যাগগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পেরেছি তোমার দেরী হবার কারণ। এসব আবার কিনতে গেলে কেনো? আমাকে লিস্ট দিতে আমি নিয়ে আসতাম।
– আরে নাহ। তেমন কিছু না। মা আর জারার জন্য কিছু খাবার দাবার। অফিসে মিটিং ছিল তাই দেরী হয়েছে। আচ্ছা, বাদ দাও এসব কথা! জারা কোথায়? টের পাচ্ছিনা একদম। আমি এলাম তাও খবর নেই।
– দাদীর সাথে লুডু খেলে। তাই হয়ত টের পায়নি। ফ্রেশ হয়ে নাও । তোমাকে একটা খবর বলব।
– তাই? আমার কাছেও একটা খবর আছে জনাব! মিটিমিটি হেসে বলল ভাবনা।
– ওকে তবে তুমি বল!
– উহু তুমি।
– আচ্ছা, আচ্ছা! আগে চেঞ্জ করো। তারপরে আমিই প্রথমে বলবো । ওকে?
– ওকে।
আবিরকে আজ বেশ কিছুদিন পরে খুব ফ্রেশ লাগছে। ভাবনার ভালো লাগছে এটা দেখে। তার প্রমোশনের খবর শুনলে হয়তো আরো খুশি হবে এমনটা ভাবতে ভাবতে সে ওয়াশরূমে গেলো ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই পেছন থেকে যেয়ে আবিরকে দুই বাহুতে আবদ্ধ করলো। আবিরও যেন এমন কিছুর অপেক্ষায় ছিল। হেঁচকা টানে ভাবনাকে সামনে এনে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। ভাবনার নাকের সাথে নাক ঘষতে ঘষতে সে বলল, ম্যাডামের কষ্টের দিন বুঝি এবার ঘুচবে। এই ক’টা মাস কি কষ্টটাই না করেছেন আমার সংসারের জন্য!
– এ কেমন কথা ? সংসার বুঝি তোমার একার?
– সরি , সরি ! ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিবেন।
– এবার বল কি বলছিলে। জব হয়েছে ?
– হুম!
– মানে ? চাকরী পেয়েছ তুমি? উত্তেজিত হয়ে বলল ভাবনা।
– ইয়েস ম্যাম। এই গরীব বেকার ছোটখাটো একটা চাকরী যোগার করতে পেরেছে অবশেষে।
– ওয়াও! এতক্ষণে বললে? কংগ্রাচুলেশানস! বলেই ভাবনা শক্ত করে আবিরকে জড়িয়ে ধরলো।
– থ্যাংক ইউ সো মাচ!
– এবার বল কোথায় জব হয়েছে?
– একটা রিয়েল স্টেট কোম্পানীতে সেলস এন্ড কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে । অফিস আপাতত তেজগাঁওতে । বেতন আগের চেয়ে কিছুটা কম। ভাবলাম একদম বসে থাকার চেয়ে এটা বা কম কীসে! কি বল?
– অসুবিধা নেই। তাতে কি! খুব খুশি হলাম তোমার খবরটা শুনে। তোমার জন্য খুব চিন্তা হতো এতদিন। যাক চিন্তা তবে কমলো। মাকে বলেছো এই সুখবর? তোমার জন্য খুব চিন্তা করেছে এতদিন।
– হুম, জানিয়েছি। মাও খুব খুশি। কিন্তু এখন নতুন সমস্যা হলো মাকে রাখবো কার কাছে? বললাম আপনের বাসায় রেখে আসার কথা । কিন্তু তাতেও রাজি না সে। কি যে করি!
– এক কাজ কর! বড় আপার মেয়ে কুহেলীর তো এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে ক’দিন বাদে । তখন তো একদম ফ্রী থাকবে বাড়ীতে। আমাদের এখানে নিয়ে এস। কিছুদিনের জন্য নিরিবিলি এখানে বেড়িয়ে যাক। মায়েরও ভালো লাগবে খুব।
– খুব ভাল কথা মনে করেছো । আপাকে কালকেই ফোন দিব আমি। যাক তিন মাস তো থাকতে পারবে এখানে। এরপরের চিন্তা এরপরে করবো । আপাতত চিন্তামুক্ত। কুহেলীও কিছুদিন ধরে এখানে বেড়াতে আসার কথা বলেছিলো । আমি ওর কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম নিজের টেনশনে।
– কালই ফোন দাও আপাকে। আর তোমার জয়েনিং ডেট কবে?
– নেক্সট মান্থে।
– তবে তো ভালোই হল। তুমি নিজে যেয়ে নিয়ে এসো কুহেলীকে। দুলাভাই ছেলেমেয়ের ব্যাপারে কেমন খুঁতখুঁতে তা তো জানোই। পারলে আপার সাথে কথা বলে দুলাভাইয়ের সাথেও কথা বলো।
– ঠিক বলেছো। আচ্ছা, আমাকে কী যেন খবর বলবে বলেছিলে ? আমি তো একদমই ভুলে গিয়েছিলাম । বল দেখি কী খুশির খবর অপেক্ষা করছে আমার জন্য? একদিনে এত খুশির খবর হজম করতে পারবো তো? মায়ের ব্যাপার নিয়ে কি যে টেনশনে ছিলাম ! তুমি এক চুটকিতে সমাধান দিয়ে দিলে। মাঝেমাঝে মনে হয় তোমার কাছে বুঝি সব কিছুর সমাধান পাওয়া যাবে।
– হাহাহা। মজার কথা বললে। আমিও তোমার খবর শুনে আমার খবর বলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
– হুম এবার বল!
– আমার প্রমোশন হয়েছে।
– আলহামদুলিল্লাহ! তবে কি এবার চীফ একাউন্ট্যান্ট? তাহলে তোমার নাক উঁচু দিলরুবা ম্যাডামের পোস্টটা পেয়েই গেলে। উনি কি জব ছেড়ে দিয়েছেন নাকি ফায়ার হয়েছেন?
– আরে নাহ! ওসব কিছুই না। উনি উনার জায়গায় ঠিকঠাক আছেন। আমি চীফ টিফ কিছু না এসিসট্যান্টই আছি।
– মানে কি ? তুমি না বললে প্রমোশন হয়েছে।
– হয়েছে তো! তবে একাউন্ট্যান্ট না। এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে।
– ফান করছো না তো?
– আরে নাহ! ফান করবো কেনো ? আমি মাসুদ সাহেবের জায়গাতে রিপ্লেস হয়েছি।
– ওহ মাই গড! এসব কী বলছো ? এটা কী করে সম্ভব!
– সম্ভব সাহেব! সবই সম্ভব! আপনার বউয়ের উপর আস্থা নেই কি?
– আস্থা অবশ্যই আছে। তাই বলে এত বড় পোস্ট?
– তোমার বিশ্বাস হচ্ছেনা? আমি তোমাকে আমার প্রমোশন লেটার দেখাচ্ছি। ওয়ান মিনিট!
ভাবনা ঝটপট করে তার ব্যাগ থেকে প্রমোশন লেটার বের করে আবিরের হাতে দিল। আবির এক নজর চোখ বুলিয়ে নিলো। সে খুশি হলো কি অখুশি হলো সেটা ভাবনা বুঝতে পারলোনা।
– ভাগ্য তো খুলে গেছে একদম !
– তা বলতে পারো।
– বেতন তো বেশ পাবে দেখছি।
– যে গাধার খাটুনি খাটতে হয় তাতে বেতনটা ঠিকই আছে। গত একমাস আমার যে পরিমাণ ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে তা মনে হয় আমার এই দেড় বছরেও হয়নি।
– গত এক মাসে মানে কি? তুমি না বললে তোমার এই মাসে প্রমোশন হয়েছে!
– গত মাস থেকে কাজ করছি। এইমাসে পার্মানেন্ট হলাম। তোমাকে বলিনি কারণ শেষ পর্যন্ত যদি টিকতে না পারি তাই। আজই কনফার্ম হলাম । আজ এমডি স্যার নিজেই মিটিংয়ে এনাউন্স করেছেন। প্রথমে আমাকে তার বন্ধু মানে মাসুদ সাহেবকে বাদ দিয়ে তার এই পোস্টে আনার জন্য রায়হান স্যারের উপর খুব ক্ষেপেছিলেন। পরে আমার পার্ফম্যান্সে সন্তুষ্ট হয়ে ছেলের সিদ্ধান্তে খুশিই হয়েছেন। নিজেই আজকে সবার সামনে আমার খুব প্রশংসা করেছেন।
– বেশ তো ! আজকাল অনেক কথাই গোপন করতে শিখেছো দেখছি এতবড় পোস্টে তোমাকে কোন স্বার্থে চাকরী দিলো ব্যাপারটা কেমন যেন অড মনে হচ্ছে না! আর এতকিছু ঘটে গেছে অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি।
– ভেরি সরি, আবির। আমি ভেবেছিলাম তুমি দুশ্চিন্তা করবে তাই। এটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিলো। তাই অযথা তোমাকেও টেনশনে রাখতে চাইনি। প্লিজ, বুঝতে চেষ্টা করো। আর আমি এ পদে আগে যিনি ছিলেন তার চেয়ে যোগ্য তাই আমার এখানে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। আর কিছুই না। এখানে অড লাগার কি আছে? আমার কাছেও প্রথমে অবাক লেগেছিলো। পরে ভেবে দেখলাম আমার যোগ্যতা অনুযায়ী ঠিকই আছে। আমি মাসুদ সাহেবের থেকে সবদিক থেকে যোগ্য !
– ইটস ওকে। বুঝতে পেরেছি। চল, খেতে যাবে। খুব খিদে পেয়েছে।
ভাবনা কিছুটা অবাক হলো মনে মনে। ভেবেছিলো আবির কত খুশি হবে। অথচ তার ছিটেফোঁটাও দেখছেনা। উলটো কিসব বলছে। খুব কষ্ট পেল ভাবনা।
– আগে মায়ের সাথে কথা বলে আসি । তারপরে খাবার দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করো।
– ঠিক আছে।
– আবির , তুমি খুশি হওনি?
– খুশি হবোনা কেনো?
– তবে আমাকে কংগ্রাচুলেট করার কথা কি ভুলে গেলে?
– ওহ, সো সরি! অনেক অনেক অভিনন্দন। পেশা জীবনে এভাবেই সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যাও সেই দোয়া করি।
পরেরদিন সকালে খুব মনমরা হয়ে বসে আছে দেখে আবিরের মা ছেলের পাশে এসে বসলো। পাশে এসে বসার পরেও আবির তার সাথে কোনো কথাবার্তা বলছেনা দেখে আবিরের মা নিজে থেকে বোঝার চেষ্টা করছে আবিরকে। এতদিন পরে চাকরী হয়েছে তার তো হাসিখুশি থাকার কথা। তবে এমন কেন?
– বাবা, কোনো কারণে কি তোর মন খারাপ? এভাবে বসে আছিস যে!
– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তার মাকে বলল, না মা! তেমন কিছু নাহ! এমনিতেই।
– তুই বললেই হবে আমি তোর মুখ দেখেই মনের খবর টের পাই। আমার কাছে বল কী হয়েছে। না হলে আমারও খুব অস্থির লাগবে।
– বললাম না কিছুনা। তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিলো। আমার অফিস শুরু হলে কীভাবে থাকবে তাই! আপাতত কিচজুদিনের জন্য একটা সমাধান পেয়েছি। কুহেলীর এক্সাম শেষ হলে আসবে এখানে। আমি আপা দুলাভাই দুজনের সাথেই কথা বলেছি। তারা রাজী।
– ভালো করেছিস। কতদিন দেখিনা কুহুকে। ভালোই হবে জারারও একজন সঙ্গী হবে। কিন্তু বাবা আসল কথাই তো বলছিস না। কি হয়েছে তোর? চাকরী নিয়ে কোনো সমস্যা? এ চাকরী ভালো না হলে করার দরকার নেই। সামনে আরো ভালো চাকরী পাবি।
– তেমন কিছু না ,মা। বললাম না তোমার জন্য মন খারাপ ছিলো।
– কথা ঘুরাবিনা একদম! নিজেই তো বললি কুহু আসছে। তবে আবার কিসের চিন্তা? তুই কি ভাবনার কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?
– আবির কিছুটা চুপ করে থেকে বলল, মা সত্যি করে বলতো আমি কি ভাবনার অযোগ্য ? ওর পাশে নিজেকে আজকাল বড্ড বেমানান লাগে। নিজের প্রতি লজ্জা হচ্ছে খুব।
– এমন হবে কেনো ? অযোগ্য হলে কি তোকে বিয়ে করতো ? এত বছর পরে এসব কী বলছিস? ও কি তোকে এমন কিছু বলেছে?
– নাহ! এমনিতে মনে হলো। আচ্ছা , আমি একটু বাইরে যাবো একটা কাজ আছে। তাড়াতাড়িই চলে আসবো । তুমি সাবধানে থেকো। বলেই আবির ওর মাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বারিয়ে গেলো। আবিরের মা বুঝতে পারলো হয়তো নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যই সে এমন করছে।
আবির চলে যাবার পরে তার মা ছেলের দুশ্চিন্তার কারণ কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। কাল রাতে ভাবনার প্রমোশনের খবর শুনে সারারাত খুব হাঁসফাঁস করে রাত কেটেছে আবিরের মত আবিরের মায়েরও। ছেলের চেয়ে বউয়ের আয় রোজগার বেশি হলে সেই সংসারে কি আর শান্তি থাকে?
বউয়ের কাছে স্বামীর মূল্য কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে এটা যেন সে নিমিষেই দেখতে পেলো। এমনিতেই ভাবনা ইচ্ছেমত চলাফেরা করে তার উপর যদি এভাবে দিনদিন তার ছেলেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে তবে সামনে যে খুব ভাল কিছু অপেক্ষা করছেনা এটা নিয়ে আবিরের মত সেও খুব দুশ্চিন্তায় আছে। ভাবনার স্বেচ্ছাচারিতার কথা সে ভুলে যায়নি। ভাবনা তার চাকরী করার জন্য আবিরকে ছেড়েই বাসা নিয়েছিলো এখানে। সে তার ইচ্ছেমত এটা সেটা কেনাকাটা করে। আবিরকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনা। এতদিন তো তবু সহ্য করা গেছে কিন্তু এখন যে ভাবনা তার নিজের বানানো নিয়মনীতি এই সংসারে প্রয়োগ করতে শুরু করবে এতে আর বেশি দেরী নেই। আবিরের জন্য খুব মায়া হচ্ছে তার মায়ের। এতদিন আবিরের এই সংসারে যাও ক্ষমতা ছিলো এখন তাও হারাবে। এমন করে মূল্যহীন হয়ে কীভাবে পুরো জীবন কাটবে তার ছেলের? কতদিন ধরে সে ভাবনাকে বলছে আরেকটা বাচ্চা নিতে সেদিকে কোনো কান নেই তার বউয়ের। তার নাকি এই একটা মেয়ে হলেই চলবে! এ কেমন কথা! তার ছেলের বংশ বাড়াতে হবেনা। আসল কথা হচ্ছে চাকরী ছাড়তে হবে বাচ্চা নিলে তাই সে বাচ্চা নিতে চাচ্ছেনা। আবিরের চাকরী হয়েছে শোনার পর থেকে সে মনে মনে সারাদিন ভেবে রেখেছে ভাবনাকে এবার জোর করে ধরবে একটা বাচ্চা নেবার জন্য। মরার আগে একটা নাতীর মুখ দেখতে চায় সে। কিন্তু কোথায় কী? উলটো বউ যে খবর শুনিয়েছে তাতে এ জীবনে আর নাতীর মুখ দেখা হবে বলে তার মনে হচ্ছেনা। গতকাল রাতে মা বোনদের কাছে যেভাবে খুশি হয়ে হয়ে ফোনে তার প্রমোশনের কথা বলছিলো তাতে মনে হচ্ছে ভাবনা এখন হাওয়ায় ভাসছে। এই মুহূর্তে বাচ্চা নেবার জন্য বেশি জোরাজুরি করলে সংসার রেখেই না হাঁটা দেয় সেই ভয় এখন আবিরের মায়ের।
চলবে……